বিজ্ঞাপন

বোরো ধানে শঙ্কা এখন ভারি বর্ষণের

April 18, 2020 | 8:23 am

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশের হাওরাঞ্চলে এখন পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাসের এই সময়ে বোরো ধান কাটতে প্রথম থেকেই শ্রমিক সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। তবে কৃষকরা বলছেন, শ্রমিক সংকট এখনো তেমন প্রকট নয়। এছাড়া ধান কাটায় সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা। ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতিও। তবে এখন আশঙ্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে আগাম ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস। এজন্য হাওরে মাইকিং করে পাকা ধান কেটে ফেলতে বলছে স্থানীয় প্রশাসন। হাওরাঞ্চলের একাধিক কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, হাওরের সাত জেলায় এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর। তবে বোরোর আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। শুক্রবার (১৭ এপ্রিল) পর্যন্ত ২০ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে, যা মোত আবাদি জমির ৯ শতাংশ।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। ধানের দামও পাওয়া যাচ্ছে। ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা মণে ধান বিক্রি হচ্ছে। ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় কোনো কোনো কৃষক এবারের ফলনে খুশি হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর মাঠের ফসল ঘরে তুলতে কৃষকরা এখন মহাব্যস্ত সময় পার করছেন।

বিজ্ঞাপন

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার কৃষক আবু সালেক মোবাইল ফোনে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সপ্তাহ খানেক ধরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। ভালো হয়েছে ফলনও। শ্রমিকের সংকট নেই।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, কাজের লোক এখন সব গ্রামে রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে যারা থাকত, তারা এখন গ্রামে। তারাই এখন ধান কাটছে। বরং অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার শ্রমিকের মজুরি কম।

তিনি আরও বলেন, এবার এক কানি জমি কাটাতে ৪ হাজার টাকা নিচ্ছে। অন্য বছর তা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে কাটিয়েছি। আর পাকা ধান দ্রুত কেটে ফেলতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। বাজারে ধানের দামও বেশি রয়েছে। ৮২০ টাকা মণে বিক্রি করছি।

তবে একই উপজেলার আরেক কৃষক রনি ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, এবার ২০ একর (১০০ শতাংশে এক একর)  জমিতে ধান করেছি। আগামীকাল থেকে ধান কাটা শুরু হবে। গ্রামে শ্রমিক সংকট রয়েছে। বাইরের শ্রমিকরা আসছে না। এলাকার লোক দিয়ে ধান কাটাতে বেশি টাকা লাগছে। আগে প্রতি একর জমির ধান ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায় কাটাতে পারলেও এখন খরচ হচ্ছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। এখন প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। বেপারিরা ধান কিনতে চায় না। তারা বলছে এখন ধান কোথাও নেওয়া যাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার কৃষক চান মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, এখন স্থানীয় দেশি জাতের ধান কাটা চলছে। বিআর-২৮ ধান কাটা শুরু হয়েছে। এখন আগের চেয়ে ধান চাষ কমে গেছে। গেল কয়ক বছর ধরেই হাওরে ধান কম করা হচ্ছে। কোনো কোনো হাওরে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ জমি পর্যন্ত পতিত রয়েছে। ধানের আবাদ কম হওয়ায় শ্রমিক সংকট তেমন হওয়ার কথা নয়। আবহওয়া ভালো থাকলে, বৃষ্টি বাদল না হলে শ্রমিক সংকট তেমন হবে না বলে মনে হচ্ছে। তবে সবে ধান কাটা শুরু। আরও কয়েকদিন পরে সেটি বোঝা যাবে।

এদিকে, নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার কৃষক কাজল চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, শ্রমিকরা এখন আসতে শুরু করছে। আগের দিন যারা না করেছিল, আজ তারাও এসেছে। মাঠে পর্যাপ্ত শ্রমিক রয়েছে। এছাড়া মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। গতকাল ধান বিক্রি করেছি ৭৮০ টাকা মণে। তবে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আজ ৬৫০ থেকে ৬৮০ টাকা মণে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। আর ধান কাটা শুরু হয়েছে সপ্তাহ খানেক হলো।

একই উপজেলার আরেক কৃষক শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে। শ্রমিক সংকট তেমন নেই। মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। আমরা খুশি। কিন্তু গতকাল হঠাৎ ঝড় হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় সেই ধানগুলো মাটিতে মিশে গেছে। এখন মেশিন দিয়ে আর ধান কাটা যাচ্ছে না। এগুলো শ্রমিক দিয়ে কাটতে হবে। তাই হঠাৎ করে শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। মজুরিও বেড়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, জেলার ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমির মধ্যে ১১ হাজার হেক্টরের জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। অর্থাৎ ৫ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। এলাকায় কৃষি শ্রমিকের সংকট রয়েছে। অন্যান্য বছর জেলার বাইরে থেকে ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক আসে। এখন করোনার ভয়ে কেউ আসতে চাচ্ছে না। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। বালু উত্তোলন ও পাথর কাটার কাজে ব্যবহৃত শ্রমিকদের এখন ধান কাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করা হয়েছে। বাইরে থেকেও কিছু কিছু শ্রমিক আসছে। এছাড়া যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। হারভেস্টার ও রিপার ব্যবহৃত হচ্ছে।

জানতে চাইলে কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, হাওরে বোরো ধান কাটতে শ্রমিক সংকট আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে কৃষি খাতে এমনিতেই তো শ্রমিক সংকট রয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছেন। তারা ধান কাটার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন।

সচিব বলেন, এবার ১৩৬টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ২১১টি রিপার দেওয়া হয়েছে হাওরে ধান কাটতে। এগুলো দিয়ে ধান কাটা চলেছে। আমার ধান আমি কাটব— এমন স্লোগানও উঠেছে। তবে সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লায় শ্রমিকের কিছুটা সমস্যা রয়েছে। এই দুই উপজেলাতেও ১০টি অতিরিক্ত হারভেস্টার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হাওরের তিন ধরনের ধান হয়ে থাকে। এর মধ্যে এখন ২৮ জাতের ধান কাটা হচ্ছে। ২৮ ও ৫৮ জাতের ধান ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কাটা শেষ হবে। আর ২৯ ধান কাটা শেষ হবে আগামী ১০ মের মধ্যে।

এদিকে, বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর, ইউরোপীয় ইউনিয়নভিত্তিক আবহাওয়া সংস্থা (ইসিএমডব্লিউএফ) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আবহাওয়া সংস্থা (এনওএএ) তথ্য অনুযায়ী ১৭ থেকে ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের মেঘালয় ও আসামের বরাক অববাহিকায় ভারি বৃষ্টিপাতের (১০০-২৫০ সেমি) সম্ভাবনা রয়েছে। ১৭ থেকে ২১ এপ্রিল সম্ভাব্য আকস্মিক বন্যার কারণে হাওরাঞ্চলে বিশেষ কৃষি পরামর্শ দিয়ে রেখেছেন কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্প। পূর্বাভাস থাকায় নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এক চিঠিতে দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দিয়েছে। কিশোরগঞ্জে মাইকিং করা হয়েছে এমন তথ্যও জানা গেছে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন