বিজ্ঞাপন

জলাভূমি, জল ও জীবন অবিচ্ছেদ্য

February 2, 2022 | 2:58 pm

পাভেল পার্থ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীনালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশকে ঘিরে রেখেছে। এ দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। আর এই জলাভূমিকে উপলক্ষ্য করে প্রতিবছর সারাবিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব জলাভূমি দিবস। ১৯৯৭ সনের আগে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ সন থেকেই প্রথম প্রতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রতি বছরই পৃথিবীর জলাভূমি সমূহের গুরুত্ব এবং এর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক এবং উন্নয়নধারাকে বিবেচনা করে প্রতি বছরের জন্যই এক একটি প্রতিপাদ্য তৈরি করা হয়। ২০০৬ সনে জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাভূমিসমূহ এবং পানিনির্ভর জীবন ও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রা’; ২০০৭ সনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আগামীর জন্য মাছ?’; ২০০৮ সনে ‘স্বাস্থ্যকর জলাভূমি, স্বাস্থ্যকর জনগণ’; ২০০৯ সনে ‘নদী ও নদী তীর ব্যবস্থাপনা’; ২০১০ সনে ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন’; ২০১১ সনে ‘জলাভূমি ও জঙ্গল’; ২০১২ সনে ‘জলাভূমি ও পর্যটন’; ২০১৩ সনে ‘জলাভূমি ও পানি-ব্যবস্থাপনা’; ২০১৪ এবং ২০১৫ সনের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমি সমূহই আমাদের ভবিষ্যত’; ২০১৬ ‘জলাভূমি আমাদের ভবিষ্যত ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন’; ২০১৭ ‘জলাভূমি দুর্যোগ কমায় বা জলাভূমি দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস করে; ২০১৮ সনে ‘স্থায়িত্বশীল ভবিষ্যত নগরের জন্য জলাভূমি’; ২০১৯-এ ‘জলাভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন’ এবং ২০২০ সনের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য’। ২০২১ সনের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘জলাভূমি ও জল অবিচ্ছেদ্য এবং জীবনের জন্য অপরিহার্য’। ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য ‘মানুষ ও প্রকৃতির জন্য জলাভূমি’।

দিবসকে ঘিরে প্রতিপাদ্য তো থাকবেই। কিন্তু জলের দেশ বাংলাদেশে জলাভূমির অবস্থা কী? ঢাকা ছিল ২৬ খালের শহর। জলাভূমি খুন করেই গড়ে ওঠেছে আজকের রাজধানী ঢাকা শহর। আর এই ঘিঞ্জি ইটদালানের শহরে জল কই? একটুখানি ছায়াশীতল নিরাপদ পাবলিক পানি? শিশুবয়সেই আমাদের পড়ানো হয়, পানির আরেক নাম জীবন। কিন্তু আমরা প্রতিদিন পানি হত্যা করেই নিজেদের ভোগ আর বিলাসিতাকে চাঙ্গা রাখছি। দখল, দূষণ, লুটতরাজ আর উন্নয়নের চাবুকে আমাদের জল কী জলাভূমি সবই আজ নিখোঁজ।

জলাভূমি মানে কী? যে ভূমিতে জল জমে থাকে, জলাধার বা অন্যকিছু। জলাভূমি মানে কি কেবলমাত্র একদলা জমে থাকা পানি? তাহলে জলাভূমির সংজ্ঞা কী? কে কীভাবে এই জলাভূমিকে দেখছে? রাষ্ট্র কীভাবে এই সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছে? দেখা যায় রাষ্ট্রীয় নীতি ও নথিগুলো কী বলে। জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯) এর ৪.১৩ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘হাওড়, বাওর ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্টের ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। হাওর এবং বাওরগুলোতে শুষ্ক মওসুমেও যথেষ্ট গভীরতায় পানি থাকে তবে ছোট বিলগুলো সাধারণত চূড়ান্ত পর্যায়ে আর্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। এই বিলগুলো প্লাবনভুমির নিম্নতম অংশ। এই জলাশয়গুলো আমাদের প্রাকৃতিক নানা ধরণের জলজ সবজি ও মৎস্য-সম্পদের সিংহভাগের উৎস এবং পাখির আবাসস্থল। তাছাড়াও শীত মওসুমে উত্তর গোলার্ধ থেকে আগত অতিথি পাখিদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ও বটে। হাওর এবং বিলগুলো খালের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। অতীতে প্রকৌশলগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনেক বিলকে তাৎক্ষণিক ফসল লাভের জন্য নিষ্কাশিত আবাদী জমিতে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকট আকার ধারণ করে। প্রথমেই মাছ এবং গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের উৎস কচু, শাপলা, কলমি জাতীয় জলজ সবজীর বিলুপ্তি ঘটে। বর্ষা মওসুমে প্লাবনভূমির বর্জ্য প্রবহমান খালের মাধ্যমে বাহিত ও শোধিত হয়ে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সেই প্রাকৃতিক শোধনক্রিয়া ব্যাহত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে।’

বিজ্ঞাপন

অপরদিকে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ ২০০০ সনের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে, ‘হাওর ও জলাভূমি এলাকা অর্থ নিচু প্লাবিত অঞ্চল যাহা সাধারণত হাওর এবং বাওর বলিয়া পরিচিত।’ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০ এর ১৮৭ নং অনুচ্ছেদে আছে, ‘বদ্ধ জলমহাল বলিতে এরূপ জলমহাল বুঝাইবে যাহার চতুঃসীমা নির্দিষ্ট, অর্থাৎ স্থলবেষ্টিত এবং যাহাতে মৎস্যসমূহের পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে মৎস্য ধরার উপযোগী। সাধারনত হাওর, বিল, ঝিল, হ্রদ, দীঘি, পুকুর ও ডোবা ইত্যাদি নামে পরিচিত জলমহালকে বদ্ধ জলমহাল বলিয়া গণ্য করা হয়’।

জাতীয় পানি নীতিতে আরও উল্লেখ আছে, ‘হাওড়, বাওর ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যর ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। সরকার মনে করে যে বর্জ্য শোধন, ভূগর্ভস্ত পানির পুনর্ভরণ, সব জলজ ও জলচর প্রাণী ও তৃণের অস্তিত্ব এবং সর্বোপরি পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নিশ্চিত করতে, জলাশয়গুলোর শুধু সংরক্ষণই নয়, উপরন্তু উন্নয়ন প্রয়োজন যাতে এগুলোকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা যায়। -তার মানে রাষ্ট্রীয় নথিগুলোও জলাভূমির কোনো একক সংজ্ঞায়ণ দাঁড় করায়নি। কিন্তু জলাভূমি ঘিরে রাষ্ট্রীয় সকল সংজ্ঞায় একটি দারুণ কঠিন মিল রয়েছে। দেখা যাচ্ছে জলাভূমির সকল ঐতিহাসিকতাকে বাতিল করে বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় নীতি ও নথি জলাভূমিকে করপোরেট বাণিজ্যের চশমায় দেখে চলেছে। যেন জলাভূমি মানে একদলা জমানো পানি, বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ, পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল আর পর্যটন-বাণিজ্য। জলাভূমি নিয়ে কোনো রাষ্ট্রীয় সংজ্ঞাতে জলাভূমির প্রাণস্পন্দন ও জীবনের ছন্দ পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকতা ও জীবনপ্রবাহের কোনো ধারা এখানে নেই। ভিন্ন ভিন্ন জলাভূমির সঙ্গে প্রাণ ও প্রকৃতির যে জটিল সম্পর্ক এবং বিকাশ তা রাষ্ট্রের জলাভূমি বিষয়ক চিন্তা ও দর্শনে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর দেশজুড়ে জলাভূমিসমূহের করুণ যন্ত্রণা ও সংকটের নাভিবিন্দুটি এখানেই। জলাভূমিকে কীভাবে, কার চোখে দেখা হচ্ছে। ধারণ করা হচ্ছে, দেশজুড়ে জলাভূমির অবস্থান, চরিত্র, স্বভাব ও জীবনপ্রণালী ভিন্ন ভিন্ন। পাহাড়ি অঞ্চলের ঝিরি, ঝর্ণা, হ্রদ, কুণ্ড থেকে শুরু করে বিল, বাওর, খাল, খাঁড়ি, বাইদ, হাওর। পুকুর, দীঘি থেকে শুরু করে নদীপ্রণালী কিংবা সমুদ্র।

দেশের নানাপ্রান্তের ভিন্ন ভিন্ন জলাভূমি জীবনে অভ্যস্ত জনজীবনের কাছে জলাভূমির ব্যঞ্জনা ও সম্পর্কগুলো ভিন্ন ভিন্ন। তারপরও দেশজুড়ে জলাভূমির একটি পাবলিক সংজ্ঞা আছে। জলাভূমি মানে ‘জলাভূমি আশ্রিত জীবনপ্রবাহ’। কেন আজ দেশজুড়ে জলাভূমি সমূহের দুঃসহ করুণ অবস্থা? প্রধান কারণ হলো আমরা জলাভূমির এই পাবলিক সংজ্ঞা মানছি না। দেশের জলাভূমিগুলো সম্পর্কে একবারেই না জেনে, না বোঝে, সেই জীবনের সঙ্গে কোনোভাবেই একাত্ম না হয়ে গায়ের জোরে ‘জলাভূমি উন্নয়ন কি সংরক্ষণের’ পাতানো দরদ দেখাই। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বর্ষা পেরুলেও এখনও আমরা জলাভূমির প্রতি এক বিঘৎ দরদ ও দায়িত্ব দেখাতে পারিনি। আমরা জলাভূমিকে বরাবর এখনও ‘পতিত’ নিচু-অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করি। গায়ের জোরে দখল, নিয়ন্ত্রণ ও দূষণ করি। লণ্ডভণ্ড করে দেই। তবে জলাভূমি সুরক্ষায় বারবার দ্রোহী হয়েছে কেবল দেশের জলমগ্ন পা-ফাটা মানুষেরাই। হাওরের ভাসান পানিতে পাবলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুনামগঞ্জে গড়ে ওঠা ‘ভাসান পানির আন্দোলন’, দক্ষিণাঞ্চলের ‘ভবদহ’ বা ‘বিলডাকাতিয়া আন্দোলন’ তাই সাক্ষ্য দেয়। মেয়াদোত্তীর্ণ তথ্য, গড়মিল বিশ্লেষণ আর দখলিপনার মর্জি দিয়ে জলাভূমি বাঁচবে না। আজ তাই জলাভূমি সুরক্ষায় একেবারেই জলাভূমি জীবনের মানুষ দরকার। যাদের পা ফাটা এবং শরীরে আঁশটে ঝাঁঝ কিন্তু তথ্যে তীব্র, যুক্তিতে সপ্রতিভ এবং সংরক্ষণে মমতাময়।

বিজ্ঞাপন

জল ছাড়া জলাভূমি হয় না। জলাভূমি থাকলে বিকট ঢাকা শহরটিও এতো বিচ্ছিরি আর খিটমিটে থাকতো না। একটা শীতল মেজাজ ধারণ করতো এই শহর। জলময় সাহস আর স্মৃতিকাতরতা নিয়ে আসুন সবাই জলাভূমি আগলে দাঁড়াই, আর এই জল থেকেই যে আমাদের জীবনের জন্ম।

লেখক: লেখক ও গবেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন