বিজ্ঞাপন

মার্কিনী আরব বসন্ত এবং আজকের বাংলাদেশ

December 22, 2023 | 7:48 pm

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

আগামী ৭ জানয়ুারি অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের মনঃপুত নাহলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ‘আরব বসন্তের মত’ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে বলে সতর্ক করেছে রাশিয়া। গত ১৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এই মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন। এবিষয়ে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে তার মন্তব্য জানতে চান। জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, আমরা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে সমর্থন করি এবং এর চেয়ে বেশি বলার মতো আমার আর কোনও মন্তব্য নেই। পাশাপাশি ‘আরব বসন্ত’ নয়, ‘বাংলা বসন্তের’ জন্য এদেশের মানুষ প্রস্তুত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। এসবের অর্থ হচ্ছে নির্বাচন প্রতিহত করার অভিলাষী দলের মধ্যে মার্কিনী অভিসন্ধির ব্যাপারে বেশ “জোশ” লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচনে বাধা দেয়ার চেষ্টা ব্যার্থ হবার পরে নির্বাচন বিরোধীরা মার্কিনী তৎপরতায় পুলকিত অনভুব করছে! তাহলে ব্যাপারটি এরকম দাঁড়ায় যে আরব বসন্ত বাংলাদেশে রপ্তানি করার লক্ষ্যে মার্কি ন সাম্রাজ্যবাদে র বহুমখুী ষড়যন্ত্র চলমান থাকা সম্পর্কে মারিয়া জাখারোভার বক্তব্যের সারবত্তা আছে।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন হচ্ছে “আরব বসন্ত” কী ? “আরব বসন্ত” বলতে আরব অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ২০১০ সালের শেষের দিকে আরবের বিভিন্ন দেশে শুরু হওয়া গণজাগরণকে বোঝায়। এতে আরব রাষ্ট্র সমূহের জনগণের বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন সংগঠিত হয় তাই “আরব বসন্ত” বা “আর রবিউল আরাবী” নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। আরব বসন্তের শুরু হয় ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ায়। এরপর তা মিশরে , লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। আরব বিশ্বের এই গণঅভ্যূত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। এভাবে “আরব বসন্ত’ এর মাধ্যমে ওইসব দেশের মধ্যে মার্কি ন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা স্থায়ীভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছে। আরব দেশ সমূহের তুলনায় রাজনৈতিক উন্নয়নের দিক দিয়ে অধিকতর অগ্রসর বাংলাদেশে এধরনের মার্কিন ষড়যন্ত্রের নীল নক্শা নিশ্চিতভাবেই মুখ থুবড়ে পড়বে।

বর্তমানে “আরব বসন্ত” রপ্তানির মার্কি নী ষড়যন্ত্র আজকের বাংলাদেশে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেন ব্যর্থ হবে মার্কি ন ষড়যন্ত্র? এপ্রশ্নের উত্তরের জন্য এবং বিষয়টি সম্পর্কে অধিকতর উপলব্ধি ও হৃদয়ঙ্গমের নিমিত্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু পাকিস্তান এবং আমেরিকার জন্য লজ্জাকর ও অপমানজনক দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনা বিবেচনার্থে এখানে উল্লেখ করা সঙ্গত মনে করছি।

প্রথম ঘটনা ১৯৭১ এর। পাকিস্তানে র প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সক্রিয় সমর্থন এবং সহযোগিতা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধরত বাঙালি মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে “World’s best fighting force” হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনারেল আমির আবদল্লুাহ খান নিয়াজীর নেতৃত্বে ৯৩০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোন সেনাবাহিনীর এত বিশাল সংখ্যক আত্মসমর্পণে র ঘটনা আর ঘটেনি। আর এমন প্রকাশ্যে অস্ত্র ও আত্মসমর্পণের ঘটনা মানব ইতিহাসে আর একটিও নাই। আমেরিকার মত শক্তিশালী সমর্থক থাকার পরেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে “মার্কিন আরব বসন্ত” বা মার্কিনীদের অন্যসব ষড়যন্ত্রের পরিণতি বিবেচনা করা যেতে পারে । অর্থাৎ কোন ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশের অগ্রগতি রুখতে পারবে না।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় ঘটনাটি বা দুর্ঘটনাটি ঘটে ছিল ১৯৮৮ সালে। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত তার নিজের তৈরি “ধর্ম যোদ্ধাদের ধাওয়া” খেয়ে ২০২১ সালে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি সাম্প্রতিক কালের খবর। কিন্তু ১৯৮০’র দিকে পাকিস্তানে মার্কিন প্রভাব প্রতিপত্তির স্বর্ণযুগ চলছে তখন। “আরব বসন্ত” শব্দবন্ধের ব্যবহার তখনও অবশ্য শুরু হয়নি। তবে আফগানিস্তানে সোভিয়েত উপস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আফগান মুজাহিদদের সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে সব ধরনের আয়োজন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এইসব মার্কিন আয়োজনের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক।

১৭ অগাস্ট, ১৯৮৮: সি -১৩০ হারকিউলিস হেলিকপ্টারে চড়ে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী সেনা ছাউনি ভাওয়ালপুর যাচ্ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক। সাথে ছিলেন পাকিস্তানে তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রদতূ আর্নল্ড রাফেল এবং সিনিয়র মার্কিন সামরিক অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হার্বার্ট এম ওয়াসমসহ মোট ৩০ জন। উদ্দেশ্য, মরুভূমির পরীক্ষাস্থলে মার্কিন কোম্পানির তৈরি এম-১/এ যুদ্ধ ট্যাঙ্কের একটি প্রদর্শনী দেখা। এই ট্যাঙ্ক কেনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছিল। ফেরার সময় উপহার হিসাবে ভাওয়ালপুরের বিখ্যাত আম উপঢৌকন দেয়া হয়েছিল হেলকপ্টার যাত্রী প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এবং অন্যান্য ভি-ভি আইপি-দের। লকহিড কোম্পানির তৈরি এই হেলিকপ্টারটি ভাওয়ালপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে, হঠাৎ সুতলজ নদীর কাছে মাটিতে আছড়ে পড়ে! ফলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং জিয়াউল হকসহ দুর্ঘটনা কবলিত হেলিকপ্টারটির সব আরোহী মারা যান। উড়ন্ত অবস্থায় উঁচু থেকে পড়ার কারণে আরোহী সকলের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকান সাংবাদিক জে এপস্টাইন ১৯৮৯ সালে র ভ্যানি টি ফে য়ারের ইস্যুতে জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যুর বিবরণটি এরকম, ‘… গ্রামবাসীরা সি -১৩০ হেলিকপ্টারটি আকাশে উর্ধ্বমুখীহতে দেখেছে , যেন এটি একটি অদৃশ্য রোলার কোস্টারে রয়েছে । এর তৃতীয় লুপের পরে, এটি সরাসরি মরুভূমির দিকে নিমজ্জিত হয়, মাটিতে নিজেকে সমাহি ত করে । তারপরে, এটি বিস্ফোরিত হয় এবং জ্বালানী পোড়ানোর সাথে সাথে আগুনের বল হয়ে যায়।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পাকিস্তান কোন রাষ্ট্রই এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কারণ এবং এর জন্য দায়ী কাউকেই সঠিক ভাবে চিহ্নিত করতে পারে নাই। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তান। সেনা শাসক জিয়াউল হকের বন্ধু আমেরিকা হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন অসহায় অবস্থার উদাহরণ “ভুল ঔষধ” প্রয়োগের মার্কিনী ধারা আমাদের সামনে হাজির করে। তাই সেখান থেকে ২০২৩ এ এসে বাংলাদেশকে নিয়ে “মার্কিন আরব বসন্ত” এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রে র পরিণতি উপলব্ধি করা যেতে পারে। এটি সহজেই বোঝা যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের বন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক ও রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড রাফেলকে বাঁচাতে পারে নাই সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন ধরনের ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশে “আরব বসন্ত” সৃষ্টি করতে পারবে না।

বিজ্ঞাপন

উপরের দু’টি ঘটনা থেকে আরও একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে মার্কিনীদের বন্ধুত্বের অবলম্বনে বিএনপি-জামায়াত জোট কর্তৃক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভন্ডুল করার প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। যেমন মার্কিনীদের বন্ধুত্ব ১৯৭১ সালে বাঙালি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে “বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা” ৯৩০০০ পাকিস্তানী সৈন্যের আত্মসমর্পণ ঠেকাতে পারেনি। যেমন জিয়াউল হক ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাফেলকে বহনকারী সি-১৩০ হারকিউলিস হেলিকপ্টারে নাশকতামূলক দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি!

তবে মার্কিন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। গেল ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখে ৮ দফা দাবি কার্যকর করতে আমেরিকার আমদানিকারকদের সংগঠন অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনকে (এএএফএ) একটি চিঠি দিয়েছে কংগ্রেসের আট সদস্য। যেখানে , বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ২৩ হাজার টাকা করতে দেশটির ক্রেতা প্রতিষ্ঠান গুলোকে চেপে ধরার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে । রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের ভেতর অবস্থিত কারখানার শ্রমিকদের বেতন ওয়াশিংটনের চাওয়া অনুযায়ী বৃদ্ধি করতে ও এএএফএকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে ওই চিঠিতে। শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর নামে ১৬ নভেম্বর ২০২৩-এ বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার খড়গ নিয়ে হাজির হয় বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র। যারা শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে নিজেরাই মানে না আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র সবেচে য়ে গুরুত্বপূর্ণ সব নির্দেশনা!

এমন সব হুমকি ধামকি, আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই এবার বাংলাদেশে র রফতানি আয়ের প্রাণ তৈরি পোশাক শিল্পকে বেকায়দায় ফেলতে নতুন ছক কষেছে মার্কিন কংগ্রেস। সরকার কর্তৃক পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৫৬ শতাংশ বাড়ানোর পরে ও এমন ধরনের “মার্কিনী তৎপরতার বিরুদ্ধে” বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিকদের নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যেই তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। শ্রমিক নেতাদের অবস্থান বেশ পরিষ্কার। তারা বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমিকরা ভালো থাকুক কখনোই তা চায় না যুক্তরাষ্ট্র। বরং ক্ষতির পাল্লা ভারি করতেই একটার পর একটা কৌশল সাজিয়েছে ওয়াশিংটন। মার্কিন কংগ্রেসের এখতিয়ার বহির্ভূত এমন নাক গলানো যার বড় প্রমাণ। একলাফে ৫৬ শতাংশের বেশি বেতন বাড়ানোর পরও মার্কিন কংগ্রেসের এমন নক্শা আঁকাকে বাংলাদেশ ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন উদ্যোক্তারা। এইসব নানামখুী তৎপরতা, বয়ান এবং আলোচনার মধ্যে দেশের শাসনতন্ত্র অনযুায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছেন বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। লক্ষ্য একটাই সকল ষড়যন্ত্রের বাঁধা পেরিয়ে ৭ জানয়ুারি ২০২৪ তারিখ ভোট দেয়া।

লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ,ঢাকা। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনষুদ; সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন