বিজ্ঞাপন

অমিত গোস্বামী-এর গল্প ‘বেবি সিটিং’

May 4, 2022 | 6:12 pm

অধিরাজ ব্যালকনিতে ছোট টেবিলের ওপরে ফোনটা রাখতেই নাতনি তিতি দৌড়ে এল। ওকে ইউটিউব চালিয়ে দিতে হবে। ও এতক্ষন একা একা খেলেছে। দাদাই ফোনে বকবক করছিল। কাজেই এটা তার অধিকার। অধিরাজ ইউটিউব চালিয়ে দিতেই তিতির মুখটা উজ্জল হয়ে উঠল। ও এখন কার্টুন দেখছে।

বিজ্ঞাপন

তিতির বয়স সবে দুই। কথা বলতে শিখেছে। তবে পুরো বাক্য বলে না। কাজের শব্দটুকু বলে। যেমন ভুখ, পানি, সুসু, নিদ। অধিরাজ শেখায় খিদে, জল, সুসু, ঘুম তিতি তবু হিন্দি শব্দগুলোই তুলে নিয়েছে। তিতি অধিরাজের মেয়ের মেয়ে। মেয়ে টুপুর বিয়ে করেছে সায়াহ্নকে। সায়াহ্ন এখন সানি। দিল্লির প্রবাসী বাঙালি। সানি টুপুরের সাথে কথা চালায় প্রায়ই হিন্দিতে অথবা হিন্দি বাংলা মিশিয়ে। কাজের মেয়েটিও হিন্দিভাষী। কাজেই তিতির চারিদিকে আলাদা ভাষাবিশ্ব। সে তো হিন্দি বলবেই। গত এক বছরের কিছু বেশি সময় অধিরাজ দিল্লিতে আছে। তার থাকার কারনও এই তিতি। প্রায় চোদ্দমাস আগে অফিসে বসে মেয়ে টুপুরের ফোন এসেছিল অধিরাজের কাছে।

বাবা, আমি তিতি বলছি, তুমি কি খুব ব্যস্ত? কথা আছে তোমার সাথে।

না, না, বলো।

বিজ্ঞাপন

বাবা, আমি চাকরি পেয়েছি। ইটস দ্য গুড নিউজ। আই বি এম দিল্লিতে। নেক্সট পয়লা জয়েনিং।

গ্রেট, কনগ্রাচুলেশন।

ইয়েস বাবা। তোমায় যে জন্যে ফোন করেছি, তা হল ক্যান ইউ কাম ডাউন হেয়ার বাই দ্য এন্ড অফ দিস মান্থ?

বিজ্ঞাপন

মানে?

আরে বাবা আমি ও সানি চাকরি করতে যাব, কিন্তু তিতিকে কে দেখবে? কাজের লোক না হয় টেক কেয়ার করল, কিন্তু আমাদের বাড়ির কাউকে থাকতে হবে তো!

তোর মায়ের সাথে কথা বলেছিস?

বলেছি। মায়ের পক্ষে এখন তো ইমপসিবল। সরকারী চাকরি। আর তুমি যখন ডিসিশন নিয়েছ চাকরি ছেড়ে দেবে তখন তোমার তো সমস্যা কিছু নেই।

বিজ্ঞাপন

আমি স্বাধীনভাবে লিখব বলেই তো চাকরি ছাড়ছি। দিল্লি গেলে এসব করব কি ভাবে?

ফোন আছে। ফোনে যোগাযোগ রাখবে আর বসে বসে লিখবে। নেটে পাঠিয়ে দেবে। মা যখন আসবে তুমি কলকাতা যেও।

ধুসস, এভাবে হয় নাকি?

শোন বাবা, এইটুকু বাচ্চাকে ক্রেসে নেয় না। তুমি না এলে আমি চাকরি করতে পারব না।

বলেই ফোনটা কেটে দিল টুপুর। অধিরাজ থুম মেরে বসে রইল ওর চেয়ারে। পুরো আলাপচারিতা নিয়ে ভাবতে বসল। সহকর্মী সৌরভ সামনে এসে বলল– ব্যাপার কি দাদা, ব্যোমকে গেলে যে। কি হয়েছে? অধিরাজ উত্তর দিল– ব্ল্যাকমেল।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই স্ত্রী সীমা জিজ্ঞাসা করল– কি ঠিক করলে? কবে যাবে?

কিসের কি ঠিক করলাম?

দিল্লি যাওয়ার।

মানে তুমি ধরেই নিয়েছ যে আমি চাকরি ছেড়ে দিল্লি যাব?

তা তো ধরে নিয়েছি। তুমি ওকে আজ অবধি কোন ব্যাপারে ‘না’ বলেছ?

তা বলি নি। কিন্তু এক্ষেত্রে তো একটা উপায় বার করতে হবে।

কয়েকদিন ভেবে অধিরাজ বেরোনোর কোন উপায় খুঁজে পেল না। এদিকে হোয়াটসঅ্যাপে টুপুর সমানে মেসেজ পাঠাচ্ছে। বক্তব্য একই। তুমি না এলে আমার চাকরি করা হবে না। হাউজ ওয়াইফ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্যে আমি জন্মাই নি। জানি না, কি করে ফেলব। তারপরে তুমি বুঝবে। উপায়ন্তর না দেখে অধিরাজ একদিন সানিকে ফোন করে তার মতামত জানতে চাইল। সানি স্ট্রেটকাট ছেলে। বলল, এটা টুপুরের বিষয়। চাকরি আমি করতে না করি নি আবার বলি নি যে চাকরি করতে হবে। কিন্তু তিতিরকেও অবহেলা করলে হবে না। কে দেখবে তিতিরকে? লাস্ট অপশন তুমি। কাজেই তোমাকে ধরে বসেছে। তুমি আবার ওকে রিফিউজ করতে পারো না। কাজেই…

কাজেই অধিরাজকে দিল্লি যেতে হল। দ্রুত ভলান্টেয়ারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে দুঁদে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অধিরাজ দত্ত দিল্লিতে এসে বেবি সিটার হলেন। প্রথমমাস দুয়েক সময়টা খুব ভাল কাটল অধিরাজের। ওকে বিশেষ কিছুই করতে হয় না। লেখালেখির সমস্যাও নেই। পলিটিকাল কভারেজের চাপ নেই। উপসম্পাদকীয় ও অন্যান্য লেখা লিখতে ওর কোন সমস্যা হচ্ছিল না। সানি ও টুপুর সকালে পাউরুটি ডিম কলা বা দুধ ওটস খেয়ে বেড়িয়ে যেত। অধিরাজের তাই বরাদ্দ। দুপুরে সবজি ডাল ভাত করে দিত কাজের মেয়েটি। খেয়ে নিত অধিরাজ। রোজ একই স্বাদ। রাতে যেদিন টুপুরের ইচ্ছে হত কখনও মাছের ঝোল, কখনও চিকেন, কখনো মাটন আর রাইস কুকারে ভাত রান্না করত। নাহলে সানি আর টুপুর মিলে হোম ডেলিভারির অর্ডার দিত। কখনও পিৎজা, কখনও বিরিয়ানি, কখনও নান চিকেন। অধিরাজের জীবন থেকে লুচি, পরোটা, সাদা আলুর তরকারি, জিলিপি, শুক্তো, গন্ধরাজ লেবু দিয়ে কলাইয়ের ডাল, পাঁচমিশেলি লাবড়া, কই মাছ, চুনো মাছের ঝাল, কচি পাঁঠার পাতলা ঝোল, আমের চাটনি সব ভ্যানিশ হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যেই।

জীবনে যে অধিরাজ রান্নাঘরের ছায়া মাড়ায়নি সেই মানুষ দুপুরে তিতি ঘুমোলে রান্নাঘরে ঢুকে পড়তে শুরু করল। চেষ্টায় কি না হয়। ইউটিউব দেখে রান্না করতে শুরু করল। ক্রমেই অধিরাজ চলনসই থেকে পাকা রাঁধুনী হয়ে উঠল। মেয়ে জামাইবাড়ি ফিরে বলে– আজ কি রান্না হয়েছে বাবা? কাল একটু বড়ি-বেগুনের ঝাল কর। কিন্তু বাধ সাধল স্ত্রী সীমা। পুজোর ছুটিতে এসে প্রায় বিদ্রোহ করে বসল, তোমাকে এখানে রান্না করার জন্যে থাকার কথা বলা হয়েছে? তুমি রান্না করবে? তাহলে লিখবে কখন? অধিরাজ সামান্য কাঁচুমাচু স্বরে বলল, আমার রান্না টুপুররা ভাল খায়, না হলে বাইরের জাঙ্কফুড আনে, কি করব? সীমা রণরঙ্গিণী, কি করব মানে? রান্নার লোক রেখে দেবে। সে এসে রান্না করবে। সীমা করিৎকর্মা। পুজোর ছুটির মধ্যেই সে একজন বাঙালি রান্নার মহিলা জোগাড় করে আনল। খরচ বাড়ল বটে, কিন্তু তা নিয়ে ট্যাঁফোঁ করার মত বোকামি টুপুর বা সানি করল না।

তিতির এমনি ঝামেলা নেই। সকালে কাজের মেয়েটি এলে ঘুম থেকে উঠে টুপুর সানি প্রতিযোগিতা করে দ্রুত রেডি হয়। দুজনেই ন’টার মধ্যে অফিস রওনা হয়ে যায়। কাজের মেয়েটি সকালের খাবার দিয়ে যায়। তারপরে তিতিকে তুলে স্নান করাতে খাওয়াতে নিয়ে যায়। এই সময়টা অধিরাজের কাজের সময়। সে লেখে। ফোন করে। প্রতিবেদন, গল্প পাঠায় ই-মেলে। এই সময়ে খুব একটা জ্বালায় না তিতি। ও বোঝে, দাদাই কাজ করছে, এখন যেতে নেই। অধিরাজ নিজেই কালো কফি বানায়, খায় আর লেখে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে কী করে যেন তিতি মা দিদিমার মত শিখে ফেলল, দাদাইয়ের ওসব ফালতু লেখালেখি। এখন হেঁটে হেঁটে চলে আসে, এসেই কোলে উঠে বলে– কারতুন চালা দো। অধিরাজ লেখার ফাইল বন্ধ করে তার ল্যাপটপে কার্টুন চালিয়ে দেয়। প্রথমদিকে যেসব ইংরেজি কার্টুন তিতি দেখতে ভালবাসে সেগুলি চালাত সে। কিন্তু দেড় বছর বয়সে যখন তিতির মুখে বুলি ফুটল অধিরাজ অবাক হল তার মুখে সব হিন্দি শব্দ শুনে। কিছুদিনের মধ্যে সে বুঝতে পারল এটাই স্বাভাবিক। ব্যাপারটা বুঝলেও কোথাও যেন পরাজয়ের তেতো স্বাদ অনুভব করল অধিরাজ। বাংলা ভাষার সাংবাদিক ও লেখক অধিরাজ দত্তর নাতনি বাংলা জানবে না? রবীন্দ্রনাথ পড়বে না? আরে ইয়ার, তু ইয়ার বলে কথা বলবে? ফোনে সীমার কাছে দুঃখের কথা বলে বিস্তর ধাতানি খেল অধিরাজ। বাংলার শিক্ষিকা সীমা বলল, বাংলা আজ পড়ে ক’জন! থাকবে দিল্লিতে, কাজেই হিন্দি আর ইংরেজিটা শিখলেই হবে। বাংলা নিয়ে আর আদিখ্যেতা করতে হবে না।

তা বলে নিজের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ পড়বে না, শরৎচন্দ্র… সুনীল, শক্তি, শঙ্খ?

কি হবে পড়ে? বড় চাকরী পাবে? বাংলার তো শ্রাদ্ধ করে ফেলেছে কলকাতা। জগাখিচুড়ি বাংলা। পরীক্ষায় তার জন্যে নম্বর কাটা যায় না। বোর্ডের নির্দেশ। সরকারী নিদান। তাই বাংলা না শিখেও সবাই পাস। যত বুক ধড়ফড় তোমারই?

তা তো কিছুটা হবেই। বাংলা আমার সাব্জেক্ট ছিল।

তা হলে বাংলাদেশে যাও। বাংলা বাংলা করে হেদিয়ে মর গে।

সীমার কাছে বাংলা নিয়ে গলা ধাক্কা খেয়ে অধিরাজের অদ্ভুত এক জেদ চাপল। ইউটিউব খুঁজে খুঁজে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গানের সাথে অনেক কার্টুনচিত্র সে ডাউনলোড করল। এভাবে গত মাস পাঁচেক সেই কার্টুন চিত্র চলছে। তিতি শুনছে। কিন্তু একটা বাংলা শব্দ আজ অবধি উচ্চারন করেনি। হতাশ হয়ে মাস খানেক আগে অধিরাজ সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে এবারে টুপুররা ক্রেস খুঁজে নিক। দু’বছর বয়স তো প্রায় হয়ে এল তিতির। তারও আর ভাল লাগছে না। তিতি ক্রেসে গেলে এখানকার বাচ্চাদের সাথে মিশতে পারবে। এখানকার ভাষা সংস্কৃতির সাথে আরো সংম্পৃক্ত হবে। টুপুরের আবার ক্রেসের বাচ্চা রাখার বেশ কিছু নিয়মনীতি পছন্দ হচ্ছে না। সমানে সে ফোন করছে মাকে, বাবাকে আর কটা দিন ম্যানেজ করতে বলো। সীমা কলকাতা থেকে ফোন করে অধিরাজকে দাবড়াচ্ছে।

এতদিন করলে যখন আর ছ’টা মাস চালিয়ে দাও।

আরে আমার পত্রিকাগুলোর সাথে দেখা না করলে আর কতদিন চালানো যায়?

ফোনে ম্যানেজ করতে পারছ না?

তুমি বুঝতে পারছ না, সব কিছু মেল বা ফোনে হয়? বইমেলায় থাকব না, লিটারেরি মিটে থাকব না, টিভি শোতে থাকব না, প্রকাশক আমার দেখা পাবে না– এভাবে হয়?

তা হয় না হয়ত। আর তো মাত্র ছ’মাস।

একদিনও নয়। তোমার মেয়ে আমাকে পার্মানেন্ট বেবি সিটার বানিয়ে ছাড়বে।

নিজের নাতনিকে রাখা বেবি সিটিং হল? তুমি কী নিষ্ঠুর। তুমি তো কংসরাজার বংশধর।

কিন্তু অধিরাজ নিজের মনে স্বীকার করে যে তার দিল্লি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কারন একটাই। তা হল তিতির বাংলা না বলা। এটা যে তার কত বড় পরাজয় সেটা অধিরাজ ছাড়া আর কে ভাল জানে? তিতি লেপটে থাকে দাদাইয়ের কাছে। আদর করে। খেলে। বেড়াতে যায়। আবার টুপুর যদি কোন কারনে অধিরাজের ওপরে চেঁচায় তিতি ওর মাকে বকে দেয়, ‘চোওওপ, মার দুঙ্গি’। কিন্তু হাজার চেষ্টায় একটা বাংলা শব্দ তিতির মুখ থেকে বার করা যায় নি আজ অবধি।

অধিরাজের জেদের কাছে কিছুটা নরম হতে হয়েছে টুপুরকে। খুব রেগেমেগে বলেই ফেলল দিন দুয়েক আগে, আচ্ছা তুমি যেতে চাও, যাও, আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও ভাল একটা ক্রেস খুঁজে বার করার। তারপরে তিতিকে একটু সেটল করে দিয়ে কলকাতা গিয়ে রবীন্দ্রনাথ হয়ো। আজ পঁচিশে বৈশাখ। আবার রবিবারও বটে। তাই সকাল থেকে সানি আর টুপুর বেরিয়েছে ক্রেস খুঁজতে। কাজের মেয়েটাও আসে নি।

অধিরাজের ল্যাপটপে রবীন্দ্র সংগীতের সাথে কার্টুন চিত্র বাজছিল। তিতি মন দিয়ে দেখছিল সেই চিত্র কাহিনী। হঠাত ছবি স্থির হয়ে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। ওয়াইফাই কানেকশন গোলমাল করেছে। উঠে সুইচবোর্ডের ওয়াইফাইয়ের একটা সুইচ অফ করে আবার অন করতে হবে। তাহলেই একটু পরে কানেকশন এসে যাবে। অধিরাজ বিরক্তবোধ করল। ব্যালকনির চেয়ার থেকে উঠে সামনের ঘরের সুইচ বোর্ডের কাছে এল সে। সুইচ অফ অন করল। আবার এসে দাঁড়াল ব্যালকনিতে। দেখল তিতি ঘুরে ঘুরে নাচছে আর স্পষ্ট উচ্চারনে গাইছে– ‘হা রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দে রে রে রে, যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে’। অধিরাজ লাফিয়ে উঠল। একা বাড়িতে সেও তিতির সাথে ঘুরে ঘুরে নাচতে শুরু করল। তিতি খালি ওই দুই লাইন বলছে আর নাচছে। অধিরাজও ঘুরে ঘুরে নাচছে। কোন দিকে খেয়াল নেই।

ফোনটা বাজছে। টুপুর। নাচতে নাচতেই ফোন তুলে নিল অধিরাজ।

বাবা, কিডস কর্ণার নামে একটা ক্রেস পেয়েছি, কাছেই…

দরকার নেই টুপুর। তোরা চলে আয়। তিতি ক্রেসে যাবে না। বাড়িতেই থাকবে।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন