বিজ্ঞাপন

মনোনয়ন দৌড়ে ২ দলের ১ ডজন নেতা, আসতে পারে নতুন মুখ

June 27, 2023 | 8:00 am

আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেকমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউছুফের মৃত্যু এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়, সাবেকমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এমপি’র নিষ্ক্রিয়তায় ফরিদপুর-৩ আসনের প্রার্থিতা দুই দলের আগ্রাহী প্রার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই এ আসটিতে এবার নতুন মুখের ছড়াছড়ি। কাঙ্ক্ষিত মনোনয়ন ভাগিয়ে নিতে ইতোমধ্যে দুই দলের ডজন খানেক নেতা দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচনি এলাকার সাধারণ ভোটার এবং রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ বেঁচে থাকলে এবং ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলে ধানের শীষ ও নৌকা প্রতীকের জন্য প্রার্থী বাছাই নিয়ে ভাবতে হতো না বিএনপি-আওয়ামী লীগকে। কিন্তু এদের একজনের মৃত্যু এবং আরেকজনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এ আসনটিতে নৌকা-ধানের শীষের একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী তৎপর হয়েছেন।

উন্মুক্ত তথ্যকোষ এবং নির্বাচনি এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ কামরুল ইসলাম সালেহ চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম মৃধা, ১৯৮৬ সালে জয় পান বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের মহব্বত জান চৌধুরী, ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির কামরান হোসেন চৌধুরী, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পর পর তিনটি নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ এবং ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পর পর তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী হন ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

অর্থাৎ এ আসনে ১১টি নির্বাচনে মধ্যে সর্বোচ্চ চারবার করে জয় পেয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এছাড়া স্বতন্ত্র, বাকশাল ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী একবার করে নির্বাচিত হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

এমন হিসাব-নিকাশের এই আসনটিকে নৌকা বা ধানের ধীষের ‘ঘাঁটি’ বলার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে এ আসনের প্রার্থীদের জয়-পরাজয়। সে কারণেই আসনের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দুই দলকেই ‘১০ বার’ ভাবতে হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের হেভিওয়েট নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল, মানববতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদকে মনোনয় দিয়েছিল বিএনপি। সেই ভুলের মাশুল পরের তিন নির্বাচনে দিতে হয়েছে বিএনপিকে— এমনটিই বলছেন এলাকার সাধারণ ভোটাররা।

আর পড়ুন:

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ

গত বছর ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন (বাবর) গ্রেফতার হওয়ার পর ফরিদপুর-৩ আসন নিয়ে নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয়। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০০৮ সালে প্রথম বিজয়ী হয়েছিলেন। দায়িত্ব পেয়েছিলেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। তারপর থেকেই এই আসনটি নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এই আসনে তাকে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত প্রার্থী হিসেবে মনে করা হতো।

কিন্তু বছর দুয়েক আগে ফরিদপুরে শুদ্ধি অভিযানের প্রেক্ষাপটে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন যে আগামীতে ফরিদপুর-৩ আসনের মনোনয়ন পাচ্ছেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। যদিও তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন বয়সের কারণে খন্দকার মোশাররফ হোসেন নিজেই ভোটের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। আর এ কারণেই ফরিদপুর-৩ আসনে আগামী নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন, সে বিষয়টি নিয়ে নানারকম গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গত বছর ৮ মার্চ বাবর আটক হওয়ার পর ফরিদপুর-৩ আসন নিয়ে নানামুখী আলাপ-আলোচনার সূত্রপাত হয়।

নির্বাচনি এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফরিদপুর-৩ আসনে যদি শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রার্থী না হন তাহলে এই আসনের অন্যতম দাবিদার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি, হা-মীম গ্রুপের মালিক এ কে আজাদ। তিনি ফরিদপুরের সন্তান এবং দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত। এই আসনে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন যে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহকে মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর আসন থেকে সরিয়ে এনে ফরিদপুর-৩ আসনে প্রার্থী করা হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

আবার গুঞ্জন রয়েছে, গত নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান ফরিদপুর-৩ আসনের প্রার্থী হতে আগ্রহী বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের এই হেভিওয়েট নেতা নিজের আসন ছেড়ে ফরিদপুর-৩ আসনে প্রার্থী হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মনে করছেন নির্বাচনি এলাকার সাধারণ ভোটাররা।

উল্লিখিত হেভিওয়েট প্রার্থী ছাড়াও মাঠে রয়েছেন- কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য বিপুল ঘোষ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক, সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. ফারুক হোসেন। আগ্রহী এসব সম্ভাব্য প্রার্থী মনোনয়ন নিশ্চিত করতে নির্বাচনি এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সভা-সমাবেশ, গণসংযোগ এবং কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছেন।

ফরিদপুরের ৩ আসনের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, বাইরে থেকে কোনো প্রার্থী নয়, বরং তৃণমূলের ত্যাগী-পরীক্ষিত কোনো ব্যক্তিকেই এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া উচিত। বিশেষ করে ৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফরিদপুরে যারা বিভিন্নভাবে নিপীড়িত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, দলের কঠিন সময় সংগঠনকে আগলে রেখেছেন, এরকম ব্যক্তিদেরই মনোনয়ন দেওয়া উচিত।

মনোনয়ন বিষয়ে জানতে চাইলে এ কে আজাদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে আছি। কখনও নির্বাচন করার সুযোগ হয়নি। আমার বিশ্বাস, দল এবার আমাকে সেই সুযোগটা দেবে। আর সুযোগ পেলে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’

বিএনপি

নির্বাচনেরে ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না এলেও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়নের আশায় এলাকায় গণসংযোগ চালাচ্ছেন। কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে এলাকায় রাজতৈনিক তৎপরতা বাড়িয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।

এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাবেকমন্ত্রী প্রয়াত চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ ও জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি মাহবুবুল হাসান ভুঁইয়া পিংকু। এ ছাড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদ্দারেস আলী ইছা ও যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন খান পলাশও ধানের শীষ প্রতীক পাওয়ার জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করছেন।

এলাকার সাধারণ জনগণ এবং ভোটাররা বলছেন, ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে আগ্রহী এসব সম্ভাব্য প্রার্থীর কেউ অতীতে নির্বাচন করেনি। প্রয়াত কামাল ইবনে ইউসুফই ছিলেন বিএনপির প্রধান পছন্দ। তিনি নির্বাচন করতে চাইলে দলের অন্য কোনো নেতার কথা ভাবার প্রয়োজন পড়ত না বিএনপির। তারপরও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতের দাবি পূরণে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফকে বাদ দিয়ে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ নেই। জামায়াতের সঙ্গেও আসন ভাগাভাগি করতে হবে না বিএনপিকে। সুতরা বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে দলের আগ্রহী নেতাদের মধ্য থেকেই একজনকে বেছে নিতে পারবে বিএনপি। এক্ষেত্রে মোহন মিয়ার দৌহিত্রী, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের কন্যা চৌধুরী নায়াব ইউসুফের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার দীর্ঘ দিন ধরে বিএনপির রাজনীতি করে আসা ফরিদপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদ্দারেস আলীর ঈছার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।

মনোনয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আপাতত মনোনয়ন বা নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না, আন্দোলন নিয়ে ভাবছি। আন্দোলন করছি। দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে দিলে অবশ্যই আমার দল নির্বাচনে যাবে। তখন যদি দল আমাকে মনোনয়ন দেয় আমি অবশ্যই নির্বাচন করব। নির্বাচনের জন্যই তো রাজনীতি করছি।’

ফরিদপুরের সাংস্কৃতিককর্মী ও সংগঠক মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফরিদপুরের এই আসনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপ-মহাদেশের কিংবদন্তিতুল্য রাজনীতিবিদ লাল মিয়া, মোহন মিয়াদের উত্তসূরিরা এখানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় বরাবরই ধানের শীষের প্রার্থীরা জয় পেয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফকে মনোনয়ন না দিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল একাত্তরের ঘাতক আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদকে মনোনয়ন দেওয়ায় বিএনপি এ আসনটি হারায়। এরপর আর বিএনপি এ আসনে জিততে পারেনি। আবার আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্যও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নন। তার নিজের এবং আত্মীয় স্বজনের কর্মকাণ্ডে খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সমর্থকেরা ক্ষুব্ধ। সুতরাং এ আসনটিতে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দুই দলকেই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। ভুল করলে চলবে না।’

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী এই আসেনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৮৭১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগে মনোনীত প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ পান ২১ হাজার ৫০০ ভোট। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খন্দকার মোশাররফ হোসেন নৌকা প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭টি ভোট পেয়ে জয়ী হন। সেবার স্বতন্ত্র প্রার্থী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ কলস প্রতীক নিয়ে পান ৭৬ হাজার ৪৭৮ ভোট।

সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন