বিজ্ঞাপন

‘মেয়েরাই বাবা-মায়ের মুখ আলোকিত করেছে’

March 8, 2020 | 7:30 pm

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: “আমার জন্মের পর ঘরে আরও তিন বোনের জন্ম হয়। প্রত্যেকবার বোন হওয়ায় পাড়া প্রতিবেশি নানান কথা বলতো। বাবা-মা চুপ করে শুনতো। বড় হওয়ায় আমাকেও অনেক কথা শুনেও হজম করতে হয়েছে। কখনও মন খারাপ হতো, একটা সময় আর মন খারাপ হয়নি। ধীরে ধীরে আমরা সবাই বড় হতে লাগলাম। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পার করলাম, চাকরিতে যুক্ত হলাম। এখন বাবা মা বলেন, মেয়েরাই আমাদের মুখ আলোকিত করেছে। বাবা-মা আমাদের নিয়ে বুক ভরে গর্ব করেন। তারা বলেন, ‘একজন ছেলের চেয়ে কম কিসে আমাদের মেয়েরা’।”

বিজ্ঞাপন

নারী দিবস উপলক্ষে ট্রাফিক পুলিশের সবুজবাগ জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) আশরাফি তানজিনা সারাবাংলার কাছে এভাবেই নিজের সফলতার কথা তুলে ধরেন। সফল এই নারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার সফলতার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন, মা ইয়াসমীন আজিজ। সেই ছোট্ট থেকে চাকরি এবং চাকরির পর ট্রাফিকের মতো জায়গায় ননস্টপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি, তার পেছনেও মায়ের অবদানই সবচেয়ে বেশি। এর বাইরে বড় হওয়ার অনুপ্রেরণা আর স্বপ্ন সারথি হয়ে পাশে থাকা ব্যক্তিটি হলেন বাবা এম এ আজিজ। তারা এখন আমার বাসাতেই থাকেন। ছেলে হলে যেভাবে থাকতেন ঠিক সেভাবেই আমার বাসাতে তারা থাকেন। সবকিছু আগের মতোই তারা দেখাশোনা করেন।’

আশরাফি তানজিনা বলেন, ‘পুরান ঢাকার আরমানিটোলা আনন্দময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গ্রেডিং সিস্টেমের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। এরপর ভিকারুন নূন নেসা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগের পাস করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। এর মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। ৩১তম বিসিএস দিয়েও প্রিলি পাস করতে পারিনি। এরপর ৩৩ তম বিসিএস এর আগেই কোল জুড়ে সন্তান আসে, তবে ৩৩তম বিসিএসেই চাকরি হয়ে যায় আমার।’


আমার দ্বিতীয় ছোটবোন পড়ালেখা শেষ করে গাজী টেলিভিশনে নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজে যোগ দেন। সেখান থেকে বিয়ে হওয়ার পর এখন তারা সুইডেনে সেটেল হয়েছেন। সেজো ছোটবোন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি বিভাগ থেকে পড়াশুনা শেষ করে ওষুধ কোম্পানি স্কেফ ফার্মাতে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। সবশেষ বোনটি ইডেন কলেজ থেকে ম্যানেজম্যান্টে অনার্স করছেন, জানান সহকারী কমিশনার তানজিনা।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘আমি পুলিশে চাকরি করছি। ভীষণ ব্যবস্তায় থাকতে হয়। লোকজন আমাকে এসে না পেয়ে আব্বুর কাছে আসে। আব্বু আমাকে বলেন, দেখো তাদের সমস্যাটা সমাধান করতে পারো কিনা। এ বিষয়টা আব্বু অনেক এনজয় করেন। আমিও ভীষণ এনজয় করি। একজন স্কুল শিক্ষকের চার মেয়ে আজ ওয়েল স্টাবলিশ, এটা গর্বের সাথে বলে সব সময়।’

সারদা পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের সময় ঘোড়াকে দৌঁড়ানোর আগে আমি থামাতে শিখেছিলাম। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম দৌড়ের সময় ঘোড়া থামাতে না জানলে পড়ে গিয়ে আমাকে আহত হতে হবে। তাই কর্ম ও সংসারসহ পারিপার্শ্বিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রত্যেক নারীকে আগে থামতে শিখতে হবে। যাতে তার আহত হওয়ার আশংকা না থাকে। অনেকেই হয়তো রেগে প্রশ্ন করতে পারেন থেমে যেতে হবে? তবে এখানে থামা মানে স্থির হয়ে যাওয়া নয়। থামা মানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কৌশলী হয়ে সামনের দিকে সমান তালে এগিয়ে যাওয়া— বলছিলেন ৩৩ম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেওয়া আশরাফি তানজিনা।

এই সিনিয়র সহকারী কমিশনার বলেন, ‘পুলিশে যেমন সীমাবদ্ধতা রয়েছে তেমনি কাজ করারও অনেক জায়গা আছে। এখন যেখানে কাজ করছি সেটা অনেক বড় একটি অঞ্চল। নানান প্রতিকূলতা নিয়ে কাজ করতে হয়। ১৪১ জনের জনবল নিয়ে কাজ করি। যা এলাকার তুলনায় অনেক কম। পুলিশে এখন অনেক ভালো ছেলেমেয়ে যোগ দিচ্ছে। তারা ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে ছেলেমেয়েরা পুলিশে চাকরি নিচ্ছেন। এমনকি বুয়েট থেকে পাশ করেও পুলিশে জয়েন করেছেন। পুলিশে পরিবর্তন হচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে ভবিষ্যতে আরো হবে। পুলিশ এখন মানবিক হওয়ার দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

পুলিশে কোনো বৈষম্য নেই উল্লেখ করে তানজিনা বলেন, ‘আসলে গৃহিণী আমি ও সারদা থেকে প্রশিক্ষণ শেষের আমি দুটোতেই বিস্তর ফারাক। সারদায় প্রশিক্ষণকালীন সময়ে ১১ ফিটের একটি দেয়াল লাফ দেওয়া ছাড়া ছেলে সদস্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে আমাকে। সে কারণেই এখন নিজেকে যেকোনো কাজের যোগ্য বলেই মনে হয়।’

শত বাধায়ও হার না মানা ফরিদা পারভিন

 

ট্রাফিকের মতো একটি ব্যাস্ততম বিভাগের দ্বায়িত্বে থেকেই আবার সংসার সামলানোর বিষয়ে এ নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার স্বামী একজন ব্যাংকার। ৪ বছরের মেয়েকে রেখে সারদায় ট্রেনিংয়ে যাই আমি। এখন আমার মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। আসলে কর্মজীবী নারী বা মায়েদের ক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গে বোঝাপড়া, সহমর্মিতা ও দায়িত্বগুলো ভাগ করে নেওয়া একটি বড় বিষয়।’

বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ এর জুলাই পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত মোট নারীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৪০২ জন। যা বাংলাদেশ পুলিশের মোট জনবলের ৭.১০ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

পুলিশ সদর দফতরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের উচ্চপর্যায়ে অর্থ্যাৎ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত ১ম শ্রেণির নারী পুলিশ কর্মকর্তা আছেন মোট ২৮৬ জন। এরমধ্যে অতিরিক্ত ডিআইজি ৫ জন, পুলিশ সুপার ৭০ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১০১ জন এবং সহকারী পুলিশ সুপার আছেন ১০১ জন। পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ১১৩ জন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) ৮২৯ জন, সার্জেন্ট ৫৩ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ১ হাজার ৩৯ জন, নায়েক ১১১ জন এবং নারী কনস্টেবল রয়েছে ১০ হাজার ৯৭১ জন।

সারাবাংলা/ইউজে/এমও

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন