বিজ্ঞাপন

আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি (দ্বিতীয় পর্ব)

April 8, 2024 | 7:29 pm

প্রিন্স আশরাফ

কবিতার রাজধানীতে যাত্রা

বিজ্ঞাপন

রাতের বাসগাড়িতে চেপে বসতেই সামিউলের মাথায় একটা লাইন চেপে বসল, যাচ্ছে গাড়ি যাত্রাবাড়ি, গাড়ির নাম্বার ৩৮০। ওর গাড়ির নাম্বার কত ও জানে না, কেউ গাড়ির নাম্বার দেখে গাড়িতে চড়ে না। কিন্তু লাইনটা মাথার মধ্যে ঢোকার পর ওর কেন জানি গাড়ির নাম্বারটা দেখার অদম্য কৌতুহল জেগে উঠল। গাড়ি ছাড়তে এখনও কিছুটা দেরী আছে, সামনে ড্রাইভারের সিটে কেউ বসে নেই। গাড়ির নাম্বার দেখার কৌতুহল মেটাতে সামিউল গাড়ি থেকে নিচে নামল। কোথায় যেন পড়েছিল, সবকিছুর বিপদজনক প্রান্তেই আমাদের কৌতুহল। কৌতুহলকে সৎকে শঠ, দয়ালুকে নির্মম আর বিশ্বাসীকে নাস্তিক বানিয়ে তোলে। মাঝে মধ্যে এরকম হয় মাথায় যেরকম হঠাৎ হঠাৎ করে অন্যের কবিতার লাইন, গানের লাইন, বিখ্যাত লাইন উকি দেয় তেমনি সম্পূর্ণ নতুন অচেনা পংক্তিও ঘুরতে থাকে, সবই যেন অবচেতন মনের খেয়াল। মায়ের সাথে সুদীর্ঘ এক যুগ শুধুমাত্র মায়ের সেবাশ্রুশষা ছাড়া প্রায় নিষ্কর্মা কাটানোর সময়গুলোতে সে গল্প উপন্যাস কবিতার বই পড়েই কাটিয়েছে। তার গ্রামে একমাত্র সাহত্যি জগতের সাথেই তার কারবার ছিল। স্থানীয় পত্রিকা লিটিল ম্যাগাজিনে লেখা ছাপা হওয়া ছাড়া কিছু লোকাল সাহিত্য সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল সে। এসব কারণে যেমন কবি নাম যেরকম রটে গিয়েছিল তেমনি অপ্রকৃতিস্ত মাকে দেখভালের ব্যাপারটাও কিংবদন্তীর মতো হয়ে গিয়েছিল। কেউ বাবা-মায়ের সেবার উদাহরণ টেনে আনলে তার নামটা অবধারিতভাবেই উচ্চারিত হতো, এ কারণে গ্রামের লোকে তাকে বেশ পছন্দই করতো। চল্লিশার পর জমিজিরাত বন্ধকী রেখে এবং ভিটেমাটিও বন্ধক রেখে শুধু নিজের জন্য যদি কখনও আসে একটা ঘর রেখে যখন সবাই জানতে পারল সে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে তখন গ্রামের একমাত্র কবি ও ভালমানুষ চলে যাচ্ছে বলে গ্রামের লোকেরা খুব দুঃখ প্রকাশ করল। একটা গ্রাম কবি শূন্য হয়ে গেলে খুব একটা যায় আসে না, কিন্তু ভাল মানুষ শূন্য হয়ে গেলে আর কিছু থাকে না!
বাস চলতে শুরু করতে ও ভেতরের তীব্র আলো নিভে যেতেই সামিউল ঘুমানোর আয়োজন করল। পাশের সিটে কোন যাত্রী না থাকায় হাতপা ছড়িয়ে ঘুমাতে পারবে ভাবল। অবশ্য পথিমধ্যে যাত্রী উঠলে তখন সুখের ঘুম নষ্ট হবে। ঢাকায় যে তার এই প্রথম যাত্রা তা নয়। এর আগেও সে অনেকবার ঢাকায় গিয়েছে। মায়ের অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য যেমন গিয়েছে তেমনি বইমেলা থেকে বই কিনে ও কিছু সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের বই কেনার জন্যই গিয়েছে। শুধু বই কেনাই সার হয়েছে তার গ্রাম থেকে ডাক যোগে পাঠানো তার একটা কবিতাও কেউ ছাপেনি। ডাকের চিঠি সম্পাদকের হাত ঠিকঠাক পৌছায় না ভেবে এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল, তারপর ইমেইলের যুগ এলে সম্পাদকের প্রাপ্তি স্বীকার পেয়েছে, কিন্তু ছাপার অক্ষরে কবিতা আসেনি। এবার ঢাকায় গিয়ে কিভাবে জাতীয় পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে কবিতা আসেনা সেটাই দেখে নেবে। আর কবিতার জন্য জমিবাড়ি বন্ধকী টাকা সে আলাদাভাবে গচ্ছিত রেখেছে ব্যাংকে। ওই ব্যাংক ব্যালেন্স কমবে এবং তার কবিতার ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়বে।
কবিতার ব্যাংক ব্যালেন্স লাইনটা মাথায় আসতেই ঘুম ঘুম ভাব ছুটে গেল সামিউলের। দ্রুত ধাবমান বাসের খোলা জানালার বাতাস উপেক্ষা করে সে প্যান্টের পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করল। এটাই এখন তার কবিতার খাতা, কবিতার নোটবুক, কবিতার ডায়রি। বাংলা কিবোর্ডে চটপট লিখে ফেলল, ‘তোমার নামে কবিতা ব্যাংকে হাজার কবিতা জমা/বুকের ভল্টে সোনার দামে রেখেছি বিচ্ছেদনামা।’

খুব ভোরেই ঢাকার গাবতলী বাসস্টান্ডে নামার কথা থাকলেও ফেরী জটিলতায় সেটা সকাল নটায় গিয়ে গড়াল। স্কুল বন্ধু নাদিম জানিয়েছিল, নটার আগেই ও এবং ওর ওয়াইফ চাকরিতে বেরিয়ে যায়। বাসা তালা দেওয়া থাকে। সামিউল বাস থেকে লাগেজ নামিয়ে নিয়ে মুক্ত হাওয়ায় একটা সিগারেট ধরাল। এক কাপ চা হলে ভাল হতো। পাশেই চায়ের ছোট্ট দোকান। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেট টানতে টানতে ভাবল বউয়ের ধামা ধরে থাকা নাদিমের ওখানে উঠবে না, অস্বস্তি লাগবে। মাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসার সময় ওর এক মামাত ভাই মিজানুরের ওখানে উঠলে এখন মা না থাকায় ওটার ইচ্ছে নেই। এমনিতে মিজান ভাইয়ের সাথে ওর সম্পর্ক খুব একটা ভাল না, তারপরে মায়ের মৃুত্যুর খবর সে নিজে ফোন করে জানাইনি। মিজান ভাইই উল্টো ফোন করে দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে, ‘দরকার পড়লে এই ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, দরকার না পড়লে আর যেন অস্তিত্বই নেই!’ সামিউল মুখ বুজে কথা কটি শুনেছে। শেষ ভরসা জহিরের মেস। মেসটা জহিরের না। তবে বিয়ের পিড়িতে না বসা ঝুট ব্যবসায়ী জহির দীর্ঘদিন ওই মেসে থাকে বলে বন্ধুরা সবাই জহিরের মেস বলেই ডাকে।
জহির এরকম বন্ধু যাকে ফোন না দিয়েও ওর মেসে গিয়ে ওঠা যায়। তারপরও সামিউল ফোন দিল। ঘুমে জড়ানো গলায় জহির বলল, ‘আরামবাগের ওই মেসেই আছি। চলে আয়। খালাম্মার খবর শুনেছি পলাশের কাছ থেকে। তোর জন্য ভালই হলো। আর কোন পিছুটান রইল না। এতোদিন কবিতা তোকে গিলে খেয়েছে, এবারে সব উগড়ে দে।’ ফোন কেটে দেওয়ার ঠিক আগে আগে জহির বলল, ‘শেলীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে শুনেছিস বোধ হয়! পলাশ বলছিল। এই ঢাকাতেই নাকি থাকে। কিসে যেন একটা চাকরিও নাকি করে!’
সে কিছুই শোনেনি। পলাশ জহিরকে জানালেও তাকে জানাইনি। জানাইনি হয়তো তার ভালর জন্যই। হয়তো মাকে নিয়ে ব্যস্ত যে ছেলে, সম্প্রতি যার মা মারা গেছে তাকে প্রাক্তনের কোন খবর জানাতে নেই। এমনকি অন্য কারোর কাছেও শোনেনি। কিন্তু সামিউলের মনে হচ্ছে না শোনাটাই ভাল ছিল। আবার একসাথে অন্যরকম একটু অনুভূতি হচ্ছে। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, একরত্তি শিশুসন্তানকে নিয়ে এই শহরেই বাস করছে, বুকের মধ্যে কি কোথায় জানি একটু ফুরফুরে হাওয়া বইতে থাকে। এক মানুষ এক সাথে কতগুলো অনুভুতি ধারণ করে?

জহিরের মেসে উঠেই প্রথম যে কাজটা করল, মেস ম্যানেজারের কাছে একটা সিটের জন্য বোর্ডার হওয়ার জন্য জানিয়ে রাখল। জহির একটু অবাক হয়ে বলল, ‘তোর শুধু শুধু সিট ভাড়া দেওয়ার দরকার কি? যে কদিন থাকবি আমার সাথেই থাক।’
সামিউল কদিনে গজিয়ে যাওয়া দাড়ি খসখস করে চুলকাল। ‘আমি শুধু সিটের জন্যই জানাইনি। আমার একটা গোটা রুম দরকার।’
‘কেন?’ জহির গাজীপুরের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, দুপুরে আর মেসে ফিরবে না। ‘আমি তো সারাদিন থাকিই না বলতে গেলে।’
‘শুধু দিনের জন্য না রাতেও আমার নিরিবিলি দরকার। নিরিবিলিতে ছাড়া আমি লিখতে পারি না। বাড়িতে মাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পড়িয়ে রাখতাম, তখন মনে হতো বিশ্ব চরাচরে আমি ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। আমার সেরকম মনে হওয়াটা জরুরি।’
‘বুঝলাম, তা এতোদিন বাড়িতে বসে যা লিখেছিস ওগুলোই আগে ছাপা হওয়ার ব্যবস্থা কর। ঘরে বসে না লিখে পত্রিকা অফিসগুলোতে যা, সাহিত্য সম্পাদকের সাথে দেখা কর। শোন, আমাদের ঝুট ব্যবসায় আমরা একটা জিনিসই বুঝি, সেটা হচ্ছে জনসংযোগ! যতো ব্যবসায়ীর সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে ততই আমি অর্ডার পাব। আমার তো মনে হয়, লেখালেখির ব্যাপারটাও তাই, তুই যত জনসংযোগ বাড়াতে পারবি ততই তোর লেখা ছাপা হবে। আন্ডার গার্মেন্টসই হোক আর কবিতাই হোক মানুষের সাইজ বুঝেই দিতে হবে, বুঝেছিস!’
সামিউল ভাল করেই বুঝতে পেরেছে, গ্রামে বসে বুঝতে পেরেছিল বলেই শহরে এসেছে। সে শক্ত হয়ে ওঠা দাড়ি চুলকে জিজ্ঞেস করল, ‘সম্পাদকের সাথে দেখা করতে কি আওলাঝাউলা যাওয়াই ভাল নাকি ক্লিনড শেভ হয়ে মাঞ্জামোঞ্জা মেরে যাব?’
‘আমার মনে হয় শেভটেভ হয়ে মাঞ্জামোঞ্জা মেরে যাওয়াই ভাল। কবি লেখকদের সম্পর্কে সবার ধারণা ওরকম আওলাঝাওলা সেজন্য কেউ তাদেরকে ঠিক দাম দিতে চায় না। আর দাম দিতে হলে আগে নিজেকেই দাম দিতে হবে। তুই এক কাজ করবি, সম্পাদককে নিজে যে বেকার তা বুঝতে দিবি না, বরং এরকম ভাব করবে যেন খুব ভাল জব করিস, তাহলে দেখবে খাতির করবে। আমাদের দেশে কবি লেখক হওয়ার আগে চাকুরিজীবী হওয়া জরুরি।’
‘কিন্তু আমি তো এখন কোন চাকুরিটাকুরি করি না।’
‘এখন করিসনা পরে করবি। সারাজীবন তো আর বেকার বসে খাবি না। কোন লাাইনে চাকুরি খুজবি ভেবেছিস কিছু?’
‘ভাবছি সাংবাদিকতা লাইনেই ট্রাই করব। তাহলে চাকুরিরও চাকুরি হবে আবার আমি সবসময় লেখালেখির মধ্যেই থাকব।’
‘দেখিস, তাই বলে আবার সম্পাদকের কাছে প্রথম সাক্ষাতেই সাংবাদিকতার চাকুরি চেয়ে বসিসনে। তাহলে তুইও শেষ, তোর কবিতাও শেষ!’

বিজ্ঞাপন

মধ্যম মানের পত্রিকা বলেই বোধ হয় সাহিত্য সম্পাদক সামিউলকে একটু খাতিরই করল। প্রথমে অফিসের রিসিপশনে কিছুটা সময় বসিয়ে রাখলেও তারপর নিজেই ডেস্ক থেকে উঠে এলো। মাথায় কাচাপাকা চুল এবং ঠোটের নিচে ঝাটা গোফের কারণে সাহিত্য সম্পাদককে কিছুটা ভারিক্কী দেখালেও বয়স চল্লিশের উপরে হবে না। হ্যান্ডশেক শেষে অফিসের বাইরে নিয়ে গিয়ে অফিস লাগোয়া ছোট্ট চা সিগারেটের দোকানে বসাল। দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে নিজেই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট অফার করল। ইতস্তত করে হলেও স্মোকার বলে নিল সামিউল। তখনই বুঝতে পারল ভুলটা কোথায় হচ্ছে। ঢাকা অথবা ঢাকার মানুষ অভিজ্ঞ জহির বলেছিল দেখা করতে খালি হাতে না যাওয়াই ভাল, ঢাকার মানুষ কিছু পেতে পছন্দ করে। সেখানে উল্টো সে সম্পাদকের চা-সিগারেট ধ্বংস করছে। তার কবিতা গেছে?
তখনই মাথায় বু্িদ্ধটা খেলে গেল সামিউলের। নিজের প্রয়োজনেই সিগারেট নিচ্ছে এরকমভাবে সম্পাদকের ব্রান্ডের দামি এক প্যাকেট সিগারেট দোকান থেকে কিনে নিয়ে নিজের হাতে রাখল। তারপর সম্পাদকের কাছে জহিরের শেখানো জহিরের গার্মেন্টস ব্যবসার পার্টনার বলে নিজেকে চালিয়ে দিল। এবং তাই শুনে সম্পাদক মন্তব্য করল, ‘ধরাবাধা চাকরি আর ভাল্লাগে না, হাতে গোণা বেতন। আপনাদের মতো বিজনেস টিজনেস করতে পারলে ভাল হতো। দেইখেন তো কোন সুযোগ টুযোগ আছে কিনা?’
সামিউল মনে মনে হেসে ফেলল। সে নিজেই সাংবাদিকতার চাকুরি খুজছে, আর এই সাংবাদিক ব্যবসায় আসতে চায়। সামিউল সেরকম সুযোগ থাকলে অবশ্যই জানাবে আশ্বস্ত করল। তারপর বিদায় নেওয়ার সময় জোর করে সিগারেটের প্যাকেটটা সম্পাদকের হাতে গুজে দিল। ঝাটা গোফের নিচে স্মিত হাসি বোঝা না গেলেও দামি প্যাকেট পেয়ে প্রসন্ন হয়েছে তা সম্পাদকের পরের কথায় বোঝা গেল। ‘আপনার কবিতা আমার ব্যক্তিগত ইমেইলে দিয়ে রাখবেন। এই সংখ্যার কাজ করে ফেলেছি। নেক্সট সংখ্যায় ধরে দেওয়ার চেষ্টা করব।’ সামান্য একটা সিগারেটের প্যাকেটের কল্যাণে সম্পাদক কবিতা না পড়েই ছাপা হওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে দিল। অথচ গ্রামে বসে পাঠানো কবিতা পড়েও কোন সম্পাদক রেসপন্স করতো না। একেই বলে বোধ হয় ফেল কড়ি মাখো তেল! এই কবিতার শহরে শুধু টিকে থাকা নয়, শনৈ শনৈ উপরে উঠতে গেলে, সাহিত্য পুরুষ্কার, পদক, একাদেমী এসব পেতে গেলে কড়ি ফেলতেই হবে।
সম্পাদক তার হাত ছেড়ে দেওয়ার আগে বলল, ‘ প্রতি সপ্তাহে অনেক অনেক কবিতা পাই। কবিতা লেখা সহজ, মোবাইলে লেখে বলে আরো সহজ। এ দেশে সবাই কবি। কবিতা দেন ঠিক আছে। দুই একটা ছোটগল্পও দিয়েন। গল্প খুবই কমই আসে। গল্প লেখার পরিশ্রম কেউ করতে চায় না। সবাই কবি হতে চায়!’

পরের সপ্তাহেই জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতায় ছাপার অক্ষরে নিজের কবিতা দেখেও কেন জানি খুশি হতে পারল না সামিউল। কবিতার পংক্তিগুলো কেমন যেন অষ্পষ্ট ঝাপসা মিলিয়ে যাওয়া মনে হতে লাগল ওর কাছে। সেখানে ফুটে উঠতে লাগল একটা সিগারেটের প্যাকেট এবং তার গায়ের লেখাগুলো, ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ধুমপানে মৃুত্যু ঘটায়। যেন কবিতা নয় একটা সিগারেটের প্যাকেট ছাপা হয়েছে। এবং বুঝতে পারল এই শহরে ছাপা হতে হলে কবিতা নয় কবিতার আদলে সিগারেটেরে প্যাকেট, টিশার্ট, বিরিয়ানির প্যাকেট, বিক্যাশ, সম্পাদকের লেখা বই এসবই ছাপা হবে। এবং এই ছাপার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সম্পাদকের জন্য আরেক প্যাকেট সিগারেটের টাকা আলাদা করে রাখতে রাখতে সম্পাদকের কথা মতো একটা ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করল। সাহিত্য পাতার জন্য নির্ধারিত শব্দসংখ্যার মধ্যেই তাকে গল্পটা লিখে শেষ করতে হবে তাকে। তাই যতই কথার বুদবুদ ফেনিয়ে উঠুক না কেন। মায়ের মৃত্যু নিয়েই একটা ‘নিসংগ মৃত্যু অথবা মৃত্যুর নিসংগতা’ নামে একটা ছোটগল্প লিখে ফেলল সে। পাঠিয়ে দিল সম্পাদকের ব্যক্তিগত ইমেইলে। আরেকটা সিগারেটের প্যাকেটের বিনিময়ে গল্পটা ছাপা হওয়া নিশ্চিত করে নিল অন্য সাহিত্য সম্পাদের ফোন নাম্বারে জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আরেকটু জাতে ওঠা যাক ভেবেই সে এবারে প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদককে তেল দিতে শুরু করল। এই সাহিত্য সম্পাদকের নিজস্ব সম্পাদনায় লিটিল ম্যাগাজিন গোছের একটা সাহিত্য পত্রিকা অনিয়মিত বের হয়। সামিউল সেই পত্রিকায় এক পেজ বিজ্ঞাপন দিতে চেয়ে ফোন দিল। সাধারণত লিটিল ম্যাগাজিনগুলোতে সহজে কেউ বিজ্ঞাপন দিতে চায় না। বিজ্ঞাপন পাওয়ার খুশিতে গদগদ সাহিত্য সম্পাদক সামিউলকে ভাইবন্ধু ডেকে জানতে চাইল কি খেদমত করে। সামিউল যখন জানাল সে গল্প কবিতা লেখে, জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয় জানিয়ে মধ্যম মানের দৈনিকে ছাপার কথা বলল, তখন সম্পাদক একটু ভাব বজায় রেখে বলল, ‘আপনি পত্রিকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়ে রাখেন। আমি দেখব। তবে আমাদের পত্রিকায় যা তা লেখা তো সহজে যায় না, আর ছাপা হতেই একটু বেশি সময় লাগে। আপনি দেন, দেখি আমি কি করতে পারি!’
লেখা ছাপা হওয়ার জন্য বিজ্ঞাপনের প্রতিশ্রুতি তো দিয়েছে কিন্তু কি বিজ্ঞাপন দেবে সামিউল বুঝতে পারে না। তার কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই যে তার বিজ্ঞাপন দেবে, প্রকাশিত কোন বই নেই, এমনকি প্রকাশিতব্য কোন বইও নেই। অথচ বিজ্ঞাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছে এখন না দিলে লেখা তো ছাপা হবে না, সম্পাদক গোস্বা হয়ে থাকবে। আর সাহিত্য জগতে পত্রিকার সম্পাদককে গোস্বা করে টিকে থাকা মুশকিল। বিজ্ঞাপন দেওয়ার টাকা থাকলে নিজের ছবি বড়ো করে ছেপে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসছে না। সবচেয়ে ভাল হয় বিজ্ঞাপন টন না দিয়ে বিজ্ঞাপনের টাকাটা সম্পাদককে পাঠিয়ে দিতে পারলে। টাকাটাই বড়ো কথা, টাকা কথা রাখে! কিন্তু এসব সম্পাদকরা আবার বেশ রাশভারী স¦ভাবের হয়, কাজ না করে দিয়ে শুধু টাকার ভিক্ষাবৃত্তি তারা করে না।
জহিরের সাথে এই নিয়ে আলোচনা করলে জহিরই পথ বাতলে দিল, ‘তুই আমার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিয়ে দে। বিজ্ঞাপন ফরম্যাট করাই আছে। কোন কাজ করা লাগবে না।’
সামিউল একটু ইতস্তত করল, ‘্এটা তো একটা সাহিত্য পত্রিকা। তোর তো কাপড়চোপড়ের কারবার। এই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কি লাভ হবে?’
জহির হেসে বলল, ‘কেন সাহিত্য পড়–য়া মানুষ কি কাপড় চোপড় পরে না? কবি সাহিত্যিকরা কি উলঙ্গ ঘুরে বেড়ায়।’ তারপর কলেজে পড়া যুক্তিবিদ্যার ক্লাসের কথা মনে করে বলল, ‘যারা বই পড়ে তারা কাপড়ও পরে কিন্তু যারা কাপড় পরে তারা সবাই বই পড়ে না।’ ‘শোন, বইয়ের বিজ্ঞাপন তুই সব জায়গায় দিতে পারবি না, কিন্তু কাপড়ের বিজ্ঞাপন পৃথিবীর সব জায়গায় দেওয়া যায়।’
জহির ল্যাপটপ খুলে বিজ্ঞাপনের ফাইলটা সামিউলের মেইলে সেন্ড করতে করতে বলল, ‘আমার এই বিজ্ঞাপনের জন্য তো তোকে গাটের টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তাও শুধু কবিতা ছাপানোর জন্য। এরকম গাটের টাকা খরচ করে কবিতা ছেপে কবি হওয়ার কদ্দিন?’
‘ও তুই বুঝবিনে। তুই তোর ব্যবসায় ইনভেস্ট করিসনি? প্রথমদিন থেকেই কি লাভ উঠে এসেছে। এটাও আমার ইনভেস্টমেন্ট। এখন ইনভেস্ট করছি। এক সময় লাভ উঠে আসবে। তখন আমার আর ইনভেস্ট করা লাগবে না। তখনই কবিতাই আমার বড়ো ইনভেস্ট হবে।’
কথার মধ্যেই সামিউলের ফোনে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো। মেয়েলী গলা। কেমন যেন পরিচিত স্বর। বুকের মধ্যে একটু ধুকপুক করে উঠল। শেলীর স্বর নয়তো?
শেলী নিজের পরিচয় দিয়ে জানাল, সবার কমন বন্ধু পলাশের কাছ থেকেই সামির নাম্বারটা জোগাড় করেছে। করেছে ফোন দিয়ে কনগ্রেটস জানানোর জন্য।
সামিউল একটু অবাক হলো। অভিনন্দন কিসের জন্য? সে এরকম কোন কাজ করেনি যাতে তাকে অভিনন্দন জানানো যায়। চাকরিবাকরি পেলেও না হয় একটা কথা ছিল। এতোদিন রোগেশোকে ভুগে মা মারা গেছে এইজন্যই কি? অসুস্থ মাই তাদের প্রেম-বিয়ের পথ বাধা হয়েছিল। নিজেই হেসে ফেলল। মানুষ এখনও এতোটা হৃদয়হীন হয়নি যে কারোর মৃত্যুতে অভিনন্দন জানাবে। সে বিভ্রান্ত গলায় বলল, ‘কনগ্রাটস জানাচ্ছে কিসের জন্য?’
‘তোমার গল্পের জন্য। পত্রিকায় তোমার গল্পটা পড়লাম। মাকে নিয়ে। নিসঙ্গ মৃত্যু অথবা মৃত্যুর নিস্গংতা। এই নামই তো?’
‘হ্যা।’
‘আমাদের অফিসে প্রায় সবগুলো পত্রিকা রাখে। আর আমার চাকরিটাও এরকম খুটিয়ে খুটিয়ে পত্রিকাগুলো পড়তে হয়। সেখানেই তোমার লেখাটা চোখে পড়ল। আমি জানি এই নামে পৃথিবীতে একজনই আছে যে লেখালেখি করে। তারপরও গল্প পড়েই বুঝে ফেললাম এ আমার চেনা গল্প। তোমার গল্প। তোমার মায়ের গল্প। আর এই গল্পের আড়ালে আমাদের বিচ্ছেদের গল্পও লুকিয়ে আছে। মনটা খূবই খারাপ হয়ে গেল। তখন বুঝতে পারলাম তুমি খুব ভাল গল্প লিখেছো। পলাশের কাছ থেকে জানতে পারলাম, তুমি নাকি এখন ঢাকাতেই আছো, ঢাকায় থাকছো।’
শেলী সবসময়ই বেশি কথা বলতো, একবার কথা শুরু করলে আর থামতো না। এখনও সেই স্বভাবই আছে। সামিউলের মনে হলো, মানুষ আর সব বদলাতে পারলেও নিজের স্বভাব কখনও বদলাতে পারে না। এই স্বভাব দেখেই গোয়েন্দারা অনেক ক্লু পেয়ে যায়।
শেলী অফিসে বসেই ফোন দিয়েছিল। বোধ হয় তার ডাক পড়ল। অন্য এক পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেল। শেলী তাড়াতাড়ি বলল, ‘শোনো, আমাকে ডাকছে। ফোন রাখতে হচ্ছে। ও আচ্ছা ভাল কথা, তুমি ঢাকায় আছো যখন একদিন চলে এসো আমার অফিসে। পাশে একটা খুব এ্যারিস্ট্রোক্রেট ফুডকোর্ট আছে। লাঞ্চ টাইমে দুজুনে মুখোমুখি বসে কথা বলা যাবে।’
শেলী ফোন রাখতেই জহির বলল, ‘তোর ইনভেস্টমেন্টের ফল ফলতে শুরু করেছে দেখছি। দুই প্যাকেটে সিগারেট ইন্টভেস্ট না করলে এই গল্পও ছাপা হতো না। আর গল্প পড়ে অভিভূত হয়ে শেলীও ফোন করতো না। তা কবে দেখা করতে যাচ্ছিস শেলীর সাথে?’
‘বুঝতে পারছি না।’ সামিউলকে দ্বিধাগ্রস্থ দেখাল, ‘দেখা করাটা ঠিক হবে কিনা!’
‘ঠিক হবে কেন? স্বামী থাকলে না হয় এক কথা হতো। স্বামী নেই এখনই তো মওকা। আর দেখা হলেই কি বিয়ে করে ফেলতে বলবে নাকি? আমার কথা শোন, দুএকদিনের মধ্যেই দেখা করে আয়। আর যাওয়ার সময় অবশ্যই শেলীর মেয়ের জন্য দামী চকলেট নিয়ে যাস। ওটাই একটা ইনভেস্টমেন্ট। মনে করবি ওও তোর একজন সম্পাদক। তোর কবিতার যেমন সম্পাদক, তেমনি জীবনেরও। তোর জীবনের সম্পাদক। মেয়েরাই পুরুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সম্পাদক!’

চলবে…

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন