বিজ্ঞাপন

সিরাজুল এহসান-এর গল্প ‘উপহাস্য জিগির অথবা উষ্ণতার খোঁজ’

May 4, 2022 | 6:21 pm

‘ওই হালার পুত, দুই দিনির টাহা পামু কিন্তু। আইজক্যা শোধ দিয়া তয় এইহানে ঘুমাইবি। নাইলে ওঠ, ফুট এহানত্থন।’ দারোয়ানের বাজখাই গলার আওয়াজে আর লাঠির গুঁতা খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ে দুলাল। বুকের মধ্যে ধড়পড় করতে থাকে। শরীর কাঁপে; চোখ থেকে অন্ধকার সহজে কাটে না। রাজধানীর গুলিস্তান-সংলগ্ন স্টেডিয়ামের এ বারান্দায় চট বিছিয়ে একটু আগে শুয়ে ছিল সে। বুকের স্পন্দন বাড়তেই থাকে। বিহ্বল দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দারোয়ানের ক্রুর চোখের দিকে। লাঠির দিকে চোখ পড়তে এ শীতেও শরীরের কোথায় যেন একটু ঘাম জমে সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়। দারোয়ান আবার ওঠায়। দুলাল চট দুটি গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ‘মামা, ট্যাহাতো আইজক্যাও নাইক্যা। কালকে দিমুনে’- এ কথা শুনে দারোয়ান বস্তা ওর হাত থেকে কেড়ে ফেলে দেয় দূরে। ‘তোরে ফুটতি কইছি, ফুট। আইজক্যা এই জা’গা বেইচ্যা দিছি মৌসুমির মা’র কাছে। ঠান্ডায় হ্যার কাম জমব ভালা। আইজক্যাও মাফ কইরা দিলাম, কালকে ট্যাহা না দিলে এই এলাকায় আইতে দিমু না মাঙ্গের পুলা! যা কইতাছি।’ দারোয়ানের একথা শুনে আর দাঁড়াতে সাহস পায় না দুলাল।

বিজ্ঞাপন

সরা দিনে কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল, জর্দার কৌটা, টিন ভাঙা আজ তেমন জমাতে পারেনি ও। যা টোকাতে পেরেছিল তাতে রাতের খাবারের টাকাও হয়নি। অগত্যা দুটি চিতই পিঠা খেয়ে এ স্টেডিয়ামের বারান্দায় ছেঁড়া বস্তাটা বিছিয়ে একটু ভালোটা গায়ে দিয়ে শুয়েছিল সবে। দারোয়ানের ঠ্যাঙানি খেয়ে রাস্তায় নামতে গিয়ে ১২ বছরের শরীর টলে ওঠে। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ হাড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। একপাও এগোতে চায় না শরীর। কোন দিকে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। একবার ভাবে পার্টি অফিসের সামনে দিয়ে মুক্তাঙ্গনের দিকে যাবে কি না। ওদিক তো উত্তর। উত্তর থেকেই তো এমন বাতাস বইছে।

গতকাল মুক্তাঙ্গনে এক সভা হয়ে গেল। ওর বয়সী অনেক শিশু ছিল সেখানে। শিশুদের নিয়ে অনেক কথা হলো। ওদের কথা বলছে শুনে দাঁড়িয়ে একটু বক্তিমেও শুনল। টোকাতে টোকাতে কথা শুনে বেশ গর্ব অনুভবে ধরা দেয়। সঙ্গী মনিরকেও শুনতে বলে। ওই সভায় আসা ওর বয়সী এক ছেলেকে বলতে শোনে- বাবা, এ জায়গার নাম কী? মধ্যবয়সী লোকটি জবাব দেয়-গুলিস্তান। ছেলেটি আবার জিজ্ঞাসা করে, গুলিস্তান মানে কী? বাবা বলেন, ফুলের বাগান। দুলাল শুনে চমকে ওঠে। এতদিন যে এলাকায় বাস করছে সেটির নামের অর্থ এত সুন্দর! মনিরকে শোনায়- ‘হুনছোস আমাগো এই গুলিস্তানের মানে নাকি ফুলির বাগান!’ মনির শুনে খেঁকিয়ে ওঠে, ধুর, ফুলির বাগান না বাল!

এখন ওই কথা মনে করে একটু ফিক করে হেসে ওঠে দুলাল। সেই হাসির রেখায় মিশে থাকে উপহাস আর কষ্টের দাগ। হাঁটতে গিয়ে আর হাঁটা হয় না। ফুটপাতেই শরীর ধসে পড়ে। একটু আড়াল খুঁজতে থাকে অসহায় চোখ। যেখানে অন্তত শীতের বাতাস একটু ঠেকাতে পারে। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই, গাড়িও কম। মানুষ সেই ভর সন্ধ্যায়ই ঘরে ফিরেছে কাঁপতে কাঁপতে। বিকালে স্টেডিয়ামে টিভির দোকানে একটু ভিড় দেখে ওরাও দাঁড়িয়ে শুনেছিল দেশের উত্তরে নাকি তাপমাত্রা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ছিল আজ। এতকিছু মাথায় ঢোকেনি ওর। ফুটপাথে শুয়ে এবার কুকুরকুণ্ডলী হয়। বস্তার মধ্যে কিছুক্ষণ সেঁধিয়ে থেকে বুঝতে পারে নিচ থেকে হুল ফোটাচ্ছে শীতের বিচ্ছু। দুই হাঁটু মিলিয়ে মাঝখানে হাত রেখে বাঁদিকে কাত হয়। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর আবার ডানদিকে ঘুরে শোয়। কিছুক্ষণ পর আবার বামে। আবার ডানে। ডান-বাম, ডান-বাম করতে করতে ঘুম আর আসে না। এবার দু’হাঁটুর মাঝখানে হাত রেখে ঘষে একটু উষ্ণতার আশায়। কয়েকবার চেষ্টা করে বুঝতে পারে শৈত্যপ্রবাহ আর পিঠের নিচের শীতল কংক্রিট ওর উষ্ণতা নিচ্ছে কেড়ে। এভাবে বার কয়েক করতে গিয়ে মাথার নিচের কাগজের পোটলার বালিশ যায় সরে। তা মাথার নিচে ফের আনতে যাবে ঠিক তখনই কোত্থেকে এক কুকুর এসে টোপলাটা মুখে তুলে ভোঁদৌড়ে দূরে মিলিয়ে গেল আর কয়েকটি স্বজাতির সঙ্গে। ‘শালার কুত্তা তোর মাইরে…’ বলে অনেকটা লাফিয়ে ওঠে। মনটা আরও খারাপ হয়ে যায় দুলালের। ঝিম মেরে ক’দণ্ড বসে থাকতেও পারে না শীতবাতাসের তোড়ে। ঠান্ডার উদ্দেশে খিস্তি ঝাড়তে গিয়ে চোখ চলে যায় দূরে। হা-করা মুখ বন্ধ হয়ে যায়, চোখজোড়া চকচক করে ওঠে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ আছে কি না। নাহ্, কাছে-কিনারে কাউকে দেখা যায় না। পার্টি অফিসের সামনে কুকুরগুলো ছোটাছুটি করছে। বিল্ডিংটা বাতাসপ্রবাহ ঘুরিয়ে দিচ্ছে বলেই কুকুরদের তাই আনন্দ-বিচরণ পার্টি অফিসের সামনে। দুলালের আকাঙ্ক্ষার স্রোতে গিয়ে পড়ে একপাশের রশি ছিঁড়ে পড়া ঝুলন্ত একটা ব্যানারের ওপর। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ব্যানারের ঝুলন্ত একপাশের রশি ধরার চেষ্টা করে। ওর চেয়ে উচ্চতায় বেশি হওয়ায় রশির প্রান্ত নাগাল পায় না। ক্লান্ত শরীরে লম্ফঝম্ফও চলে কিছুক্ষণ, তবুও থাকে নাগালের বাইরে। একটু জিরিয়ে শরীরের সব শক্তি জড়ো করে দেয় এক লাফ! এবার রশির ঝুলন্ত প্রান্ত আসে নাগালের মধ্যে। হ্যাঁচকা টানে আসে না হাতের মুঠোয়। বারদুয়েক চেষ্টা করেও ফল না পেয়ে কনুই পর্যন্ত রশি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ার চেষ্টা করতেই ছিঁড়ে পড়ে। শীর্ণ মুখে তখন ভেসে ওঠে বিশ্বজয়ের হাসি।

বিজ্ঞাপন

ব্যানারটি গায়ে জড়িয়ে এবার আর সাবেক জায়গায় শোয়ার চেষ্টা করে না। একটু আড়ালের খোঁজে এবার পা চালায়। মনে মনে স্টেডিয়ামের দারোয়ানের মা-বাপ তুলে গালি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে প্যান্টের জিপার খুলে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জলবিয়োগ শুরু করতেই ঘটে বিপত্তি। উত্তরমুখো দাঁড়ানোয় সেদিক থেকে আসা শৈত্যপ্রবাহের বেগে নিজের মূত্র নিজেকেই ভিজিয়ে দেয়। এবার আবার গালির তুবড়ি ছোটে কুয়াশা আর বহমান শৈত্যের ওপর। আধভেজা হাফপ্যান্ট নিয়ে বাঁ হাতে শরীরের নিম্নাঞ্চল চুলকাতে চুলকাতে এগিয়ে যায় দক্ষিণ দিকে। গোলাপ শাহ মাজার পেরিয়ে আরও দক্ষিণে এগোয় একটু আড়াল-আবডালের সন্ধানে। ছাদ থাক বা না-থাক অন্তত উত্তুরে বাতাস ঠেকিয়েছে এমন একটু ছায়া ওর চাই-ই চাই। বেশিদূর এগোতে হলো না। ডানদিকে বড় বিল্ডিংটায় নজর পড়তেই মনটা চনমন করে উঠল। বড় উঁচু বিল্ডিংটাই নগর ভবন। কুয়াশা কাটিয়ে সামনে-পিছনে বিস্তর আলো ছড়িয়ে হাসছে ভবনটি- তাই মনে হলো দুলালের কাছে। ভবনের দেয়ালঘেঁষে বসে পড়ে। একটু অনুভব করতে চেষ্টা করে এখানে শীত শৈত্যপ্রবাহের তীব্রতা কেমন।

পশ্চিমদিক থেকে একটু বাতাসের দাপট থাকলেও তা ঠেকিয়ে দিচ্ছে একটু দূরের ফুটপাথজুড়ে থাকা টঙের মতো দোকানগুলো। মনে হয় জায়গাটা মন্দ নয়, জুৎসই। এখানে কিছু কাগজ আর পলিথিনের ব্যাগ পড়ে আছে। এবার বালিশ বানানোর চেষ্টা করে ওসব দিয়ে। পেরেও গেল। এবার ভালো বস্তাটা বিছিয়ে নেয়, আর ছেঁড়া বস্তার সঙ্গে ব্যানার মিলিয়ে নতুন আবরণী বানিয়ে ফেলে। গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকলেও আবার নিচ থেকে কংক্রিটের শীতবিচ্ছু হুল ফোটাতে থাকে। শীতের আক্রমণ এখানে কম বলে একটু তন্দ্রাভাব আসে। অনেকক্ষণ পা গুটিয়ে থাকায় তা ছড়িয়ে দিতেই প্রাণীর অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। কখন এটি পায়ের কাছে এসে শুয়েছে ও বুঝতে পারেনি। মাথা উঁচু করে দেখে একটি মাদী কুকুর। পায়ের আঘাতেও সেটি সরে যায়নি কিংবা পালায়নি। বয়স্ক কুকুরটি শীতে কাবু হয়ে অনেকটা হাঁপানি রোগীর মতো শ্বাস টানছে। জিভেও খানিক বেরিয়ে এসেছে। দুলাল সেটির দিকে তাকাতেই উভয়ের চোখাচোখি হয়। উভয়ই অপলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দুলাল ব্যানারের খানিকটা কুকুরটির গায়ের ওপর ছড়িয়ে দেয়। পা ওর বুকের মধ্যে এগিয়ে দিলে কুকুরটি গো গো শব্দ করে, যেন স্বাগত জানাচ্ছে বা দিচ্ছে প্রশ্রয়। দুলাল এবার একটু ওম খুঁজে পায়। শীতল পা উষ্ণ হয়ে ওঠে। দুলাল এবার এক কাণ্ড করে বসে। কুকুরটির সামনের দুপা ধরে কোলের কাছে টাানার চেষ্টা করে। একটু কাঁইকুঁই শব্দ করে। একে সম্মতি ধরে নেয় দুলাল। কুকুরটি ওর দিকে পিঠ ফিরে শোয়। দুলাল পিঠে পা তুলে দিলেও ওর পক্ষ থেকে কোনো স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক আচরণ পাওয়া যায় না। ওর লোমে দুলাল উষ্ণতা খুঁজে পায়। আরও ঘনিষ্ঠ হয় প্রাণিদেহের দিকে। কুকুরও আতিশায্যে মৃদুস্বরে গা গা করে। দুলাল এবার রীতিমতো জড়িয়ে ধরে। শরীর আরও উষ্ণ হয়ে ওঠে।

মায়ের কথা, তার বুকের উষ্ণতার স্মৃতি মনে করতে চেষ্টা করে; হাতড়াতে থাকে, খোঁজে আর খোঁজে- পায় না। সব ঝাপসা। মায়ের অস্পষ্ট শরীর দূর থেকে দূরে সরে যায়। চোখে ভর করে ক্লান্তি। হামলে আসতে চায় ঘুমদৈত্যরা।

বিজ্ঞাপন

হঠাৎ করেই শৈত্যপ্রবাহের গতি বেড়ে যায়। পশ্চিমদিক থেকেও এবার বাতাস বইছে। উত্তর আর পশ্চিমের বাতাস মিলে আশপাশে মৃদু ঘূর্ণিবায়ুর সৃষ্টি হয়। মুখের ওপর থেকে সরে যায় ব্যানার। নগর ভবনের তীব্র আলো চোখে বিঁধে তির হয়ে। সাদা রং ওর কাছে জন্ডিস হয়ে যায়। মনে হয় লাইটগুলো ওকে নিয়ে হাসছে, করছে উপহাস। শৈত্যপ্রবাহের মতো লাইটও ওর ঘুমের শত্রু বলে মনে হয়। ওখানেই লাইটের মা তুলে গালি দেয়। ‘থু’ করে থুথু ছিটিয়ে দেয় উপরের দিকে। তা নিজের গায়ে পড়ল কি না বোঝা গেল না। আবার পাশ ফিরে ব্যানার দিয়ে কুকুরটিকে ঢেকে নিজেও মুড়ি দেয়। ব্যানারের গায়ে তখন ‘আজকের শিশু ভবিষ্যতের কাণ্ডারি, তাদের অধিকার/প্রতিষ্ঠা আমাদের অঙ্গীকার’ শব্দবন্ধ আলোয় ঝলসায়, শৈত্যে কাঁপে।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন