বিজ্ঞাপন

ধানমন্ডির ১৭ হাসপাতালের সামনে তীব্র শব্দ দূষণ

March 4, 2022 | 12:10 am

স্টাফ করেস্পন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর ধানমন্ডিতে ১৭টি হাসপাতালের সামনে তীব্র শব্দ দূষণের উপস্থিতি মিলেছে। চলতি বছরের মার্চে ধানমন্ডির আবাসিক এলাকায় অবস্থিত ১৭টি হাসপাতালের সামনে চালানো এক পরীক্ষায় দেখা গেছে- এ সব জায়গায় শব্দ দূষণের মাত্রা তীব্রতর। এ সব এলাকার শব্দ দূষণের মাত্রা সর্বনিম্ন ৬৯ দশমিক ৭ ডেসিবল এবং সর্বোচ্চ ৮৯ দশমিক ৯ ডেসিবল পর্যন্ত যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদর্শ মান অনুযায়ী তীব্রতর শব্দ দূষণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিজ্ঞাপন

আদর্শ মান অনুযায়ী নীরব এলাকার জন্য আদর্শ মান দিনের বেলা ৫০ ডেসিবল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই মাত্রার শব্দ দূষণ প্রাণ-প্রকৃতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের সামনে শব্দ দূষণের মাত্রা সর্বনিম্ন ২৬.৭% (৬৯.৭ ডেসিবল) এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে ৬৩% (৮৯.৯ ডেসিবল) যা ১৭টি স্থানের মধ্যে সর্বোচ্চ।

হাসপাতালগুলোকে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী নীরব এলাকা হিসাবে বিবেচনা করে দিনের বেলার নীরব এলাকার মান (৫০ ডেসিবল) মাত্রার সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখা যায় যে, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের সামনে ন্যূনতম ৩৯.৪% এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে সবোর্চ্চ ৭৯.৮% শব্দদূষণ পাওয়া গেছে। ১৭টি স্থানের মধ্যে শব্দের মাত্রা গড়ে ৮১.৭ ডেসিবল, যার মধ্যে ৯টি স্থানেই ৮০ ডেসিবলের ওপরে শব্দের মাত্রা রয়েছে। যা US EPA অত্যধিক বিপজ্জনক মাত্রার শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) ‘আন্তর্জাতিক শ্রবণ দিবস’ উপলক্ষে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং ইকিউএমএস কনসালটিং লি. এর যৌথ উদ্যোগে অনলাইনে আয়োজিত ‘প্রাণ প্রকৃতির ওপর শব্দ দূষণের প্রভাব ও প্রতিকার’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ সব তথ্য তুলে ধরা হয়।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর ১০ সদস্যের একটি গবেষক দল ২০২২ সালের মার্চ মাসে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভূমি ব্যবহারের ভিত্তিতে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে।

বিজ্ঞাপন

গবেষণার অংশ হিসেবে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত ১৭টি হাসপাতালের সম্মুখে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। প্রতিটি হাসপাতালের সামনে শুধুমাত্র কর্মদিবসে মোট ১ ঘণ্টার শব্দের উপাত্ত নেওয়া হয়। তাইওয়ানে তৈরি Lutron ব্রান্ডের স্বয়ংক্রিয় সাউন্ড লেভেল মেশিনের সাহায্যে এ উপাত্ত রেকর্ড করা হয়।

বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমেরিকান স্পিস অ্যান্ড হেয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তথ্য অনুযায়ী ৭১ থেকে ৯০ ডেসিবল মাত্রায় শব্দ তীব্রতর শব্দদূষণ হিসেবে পরিগণিত হয়। মাঠ পর্যায়ের গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থিত হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগের অবস্থান ব্যস্ততম ট্রাফিক সংযোগের পাশে অবস্থিত। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী আবাসিক এলাকার জন্য দিনের বেলায় নির্ধারিত আদর্শ মান মাত্রার (৫৫ ডেসিবল) সাথে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় অবস্থিত হাসপাতালগুলোর সামনে শব্দের মাত্রার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৭টি স্থানেই আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রান্ত হয়েছে।

সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। অন্যান্যদের মাঝে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাকারিয়া, শ্রবণ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নাসিমা খাতুন, প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোসা. রাশিদা বেগম, ইকিউএমএস কনসালটিং লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক কাজী ফরহাদ ইকবাল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর কবির, ইউএসএইড ও এফসিডও এর বায়ু ও শব্দ দূষণ প্রকল্পের প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট ইঞ্জিনিয়ার মো. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী।

শ্রবণ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নাসিমা খাতুন বলেন, ‘মানবস্বাস্থ্যের উপর শব্দ দূষণের বিশেষ প্রভাবে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। স্কুলগামী শিশুদের ওপর শব্দ দূষণের প্রভাব বেশি। বর্তমানে অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে ক্লাস করার জন্য তারা ইয়ারফোন ব্যবহার করে ও পাশাপাশি অতিরিক্ত গান-বাজনা ইত্যাদি শোনার ফলে পড়াশোনায় অমনোযোগিতা ও খাবারে অরুচিজনিত সমস্যা দেখা দিচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘যেসব এলাকায় শব্দ দূষণ বেশি হয় সেসব এলাকার প্রাণীরা অন্য এলাকায় স্থানন্তরিত হয়, ফলে উদ্ভিদের পরাগায়ণ ও প্রজনন ব্যাহত হয়।’

প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোসাঃ রাশিদা বেগম বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণের ফলে গর্ভপাত হতে পারে এমনকি দূষিত পরিবেশে শিশু জন্মের পর বধির হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চ শব্দের হর্ন আমদানি ও অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজানো রোধে সরকারের আইন প্রয়োগ শব্দ দূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’

অনুষ্ঠানে শব্দ দূষণ রোধে ১০ দফা প্রস্তাবনা রাখা হয়-

১. শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এর শতভাগ বাস্তবায়ন। বিশেষ করে হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের হর্ণ না বাজানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এর আওতায় পরিবেশ ক্যাডার ও পরিবেশ পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে।

৩. বিধিমালা সংজ্ঞা অনুযায়ী চিহ্নিত জোনসমূহে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করা ও তা মান্যতার ব্যাপারে নিয়মিত মনিটরিং করা।

৪. ৯৯৯ এ কল সার্ভিস এর পাশাপাশি অনলাইনে ই-মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদান করা যেতে পারে।

৫. পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ, সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সহ অন্যান্য প্রশাসনিক দপ্তরের সমন্বয় সাধন করা।

৬. হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ নিশ্চিত করা, স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন না করা, হর্ন বাজানোর শাস্তি বৃদ্ধি, চালকদের শব্দ সচেতনতা যাচাই করে লাইসেন্স প্রদান করা এবং শব্দের মাত্রা অনুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেওয়া।

৭. শব্দের মাত্রা হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত নির্মাণ প্রকল্প ও শিল্প-কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র প্রদান না করা।

৮. উচ্চ শব্দ এলাকায় ইয়ার মাফ সহ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার করা।

৯. ছাদ, বারান্দা, খোলা জায়গায় গাছ লাগানো (গাছ শব্দ শোষণ করে) এবং সড়কের পাশে গাছ লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা।

১০. সন্ধ্যার পর ছাদ ও কমিউনিটি হলে গান-বাজনা না করা, ব্লেন্ডার, প্রেশার কুকার ও ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার না করা, ড্রিল ও গ্রাইন্ডিং মেশিন এর ব্যবহার সীমিত করা।

সারাবাংলা/আরএফ/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন