বিজ্ঞাপন

১০ বছরে সরিষা চাষ বেড়ে ৪ গুণ— নেপথ্যে ভোজ্যতেলের দাম, আবাদে লাভ

February 13, 2024 | 10:57 am

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আবাদে কম খরচের বিপরীতে বেশি লাভের কারণে রাজশাহীতে বেড়েছে সরিষার আবাদ ও উৎপাদন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব বলছে, গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদ বেড়েছে ৩৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। আর গত ১০ বছরে এর আবাদ বেড়ে হয়েছে প্রায় চার গুণ।

বিজ্ঞাপন

কৃষকরা বলছেন, কম খরচে সরিষা আবাদে বেশি লাভ। এর সঙ্গে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সরিষার দিকে নজর কৃষকদের। তিন ফসলি জমিতে এর চাষ আরও বেড়েছে। আবার কেউ কেউ সরিষা ক্ষেতে মধুও উৎপাদন করছেন। সেক্ষেত্রে সরিষার আবাদ বাড়তি অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকেও সরিষা আবাদ ও উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। ফলে এর আবাদও দিন দিন বাড়ছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলার ৯টি উপজেলা ও মহানগরীর দুটি থানায় সরিষার আবাদ হয়েছে ৭৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ২৬২ মেট্রিক টন। গত বছর চাষ হয়েছিল ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৩৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেড়েছে।

এ বছর সবচেয়ে বেশি সরিষা চাষ হয়েছে গোদাগাড়ী উপজেলায়। এ উপজেলায় ২২ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরিষা আবাদ হয়েছে বাগমারা উপজেলায়— ১৮ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার ২১২ মেট্রিক টন। তানোর উপজেলার ১০ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। দুর্গাপুর উপজেলায় সরিষা চাষ হয়েছে সাত হাজার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন ধরা হয়েছে সাত হাজার ২৭০ মেট্রিক টন।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া মোহনপুর উপজেলায় সাত হাজার ১৭৫ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত হাজার ১৭০ মেট্রিক টন। পুঠিয়া উপজেলায় পাঁচ হাজার ১৫৫ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন। পবা উপজেলায় চার হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে চার হাজার ৫৩০ মেট্রিক টন, চারঘাট উপজেলায় এক হাজার ১২২ হেক্টর জমিতে ৯৮০ মেট্রিক টন ও বাঘা উপজেলায় ৮৩৫ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৮০ মেট্রিক টন এবং নগরীর মতিহার থানায় ২৩ হেক্টর জমিতে ১০ মেট্রিক টন ও বোয়ালিয়া থানায় ১৫ হেক্টর জমিতে ১০ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলার বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গাছে গাছে সরিষার দানা দোল খাচ্ছে। এসব এলাকার কৃষক বলছেন, কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় তারা সরিষা আবাদ করেন। এ ছাড়া আমদানি করা সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরিষা তেলের চাহিদাও বেড়েছে। এ কারণে এ অঞ্চলের কৃষকরা সরিষা আবাদে ঝুঁকে পড়েছেন।

জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরিষার আবাদ হয়েছে গোদাগাড়ী উপজেলায়। ছবি: সারাবাংলা

গোদাগাড়ীর উদপুর গ্রামের গ্রামের কৃষক আবদুল মোত্তালেব বলেন, ‘গত বছর ছয় বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছিলাম। ভালো দাম পাওয়ায় এবার আবাদ করেছি ৯ বিঘা জমিতে।’

বিজ্ঞাপন

কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ছয় বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছি। ছয় হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে সরিষা চাষে ঝামেলা কম। সেচ দিতে হয় না। প্রথমে জমিতে হালচাষ করে সরিষার বীজ বপন করার পর একবার সার দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়।’ এবার বিঘাপ্রতি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার সরিষা উৎপাদন হবে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।

কৃষকদের দাবি, সারের দাম বাড়ায় গত বছরের চেয়ে এবার বিঘাপ্রতি দুই হাজার টাকা খরচ বেশি হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি বিঘায় প্রায় সাত হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে তাদের। এক বিঘা জমিতে সরিষার সর্বোচ্চ আট মণ ফলন পাওয়া যায় বলে জানান তারা।

তানোর উপজেলার গুবিরপাড়া এলাকার কৃষক আবদুস সোবহান জানান, কয়েক বছর আগে আলুর আবাদ করতাম। আলু চাষ করে লোকসান হয়েছিল। তাই এবার সরিষার চাষ করেছি। অল্প সময়ে সরিষার ফলন পাওয়া যায়। খরচও কম।

বাগমারা উপজেলার বাড়িগ্রাম গ্রামের কৃষক রবিউল আউয়ান বলেন, ‘গত বছর এ এলাকায় এত সরিষার আবাদ ছিল না। সয়াবিন তেলের দাম বেশি হওয়ায় কৃষক সরিষার চাষ বেশি করেছেন। আমিও এবার সাড়ে চার বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছি। এক বিঘায় ছয়-সাত মণ ফলন হয়। দুই-তিন হাজার টাকা মণ বিক্রি করা যায়।’

বিজ্ঞাপন

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর গত ১০ বছরের সরিষার আবাদ ও উৎপাদনের তথ্যও দিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ বছরে সরিষার আবাদ হয়েছিল ২০ হাজার ৭০৩ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল ২৩ হাজার ৪৭২ মেট্রিক টন। ২০১৩-১৪ সালে ১৯ হাজার ৮১১ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ৭৭৩ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ সালে ১৯ হাজার ৬৯১ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ২৪ হাজার ৮৫৫ টন। তবে এই সময় সরিষা থেকে মধু উৎপাদনের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

এরপর ২০১৫-১৬ সালে ১৯ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ৮৩৫ মেট্রিক টন, সরিষা থেকে মধু উৎপাদন করা হয় ১২ হাজার ৬৩০ কেজি। ২০১৬-১৭ সালে ১৯ হাজার ৪৬১ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ৮৫৪ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয়ে ১০ হাজার ৫২৯ কেজি। ২০১৭-১৮ সালে ১৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে সরিষার উৎপাদন ছিল ২৩ হাজার ৭৩৫ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৩৪০ কেজি। ২০১৮-১৯ সালে ২১ হাজার ২৫২ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয়েছিল ২৯ হাজার ১৬৫ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৪৫ কেজি।

মৌসুমের শেষের দিকে মাঠ থেকে সরিষা সংগ্রহে ব্যস্ত কৃষকরা। কৃষি বিভাগ বলছে, এবারও সরিষার ভালো ফলন হয়েছে। ছবি: সারাবাংলা

এরপর ২০১৯-২০ সালে ২৩ হাজার ১৯৯ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ৩৪ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৫৩০ কেজি। ২০২০-২১ সালে সরিষা আবাদ হয়েছিল ২৩ হাজার ৫৪৩ হেক্টর জমিতে,। উৎপাদন হয়েছিল ৩৩ হাজার ৭১০ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৩৫ কেজি। ২০২১-২২ সালে ২৬ হাজার ১৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ৪০ হাজার ৮২৭ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয় ১২ হাজার ২৭৭ কেজি।

২০২২-২৩ সালে সরিষা আবাদে বলা যায় বিপ্লব ঘটে। এ বছরে সরিষা চাষে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হন কৃষকরা। আগের বছরের ২৬ হাজার হেক্টর থেকে এ বছরে সরিষার আবাদ ছড়িয়ে পড়ে ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনও বেড়ে হয় ৬৯ হাজার ৭৫৮ মেট্রিক টন। এ বছর মধু উৎপাদন হয় এক লাখ ৬২ হাজার ৪৬০ কেজি। চলতি মৌসুম তথা ২০২৩-২৪ সালেও ব্যাপকভাবে বেড়েছে সরিষার আবাদ। ৪২ হাজার হেক্টর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ৭৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে।

রাজশাহী কৃ‌ষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপ‌রিচালক মোজদার হোসেন ব‌লেন, ‘ভোজ্যতেলের আমদানি-নির্ভরতা কমাতে সরিষার আবাদ বাড়াতে কৃষকদের সার-বীজ দিয়ে সহযোগিতা করা হ‌চ্ছে। পাশাপাশি কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আমি নিজেও মাঠ পরিদর্শনে যাচ্ছি। কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। ফলে এ বছর সরিষার ভালো ফলন হয়েছে। বেশকিছু এলাকায় সরিষা কাটাও শুরু হয়েছে।’

মোজদার হোসেন আরও বলেন, যেসব কৃষক সরিষা চাষ করছেন তাদের পরামর্শসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হচ্ছে। অন্য ফসলের চেয়ে সরিষা সহজ ও অল্প খরচে চাষ করা যায়। জেলায় এবার সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে। আগামী বছরেও হবে।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন