বিজ্ঞাপন

এপ্রিলের প্রথম ১০ দিন ভয়ঙ্কর

April 11, 2021 | 11:43 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের বছর পেরিয়ে এসে গেল মার্চ মাস থেকে ফের সংক্রমণ বাড়তে থাকে। জানুয়ারিতে ২১ হাজার ও ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ ১১ হাজারের ঘরে নেমে এলেও মার্চে সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৬৫ হাজারের বেশি। কেবল সংক্রমণ নয়, সংক্রমণের হারও জানুয়ারিতে ৫ শতাংশ ও ফেব্রুয়ারিতে ২ শতাংশের নেমে এসেছিল। তবে মার্চে ফের সংক্রমণের হার পেরিয়ে যায় ১০ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তুলনায় হঠাৎ করে মার্চে এমন সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতা বরং আরও ঊর্ধ্বগতি পেয়েছে এপ্রিল মাসে এসে। এপ্রিলের প্রথম ১০ দিনের পরিসংখ্যান বলছে, এই ১০ দিনেই সংক্রমণ ছাড়িয়ে গেছে ৬৭ হাজার, যা গোটা মার্চের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে, একই সময়ে সংক্রমণের হার পেরিয়ে গেছে ২২ শতাংশ, যা মার্চের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু তাই নয়, এই ১০ দিনেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা মার্চের প্রায় সমান।

শনিবার (১০ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার সই করা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ৭৭ জন। ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুতে এটিই রেকর্ড। এই ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৫ হাজার ৩৪৩ জনের মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

মার্চে করোনা সংক্রমণের পরিসংখ্যান

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত মার্চ মাসের ৩১ দিনে দেশে ছয় লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এসব নমুনা পরীক্ষায় করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৬৫ হাজার ৭৯টি নমুনায়। নমুনা পরীক্ষা বিপরীতে এই সময়ে সংক্রমণের হার ছিল ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এই ৩১ দিনে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু হয় ৬৩৮ জনের।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংক্রমণ শনাক্তের দিক থেকে গেল মার্চ ছিল চতুর্থ স্থানে। এর আগে কেবল ২০২০ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে সংক্রমণ শনাক্ত হয় এই মাসের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে জুনে সর্বোচ্চ ৯৮ হাজার ৩৩০ জন, জুলাইয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯২ হাজার ১৭৮ জন ও আগস্টে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার ৩৩৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। এ মাসে অবশ্য আগের যেকোনো মাসে সর্বোচ্চ নমুনার চেয়েও প্রায় দেড়গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা হওয়ায় সংক্রমণের হার ছিল তুলনামূলক কম।

বিজ্ঞাপন

ভয়ঙ্কর এপ্রিলের প্রথম ১০ দিন

মার্চে এসে সংক্রমণ আচমকা বেড়ে গেলেও এপ্রিলে এসে সেটি ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ে মাত্র তিন দিন ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণ ছাড়িয়েছিল চার হাজার। অন্যদিকে গত মার্চের শেষ তিন দিন সংক্রমণ পেরিয়ে গিয়েছিল ৫ হাজারের ঘর। সেখানে এপ্রিল মাস শুরুই হয় ৬ হাজারের বেশি, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার সংক্রমণ দিয়ে।

এপ্রিলের ১০ দিনের মধ্যে পাঁচ দিনই সংক্রমণ ছিল সাত হাজারের বেশি। ছয় হাজারের বেশি সংক্রমণ ছিল তিন দিন। বাকি দুই দিন সংক্রমণ ছিল পাঁচ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে এপ্রিলের ১০ দিনে সারাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৬৭ হাজার ৬৪২ জনের মাঝে। এই ১০ দিনের সংক্রমণ গোটা মার্চের চেয়ে আড়াই হাজার বেশি। অর্থাৎ মাস হিসেবে সর্বোচ্চ সংক্রমণের তালিকায় এখন এপ্রিলের ১০ দিন উঠে এসেছে চতুর্থ স্থানে।

বিজ্ঞাপন

এই ১০ দিনে মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে তিন লাখ দুই হাজার ৯১৩টি। সে হিসাবে ১০ দিনে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সংক্রমণের এই হারও গোটা মার্চের সংক্রমণের হারের দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু তাই নয়, সংক্রমণের হারের দিক থেকে এপ্রিলের এই ১০ দিনের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে কেবল জুলাই মাস। ওই মাসে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ছিল ২২ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

এদিকে, মার্চ মাসে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৩৮ জন। এপ্রিলের প্রথম ১০ দিনে এই সংখ্যা ৬১৫। অর্থাৎ এই ১০ দিনেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু গোটা মার্চ মাসকেই প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এপ্রিলের ১০ দিনে করোনা সংক্রমণের যে ধারা রয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে এই মাস এর আগের সব মাসের রেকর্ড ভেঙে দেবে।

কী করণীয় পরিস্থিতিতে?

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বেগ আগে থেকেই জানিয়ে আসছিলেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা। বারবারই তারা স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণের তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ ঠেকাতে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, উৎস ও উৎপত্তিস্থলগুলো বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে সরকার এক সপ্তাহের জন্য কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছে। সেগুলোর ফল পেতে আমাদের আরও একসপ্তাহ সময় লাগবে। ওই সময় যদি দেখা যায়, সংক্রমণ ও সংক্রমণের হার কমছে, তাহলে হয়তো এই বিধিনিষেধ যথেষ্ট মনে হতে পারে। তা না হলে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, এক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যার প্রভাব দেখা যাবে তিন সপ্তাহ পরে। বর্তমানে যারা সংক্রমিত হচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে যারা গুরুতর তাদের অবস্থা বোঝা যাবে এই সময়ে। এটিও কিন্তু এখন বাড়ছে। নতুন সপ্তাহ মাত্র শুরু হতে যাচ্ছে। দেখা যাক, সেখানে কোনো প্রভাব পড়ে কি না।

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, গণমাধ্যমে খবর দেখছি, সরকার দ্বিতীয় দফায় লকডাউন দিতে যাচ্ছে। মন্ত্রিসভার দু’জন সদস্য জানিয়েছেন, কঠোর লকডাউন হবে। এখন এই কঠোর লকডাউন মানে কী, সেটি সুস্পষ্ট করতে হবে। মানুষের কাছে সঠিক বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে যে লকডাউন হলে সে কী করতে পারবে, কী করতে পারবে না। এর সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে, সেটিও বোঝাতে হবে। তারপর প্রয়োজন হবে এসব নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ হচ্ছে কি না, তার কঠোর মনিটরিং। এগুলোর কোনো একটি জায়গায় শূন্যতা তৈরি হলে লকডাউন বলি আর যাই বলি না কেন, কোনো কাজে আসবে না।

স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের গুরুত্ব তুলে ধরে ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল আরও বলেন, আমরা বারবারই বলছি, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিকল্প নেই। মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে, জনসমাগম করা যাবে না। এগুলো ঠিকমতো অনুসরণ করলেই কিন্তু করোনার সংক্রমণ ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ করা সক্ষম। তাই এ বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন