বিজ্ঞাপন

‘পাঞ্জাবি ও গেঞ্জি কেটে দেখি, বঙ্গবন্ধুর বুকটা ঝাঁঝরা’

August 15, 2022 | 1:59 pm

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

“হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে আসার পর থেকে আমার প্রতিটি মুহূর্ত মনে হয়েছিল আমি ফায়ারিং মঞ্চে আছি। যে কোনো সময়ে চলে যেতে পারে জীবন। সেনা সদস্যদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো মারমুখী। ওদের কমান্ড ফলো করেছি ঠিকই, কিন্তু প্রচন্ড রকম ক্ষুব্ধও ছিলাম। আর মুখে ছিলো দোয়া। এরই মধ্যে কৌশল করি, কীভাবে শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর মুখটি দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

অবশেষে বঙ্গবন্ধুর লাশ গোসল ও জানাজার ব্যবস্থা করা হয়। সেনারা চেয়েছিলো কফিনসহ দাফন করতে। এ সময় আমি সাহস নিয়ে বলি, রাষ্ট্রপতিকে গোসল এবং জানাজা ছাড়া দাফন করা হলে ইতিহাসে আপনার নাম থাকবে। এরপর মেজর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে গোসল এবং জানাজা নামাজের ব্যবস্থা করতে বলেন। আমি একজন মৌলভী ডেকে আনি। বঙ্গবন্ধুর গায়ের পাঞ্জাবি-গেঞ্জি খুলতে গিয়ে ওই মৌলভীর হাত কাঁপছিলো। তখন আমিই নিজে ব্লেড দিয়ে কেটে বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি ও গেঞ্জি শরীর থেকে বের করি। বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবির পকেটে তামাক খাওয়ার পাইপের ও চশমার একটু অংশ পেয়েছিলাম। পাঞ্জাবি ও গেঞ্জি কেটে দেখি, বঙ্গবন্ধুর বুকটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।”

সারাবাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ওপরের কথাগুলো বলেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফন-কাফনে অংশ নেওয়া গোপালগঞ্জ মহকুমার তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম। সম্প্রতি রাজধানীর মগবাজারে নিজ ফ্ল্যাটে সারাবাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন তিনি।

বরফ ভর্তি কফিনের ওজন অত্যধিক বেশি ছিলো বিধায় হেলিকপ্টার হতে কফিন নামাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা ২/৩ জন ব্যাংক কর্মচারী, পুলিশ কনস্টেবল, স্পীডবোট ড্রাইভারসহ সবাই মিলে ধরাধরি করে কফিন বাক্সটি বহু কষ্টে হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে রাস্তায় আনা হয়। কিন্তু এ কজন লোকের পক্ষে কফিনটি কাঁধে বহন করে সামনে নেওয়া সম্ভব ছিলোনা। আর্মির হাবিলদার ৬ জন সৈনিক নিয়ে রাস্তায় এসে ১০/১২ গজ দুরত্ব রেখে অন গার্ড অবস্থায় দুইজন দুইজন করে কফিনের আগে-পিছে নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করে। বাকী ৪ জন সৈনিক হেলিকপ্টারের নিরাপত্তার জন্য হেলিপ্যাডে থেকে যায়।

বিজ্ঞাপন

কফিনটি ধরাধরি করে মাটি হতে উঠিয়ে অল্প অল্প করে সামনে নেওয়ার চেষ্টা চলে। কয়েক কদম করে যাবার পর কফিন মাটিতে রেখে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। অবস্থা দেখে থানার ওসি কফিন বহনে আরও লোকসংগ্রহের জন্য শেখ সায়েরা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালের পেছনের পাড়ার দিকে দৌড়ে যায়। এ সময় ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন উচ্চ স্বরে বলে উঠেন, ‘SDPO! Where is your carrier? You have no Bloody IQ? Who made you officer?’ তখন আমি বলি, ‘স্যার কফিন বহন করার লোকেরা ধমক খেয়ে পানি সাঁতরে পালিয়ে গেছে।’ তিনি তখন আবারও আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘You are talkative, Don’t talk. Proceed on.’ এভাবে ১০০/১৫০ গজ পথ সামনে অগ্রসর হলে ওসি আরও ৪/৫ জন লোক নিয়ে আসে। এবার ১০/১২ জন লোক কফিন কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগুতে থাকে। ডাকবাংলো এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ির মাঝখানে একটি ছোট খাল। তার উপর দিয়ে পারাপারের জন্য কাঠের ব্রীজ। কফিন নিয়ে ব্রীজ পার হওয়ার সময় মনের মধ্যে সারাদিনের সঞ্চিত সাহস নিয়ে মেজর হায়দারকে জিজ্ঞাসা করি, ‘স্যার ঢাকায় কি রাষ্ট্রপতির জানাজা হয়েছে? না এখানে ব্যবস্থা করতে হবে?’ তিনি বিদ্যুৎবেগে উল্টা ঘুরে বলে উঠেন, ‘what?’ আমি ভীষণ ভয় পেয়ে চুপ করে থাকি। ২/৪ কদম যাওয়ার পর তিনি ব্রীজের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আমার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন, ‘কি বলেছেন?’ এবার আমি কিছুটা সহজ হওয়ার ভান করে বলি, ‘স্যার আপনার কমান্ডে দেশের রাষ্ট্রপতির দাফন হচ্ছে। বিষয়টি ইতিহাসের অংশ হবে। তাই জানতে চেয়েছি জানাজা হয়েছে কি না?’ মেজর একটু চিন্তা করে ‘I don’t know’ বলে আবার কফিনের সাথে হাঁটতে থাকেন। কয়েক পা সামনে গিয়ে ব্রীজ হতে নামার সময় বলেন, ‘SDPO, All right. call a Moulavi for Janaja.’

মরদেহ পেঁচানো সাদা কাপড় খুলতেই দেখা যায়, সাদা থান কাপড়ের লম্বা টুকরার ওপর মরদেহ রেখে পায়ের দিক হতে কাপড়টি মাথার দিকে এনে মুচড়িয়ে গিঁট দিয়ে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যেন চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছেন!

মরদেহ পেঁচানো সাদা কাপড় খুলতেই দেখা যায়, সাদা থান কাপড়ের লম্বা টুকরার ওপর মরদেহ রেখে পায়ের দিক হতে কাপড়টি মাথার দিকে এনে মুচড়িয়ে গিঁট দিয়ে রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যেন চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছেন!

আমি সাথে সাথে ওসি আব্দুল জলিলকে জানাজার জন্য ইমাম খুঁজে আনতে বলি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি গেলে আমি আবার মেজর হায়দারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘স্যার লাশের কি গোসল হয়েছে?’ এ কথা শুনে তিনি ভীষনভাবে রেগে যান এবং উচ্চস্বরে বলেন, ‘Bloody is it out of Islam? All rubbish.’ আর কথা না বাড়িয়ে কফিনের সাথে চুপচাপ হেঁটে হেঁটে কবরস্থানের পাশে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আঙ্গিনায় উপস্থিত হই। সেখানে কবর খননকারী ৪/৫ জন লোক অপেক্ষমান ছিলেন। ঐ লোকগুলোসহ সকলে মিলে ধরাধরি করে কফিনটি উঠানে নামানো হয়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বা আশপাশের বাড়িতে কোনও লোকজন ছিলো না। সবাই অন্যত্র সরে গেছে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বহুদিনের পুরানো চাকর বৈকুন্ঠ পর্যন্ত লাশ আনার খবর পেয়ে পালিয়ে গেছে। টুঙ্গিপাড়ার উপর হেলিকপ্টারের চক্কর দেখে টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতি, গিমাডাঙ্গা প্রভৃতি গ্রামের লোকজন জীবনের ভয়ে দ্রুত পানিতে নেমে কচুরিপানার নিচে মাথা লুকিয়ে অথবা গোপন জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। উপস্থিত লোকজনদের কফিনের ডালা খোলার জন্য বললে তারা পাশের বাড়ি ও গোয়ালঘর খুঁজে কাঁচি এবং হাত কোদাল সংগ্রহ করে তার কোণা দিয়ে কফিন বাক্সের ডালা খুলে মাটিতে রাখে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েই মেজর হায়দার কবরের পাশে যান এবং খননকৃত কবর দেখে বলেন, ‘Grave is all right.’ তারপর তিনি আমাকে বলেন, ‘শেখ সাহেবের পরিবারের সদস্য বা নিকটাত্মীয় কাউকে ডাকেন। তার নিকট আমরা লাশ বুঝিয়ে দেবো।’ তার কথা শুনে বাড়ির ভেতর লোক পাঠানো হলো বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় খুঁজে আনার জন্য।

এরমধ্যেই অফিসারের নির্দেশে সবাই ধরাধরি করে কফিনের ভেতর থেকে লাশ বের করে ডালার ওপর রাখে। কফিনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও বরফের পানিতে ভর্তি ছিলো। মরদেহ পানিতে প্রায় ডোবা অবস্থায় ছিলো। তাই কফিন বাক্সটির ওজন বেশী ছিলো। মরদেহ পেঁচানো সাদা কাপড় খুলতেই দেখা যায় সাদা থান কাপড়ের একটি লম্বা টুকরার ওপর মরদেহ রেখে পায়ের দিক হতে কাপড়টি মাথার দিকে এনে মুচড়িয়ে গিঁট দিয়ে রাখা হয়েছে। গিঁট খুলে মুখ বের করতেই দেখা গেলো, বঙ্গবন্ধু যেন চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছেন। সার্কেল ইন্সপেক্টর আব্দুর রহমান বাড়ির ভেতর থেকে ২টি বেঞ্চ এনে গাছতলায় আর্মি অফিসারদের বসার ব্যবস্থা করেন। তিনি আমার কাছে এসে জানতে চান, কাফনের কাপড় আনার জন্য সাইকেল দিয়ে পাটগাতি বাজারে লোক পাঠাবেন কি না? আমি ইংগিতে পাঠাতে বলে উপস্থিত লোকজনকে মরদেহ গোসলের ব্যবস্থা করতে বলি। গোসল করানোর জন্য চাপকল হতে পানি আনতে গোয়ালঘরের ভেতর রাখা গরুর খইল-ভূষি খাবার বালতি ব্যবহার করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর পরনের সাদা পাঞ্জাবী, গেঞ্জি ও লুঙ্গি ভিজে শরীরের সাথে আটসাঁট হয়ে লেগে আছে। পাঞ্জাবী ও গেঞ্জি শরীর হতে বের করা যাচ্ছিলো না। কেটে বের করার জন্য চাকু বা ব্লেডের ব্যবস্থা করা যায় কি-না জানতে চাইলে উপস্থিত একজন বলেন, ব্রীজের পাশের দোকানে ব্লেড পাওয়া যেতে পারে। কবর খননকারীদের একজন অল্পক্ষণের মধ্যেই দোকান থেকে একটি ব্লেড ও একটি কাপড় কাচার ৫৭০ সাবান নিয়ে আসেন এবং বলেন দোকানে গায়ে মাখার কোনও সাবান নেই। এ সময়ে নিরাপত্তা ইনচার্জ ইন্সপেক্টর ইছাক ফকির এসে জানায় গোপালগঞ্জ থেকে লঞ্চ যোগে আসা ফোর্স পৌঁছে গেছে। তাদেরকে শেখবাড়ি, কাজীবাড়ি, টুঙ্গিপাড়া ও হাসপাতালের সামনে পেছনে দুই স্তরে নিরাপত্তা দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছে। ওসি জলিল পাশের গিমাডাঙ্গা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল হালিম মৌলভীসহ আরও দুইজনকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। মৌলভীকে দেখিয়ে মেজর সাহেবকে জানাই, ইনিই জানাজার নামাজ পড়াবেন।

বিজ্ঞাপন

আমি মৌলভী সাহেবকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী লাশের গোসল দিতে বলি। খোলা উঠান, কোন খাটিয়া বা চৌকি নেই যার উপর লাশ রেখে গোসল করানো হবে। লাশ আড়াল করার জন্য কোন পর্দারও ব্যবস্থা নেই। গরু ঘরের মাচা হতে দুটি হোগলার চাটাই এনে লাশের এক পাশ আড়াল করা হলো। মৌলভী সাহেবকে ব্লেড দিয়ে শরীর থেকে পাঞ্জাবি কেটে লাশ বের করার জন্য বললে তিনি ব্লেড হাতে নিয়ে কাঁপতে থাকেন। ভয়ে তিনি ভীষনভাবে নার্ভাস ছিলেন। ব্লেড দিয়ে পাঞ্জাবি ও গেঞ্জি কেটে শরীর হতে বের করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু হাতসহ সারা শরীর কাঁপুনির জন্য ঠিকমতো ব্লেড ধরতে পারছিলেন না। সবাই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভীত সন্ত্রস্থ চোখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি কিছুটা সাহস করে মৌলভীর হাত থেকে ব্লেড নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরনের পাঞ্জাবি-গেঞ্জি বুক ও পেটের উপর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে কেটে দিলে পাঞ্জাবি-গেঞ্জি শরীর হতে বের করে আনা সম্ভব হয়। উপস্থিত সবাই দেখতে পেলো, বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ঘাড়ের পেছনের দিকের মাংস নেই। হয়তো গুলিতে উড়ে গেছে। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল পাশের আঙ্গুল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামান্য চামড়ার সাথে লেগে আছে। পায়ের গোড়ালির রগ কাটা। ভয়ংকর এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবাই যেন শোকে ও ভয়ে পাথর হয়ে গেছে। পাঞ্জাবির পকেটে চশমার একটি ভাঙ্গা অংশ এবং তামাকের পাইপের একটি অংশ পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধুকে যে অবস্থায় আর্মিরা গুলি করে মেরেছে সে অবস্থায় সাদা থান কাপড় পেঁচিয়ে কাঠের তৈরি কফিন বাক্সে রেখেছে। কফিন বাক্সের ভিতরে শক্ত পলিথিন বিছিয়ে তার উপর বরফ দিয়ে মরদেহ রেখে চারিদিকে আরও বরফ দিয়ে পলিথিন পেঁচিয়ে বেঁধে দিয়েছে। যাতে মরদেহ হতে রক্ত বা বরফ গলা পানি কফিনের বাইরে আসতে না পারে।

বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ঘাড়ের পেছনের দিকের মাংস নেই। হয়তো গুলিতে উড়ে গেছে। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল পাশের আঙ্গুল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামান্য চামড়ার সাথে লেগে আছে। পায়ের গোড়ালির রগ কাটা।

বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। ঘাড়ের পেছনের দিকের মাংস নেই। হয়তো গুলিতে উড়ে গেছে। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল পাশের আঙ্গুল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামান্য চামড়ার সাথে লেগে আছে। পায়ের গোড়ালির রগ কাটা।

কিছুক্ষণ পরে লাশের গোসলের কাজ শুরু হয়ে গেলো। অফিসারের নির্দেশে দ্রুততার সাথে চলছে। কাফনের কাপড় আনার জন্য যে লোকটি পাটগাতি বাজারে গিয়েছিল সে এখনও ফিরে আসেনি। আর্মি ক্যাপ্টেন এবং হাবিলদার করবস্থানসহ বাড়ির চারিদিকে অস্থিরভাবে ঘোরাঘুরি করছে এবং কোথাও লোকজন জড়ো হচ্ছে কিনা তা দেখছে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন লাশের পাশে এসে বলেন, “গোসল শেষ হয়েছে। তাড়াতাড়ি ডেড বডি কবরে নিয়ে আসেন। মাটি দিয়ে আমরা এখনই চলে যাবো।’ এ কথা শুনে আমি মেজরের কাছে গিয়ে অনুরোধ করি, স্যার পাটগাতি বাজার থেকে কাফনের কাপড় নিয়ে লোকটি এখনও আসেনি। আর ভেজা কাপড় কেটে কাফন তৈরি করা যাবে না। ক্যাপ্টেন বলেন, ‘কাটার দরকার নেই। ঐ কাপড় দিয়ে লাশ এখনই কবর দিয়ে দেন। আমাদের সময় নেই।’ এ কথা শুনে লাশ পেঁচিয়ে আনা ভেজা রক্তাক্ত কাপড়টিকে কেটে কাফন তৈরির চেষ্টা হচ্ছিল। এ সময় ইন্সপেক্টর আব্দুর রহমান গোসলের স্থানে এসে বলেন, শেখ সায়রা খাতুন রেডক্রস হাসপাতালে রিলিফের কিছু সাদা শাড়ি আছে। ভেজা কাপড়ের চেয়ে ঐ শাড়ি কেটে কাফন তৈরি সহজ হবে। আমি আবার মেজরের কাছে গিয়ে হাসপাতালে রক্ষিত রিলিফের শাড়ি কেটে কাফন বানানোর প্রস্তাব করলে তিনি রাগান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে বলেন, “I have no objection. You can bring any thing you like. But you are to complete this Bloody Burial business quickly. We have no time.” তখন আমি সার্কেল ইন্সপেক্টরকে তাড়াতাড়ি শাড়ি এনে কাফন তৈরি করে লাশ কবর দেওয়ার জন্য রেডি করতে বলি।

এরই মধ্যে যারা বঙ্গবন্ধুর স্বজন খুঁজতে গিয়েছিলেন তারা মরদেহ গ্রহণের জন্য শেখ আব্দুল মান্নান ওরফে পনু শেখ নামের একজনকে পাড়া থেকে খুঁজে এনে বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতি মামা পরিচয় দিয়ে মেজর সাহেবের সামনে হাজির করেছেন। মেজর সাহেব তার কাছ থেকে, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ বুঝিয়া পাইয়াছি’; মর্মে লিখিত নিয়ে মরদেহ হস্তান্তর করলেন। হস্তান্তর কাগজে সাক্ষী হিসেবে দস্তখত নিলেন গোপালগঞ্জ হতে আসা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের ও টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আব্দুল জলিল শেখের। রেডক্রস হাসপাতাল হতে আনা সাদা দুটি শাড়ির লাল পাড় কেটে বঙ্গবন্ধুর শরীরের মাপে কাফন তৈরি করে মরদেহে পরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সবাই মিলে কফিনের ডালাসহ মরদেহ ধরাধরি করে কবরের পাশে আনে। বাড়ির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে নিরাপত্তা ডিউটি তদারকি করছিলেন ইন্সপেক্টর শেখ ইছাক ফকির। তিনি জানালেন টুঙ্গিপাড়া ও আশপাশের কয়েকজন লোক জানাজার নামাজ আদায় করতে চায়। এ ব্যাপারে মেজরের অনুমতি চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং উচ্চস্বরে বলেন, “Bloody you could not secure the area properly. People moving around & you are inviting them for Janaja. They may snatch the dead body? All stupid. Put the dead body in the grave right now. OK?” অবস্থা বেগতিক দেখে মৌলভী সাহেব লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে ‘আল্লাহু আকবার- আল্লাহু আকবার’ বলা শুরু করেন। উপস্থিত সবাই অর্থাৎ কবর খননকারী, মরদেহ বহনকারী, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ মিলে ২০/২৫ জন জানাজার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। মৌলভী সাহেব তিন কাতার করে দাঁড়াতে বললে আমি ২/৩ জনকে সাথে নিয়ে পেছনে আরও একটি কাতার করে দাঁড়িয়ে যাই এবং ইমাম সাহেবকে জানাজার নামাজ শুরু করতে বলি। নামাজ শেষে দোয়া পড়তে পড়তে দ্রুত লাশ কবরে শুইয়ে দেওয়া হয়।


আরও পড়ুন:

‘বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়দের মারতে আর্মি আসতে পারে’

‘দুপুরে মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়া যাবে, সব ব্যবস্থা করেন’

‘যে করেই হোক, বঙ্গবন্ধুর লাশের মুখ দেখতেই হবে’


এই সময় একজন মহিলা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ দিকের কোণায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে কেঁদে লাশ দেখার কথা বলতে থাকেন। প্রায় একই সময়ে ফরিদপুরের এএসপি (সদর) আনোয়ারুল ইকবাল কবরস্থানে এসে উপস্থিত হয়ে লাশের মুখ দেখতে চান। আমি মেজরকে ক্রন্দনরত মহিলা শেখ সাহেবের আত্মীয়া বলে পরিচয় দেই এবং কবরের ভেতর লাশের মুখ খুলে দেখানোর অনুমতি চাইলে তিনি সম্মতি দেন। তারপর ঐ মহিলা ও এএসপিকে কবরের পাড়ে দাঁড় করিয়ে কবরের ভেতর লাশের মুখ খুলে দেখানো হয়। তারপর খুবই দ্রুততার সাথে মাটি দেওয়ার কাজ শেষ করা হয়। কবরের মাটি পাড়ের সমান হলেই আর্মিরা উইথড্র সংকেত দিয়ে হেলিকপ্টারের দিকে রওনা দেয়। যাবার সময় মেজর হায়দার আমাকে বলেন, ‘Look SDPO, কবর হতে লাশ তুলে কেউ যেন মিছিল করতে না পারে। ডবল লাইনে সিকিউরিটি রাখবেন, লাশ ডিকম্পোজ না হওয়া পর্যন্ত।’ আমি পরিদর্শক ইছাক ফকিরকে কবরস্থানে রেখে আর্মিদের বিদায় দেওয়ার জন্য হেলিপ্যাডে যাই। হেলিকপ্টারে অবস্থানরত পাইলটরা লাশের নিরপত্তায় নিয়োজিতদের আসতে দেখে হেলিকপ্টার চালু করেন। এরপর সেনারা দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে হেলিকপ্টারে আরোহন করলে, হেলিকপ্টারটি আকাশে উড়ে যায়। সময় তখন বিকাল সাড়ে ৩টা-৪টা।”

বিজ্ঞাপন

চলবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন