বিজ্ঞাপন

ফজলি আম রাজশাহী না চাঁপাইয়ের— জিআই নিয়ে আপত্তির শুনানি মঙ্গলবার

May 23, 2022 | 8:57 pm

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: ২০১৭ সালে ফজলি আমকে ভৌগলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। গত বছরের ৬ অক্টোবর জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাঘার ফজলি আম। এরপর থেকে ক্ষোভ জানিয়ে আসছে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী। চাঁপাইয়ের ফজলি আমকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আন্দোলনও করে যাচ্ছে তারা। ফজলি আমকে বাঘার জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিতে তারা নারাজ।

বিজ্ঞাপন

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশন দাবি, ফজলি আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের। এই ফজলি আম সারাদেশে পাঠানো হয়। তবে গবেষকেরা বলছেন, রাজশাহীর অন্তর্গত ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ। জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পেয়েছে ১৯৮৪ সালে। চাঁপাইয়ের ফজলি ও বাঘার ফজলি আমের মধ্যে আছে পার্থক্যও। ফজলি আমকে নিয়ে চাঁপাইয়ে স্বত্ব দাবি করা অযৌক্তিক।

এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে— ফজলি আম কার? রাজশাহী নাকি চাঁপাইনবাবগঞ্জের? ফজলি আমের এই জিআই স্বত্বে আপত্তি নিয়েই আগামীকাল মঙ্গলবার (২৪ মে) শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতরে একটি শুনানি হবে।

বাঘার ফজলি আমের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় ১৯১২ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত করা সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অপারেশনস ইন দ্য ডিস্ট্রিক অব রাজশাহীর চূড়ান্ত প্রতিবেদন। প্রতিবেদনের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ইংরেজিতে স্পস্টভাবে ‘দ্য বাঘা ম্যাংগো’ বা বাঘার আম, যা কলকাতায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, গবেষক ও হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকীর ‘আম’ বইটির অষ্টম অধ্যায়ে আমের জাত বিভাগে ৯৭ পৃষ্ঠার তথ্য অনুযায়ী বাঘার ফজলির পরিচিতি অন্তত ২০০ বছরের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ৫০০ বছর আগে নির্মিত ঐতিহাসিক বাঘা শাহী মসজিদের টেরাকোটার কারুকাজেও দেখা মেলে এই আমের ছবি। গবেষকেরা বলছেন, কারুকাজ করা এই আম ফজলি আমের প্রতিচ্ছবি। জনপ্রিয়তার কারণেই আমটি মসজিদে স্থান পায়।

গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলছেন, বাঘার মসজিদে যে আমের প্রতিচ্ছবি, তা ১০০ ভাগ ফজলি আমের। বাঘার ফজলি আমের ইতিহাস অতি প্রাচীন। একসময় এই আম প্রচুর পরিমাণে ‘নাটোর ম্যাংগো’ নামে কলকাতায় যেত। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে ফজলি আছে, এটা তার চেয়ে আলাদা। চাঁপাইয়ের ফজলি আকারে বড়, স্বাদে কম। বাঘার ফজলি আকারে ছোট, কিন্তু স্বাদ বেশি। ইতিহাস না জেনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্বত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব করছে বলে মনে করেন এই গবেষক।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, এটি সত্য যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রচুর ফজলি আমের গাছ আছে। কিন্তু ওই আম আর রাজশাহীর বাঘার আম আলাদা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলিকে এখনও ‘মালদাহের ফজলি’ হিসেবে এখনো ডাকা হয়। ভারতের মালদাহের ফজলি আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি একই। ওই আমের স্বাদ, আকার সবই রাজশাহীর থেকে আলাদা।

তিনি বলেন, শুনানির জন্য আমাকে ডাকা হয়নি। ডাকলে রাজশাহীর ফজলির সব ইতিহাস আমি যুক্তি দিয়ে তুলে ধরতে পারতাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের দাবি মিথ্যা প্রমাণ করতাম।

বিপরীত দাবি জানিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, ন্যায্যতা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে অবশ্যই চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতি পাবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদন হয়, রাজশাহীতে হয় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে। চাঁপাইয়ে আমের যে বাগান আছে, তার অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই ফজলি। ফজলির আদি জন্ম ভারতের মালদাহ জেলায় আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে। মূলত গৌড় অঞ্চলে এর জন্ম। অবশ্যই জিআই স্বীকৃতির আমরা দাবিদার।

বিজ্ঞাপন

২০১৭ সালের শুরু দিকে বাঘার ফজলি আম রাজশাহীর জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর বাঘার ফজলি আমকে রাজশাহীর নিজস্ব পণ্য হিসেব স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের আপত্তিতে জিআই সনদ আটকে যায় রাজশাহীর ফজলি আমের। মঙ্গলবার (২৪ মে) শুনানির মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে চায় সংশ্লিষ্ট অধিদফতর। এদিনই সিদ্ধান্ত হবে ফজলি কোথাকার।

ফজলির জিআই নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে চলছে আন্দোলন। ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির দাবিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জে বাগানমালিক, আম ব্যবসায়ী, চেম্বার অফ কমার্স, সাংবাদিকসহ জেলার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ মানববন্ধন, জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদানসহ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। সেখানকার জনপ্রতিনিধিরাও ফজলির জিআই স্বীকৃতি চাঁপাইয়ের কাছে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হাসান ওয়ালিউল্লাহ বলেছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আমের যে জাতের কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে বাঘার ফজলির স্বাদ, আকার, ওজনসহ অনেক পার্থক্য রয়েছে। ওই আমটি আসলে ভারতের মালদাহের। আর ওই ফজলি ‘মালদাহের ফজলি’ হিসেবে আগেই জিআই পেয়েছে। এর ফলে তখনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমের স্বত্ব পাওয়ার সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। তাই তাদের দাবি হাস্যকর।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন বলেন, শুনানিতে জিততে দালিলিক প্রমাণপত্রের পাশাপাশি বাঘার ফজলির ভৌগলিক পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ পরীক্ষাও করা হয়েছে। রাজশাহীর ফজলি যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বা ভারতের মালদাহের ফজলির চেয়ে আলাদা, সেটি আমরা প্রমাণ করতে পারব। তাই আশা করছি, বাঘার ফজলিই ‘রাজশাহীর ফজলি আম’ হিসেবে ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাবে।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন