বিজ্ঞাপন

নববর্ষে গোল করোনা, প্রেমের ফাঁদে ভুল করোনা

April 14, 2020 | 5:22 pm

রোহিত হাসান কিছলু

আমরা পাঁচ বন্ধু একসাথে মিরপুরের একটি মেসে থাকি। বিল্টু ভাইকে নিয়ে মোট ছয় জন। তিনি আমাদের তিন বছরের সিনিয়র বড় ভাই। সিনিয়র হওয়ার কারণে আমরা বন্ধুরা তাকে বেশ সম্মান করি। তাছাড়া জ্ঞান বুদ্ধিতেও বিল্টু ভাইকে আমরা সবসময় এগিয়ে রাখি। যেকোন সমস্যায় পড়লেই বিল্টু ভাইয়ের কাছে ছুটে যাই। তিনি দারুণ দারুণ সব চিকন বুদ্ধি দিয়ে আমাদের সমস্যা পানি করে দেন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এই মুহূর্তে বিল্টু ভাইকে মোটেও জ্ঞানী বলে মনে হচ্ছে না। তিনি চরম নির্বুদ্ধিতার একটি কাজ করতে যাচ্ছেন। বন্ধু কমল তো আমার কানে ফিসফিস করে বলেই বসলো,‘বিশ্বে গবেটদের তালিকা করা হলে আমাদের বিল্টু ভাই এখন এক নম্বরে থাকবেন। কেউ তাকে হারাতে পারবে না!’

আমি কমলের মুখে হাত চাপা দিলাম। ফিসফিস করে বললাম,‘আস্তে বল। লোকটা শুনলে কষ্ট পাবে।’

আমাদের ফিসফিস করতে দেখেই বিল্টু ভাই বুঝলেন তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘যতই ফিসফাস করো। এই বিল্টু সরকারকে কেউ ঠেকাতে পারবা না।’

বিজ্ঞাপন

আমি শেষ চেষ্টা হিসেবে আরেকবার অনুনয় করে বললাম,‘প্লিজ বিল্টু ভাই। আরেকবার ভেবে দেখো।’

বিল্টু ভাই তার নতুন পাঞ্জাবি পড়তে পড়তে বললেন,‘কোন ভাবাভাবি নাই। আমি যাচ্ছি তোদের হবু ভাবির কাছে! দুনিয়ার কোন শক্তি এখন আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।’

            ‘তবুও একবার ভালো করে ভেবে দেখো বিল্টু ভাই। করোনা ভাইরাসের জন্য পুরো শহর এখন লকডাউন। আর তুমি কি না এই সময় প্রেমিকার বাসায় যাচ্ছো নববর্ষের পান্তা ইলিশ খেতে! ব্যাপারটা কেমন না?’

বিজ্ঞাপন

            আমার কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বিল্টু ভাই বললেন,‘জীবনে তো প্রেম করিস নি! প্রেমের মর্ম তোরা বুঝবি না! আরে সম্রাট শাহজাহান প্রেমের জন্যে তাজমহল বানিয়েছে, রোমিও প্রেমের জন্যে জীবন দিয়েছে। আর আমি বিল্টু প্রেমের জন্যে মিরপুর থেকে ধানমন্ডি যেতে পারবো না! এত দুর্বল ভাবিস আমাকে?’

            আমি আবারও বিল্টু ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম,‘ওরা যা করেছে স্বাভাবিক সময়ে করেছে। লকডাউনের সময়তো করেনি!’

            বিল্টু ভাই আমার বডি স্প্রে’টা নিজের মনে করে ফস ফস করে মাখতে মাখতে বললেন,‘মরণ ছাড়া এখন আমাকে কেউ ফেরাতে পারবে না। সাত সকালে তোদের হবু ভাবি আমাকে ফোন দিয়ে কি বলেছে জানিস?’

            ‘কি বলেছে?’

বিজ্ঞাপন

            ‘বলেছে, বিল্টু বাবু, এবার নববর্ষে তোমাকে কাছে পাবো না ভাবতেই আমার কান্না পাচ্ছে। তুমি চলে এসো না একসাথে ইলিশ পান্তা খাবো।’

            ‘কিন্তু বাইরে গেলে তোমার যদি করোনা ভাইরাস ধরে, তুমি যদি মরে যাও তখন কী হবে?’

            ‘মরে গেলে তো ভালই হবে। প্রেমের জন্য মরবো। তখন রোমিও, মজনু ও সম্রাট শাহজাহানদের নামের পাশে তোদের বিল্টু ভাইয়ের নামও উঠে যাবে। তোরা গর্ব করে সবাইকে বলতে পারবি।’

আমরা আর কথা বাড়ালাম না। বুঝলাম এই বিল্টু ভাইকে আমরা থামাতে পারবো না। তিনি লকডাউন উপেক্ষা করে তার প্রেমিকার কাছে যাবেনই। বিল্টু ভাই বের হয়ে যাচ্ছে। আমরাও করুণ মুখ করে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ বিল্টু ভাই থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,‘শোন যদি কোন বিপদে পড়ি তাহলে তোদের কিন্তু ফোন করবো। এতদিন তোদের নানান বিপদে আমি বুদ্ধি দিয়েছি। কিন্তু নিজের জন্য বুদ্ধিটা ঠিক আমার আসে না।’

            আমরা মাথা কাত করে জানালাম, যতটা পারি ঘরে থেকে সবরকম সহায়তা করবো। কিন্তু এই লকডাউনে আমাদের পক্ষে বাইরে যাওয়া সম্ভব না।

বিল্টু ভাই বের হয়ে গেলেন। আমরাও মন খারাপ করে পান্তা ভাত ও আলু ভর্তা খেতে বসলাম। নববর্ষ বলে কথা। তাকে তো বরণ করে নিতেই হবে। পান্তা ভাতের সাথে আলু ভর্তা দেখে বন্ধু রানা দুঃখ করে বললো,‘এই যাত্রায় যদি বেঁচে যাই তাহলে সামনের নববর্ষের আগেই একটা প্রেম করে ফেলবো। এই শহরে যাদের প্রেমিকা আছে তাদের পাতে পান্তা সাথে ইলিশ উঠে। যাদের প্রেমিকা নাই, তাদের পাতে উঠে আলু ভর্তা আর শুটকি ভর্তা!’

            বুক ভরা দুঃখ নিয়ে আমরা আলু ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাত খাচ্ছি, এমন সময় বিল্টু ভাইয়ের ফোন আসলো। ফোন ধরতেই বিল্টু ভাইয়ের চিন্তিত কণ্ঠ শোনা গেল,‘ওই সামনে দেখি পুলিশ চেকপোস্ট। পার হওয়ার একটা চিকন বুদ্ধি দে তো!’

            হঠাৎ করে কী বুদ্ধি দিবো তা ভেবে পেলাম না। এদিকে সময়ও কম তাই দুম করে যা মাথায় এলো তাই বলে বসলাম,‘তোমার পাঞ্জাবি খুলে মাথায় বেধে উল্টা পাল্টা বকতে বকতে চেকপোস্টের দিকে এগিয়ে যাও। আমার কাছে তথ্য আছে, পুলিশ পাগলদের বিশেষ একটা ঘাটায় না।’

            বিল্টু ভাই ফোন কেটে দিলেন। বন্ধু রনি হাসতে হাসতে বললো,‘বিল্টু ভাই ফিরে আসলে তোর খবর আছে। এই আইডিয়া দেয়ার জন্য তুই কম করে হলেও দশটা কানমলা খাবি।’

            ঠিক এমন সময় আবার বিল্টু ভাইয়ের ফোন। আমি ভয়ে ভয়ে ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে বিল্টু ভাইয়ের উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল,‘খাসা একটা বুদ্ধি দিয়েছিস। পুলিশ সবাইকে আটকালেও আমাকে পাগল ভেবে ছেড়ে দিয়েছে।’

            বিল্টু ভাই ফোন কেটে দিলো। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক এই যাত্রায় মনে হয়ে বিল্টু ভাইয়ের কানমলা থেকে বেঁচে যাচ্ছি। আমার আইডিয়া কাজ করেছে। একটুপর আবার বিল্টু ভাইয়ের ফোন। ফোনটা ধরতেই এবার তার ভীত কণ্ঠস্বর শুনলাম,‘ওরে সামনে তো আর্মির চেকপোস্ট। পুলিশরে না হয় পাগল সেজে পার করেছি এদের পার করবো কিভাবে?’

            এবারও মাথায় যা আসলো বলে দিলাম। বললাম,‘তুমি তোমার পাঞ্জাবি খুলে ভালো করে ময়লা মাখিয়ে নাও। তারপর গলার কাছটা ছিঁড়ে নাও। পায়ের স্যান্ডেল পকেটে ঢুকিয়ে খালি পায়ে হাঁটো। ওরা মনে করবে তুমি গরিব লোক। ত্রাণের জন্য বের হয়েছ। আর ওরা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে বলো, ঘরে দুদিন ধরে খাবার নেই। তাই বের হয়েছি জনাব।’

            বিল্টু ভাই ফোন কেটে দিলেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করলেন। এবার তার উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর শোনা গেল,‘হ্যারে আমি তো আর্মির চেকপোস্টও পার হয়ে এসেছি। এখন একদম তোদের হবু ভাবির বাড়ির সামনে। দেখেছিস, প্রেম আসলে কোন বাধা মানে না!’

            বিল্টু ভাই ফোন কেটে দিলো। আমরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। পরক্ষণেই আবার বিল্টু ভাইয়ের ফোন। এবার তার কাঁদো কাঁদো কণ্ঠস্বর শোনা গেল। কান্নার কারণ কী জিজ্ঞেস করতেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,‘তোদের হবু ভাবি আমাকে অনেক বড় ফাঁদে ফেলেছে রে। আমি যখন তাকে বললাম, আমি তোমাদের বাসার নিচে। শুনেই সে রাগে আগুন। আমাকে বললো, তুমি সত্যি সত্যি চলে এসেছো। ছুঁচা কোথাকার! ইলিশ-পান্তা খাওয়ার এত লোভ তোমার! তখন বুদ্ধি করে যেই বললাম আমি ভালোবাসার টানে এসেছি। তখন আরো বিপদে পড়লাম।’

            ‘কী বিপদ?’

            ‘তখন তোদের হবু ভাবি বললো,তুমি লকডাউন না মেনে নিজের প্রাণের মায়া না করে বের হয়েছো মানে তুমি নিজেকে ভালোবাসো না। যে নিজেকে ভালোবাসে না। সে তার প্রেমিকাকে কী ভালোবাসবে সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে। তারপর থেকে তার ফোন অফ।’

            ‘আরে অত চিন্তা করো না। তোমার তো ওদের বাসায় এক্সেস আসে। সোজা চলে যাও। তারপর ভাবীকে বোঝাও।’

            ‘সেই চেষ্টাও করেছি রে। আজ আবার আমার হবু শ্বশুর গরিবদের মাঝে ত্রাণ দিচ্ছেন।  আমি তার সামনে গিয়ে সালাম দিতেই গরিব ভেবে আমার হাতে ত্রাণের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। তোর জন্যই আজ এমন হয়েছে।  ময়লা ধুলা-বালি মাখতে বলেছিলি,  পাঞ্জাবি ছিঁড়তে বলেছিলি।  এজন্যই আমার হবু শ্বশুরও চিনতে পারে নাই।’

            আমি কী জবাব দিবো বুঝতে পারছি না। বিল্টু ভাই এবার হু হু করে কেঁদে দিয়ে বললেন,‘নববর্ষে লকডাউন না মেনে অনেক বড় ভুল করেছিরে।’

বিল্টু ভাই আসলে কত বড় ভুল করেছিলো তা আরো ভালোমতন বোঝা গেল আমাদের মেসের সামনে ফিরে আসার পর। মেস মালিক বিল্টু ভাইকে মেসে উঠতে দিবে না। তাকে পনের দিন গেটের বাইরে থেকে তারপর ঢুকতে হবে! আমরা উপর থেকে দেখলাম, বিল্টু ভাই অসহায় হয়ে বাড়ির সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। পনের দিন টিকে থাকার জন্য তার হাতে সম্বল বলতে এখন আছে, হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রাপ্ত ত্রাণের দুই কেজি চাল, হাফ কেজি ডাল, এক কেজি আলু ও হাফ লিটার সয়বিন তেল।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন