বিজ্ঞাপন

উসকানি দিয়ে সেফজোনে থাকার চেষ্টা ছাত্রলীগের, নির্বিকার প্রশাসন

December 23, 2019 | 2:20 pm

কবির কানন, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট

ঢাবি: রোববার (২২ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় ক্যাম্পাসে সংঘাতের পুরোনো চেহারাটিই দেখলো শিক্ষার্থীরা। ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর ছিলেন হামলার লক্ষ্য। এবারও মারধরের শিকার হলেন ভিপি নুর ও তার অনুসারীরা। যাদের মধ্যে কয়েকজন বহিরাগতও ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

কী ঘটেছিলো সে সময়ে? তার খোঁজ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও হামলার শিকার যারা তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দফায় দফায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। অনেকে মিলে একজনকে লাথি-গুঁতো-লাঠিপেটা করছে এমন দৃশ্যও দেখা গেছে।

অনেকেই বলছেন, হামলাগুলো যৌথভাবে চালায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগ। প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ হামলা চালালেও পরে তাতে সক্রিয় হয় ঢাবি ছাত্রলীগ। আর শেষের দিকে তাদেরই বেশি মারমুখি দেখা যায়।

তবে পুরো ঘটনার পর ছাত্রলীগ আর এই হামলার দায় নিতে চাইছে না। তারা বিষয়টি শুধু মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল অনেকটা নির্বিকার। ঘটনাস্থলে থেকেও ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন।

বিজ্ঞাপন

ঘটনার বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানাচ্ছেন, রোববার দুপুর ১২টায় টিএসসিতে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়। কর্মসূচি শেষে মঞ্চের নেতা-কর্মীরা মিছিল নিয়ে ডাকসু ভবনের দিকে যান। ঠিক ওই সময়টিতে ভিপি নুর ২০/২৫ জন অনুসারীকে নিয়ে ডাকসু ভবনে ঢুকছিলেন। এই ঢোকার পথে কোনও ধরনের উষ্কানি ছাড়াই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হয়। এক পর্যায়ে নুর তার লোকদের নিয়ে ডাকসু ভবনে নিজের কক্ষে ঢুকে পড়েন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, ঠিক ওই সময়টিতেই ডাকসু ভবনের সামনে পৌঁছান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এবং তাদের অনুসারীরা। তারা এসে মিশে যান মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এর কর্মীদের সঙ্গে। দুটি সংগঠনের কর্মীরা তখন ডাকসু ভবনের দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকেন। এ সময় নুরুলের নির্দেশে ডাকসু ভবনের কর্মীরা ভবনের মূল গেটে তালা লাগিয়ে দেন।

পরিস্থিতি আরও থমথমে হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন ডাকসু গেটের সামনে যান। ডাকসুর কর্মীরা তার জন্য গেট খুলে দেন। তখন সাদ্দাম, সনজিতের অনুসারীরা এবং মঞ্চের কর্মীরা ভেতরে ঢুকে পড়েন। দেখা যায় সাদ্দাম ও সনজিত বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সরাসরি নুরুলের কক্ষে ঢোকেন।

বিজ্ঞাপন

ভেতরে ছিলেন এমন একটি সূত্র সারাবাংলাকে জানায়, ঢুকেই নুর কেন বহিরাগত নিয়ে ডাকসুতে এসেছেন তা জানতে চান সাদ্দাম হোসেন। তখন নুর বলেন, ‘তিনি সব সময় হামলার আশঙ্কার মধ্যে থাকেন। এ কারণে নিজের নিরাপত্তার জন্য অনেককে সঙ্গে রাখেন।’

এক পর্যায়ে নুরুল সনজিতকে উদ্দেশ্য করে তিনি ডাকসুর কেউ না হওয়া সত্ত্বেও কেন ডাকসুতে ঢুকেছেন জানতে চান। এসময় সনজিত চন্দ্র দাস নুরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি কে, তা কিছুক্ষণ পরেই বুঝবি।’

প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, এর পরপরই সনজিতের অনুসারীরা নুর ও তাদের সমর্থকদের ওপর চড়াও হয়। তারা লাঠিসোটা, রড পাইপ এগুলো দিয়ে পেটাতে থাকে। এতে নুর আহত হন। এবং আহত অবস্থায় তার কক্ষেই পড়ে থাকেন।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, সাদ্দাম হোসেনও এই মারধরের নির্দেশ দেন। ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল ইউনিটের নেতাকর্মীদের এই নির্দেশ দেন তিনি। এই নেতাদেরই একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন ছাত্রলীগের মাইর যেন তেন মাইর নয়।’

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার দায়ভার মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও নুরের নিজের। এখানে ছাত্রলীগ সম্পৃক্ত নয়।

তিনি বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও নুরের নেতৃত্বে বহিরাগত ও মৌলবাদী ছাত্রকর্মীদের মধ্যে ঝামেলা চলছিল। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামক যে সংগঠনটি গড়ে উঠেছে এদের কর্মকাণ্ডও অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। দুই পক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে গতকাল মারামারি হয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে বহিরাগত ও মৌলবাদী রাজনীতির সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে জোরালো পদক্ষেপ চান সাদ্দাম হোসেন।

হামলার জন্য তিনি নিজেও নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবং নুরকে মারধর করতে বলেছেন, এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সাদ্দাম হোসেন বলেন, এমন কোনও নির্দেশ তিনি দেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

নুর ও তার সমর্থকদের ওপর হামলার দায় কাদের এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সনেট মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পর কোটা আন্দোলনের মামুনদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। তারপর আমি চলে গিয়েছি। পরবর্তী ঘটনা সবাই দেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যদি কেউ ফায়দা লুটতে চায় তাহলে তাদেরও বিচার হোক।’

হামলার বিষয়ে মারধরের শিকার নুর এর অনুসারী রাশেদ খান সারাবাংলাকে বলেন, সাদ্দাম ও সনজিতের নির্দেশেই আমাদের মারধর করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা ভিপি নুরের রুমের লাইট-দরজা বন্ধ করে আমাদের পেটায়। আমাদেরকে কিভাবে পেটানো হয়েছে তা ডাকসুর কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।

এদিকে, রোববারের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মারামারি চলতে থাকার ৩০ মিনিটের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রক্টর আবদুর রহীম, বদরুজ্জামান ভূঁইয়া ঘটনাস্থলে পৌঁছান। কিন্তু তারা হামলা ঠেকাতে সমর্থ হননি। তাদের উপস্থিতিতেও নুরের সমর্থকদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছিলো বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। ঘটনার ৪৫ মিনিট পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী সেখানে পৌঁছান। তিনি পৌঁছে মারধরে আহত ১০ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে নুর ও রাশেদ ফারুক তখনও ডাকসু ভবনের ভিপির কক্ষে আহত অবস্থায় পড়েছিলেন।

প্রশাসনের ভূমিকার বিষয়ে আহত রাশেদ খান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদেরকে মারধরের আগে প্রক্টরকে আমি কয়েকবার কল করি। এর মধ্যে তিনি তিন বার কল ধরেন। প্রথম দফায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে আসতে বললে তিনি বলেন, প্রক্টরিয়াল টিম পাঠাচ্ছি, কিন্তু তিনি পাঠান নি ও নিজেও আসেন না। এরপর ১ ঘন্টার মতো হয়ে যায়। আমি বারবার তাকে কল করি। তাকে জানাই, স্যার আমরা অবরুদ্ধ। তিনি আমাকে বলেন, তুমি কি ডাকসুর প্রতিনিধি? তুমি ভিপির রুমে কেন গিয়েছো? আমি বলি, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আমার কি অধিকার নাই ডাকসুতে আসার? এরপর তিনি আমাকে ধমকে ফোন কেটে দেন।

রাশেদ খান বলেন, ‘সব কিছুই হতে পেরেছে প্রক্টরের অবহেলার জন্য। গতকাল আমরা মারা গেলে তার জন্য তিনিই সর্বপ্রথম দায়ী থাকতেন।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গতকাল হাসপাতালে তাদের দেখতে গিয়েছিলাম। বহিরাগতসহ সবার সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারি কাম্য নয়। শুধু তদন্ত করে ব্যবস্থা নিলে ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সব পক্ষকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে বলেও মনে করেন ঢাবি প্রক্টর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রক্টর আবদুর রহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা খবরটি জানার পরপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছাই এবং তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি অধ্যপক মো. আখতারুজ্জামানকে ফোন দিলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান।

সারাবাংলা/কেকে/এমএম

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন