বিজ্ঞাপন

লেগেছে মাতন দোলা, আবার এল জব্বারের বলিখেলা

April 23, 2024 | 10:02 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম শহরের লালদিঘীর চার পাড়সহ আশপাশের এলাকাজুড়ে হরেক পণ্যের সমাহার। ফুলঝাড়ু, রঙ-বেরঙের হাতপাখা, বাহারি সাজের মাটির ব্যাংক, ঘর সাজানোর টব। সূঁই-সূতা, কানের দুল, নাকফুল থেকে রান্নার হাড়ি পর্যন্ত কী নেই পণ্যের পসরায়!

বিজ্ঞাপন

বাঁশির সুর আর ভুভুজেলার আওয়াজ বার্তা দিচ্ছে এসে গেছে আব্দুল জব্বারের বলিখেলা। লালদিঘীর পাড়জুড়ে যে পণ্যের পসরা, সেটা বলিখেলা উপলক্ষ্যে আয়োজিত বৈশাখী মেলা। শতবর্ষী আব্দুল জব্বারের বলিখেলা আর বৈশাখী মেলা, যে আয়োজনের জন্য এখনও উন্মুখ হয়ে থাকেন চট্টগ্রাম শহরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলার বাসিন্দারা। তাই তো আনুষ্ঠানিকতার তোয়াক্কা না করেই শুরু হয়ে গেছে মেলা, চলছে বিকিকিনিও।

প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ২৪ এপ্রিল অর্থাৎ বুধবার থেকে তিন দিনের বৈশাখী মেলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই রাস্তা-ফুটপাত জুড়ে বসে গেছেন দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে আসা বিক্রেতারা। প্রখর রোদ আর গরম উপেক্ষা করে যাচ্ছেন ক্রেতারাও। যথারীতি মেলার দ্বিতীয় দিনে বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) লালদিঘী ময়দানে হবে বলিখেলা। সেখানে এখন বলিখেলার মঞ্চ বানানোর কাজ চলছে পুরোদমে।

বৈশাখী মেলার পরিসর শুরু হয়েছে নগরীর আন্দরকিল্লার মোড় থেকে। এরপর সেটা বকশিরহাট বিট, লালদিঘীর চারপাশ, কেসিদে রোড, জেলা পরিষদ চত্বর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ছড়িয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

দেখা গেছে, হাজারখানেক অস্থায়ী দোকান বানিয়ে ক্ষুদ্র বিক্রেতারা বাঁশ ও বেতের আসবাব, ঝাড়ু, ঝাটা, মাদুর, পাটি, পাখা, পাপোশ, কুলা, ঢালা, মোড়া, হরেক রকমের ঘর সাজানোর কারুপণ্য, নানা ধরনের টব, শিশুদের খেলনাপাতি, হাড়িপাতিল, দা-বটি-খুন্তি, সাজের গহনা বিভিন্ন গাছের চারা নিয়ে বসেছেন। কাঠের তৈরি খাট, আলমিরা, আলনাসহ আরও নানা আসবাবপত্রও আছে বিক্রির তালিকায়।

ক্রেতাদের চাহিদা বেশি ফুলের ঝাড়ু, বেতের গৃহস্থালিসহ নানা সরঞ্জামের। গরমে হাতপাখার বিকিকিনিও চলছে বেশ। ছবি: সারাবাংলা।

ক্রেতাদের চাহিদা বেশি ফুলের ঝাড়ু, বেতের গৃহস্থালিসহ নানা সরঞ্জামের। গরমে হাতপাখার বিকিকিনিও চলছে বেশ। ছবি: সারাবাংলা।

বরাবরের মতো মেলায় নজর বেশি ফুলের ঝাড়ু, বেতের গৃহস্থালিসহ নানা সরঞ্জামের দিকে। গরমে হাতপাখার বিকিকিনিও চলছে বেশ। বিক্রেতারা একজোড়া ফুলঝাড়ুর দাম হাঁকছেন ৩০০ টাকা।

রাঙ্গুনিয়া থেকে ফুলঝাড়ু নিয়ে আসা মালেক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা পাহাড় থেকে ঝাড়ুর ফুল সংগ্রহ করি। তারপর সেগুলো দিয়ে ঝাড়ু বানাই। আমাদের গ্রামে অনেকেই এ কাজ করে। এরপর পাটিপাতা দিয়ে হাতপাখা বানাই। বাপ-দাদা থেকে বংশ পরম্পরায় এটাই আমাদের কাজ।’

বিজ্ঞাপন

রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া উপজেলার কাজল দেবনাথ ৩৬ ধরনের পাটি নিয়ে এসেছেন মেলায়, যার মধ্যে বরিশাল-সিলেটে তৈরি পাটিও আছে। পাটির দাম গতবছরের চেয়ে এবার অন্তত ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেশি। শীতল পাটির দাম চাওয়া হচ্ছে তিন হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার মধ্যে।

কাজল দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবছর যে পাটি দুই-আড়াই হাজার টাকা বিক্রি করেছি, সেটা এবার আরও ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা দাম বেড়ে গেছে। শীতল পাটি গতবছর আড়াই হাজার টাকা বিক্রি করেছিলাম। আমরা তো সব পাটি বানাই না। যেগুলো আমরা বানাই, সেগুলোর দাম কিছুটা কম। যেগুলো আমাদের সিলেট, বরিশাল থেকে কিনে আনতে হয়েছে, সেগুলোর দাম বেশি।’

বাহারি রংয়ের হাতপাখার বিকিকিনিও চলছে বেশ। ছবি: সারাবাংলা।

বাহারি রংয়ের হাতপাখার বিকিকিনিও চলছে বেশ। ছবি: সারাবাংলা।

বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের খেলনার পাশাপাশি বেতের তৈরি মাছ ধরার পলো, চাই, আতাকুলা নিয়ে নরংসিদি থেকে এসেছেন মোজাম্মেল। এবার জিনিসপত্রের দাম বেশি কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নরসিংদি থেকে ট্রাকের ভাড়া লেগেছে শুধু ১৫ হাজার টাকা। ৭-৮ হাজার টাকার ভাড়া ডবল হয়ে গেছে। কিছু করার নেই।’

টব, ফুলদানি, মাটির চুলা, মাটির ব্যাংক, রান্নার হাড়ি নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে এসেছেন গোপীনাথ পাল। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘গাড়ি ভাড়া বেশি বেড়েছে। সঙ্গে আটজন এসেছে। সবার মজুরিও গতবারের চেয়ে বেশি। বিক্রি করে আমাদের পোষাতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

মাটির তৈজসপত্র নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে আসা সুশান্ত পাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিন ট্রাক নিয়ে ১২ জন এসেছি। প্রতি ট্রাকের ভাড়া পড়েছে ১৮ হাজার টাকা। মেলা রকমের মাল এনেছি। বিক্রি যদি ঠিকঠাকমতো হয়, তাহলে লাভ হবে। না হলে মাল নিয়ে ফেরত যেতে হবে।’

প্রস্তুত হচ্ছে মঞ্চ, এখানেই ১২ বৈশাখ জমবে জব্বারের বলি খেলা। ছবি: সারাবাংলা।

প্রস্তুত হচ্ছে মঞ্চ, এখানেই ১২ বৈশাখ জমবে জব্বারের বলি খেলা। ছবি: সারাবাংলা।

দা, বটি, চাকু, ছুরি, ছাকনি, কড়াই, ফ্রাইপেন নিয়ে নওগাঁ থেকে আসা ওয়াহিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এগুলো আমরা বানাই না। আমাদের এলাকায় যারা বানায়, তাদের থেকে কিনে বিক্রি করতে এসেছি। সেজন্য মালের দাম বেশি। মেলা এখনও ভালোভাবে শুরু হয়নি। কাল থেকে বিক্রি ভালোভাবে শুরু হবে আশা করছি।’

গত বছরের মতো এবারও এরশাদুর রহমান ঢাকা থেকে এসেছেন কাঠের তৈরি খাট, আলমিরা, আলনাসহ বিভিন্ন জিনিস নিয়ে। তিনি বলেন, ‘৮ লাখ টাকার কাঠের জিনিস নিয়ে মেলায় এসেছি। আশা করছি সবগুলো বিক্রি হয়ে যাবে। সকাল থেকে কিছু ক্রেতা আসছে। বলি খেলার দিন বেচাকেনা বেশি হবে বলে আশা করছি।’

গৃহিণী মিতু বিশ্বাস ফুলঝাড়ু, মাটির টব কিনে ফিরছিলেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভিড় বেড়ে যাবে, সেজন্য আগেভাগে কিনে নিলাম। এবার জিনিসপত্রের দাম খুব বেশি। গতবছর ফুলের ঝাড়ু কিনেছিলাম জোড়া ১৫০ টাকায়। এবার অনেক দরদাম করে ২৫০ টাকায় কিনেছি।’

দা, বটি, চাকু, ছুরি, ছাকনি, কড়াই, ফ্রাইপেন কি নেই মেলায়। ছবি: সারাবাংলা।

দা, বটি, চাকু, ছুরি, ছাকনি, কড়াই, ফ্রাইপেন কি নেই মেলায়। ছবি: সারাবাংলা।

জব্বারের বলিখেলা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার বলিখেলার ১১৫তম আসর অনুষ্ঠিত হবে। মূল মেলা কাল (বুধবার) থেকে তিন দিন চলবে। যেহেতু দূর-দূরান্ত থেকে অনেক বিক্রেতা আসেন, তারা আগেভাগেই চলে আসেন, সেজন্য তাদের বসতে দেওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সারাদেশে তাপদাহ চলছে। চট্টগ্রামেও গরম খুব বেশি। আমরা পুরো মেলাজুড়ে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করেছি। সবাইকে অনুরোধ করছি, মেলায় যেসব শরবত বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো যেন কেউ পান না করেন। এ ছাড়া, যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে।’

এদিকে, মঙ্গলবার থেকে বলিখেলায় অংশগ্রহণে ইচ্ছুকদের নিবন্ধন শুরু করেছে আয়োজক কমিটি। লালদিঘীর পাড়ে চসিক পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে খেলায় অংশ নিতে আসা বলিদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে বলিখেলার উদ্বোধন করবেন রেলপথ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।

মানুষের নজর বেশি ফুল ঝাড়ুর দিকে। ছবি: সারাবাংলা।

মানুষের নজর বেশি ফুল ঝাড়ুর দিকে। ছবি: সারাবাংলা।

নগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার অতনু চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাঁদাবাজি, দোকান দখল-বেদখল, ইভটিজিংসহ সবধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে দমনের জন্য আমাদের কমিশনার স্যার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি পুলিশ পরিচয়েও যদি কেউ চাঁদাবাজি করে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। মেলায় থানার একাধিক টিম টহলের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকবে। ডিবির টিম এবং সাদা পোশাকের পুলিশও থাকবে।’

‘মূল মেলা কাল (বুধবার) থেকে শুরু হবে। এরপরও বিক্রেতারা প্রায়ই রাস্তায় বসে গেছেন। আমরা যতটুকু সম্ভব তাদের মূল রাস্তা থেকে সরিয়ে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি।’

এদিকে, বলিখেলা ও বৈশাখী মেলা উপলক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকা দিয়ে বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত যানবাহন চলাচলে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে নগর পুলিশ।

বাহারি রংয়ের সাজ-সজ্জার জিনিসে জমে উঠছে বৈশাখী মেলা। ছবি: সারাবাংলা।

বাহারি রংয়ের সাজ-সজ্জার জিনিসে জমে উঠছে বৈশাখী মেলা। ছবি: সারাবাংলা।

সিএমপির জনসংযোগ শাখা থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, তিনদিন লালদিঘী অভিমুখী সবধরনের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এজন্য নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়, পুরাতন টেলিগ্রাফ রোড, বোস ব্রাদার্স মোড়, রাইফেল ক্লাব, কোতোয়ালি মোড়, আমানত শাহ মাজার রোডের মুখ এবং টেরিবাজার তিন রাস্তার মুখে প্রতিবন্ধক স্থাপন করা হবে। পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান কোতোয়ালি মোড় থেকে ফিরিঙ্গীবাজার মেরিন ড্রাইভ রোড ব্যবহার করে চাকতাই ও রাজাখালী হয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে যাতায়াত করবে।

উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করতে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর কুস্তির প্রবর্তন করেছিলেন, যা চট্টগ্রাম অঞ্চলে ‘বলিখেলা’নামে পরিচিত। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সনের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদীঘির মাঠে এই বলিখেলার সূচনা করেন তিনি। সূচনার ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর লালদীঘির মাঠে ১২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় বলিখেলা। পাশাপাশি তিনদিন ধরে চলে বৈশাখী মেলা।

ছবি: শ্যামল নন্দী, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন