বিজ্ঞাপন

‘হাইপ্রোফাইল’ তদন্তে গতি পাচ্ছে এমপি আজীম হত্যা মামলা

May 31, 2024 | 11:02 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যা মামলার তদন্ত আরও গতি পাচ্ছে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি এ তদন্তকে ‘হাইপ্রোফাইল’ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি) গঠন করে তদন্ত শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সব মামলার তদন্ত করতেই সাধারণত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা এসআইটি গঠন করা হয়। এটিকে ‘সিট’ বলেও দাবি করা হয়।

এমপি আনার হত্যা মামলা গ্রহণের ৯ দিনের মাথায়, মামলার তদন্তকারী সংস্থা ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা সিআইডির মধ্যে নতুন এই দল গঠন করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন আইজিকে। সঙ্গে রয়েছেন আরও ১২ জন অভিজ্ঞ গোয়েন্দা।

আপাতত ১৩ জনের এ গোয়েন্দা দলই আনার হত্যা মামলার তদন্ত করবে বলে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি সূত্র থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। নতুন তদন্ত দলটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত, নেপালে পালিয়ে থাকা সিয়ামের গতিবিধিও নজরবন্দি করা হয়েছে। সেখানে সিআইডি ছাড়াও কাজ করছে কলকাতা পুলিশের এসটিএফ বা স্পেশাল টাস্কফোর্স।

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সেখানে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাও একইভাবে কাজ করছে।

তবে নেপালে গ্রেফতার হলে সিয়ামকে কিভাবে আনা হবে, সেই বিষয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল-তিন দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে এরই মধ্যে আলোচনা শেষ হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, এমপি আনার হত্যার অন্যতম অভিযুক্ত সিয়াম মরদেহ গুম করে নেপালে আত্মগোপন করেছে। আর সিয়ামের বিষয়ে কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া কসাই জিহাদও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে, ভিসা না পাওয়ায় এমপি আনারের মেয়ে ডরিন ও এমপির ব্যক্তিগত সহকারী এখনো কলকাতায় যেতে পারেননি। শনি ও রোববার দুদিন বন্ধ থাকায় সোমবারের আগে ভিসা পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।

এদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার তিন আসামিকে আরও ৫ দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

শুক্রবার শুনানি শেষে এ আদেশ দেন ঢাকা মহানগর হাকিম শান্ত ইসলাম মল্লিক।

বিজ্ঞাপন

রিমান্ডে যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন- আমানুল্লা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুঁইয়া (৫৬), তানভীর ভূঁইয়া (৩০) ও শিলাস্তি রহমান (২২)।

আট দিনের রিমান্ড শেষে এদিন দুপুরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তাদের হাজির করা হয়। মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদের ৮ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান।

আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এস আই জালাল উদ্দিন আহমেদ জানান, রাষ্ট্রপক্ষে রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু।

এর আগে গত ২৪ মে আসামিদের ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিল আদালত।

হত্যার সময় ফ্ল্যাটে ছিলেন শিলাস্তি

ডিবি সূত্র জানায়, এমপি আজীমকে হত্যার সময় শিলাস্তি কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আজীমকে অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্ব ছিল শিলিাস্তি। তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকে আজীমকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শিলাস্তিসহ তিন আসামির রিমান্ড আবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করে ডিবি। আবেদনে বলা হয়, এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন, সিয়াম ও মোস্তাফিজসহ অজ্ঞাতনামা অন্য আসামিদের সঠিক নাম-ঠিকানা সংগ্রহ ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তাদের গ্রেফতার ও ঘটনার রহস্য জানতে গ্রেফতার তিন আসামির রিমান্ড প্রয়োজন।

আবেদনে আরও বলা হয়, গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়া জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) শীর্ষস্থানীয় নেতা। তিনি খুলনা, ঝিনাইদহ, যশোরসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে আজীমের আদর্শের বিরোধ ছিল। এ ছাড়া মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের সঙ্গেও আজীমের বিরোধ ছিল। শাহীন ও শিমুল তাকে হত্যার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেন।

গত জানুয়ারি ও মার্চ মাসে দু’বার তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। পরে শাহীন কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় ২৫ এপ্রিল একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। পরিকল্পনায় যুক্ত হন শিলাস্তি  রহমান। তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শাহীন গত ১০ এপ্রিল দেশে চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে শিমুল ও শাহীনের নির্দেশে অন্য আসামিরা ভুক্তভোগীকে কৌশলে ব্যবসার কথা বলে কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যান।

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শিমুল ভূঁইয়া অন্য আসামির সহায়তায় আজীমকে হত্যা করেন। হত্যার পর হাড়-মাংস আলাদা করা হয়। মাংসের ছোট ছোট টুকরো করে ফ্ল্যাটের টয়লেটের কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করা হয়। এ ছাড়া হাড়সহ শরীরের অন্যান্য অংশ ট্রলিব্যাগে করে কলকাতার নিউ টাউন থেকে দূরে একটি খালে ফেলে দেওয়া হয়। হত্যা ও হাড়-মাংস আলাদা করায় ফয়সাল, মোস্তাফিজ ও জিহাদ সরাসরি জড়িত।

ভারতীয় সিআইডির হাতে ৬ সাক্ষী

কলকাতায় সিআইডির এফআইআরে মূলত সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে আরও অভিযুক্ত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না সিআইডি। সিআইডির এফআইআরে অভিযুক্ত হিসেবে রয়েছেন– সৈয়দ আমানুল্লাহ, শিলাস্তি রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, ফয়সাল আলী শাহী, জিহাদ ওরফে জুবের, সিয়াম হোসেইন ও আক্তারুজ্জামান শাহীন। তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

সিআইডি বলছে, সঞ্জিবা গার্ডেনের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের মূল ফ্লোরের বাথরুমে এমপি আজীমের দেহ টুকরো টুকরো করা হলেও রক্তের দাগ ছড়িয়ে ছিল ঘরের চারদিকে। ফ্ল্যাটের মূল দরজার চার ফুটের মধ্যে পাওয়া যায় প্রথম নমুনা। দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় ছয় ফুট দূরে। অভিযুক্তদের প্রত্যেকের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। একাধিক সাক্ষীর বয়ান রেকর্ড করেছে তারা।

সিআইডির দাবি, কলকাতার এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অন্তত তিনটি গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। সিআইডির এফআইআরে দাবি করা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গাড়িটি লাশ ফেলার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাড়িটির চালক সিদ্ধার্থ কুণ্ডুকে অন্তত ৭০ ঘণ্টা পুলিশি জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে তাকে এখনও গ্রেফতার করেনি পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়নি এমপি আজীমের কথিত বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকেও। এই দু’জনকেই সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করতে চায় সিআইডি। দু’জনের দেওয়া প্রাথমিক তথ্যে পুলিশি তদন্ত এগিয়েছে দ্রুতগতিতে।

ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন।

এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। ২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউ টাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার।

পুলিশ বলছে, এমপি আনার হত্যার ‘হোতা’ তার বাল্যবন্ধু ও ঝিনাইদহের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আখতারুজ্জামান ওরফে শাহীন মিয়া। আর হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লা ওরফে শিমুল। আনার কলকাতায় যাওয়ার পরদিন বৈঠক করার জন্য আখতারুজ্জামানের ভাড়া বাসায় যান। সেখানেই আসামিরা তাকে হত্যা করে।

আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন ২২ মে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন, যেখানে তার বাবাকে ‘হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের’ অভিযোগ আনা হয়। তবে আসামি হিসেবে সেখানে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ গত ২৪ মে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সংসদ সদস্যকে হত্যার পর শরীরের বিভিন্ন অংশ টুকরো করে হলুদ লাগিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা জানতে পেরেছেন। ফলে লাশ উদ্ধার করা কঠিন।

তদন্তের এক পর্যায়ে জিহাদ হাওলাদার নামের এক কসাইকে গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি।

জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডিকে জিহাদ বলেছেন, আখতারুজ্জামানের নির্দেশেই তিনি ‘সব কাজ’ করেছেন। আরও চার জন বাংলাদেশি এই কাজে সাহায্য করেছেন।

ভারতীয় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল বাংলাদেশে এসে ২৪ মে ঢাকায় গ্রেফতার তিনজনকের জিজ্ঞাসাবাদ করে যান। এরপর ২৫ মে কলকাতায় যান হারুন অর রশীদসহ ডিবির তিন কর্মকর্তা।

তারাও কসাই জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তাকে নিয়ে সঞ্জিবা গার্ডেনসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

গত মঙ্গলবার সঞ্জীবা গার্ডেনের সেপটিক ট্যাংক থেকে বেশ কিছু মাংসের টুকরো উদ্ধার করা হয়।

পরে এ বিষয়ে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সেপটিক ট্যাংকের মধ্যে কিছু মাংস পাওয়া গেছে। সেটি সংসদ সদস্য আনারের না অন্য কিছু, তা ডিএনএ পরীক্ষা না করে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে না।’

কলকাতা থেকে ফিরে ডিবির হারুনও ডিএনএ পরীক্ষা পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলছেন।

শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরে জানতে চাইলে ডিবির হারুন বলেন, ‘শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরাতে ভারতের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকায় ভারতের মাধ্যমে তাকে ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে।’

বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রানধির জেসওয়াল সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, এ তদন্তে বাংলাদেশকে ‘পূর্ণ সহায়তা’ দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন
এমপি আজীম হত্যায় জড়িত শিমুলের সহযোগী সাইফুল মেম্বার আটক

আজীম হত্যা: ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংকে মিলল ৪ কেজি ‘টুকরো মাংস’
এমপি আজীম হত্যায় তিন আসামি ৮ দিনের রিমান্ডে
আজীমের মেয়ের মামলা: ৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ
এমপি আজীম অপরাধী হলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কেন এলো না?
৫ কোটি টাকা চুক্তিতে এমপি আজীমকে হত্যা— নেপথ্যে বন্ধু শাহীন
কলকাতা থেকে ফিরে আনার হত্যা নিয়ে যা বললেন হারুন

 

সারাবাংলা/একে

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন