বিজ্ঞাপন

খুনের আড়ালে

June 17, 2024 | 3:57 pm

অরুণ কুমার বিশ্বাস

খুব জটিল কেস এটা, বুঝলেন ডিটেকটিভ।
চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন মোহাম্মদপুর থানার এসি হারিসুল হক। তিনি মডেল থানার দায়িত্বে আছেন বেশ ক’মাস হল। সত্যি বলতে, এমন ক্লুলেস কেস তিনি আর পাননি।
অলোকেশ হারিসুলের বিশেষ পরিচিত। ঠিক বন্ধু নয়, তবে দুজনেই সাহিত্যের ছাত্র। বই পড়তে ভালোবাসেন, আর রহস্য খুঁজতে তাদের আগ্রহের কিছু কমতি নেই।
ঘটনা ঘটেছে গতকাল বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ। কাটাসুর পনেরো নম্বরের এক ভদ্রমহিলা আচমকা খুন হন। খুনের ধরনটা বড় অদ্ভুত, বুঝলেন অলোকেশ। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন এসি হারিসুল।
অদ্ভুত মানে! কীভাবে খুন হলেন ভদ্রমহিলা?
সম্ভবত বঁটির কোপে। হারিসুল বললেন। এই জামানায় প্রফেশনাল কোনো কিলার এভাবে বঁটি দিয়ে কাউকে মারবে না। বড্ড কাঁচা কাজ।
ওহ্ তাই! হতে পারে খুনটা প্রি-প্ল্যানড নয়, হয়তো যে খুনি সে মাথা গরম করে মেরে দিয়েছে! ডিটেকটিভ অলোকেশ তার অনুমানের কথা বললেন।
মে বি, অর মে নট বি। দুদিকেই মাথা নাড়েন এসি হারিসুল।
বুঝলাম। কিন্তু মিস্টার হক, কেসটা আরেকটু ডিটেলে বললে হত না! কে খুন হলেন, মোটিভ কী থাকতে পারে, পুরোটা না জানলে ডিডিউস করি কী করে বলুন!
তাতে একটা হতাশার ভাব ফুটে উঠলো হারিসুলের মুখমণ্ডলে। শুনে আর কী হবে বলুন! একেবারে ক্লুলেস কেস। যাকে বলে কানাগলি।
হুম। বুঝলাম। তাও বলুন, দেখি কিছু করা যায় কি না। অলোকেশ চায়ের কাপ হাতে নিলেন, কিন্তু চুমুক দিলেন না। চা’টা ঠান্ডা হয়ে গেছে। একেবারে পানসে। তিনি ঠান্ডা পানীয় পছন্দ করেন না। আর কফি পেলে তিনি চা বা অন্য কিছু খান না। কফিতেই তার মগজ খোলে ভালো।
অলোকেশের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দেন হারিসুল। সেই সঙ্গে এই কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার মুৎসুদ্দিকে ডেকে পাঠালেন। ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দি। অফিসার হিসেবে ইনি যেমন চৌকস, তেমন সাহসী।
রিপোর্ট পড়ে অলোক যেটুকু জানলেন-
ভিকটিমের বয়স পঁয়ত্রিশ বা কিছু কম, নাম বেবি। তিনি পেশায় সৌখিন মডেল, তার স্বামী বিশিষ্ট ইএনটি স্পেশালিস্ট ডক্টর কামরান করিম। কাটাসুর পনেরো নম্বরের আটতলা ভবনের চারতলায় বাসা তার। খুনটা বস্তুত সেখানেই সংঘটিত হয়।
এইঅব্দি পড়ে মুখ তুলে তাকালেন অলোকেশ।
স্যার, আসবো?
ওহ্ মুৎসুদ্দি, আসো আসো। কাম অন ইন। এসি হারিসুল মৃদু হেসে বললেন। মিট মাই ফ্রেন্ড অলোকেশ রয়, খুব জিনিয়াস একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। এর নাম তুমি নিশ্চয়ই শুনে থাকবে।
জি স্যার, উনাকে আমি চিনি স্যার। হাসলেন ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দি। নাও, তুমি বেবি খুনের কেসের ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে কথা বলো। আমি একটু বেরোচ্ছি। হেডকোয়ার্টার্সে একটা জরুরি মিটিং আছে। ফিরে এসে সব প্রগ্রেস কী হল তা শুনবো।
বেরিয়ে যান হারিসুল। অলোক অযথা ভ্যানতারা না করে বললেন, দেখুন মিস্টার মুৎসুদ্দি, যদি সুযোগ থাকে তাহলে আমি খুনের স্পটটা একবার দেখতে চাই। সত্যি বলতে কি, অকুস্থল না দেখে আমি রহস্য অনুসন্ধানের কাজে ঠিক স্বস্তি পাই না। কারণ সিইং ইজ বিলিভিং।
শিওর স্যার। খুব দূরে তো নয়, চলুন তাহলে এখনই যাওয়া যাক। মুৎসুদ্দি সসম্ভ্রমে বললেন। তাতে লাজুক হাসেন অলোকেশ। বললেন, দেখুন মিস্টার আরমান, আমাকে স্যার বলবার দরকার নেই, একই সাথে খুনের তদন্ত করছি, ভাই ডাকতে পারেন, বা শুধু ফার্স্ট নেম।
তাতে জিভ কাটলেন আরমান। সে কি স্যার! আপনি আমার বসের বন্ধু। আপনাকে আমি নাম ধরে ডাকবো! তাই কি হয় কখনও!
নিজে সরকারি চাকরি না করলেও বিউরোক্র্যাসি কী জিনিস অলোকেশ তা বোঝেন। এ নিয়ে তিনি আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, চলুন তবে যাই। শুভস্য শীঘ্রম!
খুনের কেস আর শুভ! মনে মনে বললেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি।
অফিসারের টাইটেলটা বড় অদ্ভুত। মুৎসুদ্দি। এই নামের বংশলতিকা এদেশে আর বেঁচে আছে বলে অলোকের জানা নেই।
উদ্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে কলবেল চাপলেন ইন্সপেক্টর। চারতলায় সিঁড়ির ডানদিকের ফ্ল্যাট। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই। তবে কি ভিকটিমের স্বামী ডক্টর করিম বাসায় নেই! আবারও কলিং বেল প্রেস করলেন মুৎসুদ্দি। এবারে কিন্তু ভেতর থেকে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। তার মানে ভেতরে কেউ আছেন। তিনি আসছেন।
ভিকটিমের স্বামী মিস্টার করিম এসে দরজা খুললেন। অন-ডিউটি পুলিশ অফিসার মুৎসুদ্দি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে ভড়কানোর কিছু নেই।
সরি মিস্টার করিম, আপনাকে আরেকটু বিরক্ত করতে এলাম। প্লিজ, কিছু মনে করবেন না। ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দি যেন বিনয়ের অবতার।
না না, মনে করবো কেন! এটা আপনার ডিউটি অফিসার। আসুন, বসুন প্লিজ। এ-কথা বলে ভদ্রলোক অলোকের দিকে তাকালেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইনি পুলিশ কর্মকর্তা নন। একে তো তার পরনে উর্র্দি নেই, তাছাড়া এমন নরমসরম চেহারা পুলিশের হয় না।
আলাপ করিয়ে দিই ডক্টর কামরান করিম। ইনি মিস্টার অলোকেশ রয়, বিশিষ্ট প্রাইভেট ডিটেকটিভ, আমার বসের বন্ধু।
ভ্রু কোঁচকান ডক্টর করিম। তিনি হয়তো ভাবছেন, একে আবার কে নিযুক্ত করলো! পুলিশ থাকতে মিছে বেসরকারি টিকটিকি কেন!
ঘাবড়াবেন না ডক্টর করিম, ইনি স্যারের দীর্ঘদিনের পরিচিত। তিনি আপনার স্ত্রীর কেসটা আলাদাভাবে খতিয়ে দেখতে চান। তবে তিনি আমার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখবেন। তাতে আপনার ভাল বৈ মন্দ হবে না।
হু! একরকম শব্দ করলেন করিমসাহেব। তার চেহারা দেখে বোঝা যায়, স্ত্রীর অকালমৃত্যুতে তিনি খুব ভেঙে পড়েছেন। স্ত্রীকে তিনি বেশ ভালবাসতেন।
খানিক বাদে একটা অল্পবয়সী মেয়ে মেলামাইনের ট্রেতে করে কিছু খাবার নিয়ে এলো। কিন্তু অলোকের খাবারে মন নেই। তিনি যখনতখন কিছু খানও না। তবে কফি চলতে পারে।
বলুন মিস্টার করিম, গোড়া থেকেই বলুন। কেসটা আসলে কীভাবে ঘটেছিল! কেজো কণ্ঠে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ।
বারদুই খুক খুক কেশে শুরু করেন ডক্টর কামরান করিম। তিনি তখন অফিসে ছিলেন। বিকেল চারটা সাড়ে চারটা হবে। কাজের মেয়ে টুসির ফোন পেয়ে তিনি বাসায় এলেন। এসে দেখেন কিচেনে যেন রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে। সেখানে পড়ে আছে তার স্ত্রী বেবি। তার ঘাড়ে ও মাথায় বঁটির কোপ।
কোপটা যে বঁটির, আপনি কী করে বুঝলেন করিমসাহেব? বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চান অলোক।
কারণ রক্তমাখা বঁটিখানা পাশেই পড়েছিল।
সঙ্গে শুভ বা উর্বী নেই, তাই নিজেই নোট টুকছেন অলোকেশ। ঘটনার সময় বিকেল চারটা বা সাড়ে চারটা। ব্যবহৃত হাতিয়ারের নাম বঁটি। ওটা পাশেই পড়েছিল। বঁটিতে নিশ্চয়ই খুনির আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে।
কী মিস্টার মুৎসুদ্দি, বঁটিতে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে তো?
তা গেছে স্যার। পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেবার জন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে ওটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গুড, ভেরি গুড। অলোকেশ বললেন। তিনি হয়তো ভাবছেন, খুনের হাতিয়ার আর আঙুলের ছাপ যখন পাওয়া গেছে, খুনিকে ধরা তখন খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু আদতে অলোকের অনুমান ভুল ছিল। শুধু আঙুলের ছাপ দিয়ে ক্রিমিনাল ধরা যায় না। সেক্ষেত্রে শহরের সবগুলো মানুষকে একখানে জড়ো করে তারপর সবার সঙ্গে আঙুলের ছাপ মেলাতে হয়।
নিন, আপনারা কিছু খান। ভদ্রতা করে বললেন ডক্টর কামরান করিম।
সে পরে হবে’খন। চলুন মুৎসুদ্দি, অকুস্থলটা একবার দেখে আসি। অর্থাৎ খুনের স্পট কিচেন। উঠে পড়লেন ডিটেকটিভ অলোকেশ।
কিচেনের দরজায় আগেই ‘ডোন্ট ক্রস দ্য লাইন’ লেখা হলুদ ফিতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। বলে দেয়া হয়েছে, ভুলেও যেন কেউ কিচেনে না ঢোকে। তদন্তের খাতিরে ক’টা দিন কষ্ট করে বাইরে থেকে খাবার এনে খেতে হবে করিমকে।
ডক্টর করিমের স্ত্রী বেবির লাশ এখন মর্গে, কিন্তু কিচেনের মেঝেতে রক্তের মাখামাখি। ভাবতে পারেন না অলোক, একজন মানুষের শরীরের এত রক্ত থাকে! তার গা গুলাতে শুরু করে, তিনি রক্ত দেখে অস্বস্তি বোধ করেন।
তবুও বেশ ভালো করে কিচেন স্পেসটা পরীক্ষা করলেন অলোক। গ্যাসের চুলা, মিটসেফ, কাপবোর্ড, ডিসওয়াশার ইত্যাদি আসবাব দেখছেন তিনি। খুনের মোটিভ হিসেবে আপাতত দুটো সম্ভাবনাকে মাথায় রাখছেন অলোকেশ। এক, প্রতিহিংসা। দুই, ডাকাতি। এছাড়া আর কী মোটিভ থাকতে পারে!
রক্তের সাথে কিছু চুল মিশে আছে। বেশ লম্বা, নারীর চুল। হয়তো ভিকটিমের হবে। অবহেলা না করে অলোকেশ তার পকেট থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে তাতে চুলগাছি তুলে নিলেন।

বিজ্ঞাপন

০২.
কফি এলো। কিচেনের খানাতল্লাশি সেরে ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দি ও অলোকেশ বসার ঘরে সোফায় গা ঢেলে দিলেন। উল্টোদিকে সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন ডক্টর কামরান করিম।
কী বুঝলেন স্যার, কেসটা আসলে কী হতে পারে? লঘু আর কাঠিন্যের মাঝামাঝি একটা টোনে বললেন ইন্সপেক্টর।
কী আর হবে, খুনের কেস! বললেন অলোকেশ। অর্বাচীন কেউ হলে হয়তো ভেবে বসতো যে, অলোক কৌতুক করছেন। কিন্তু ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও চৌকস অফিসার, তাই তিনি বেশ গম্ভীরভাবে বললেন, খুনির ব্যাপারে কী ভাবছেন স্যার? কে হতে পারে! বা খুনের মোটিভ?
ইটস টু আরলি টু কমেন্ট, মিস্টার মুৎসুদ্দি। মাথা নাড়লেন অলোকেশ।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কয়েকটা বিষয় নিয়ে ভাবছেন তিনি। ডাকাত পড়েছিল কিনা সেটা জানা খুব কঠিন কিছু নয়। তাও গম্ভীর স্বরে অলোক বললেন, কিছু কি খোয়া গেছে ডক্টর আরমান?
নাহ, তেমন কিছু নয়। করিম বললেন। তারপর তিনি আরো যোগ করলেন, কেসটা ডাকাতি নয় স্যার, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
হুম। আপনার সাথে কারো শত্রুতা? এবার ইন্সপেক্টর নিজে প্রশ্ন করলেন।
ডক্টর চুপ। তার মানে এটা তার জন্য কঠিন প্রশ্ন। এই দুনিয়ায় কার না শত্রু আছে! আবার ভাবতে বসলে হয়তো একজনকেও খুঁজে পাবেন না।
একটু ভেবে বলুন ডক্টর। উত্তরটা খুব জরুরি।
নাহ্ নেই। মিনিট কয়েক পর নীরবতা ভাঙলেন আরমান। দৃশ্যত তার কোনো শত্রু নেই। তিনি অজাতশত্রু।
বলছেন! আরেকটু ভেবে দেখুন ডক্টর, অজানা কোনো শত্রু আপনার ক্ষতি করতে চায় কিনা! হতে পারে প্রফেশনাল লেভেলে, বা ভেরি পারসোনাল..! বললেন ইন্সপেক্টর।
মুৎসুদ্দি তার কথা শেষ করার আগেই তেতো গলায় ডক্টর বললেন, পারসোনাল বলতে আপনি কী বলতে চান ইন্সপেক্টর?
না মানে, আমি বলতে চাইছি আপনার কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা কাছের মানুষ, যাকে হয়তো আপনি না জেনেই কখনও আহত করে ফেলেছেন!
না, এমন কিছু নেই। স্পষ্ট করে বললেন আরমান সাহেব।
কফির শেষাংশে চুমুক দিয়ে কথা শুনছিলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। পাশেই সোফার উপর একটা অ্যালবাম পড়েছিল। বেশ মোটা। ‘ফোর-আর’ সাইজের ছবি রাখা আছে। ইদানীং কেউ আর ছবি প্রিন্ট করে না, সিডি বা ডাটাব্যাংকে ছবির সফট কপি রেখে দেয়।
কী মনে করে আলগোছে ছবির অ্যালবাম খুলে দেখেন অলোকেশ। বেশকিছু ছবি। খুব পুরোনো নয়, অতি সম্প্রতি তোলা বলেই তো মনে হয়।
কীসের প্রোগ্রাম ছিল ডক্টর?
আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভারসারি। বললেন কামরান করিম।
কত তম?
ইলেভেন্থ!
মনোযোগ দিয়ে অ্যালবামের ছবি দেখছেন অলোকেশ। এইসময় কাজের মেয়ের হাত ধরে একটি মেয়ে বসার ঘরে এলো। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সে আরমান সাহেবের মেয়ে। খুব মিষ্টি দেখতে। মাত্র ঘুম ভেঙেছে বোধ হয়। চোখ ডলছে সে। চোখ লাল, হতে পারে সে মায়ের জন্য কাঁদছে, বা কাঁচা ঘুমের কারণে চোখ লাল হয়েছে।
কী নাম তোমার?
বুলবুলি।
বাহ্ কী মিষ্টি নাম! অলোকেশ বললেন।
ছবি দেখতে দেখতে অলোক একটি ছবি দেখিয়ে বললেন, ডক্টর, ইনি কে? এই ভদ্রমহিলা?
ইতস্তত করেন কামরান। তিনি কিছু বলছেন না।
ছবিটা বেশ সময় নিয়ে দেখলেন ডিটেকটিভ। মেয়েটির চোখে মাদকতা আছে। সুশ্রী, যেন উপচেপড়া তারুণ্য! ছবিতে মেয়েটি ডক্টর কামরানের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন…! ইন্সপেক্টরকে দেখালেন অলোকেশ। ভদ্রমহিলা বেশ দেখতে, কী বলেন মুৎসুদ্দি?
জি। জি স্যার। কিন্তু এটা তো ছবি দেখার সময় নয়। আপনি কি আর কিছু জানতে চান? জানার না থাকলে চলুন স্যার, এবার আমরা যাই।
ইন্সপেক্টরের খুব তাড়া আছে। বেশকিছু পেন্ডিং কাজ রেখে এসেছেন থানায়। অলোকশে বললেন, তাড়া থাকলে আপনি বরং চলে যান আরমান। আমার আরো কিছু জিনিস দেখার আছে। আমি পরে আসছি।
ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দি বেরিয়ে যেতেই মিহি স্বরে অলোক শুধোলেন, বলুন ডক্টর, এই মহিলাটি কে! আমি বেশ বুঝতে পারছি, হয় এ আপনার আত্মীয়, নয়তো স্পেশাল কেউ। পরেরটা হবার সম্ভাবনাই বরং বেশি।
এসব কী বলছেন আপনি! ভুলে যাবেন না, মাত্রই আমার স্ত্রী মারা গেছেন। ইয়ার্কি-ঠাট্টার সময় এখন নয়।
ভুল বললেন ডক্টর। আপনার স্ত্রী মারা যাননি, তিনি খুন হয়েছেন। আর আমি মোটে ইয়ার্কিও মারছি না। আপনি নিজে থেকে সব জানালে বরং আপনার জন্যই মঙ্গল। পুলিশকে একদম বোকা ভাববেন না ডক্টর, আমি যা জানি বা বুঝি, পুলিশও কিন্তু তা জানতে চাইবে। টুডে অর টুমরো।
তাতে বিরক্ত হন ডক্টর কামরান। আপনি কে বলুন তো? কে আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছে?
কেন, আপনি শুনতে পাননি, এই কেসের আইও ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির বস এই কেসে আমার হেল্প চেয়েছেন। তিনি আমার বিশেষ বন্ধু, তাই চাইলেও আমি কেসটা এড়িয়ে যেতে পারি না। বলুন, ওই ভদ্রমহিলা কে!
ডক্টর তাও চুপ করে আছেন। শেষে অলোক বাধ্য হয়ে বললেন, ওর সাথে আপনার অ্যাফেয়ার আছে, তাই না ডক্টর?
কী বললেন! অ্যাফেয়ার। নো, নো, শি’জ জাস্ট মাই কলিগ। ওর নাম নবনীতা। শর্টকাটে আমি নবনী বলে ডাকি।
ওনলি কলিগ, আর কিছু নয় মিস্টার কামরান? নাকি স্পেশাল কেউ? নাছোড়বান্দা ডিটেকটিভ অলোকেশ।
তা হলেই বা! কারো সঙ্গে আমার অ্যাফেয়ার থাকলেও এই কেসের সঙ্গে তার যোগসূত্র কী?
নাহ, কিছু না। চেপে যান অলোকেশ। এই নিয়ে তিনি আর কোনো কথা বাড়ালেন না। বেশ বোঝা যায়, অলোকের এই বাড়তি উৎসাহ তার মোটে পছন্দ হয়নি।
ডক্টর কামরান করিম উঠে গেলে অলোক তার মেয়ে বুলবুলির সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভাবটা ঠিক জমলো না, কারণ বুলি তার মাকে খুঁজছে। ওর দুচোখে কান্নার ঘ্রাণ।
কাজের মেয়ে টুসি বুলিকে সামলাচ্ছে এখন। টুসির বয়স আন্দাজ পনেরো-ষোলো।
এই টুসি, শোনো।
বলেন সাব।
তোমার ম্যাডাম যখন খুন হন তখন তুমি কোথায় ছিলে?
ছাদে স্যার।
ছাদে কেন?
ম্যাডাম কইলো বুলিরে নিয়া উপড়ে যা। তাই গেছিলাম। টুসির স্পষ্ট জবাব।
তারপর কী হল?
মেলা সময় ছাদে থাইক্যা যখন বাসায় আহি, দেখলাম ঘরের দরজা খোলা, ম্যাডামরে কোত্থাও দেখা যাইতাছে না। শেষে রসুইঘরে গিয়া দেখি রক্তের বন্যা বইয়া গেছে, আর ম্যাডাম সেইখানে শুইয়া আছে।
তাই! তুমি তখন কী করলে টুসি?
আমি দিলাম এক চিলচিৎকার। তারপর সাবেরে ফোন করি। বলি, ম্যাডামে আর নাই, জলদি আহেন আপনে।
পুলিশ বা অন্য কেউ হলে হয়তো এই কাজের মেয়ে টুসিকে সন্দেহের তালিকায় ফেলতো, কিন্তু অলোক তা করলেন না। মানুষ এমন সুন্দর গুছিয়ে মিছে বলতে পারে না। টুসি এই খুনের সঙ্গে জড়িত নয়।
তারপর এক কাজ করলেন অলোকেশ। অ্যালবাম খুলে সেই নবনীর ছবি দেখিয়ে বললেন, দ্যাখো তো টুসি, এই ম্যাডাম কি তোমাদের বাসায় আসতো কখনও?
ছবি দেখে মুখ মুচড়ে হাসলো টুসি। বলল, আইবো না ক্যান! হেয় তো সাবের ‘কলিক’! খুব ভালো এই ম্যাডাম। আইলে আমাগো লাইগা চকলেট নিয়া আইতো।
মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনায় কত তফাৎ, তাই না! মনে মনে ভাবলেন অলোকেশ। টুসির কাছে ভাল-মন্দের হিসাবটা একেবারে সহজ। নবনী চকলেট আনে, তাই সে ভালো। না আনলে হয়তো তত ভাল ঠেকতো না। সবটাই লেনদেনের সম্পর্ক।
সে যাক, অলোক এই কেসের একটা অ্যাঙ্গেল পেলেন। হতে পারে এটা ত্রিকোণ প্রেমের ঘটনা। অবশ্য তাতে খুব একটা স্বস্তি বোধ করেন না অলোকেশ। বেবি খুনের কেসটা এত সরল নাও হতে পারে। তবে নবনী আপাতত অলোকের সাসপেক্ট লিস্টে আছে, এটুকু অন্তত বলা যায়।
ডক্টর কামরানের বাসা থেকে বেরোবার আগে টুক করে নিজের স্মার্টফোনে নবনীতার একটা ছবি তুলে নেন অলোকেশ। কাজটা করা হয়তো তার ঠিক হয়নি। রীতিমতো অন্যায়। কিন্তু এই বিচিত্র দুনিয়ায় সবসময় ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব করলে চলে! চলে না।

০৩.
সেদিনই ফোনে ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দিকে নিজের ডেরায় ডেকে নেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তিনি বুঝতে পারছেন, এই কেসে মসলা আছে। তাই মাথা খাটিয়েও সুখ।
ক্রাইম রিপোর্টার কাম গোয়েন্দাসহযোগী শুভজিত অলোকের মুখে বেবি খুনের কেসের আদ্যোপান্ত শুনলো। এবং শুধু অ্যালবামের ছবি দেখে ডক্টর কামরানের কলিগ নবনীকে টার্গেট করার ব্যাপারটা জেনে অলোকের প্রতি তার গভীর সমীহ জাগে। সত্যি, সে গোয়েন্দা বটে! এমন দুঁদে গোয়েন্দা আজকাল আর দেখা যায় না। এক ফেলুদা ছিলেন, তিনি তো আর নেই।
কিছুক্ষণ পর উর্বী এলো। তারপর এলেন ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দি।
বান্দা হাজির! স্যার, এবার বলুন কী করতে হবে? তদন্ত কদ্দুর এগোল? একটু হালকা চালে বললেন মোহাম্মদপুর থানার ওসি (তদন্ত) মিস্টার মুৎসুদ্দি।
দেখুন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি, খুনটা কোনো নারী করেছে, এবং সম্ভবত ‘অন দ্য স্পার অফ দ্য মোমেন্ট’ কাজটা হয়েছে। ঠান্ডা মাথার খুন নয়। কেজো গলায় বললেন অলোকেশ।
কী করে বুঝলেন স্যার?
বুঝেছি ইন্সপেক্টর। এবং এর সপক্ষে কিছু এভিডেন্সও ইতোমধ্যে পেয়ে গেছি আমি।
একটু কি ঝেড়ে কাশবেন প্লিজ? বেশ কৌতূহল দেখান ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি।
শুনুন তবে। গলা খাঁকরে শুরু করলেন অলোকেশ। ভিকটিমের স্বামী ডক্টর কামরান করিমের এক কলিগ আছে, নাম তার নবনীতা। দুজনে একই হসপিটালে চাকরি করেন। ভদ্রমহিলা বেশ সুন্দরী, উপচেপড়া যৌবন। কামরানের পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাও আছে।
কী করে জানলেন স্যার? ডক্টর কামরান নিজে বলেছেন?
নো নো, বাসার কাজের মেয়ে, কী যেন নাম- ওহ্ টুসি। টুসিই ব্যাপারটা কনফার্ম করলো। তাছাড়া অ্যালবামের ছবি তাই বলে। যথেষ্ঠ ঘনিষ্ঠতা না থাকলে একটা পুরুষের প্রায় কোলে চড়ে কেউ ছবি তোলে না।
তাই নাকি! ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। কে কার কোলে চড়লো স্যার?
তাতে মুচকি হাসেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। এ কেমন প্রশ্ন ভায়া! একটা মেয়ের কোলে নিশ্চয়ই একজন সোমত্ত লোক চড়তে পারেন না। ফলে তার উল্টোটা হওয়াই সমীচীন, নয় কী!
ওহ্ বুঝলাম। মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। তার মানে আপনি স্যার, সেই নবনীকেই খুনি ঠাওরালেন?
এবার একটু সময় নেন অলোকেশ। বেচুদাকে চারজনের জন্য কফি আর ফ্রেঞ্চ টোস্টের অর্ডার দেন। তারপর অর্থপূর্ণ কেশে বললেন, নট অ্যাট অল, মুৎসুদ্দি। নবনীতা খুন করেছে কিনা জানি না, তবে আপনি বরং প্রশ্ন করতে পারেন, খুনি যে নারী, সেটা কী করে বুঝলাম!
জি স্যার। ওটাই আমার প্রশ্ন। দয়া করে একটু খোলসা করবেন! এমনভাবে ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি বললেন, যেন তিনি বিনয়ের অবতার। ফাঁকে ফাঁকে তিনি আবার উর্বীকেও দেখছেন। কেসটা ঠিক ধরতে পারছেন না ইনি লেডি ডিটেকটিভ, নাকি অলোকেশের বেটার-হাফ!
বেশ একটা ভাব নিয়ে অলোক বললেন, দেখুন মুৎসুদ্দি, চেয়ে থাকার নাম দেখা নয়। গোয়েন্দাগিরি মানে গভীর পর্যবেক্ষণ, মন দিয়ে দেখা। অকুস্থল থেকে আমি এমন কিছু পেয়েছি, যাতে বোঝা যায় খুনি সম্ভবত নারী।
কী পেলেন স্যার? আমি তো আরো আগেই স্পটের খানাতল্লাশি করে এসেছি। কই, তেমন কিছু পেলাম না তো, শুধু একটা বঁটি।
হুম। এই দেখুন এটা কী? প্ল্যাস্টিক প্যাকেটে রাখা রক্তমাখা সেই কুন্তলদাম তুলে ধরলেন অলোক। কুন্তল মানে কেশ, বা মাথার চুল। এই চুলের আবার জায়গাভেদে নানারকম নাম হয়। চুল নিয়ে সেই দুর্গন্ধযুক্ত কৌতুকটা নিশ্চয়ই আপনাদের কারো অজানা নয়।
চুল স্যার! কার এটা? খুনির? কিন্তু স্যার, এটা তো ভিকটিম বেবিরও হতে পারে। তিনিও কিন্তু নারী।
হতেই পারে। কিন্তু ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি, চুলের সাইজ দেখেছেন? বেশ লম্বা। আমি সেই ছবির অ্যালবামে বেবির ছবিও দেখেছি। ভুলে যাবেন না, তিনি কিন্তু একজন মডেল কাম অ্যাকট্রেস ছিলেন। ছবিতে তাকে বব্ড হেয়ারে দেখলাম। যদি না তিনি ইতোমধ্যে চুলের স্টাইল বদলান, তাহলে বলতেই হয় যে, এই চুল ভিকটিম বেবির নয়, বরং খুনির হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং সেই খুনি এমন একজন মহিলা, যে কিনা হট টেম্পারড, বঁটির সাথে তার ভালো জানাশোনা আছে, ইত্যাদি।
হুম শব্দ করলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। টুকটুক করে নোট নিচ্ছে শুভজিত। উর্বী মনোযোগ দিয়ে শুনছে। কেসের এভরি ডিটেলস সে নিজের মগজে রেকর্ড করে নিচ্ছে।
মুচমুচে ফ্রেঞ্চ টোস্ট এলো, সঙ্গে কফি। বেচুরাম কফির রেসিপিটা বেশ ভালই শিখে নিয়েছে। গন্ধেই কফিপানের ইচ্ছেটা চনমনিয়ে ওঠে। আহ, কী সুন্দর ফ্লেভার! সত্যি, এপিটাইজিং!
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা..!’ মনে মনে জীবনানন্দ আওড়ায় উর্বী।
কফিতে চুমুক দিয়ে ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি বললেন, স্যার, এক কাজ করলে হয় না!
কী কাজ? মাথা তোলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ।
ভিকটিমের হাজব্যান্ডকে কোয়েশ্চেন করে জেনে নিই, মৃত্যুর ইমিডিয়েট আগে তার বউয়ের হেয়ারস্টাইল কেমন ছিল?
ইয়েস প্লিজ। ডু ইট ফাস্ট। সাগ্রহে বললেন অলোকেশ।
পটাপট নম্বর টিপলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। মুঠোফোন কোম্পানি ঝটপট দুজনকে কানেক্ট করে দেয়। ফোনের ওপারে ডক্টর কামরান করিম। বলুন স্যার, ফোন করেছেন কেন!
সরি টু ডিসটার্ব ইউ মিস্টার করিম। মনে করে একটু বলবেন কি, ইদানীং আপনার স্ত্রীর চুলের স্টাইল কেমন ছিল? লং কাট, অর বব্ড?
লেয়ার কাট স্যার। লম্বা নয়। ভদ্রলোকের মতো উত্তর দেন ডক্টর করিম। উত্তর তিনি পেয়ে গেছেন। ফলে ফোন কেটে দেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। তিনি অযথা সময় নষ্ট করার বান্দা নন। তিনি জানেন, টাইম ইজ মানি। এন্ড মানি ইজ দ্য পেট্রল অফ লাইফ। টাকাই দুনিয়াসুদ্ধ মানুষকে চরকি নাচন নাচাচ্ছে।
অমায়িক হেসে ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি বললেন, ইউ আর রাইট স্যার। ভিকটিমের মাথার চুল এত লম্বা নয়। এটা সম্ভবত খুনির চুল। আমি স্যার ভাবতে পারছি না, একজন নারী অন্য একটা মেয়েকে মেরে দিল! কথাটা ডেলিভারি দিয়ে উর্বীর দিকে তাকান মুৎসুদ্দি। তার মানে নারীই নারীর প্রধান শত্রু।
এ আর নতুন কী, ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। মাথা নাড়লেন অলোকেশ। আপনি গ্রিক মিথলজি পড়েননি! সেখানে তো নারীর সংহারমূর্তির গল্প ভুরি ভুরি আছে।
রাত তখন নটা। মুৎসুদ্দি বললেন, স্যার, এবার তাহলে আমাদের করণীয় কী? ডক্টর করিমের কলিগ নবনীকে কি আমরা সন্দেহের তালিকায় রাখবো?
আই’ম নট শিওর। কিন্তু তাকে সন্দেহের বাইরে রাখারও কোনো কারণ নেই। ছবিটা কিন্তু বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল ইন্সপেক্টর।
ইয়েস স্যার। মানে ওই ভিকটিমের স্বামীর কোলে চড়ে…! কথা শেষ করেন না মুৎসুদ্দি, বাকিটুকু ফিচেল হেসে পুষিয়ে দেন।
শুভ নোট নিচ্ছিল। কিন্তু এবার আর সে মৌনীবাবা হয়ে থাকতে পারলো না। ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দির কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো। ভদ্রলোক এখনও সেই কোলের মধ্যেই আছেন! এই না হলে রসিক পুলিশ!
খানিক বাদে উঠে পড়লেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। অলোকেশ বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে লাশের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পাঠাবেন প্লিজ। ওটা না পেলে অনেক কিছুই ‘ডিডিউস’ করা যাবে না।
গুডবাই বলে বেরিয়ে যান ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। উর্বী এবার একটু আরামসে শ^াস নেবার ফুরসত পেলো। সে বলল, কী মনে হয় অলোক, বাই এনি চান্স, নবনী কি খুনটা করে থাকতে পারে?
নট ইয়েট শিওর উর্বী। তবে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তুমি ওর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকবে। ধানমন্ডি সিটি হসপিটালের ইএনটি বিভাগে সে কাজ করে। সম্ভবত প্রাইভেটে পড়েছে। তার সাজগোজ সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। সরকারি মেডিকেলে পড়লে অমন পটের বিবি হয়ে থাকতো না। জানো তো, কে পড়ে পাস করেছে, আর কে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়, খেয়াল করে দেখলেই তা বোঝা য়ায।
আমাকে কী করতে হবে? জানতে চায় শুভ।
তুই বরং ভিকটিমের স্বামী ডক্টর কামরানকে ফলো কর। কেন যেন মনে হয় শুভ, এটা একটা ত্রিভূজ প্রেমের গল্প।
সত্যিই তাই? ডাউট দেয় উর্বী। আজকাল এসব হয় নাকি! মানুষ এমনিতে জীবনজটিলতায় অস্থির, তারপর আবার শখ করে কে ভালোবাসার ট্রায়াঙ্গেলে ডুবে মরবে! প্রেম তো নয়, যেনো বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল।
কিন্তু ওই কুন্তলদাম! চুলের কী হবে উর্বী? ওটা তো কোনো নারীকেই নির্দেশ করছে, নয় কী! যুক্তি দেন অলোকেশ।
শুভ আগবাড়িয়ে বলল, আমি বরং এক কাজ করি। খুনের সময় ডক্টর কামরান কোথায় ছিল, সেটা একটু খতিয়ে দেখি। কৌশলে কাজের মেয়ে টুসির কাছ থেকে জানা যায়, বেরি আর কামরানের কনজুগাল লাইফ কেমন ছিল! কাপ-সসার লোফালুফি বা দুজনের মাঝে রোজ চুলোচুলি হত কিনা জানা জরুরি।
হুম। এগুলো সব এলিমেন্টারি ব্যাপার। খতিয়ে দেখতে হবে। পিএম রিপোর্টটা আগে আসুক। তাহলে বেশকিছু বিষয় খোলসা হবে। তদন্তের কাজে গতি আসবে। অলোকেশ বললেন।

০৪.
সিটি হসপিটাল, ধানমন্ডি। ইএনটি বিভাগের আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে উর্বী। এখানে ডক্টর নবনীতা কে, ছবি দেখে তাকে সে আগেই চিনে নিয়েছে। হসপিটালের দোতলায় ক্যান্টিন, সেখানে গিয়ে থানা গাড়লো উর্বী। এতে সুবিধা হয়েছে যে, চট করে কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারবে না। হাসপাতালে রোগীর মেলা এটেন্ডেন্ট আসে, তারা ক্যান্টিনে বসে, খায়, জিরোয় বা কাম-ক্লান্ত গরিলার মতোন হাই তোলে।
বেলা তখন দুটোর মতোন বাজে। নবনীকে ক্যান্টিনে ঢুকতে দেখা যায়। সঙ্গে আরেকজন, ডাক্তার হবে হয়তো বা অন্য কেউ। তবে সে ডক্টর কামরান নয়। উর্বী তাকে চেনে। সেদিন আসবার সময় হাতসাফাই করে অ্যালবাম থেকে কামরানের একটা ছবিও তুলে এনেছিলেন অলোকেশ।
তাহলে কে সে! কান পাতে উর্বী। একটু অ্যাঙ্গেলে বসে সে উৎকর্ণ হয়।
তেতো গলায় লোকটা বলল, আগেই তোমাকে সাবধান করেছিলাম নবনী, কামরানের সাথে অত ক্লোজ হয়ো না। লোকটাকে শুরু থেকেই আমার সুবিধের মনে হয়নি। নিজে ডাক্তার, অথচ বিয়ে করেছে একটা উঠতি মডেলকে। এবার হল তো! ফাঁসলে তুমি নবনী!
ফাঁসলাম মানে! আমি কেন ফাঁসবো! আমি কি খুন করেছি নাকি! ঝেঁঝে উঠে বলল নবনীতা।
কিন্তু পুলিশ শুনেছি তোমাকে সন্দেহ করছে! জেরা করতে আসবে!
তাই নাকি? কে বলল তোমায়? নবনী চাপা অথচ কঠিন স্বরে বলল। এ সময় তাকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখায়। সুডৌল মুখখানা কেমন ফেকাসে বা রক্তশূন্য মনে হয়।
শুনেছি আমি। পুলিশ ছাড়া আরো একখানা ফেউ যুক্ত হয়েছে এই কেসে।
ফেউ! কে সে?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তার নাম আমি জানি না, তবে সে নাকি এসি সাহেবের বন্ধু। খুব চৌকস।
তাতে কী! খুন আমি করিনি রমিজ, আমি নির্দোষ। নবনী বলল। উর্বী সব শুনছে, বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটা কতটুকু সত্যি বলছে, বা আদৌ বলছে কি!
লোকটার নাম রমিজ। নবনীর বন্ধু বা কলিগ। প্রেমিক নয় তো! নাহ, ভাবসাব দেখে তা মনে হয় না। তবে শুভানুধ্যায়ী হতে পারে। মে বি, সেও লাইনে আছে। সময়সুযোগ বুঝে টুক করে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসবে। পুরুষগুলোও হয়েছে তেমনি। একটু সুন্দর দেখতে মেয়ে পেলেই তাদের নোলায় পানি গড়ায়। হুলোর মতো লেজে বাগ দেয়, কাছে পেলেই জড়িয়ে ধরবে।
চায়ের অর্ডার দেয় রমিজ। লোকটা একটুখানি টেরা। একটু না, অনেকখানি। এদের নিয়ে বড্ড বিপত্তি, জানেন তো! সে কখন কার দিকে তাকিয়ে আছে বোঝা মুশকিল। উর্বী শিকারি কুকুরের মতো উৎকর্ণ হয়ে থাকে।
শোনো নবনী, সাবধানে থেকো। খুনটা যেই করুক, তুমি যে কামরানের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলে, তা কিন্তু এই হসপিটালের অনেকেই জানে।
তো! আমি কী করবো? ঘনিষ্ঠ হলেই বুঝি তার বউকে খুন করতে হয়! তুমি মাঝে মাঝে একমন বোকার মতো কথা বলো না! আমি সত্যি বুঝতে পারি না তুমি আমার বন্ধু, নাকি চিরজনমের শত্রু! তেতো গলায় বলল নবনীতা। সে একটা গাঢ় মেরুন রঙের কামিজ পরে আছে। চোখে কাজলের প্রলেপ, বেশ লাগছে দেখতে।
রমিজ সান্ত¡নার সুরে বলল, তুমি মিছেই আমাকে ভুল বুঝছ। আমি বলি কি, একটু সাবধানে থেকো, পুলিশ তোমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে। ভুলেও তুমি বেফাঁস কিছু বলবে না। বিশেষ করে ওই প্রাইভেট গোয়েন্দার কাছ থেকে তুমি দশ হাত দূরে থাকবে। সে কিন্তু কেঁচো থেকে কেউটে বের করে আনবে।
কী সব যা-তা বলছ রমিজ! কীসের কেউটে, কীসের কী!
ঠোঁট কামড়ায় নবীনতা। একটু পরে নিজের থেকে সে বলল, শুধু একটা ভয় আছে রমিজ।
কী বলো তো?
ওই যে, ক্রেডিটকার্ডে বিল মেটানো। বেশ কয়েকটা বিল আছে যা কিনা আমার পারসোনাল কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা হয়েছিল। ওগুলো নিয়ে টানাটানি করলে পুলিশ বুঝতে পারবে যে, কামরান আমার সঙ্গে বেশ ক্লোজ।
ওহ! শব্দ করলো রমিজ। তাকে বেশ মনক্ষুণœ মনে হল। রমিজ বোধ হয় জানতো না যে, ওর অনুমানই ঠিক। তলে তলে কামরানের সঙ্গে নবনী অনেকটা পথ হেঁটেছিল। ওরা একান্তে সময় কাটিয়েছে, কী জানি, হয়তো আবাসিক হোটেলে একসাথে নিশিযাপনও করেছে।
চালিয়াত রমিজ কিন্তু মনের কথা মুখে আনেনি একদম। উল্টো সে বলল, অতীত ভুলে যাও নবনী। যা হয়ে গেছে, গেছে। সময় কারো জন্যে লটকে থাকে না। বাউকুলের মতো। সম্পর্কও না। আমি তোমার সঙ্গে আছি নবনী। থাকবোও। এইটুকু বলে রমিজ আলগোছে নবনীর একটা হাত আলগোছে নিজের হাতে তুলে নেয়। নবনীও বাধা দেয় না, বা হাত সরায় না।
ফলে উর্বী যা বোঝার বুঝে ফেলে। ব্যাটা রমিজ একটা ফেরেব্বাজ। নবনী এই কেসে বেকায়দায় পড়েছে দেখে সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে উঠে পড়ে লেগেছে। যাকে বলে ঝোপ বুঝে কোপ মারা।
শালা, অপরচুনিস্ট কোথাকার! ছুঁচো একটা।
সহসাই উর্বীর নারীবাদী সত্তা জেগে ওঠে। সে নবনীর প্রতি সহমর্মী হয়। বেচারা নবনীতা! ডক্টর কামরানের সঙ্গে তার কিছু একটা লটঘট ছিল বা আছে, এটুকু নিশ্চিত হয় লেডি ডিটেকটিভ উর্বী। তার মানে এই নয় যে কামরানের বউ বেবিকে খুনের ব্যাপারেও তার হাত আছে। অতটা সাহসী এই মেয়ে নয়।
হঠাৎ তার চুলের কথা মনে পড়ে। অলোক বলছিল খুনের স্পটে বা অকুস্থল থেকে চুল পাওয়া গেছে। সেই চুল বেশ লম্বা, অথচ বেবির মাথার চুল ছিল লেয়ার কাট, তা ঘাড়অব্দি নেমে এসেছিল মাত্র।
কিন্তু নবনীর চুল! সেও তো বেশ লম্বা। তবে কি নবনীই খুনটা করেছে! রাগের মাথায়? নবনী হয়তো তার প্রেমিক ডক্টর কামরানকে বেবির সঙ্গে শেয়ার করতে চায়নি। একলা খেতে চেয়েছিল!
উর্বী সঙ্গে সঙ্গে অলোককে ফোন দেয়। সবকিছু ভেঙে বলে। উত্তরে অলোকেশ বললেন, তুমি দেখো একটা কাজ করতে পারো কি না।
কী কাজ বস? মজা করে বলল উর্বী।
অন্য সময় হলে হেসে ফেলতেন অলোকেশ। কিন্তু এখন কাজের সময়, হাসি-ঠাট্টার সময় নয়। তিনি বললেন, দেখো, হসপিটালে নিশ্চয়ই নবনীর নিজস্ব একটা রুম বা কিউবিকল আছে। সেখানে ওর চিরুনিও থাকবে। আর মেয়েরা চুল আঁচড়ালে চুল ঝরবে না, তা কখনও হতেই পারে না। দেখো, যদি কোনোভাবে ওর একটা চুল তুমি আনতে পারো!
অমনি একটা লাইন মনে পড়ে যায় উর্বীর। চুলের বদলে অবশ্য চিল হবে। ‘হায় চিল, সোনালী ডানার চিল!’ আবারও সেই জীবনানন্দ দাশ। বাংলা সাহিত্যে এমন মহৎ কবি আর কোনোদিন আসবে না।
ফোন ছেড়ে দিয়ে নবনীর চুলের সন্ধানে নামে উর্বী। কাজটা সহজ নয় সে জানে। প্রথমে রুম খুঁজতে হবে, তারপর চিরুনি, দেন লাক্ ফেভার করলে চুল পাওয়া যাবে।
নবনী ও রমিজ তখনও ক্যান্টিনে বসে ফুসুরফাসুর করছে। এটাই সুযোগ। চট করে উপরে চলে এলো উর্বী। করিডোরের দুপাশে দুই সারি রুম। নার্সদের কমনরুম পড়লো প্রথমে। তারপর ডিরেক্টরসদের রুম। দেন ডক্টরস।
নবনীর রুম খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। ওই তো নবনীর রুম। সঙ্গে অবশ্য আরেকজন আছে। কী নাম লেখা- লায়লা খান। তার মানে সিঙ্গেল রুম নয়, দুজনের জন্য একটি রুম বরাদ্দ। এমনই হয়। হসপিটাল তো আর পাঁচতারকা হোটেল বা কারো বাপের বাংলোবাড়ি নয় যে, প্রত্যেকের জন্য বিশাল একখানা রুম থাকবে!
রুম খোলাই ছিল। টুক করে ঢুকে পড়লো উর্বী। ভাগ্যিস, নবনীতার সহকর্মী লায়লা খান নেই। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলবে নবনী তার বান্ধবী। জরুরি দরকারে তার কাছে এসেছে উর্বী।
আঁতিপাঁতি করে চিরুনি খুঁজলো উর্বী। কিন্তু না, কোত্থাও নেই। তার মানে এখানে বসে চুল ঠিক করে না তারা! নাকি লেডি ডক্টরদের জন্য স্পেশাল কোনো পারলার আছে! ইন-হাউজ পারলার! বিরক্ত বোধ করে উর্বী। মানে হয়! এ যেন তীরে এসে তরী ডোবার মতোন ব্যাপার।
সময় নষ্ট না করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো উর্বী। কিছু একটা তাকে করতেই হবে। উর্বী কখনও তার অ্যাসাইনমেন্ট ফেল করে না। অলোকেশও তার উপর কাজের ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন। উর্বী পারবে, শি হ্যাজ দ্যাট গাট্স এন্ড কমিটমেন্ট।
ভাবছে উর্বী। বেলা পড়ে আসছে। বেশি দেরি করে ফেললে নবনী হয়তো ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরে যাবে। তাহলে তার চুল তো ভাল, টিকিটিও টাচ করা যাবে না।
সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নিচে নামলো উর্বী। ওই তো নবনী আসছে। সঙ্গে টিকটিকি রমিজও আছে। তা থাক, কুছ পরোয়া নেহি। অমনি উর্বীর মাথায় একটা আইডিয়া এলো। ঝরা বা মরাপাতা যেহেতু সে পায়নি, তাকে গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে নিতে হবে।
উর্বী এমনভাবে ছুটলো যেন তার খুব তাড়া, হাঁটতে গিয়ে প্রায় সে নবনীতার গায়ের উপর ঢলে পড়লো। আর সেই সুযোগে কুট করে ছিঁড়ে নিলো নবনীর মাথার চুল। বেশ লম্বা, মসলিনের মতো ফিনফিনে চুলের টেক্সচার।
এটা কী হল? অমনি তেড়ে ওঠে ছুঁচো রমিজ। নবনী কিছু বলছে না, অথচ রমিজ খেপে গেছে। এ যেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি!
সরি! আই’ম এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম। চোস্ত ইংরেজিতে বলল উর্বী। ব্যস, তাতেই কাজ হল। রমিজের মুখ বন্ধ। দু’লাইন ইংরেজি বলতে পারলেই এখনও সকলে তাকে মহাপ-িত মনে করে। এর নাম ব্রিটিশ ভূত, এখনও যা আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে। জীবনেও নামবে না।
উর্বীর ঠোঁটে মোলায়েম হাসি। যাক, কাজটা সে করতে পেরেছে। নবনীতার মাথার চুল নিয়ে উর্বী সোজা মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে ছুটলো, অলোকেশের ডেরায়।
উর্বীর জন্য উন্মুখ হয়ে বসেছিলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। দরজায় কলবেল শুনে তিনি চেঁচালেন, দেখো তো বেচুদা, কে এলো?
বেচুদা উর্বীর বেল বাজানোর ধরন জানে। সেও চেঁচিয়ে বলল, কে আবার, উর্বী দিদিমনি আইছে।
এই আধবুড়ো লোকটার মন-মর্জি বোঝা ভার। উর্বী এলেই তার মন ভালো হয়ে যায়। তার চোখে উর্বীর মতো ভালো মেয়ে দুনিয়াতে আর একটাও নেই। অলোক দাদাবাবু কেন যে এখনও তাকে বিয়ে করছে না- এই নিয়ে বেচুরামের মনে আক্ষেপের অন্ত নেই।
চুল এনেছো? কই, দাও দেখি!
উর্বী বেশ একটুখানি ভাব নিয়ে বলল, রমণীর মাথার চুল কি এতই সস্তা! যে চাইলে আর পেয়ে গেলে!
কী বললে উর্বী! চুল তুমি পাওনি?
কী করে পাবো! তার রুমে ঢুকলাম, চিরুনি নেই, তাই কোনও চুলও সেখানে নেই। করিডোরে নবনীর সঙ্গে দেখা হল। দেখি তার সঙ্গে একখানা লেজবিহীন টিকটিকি আছে। নাম রমিজ। সেও সম্ভবত নবনীতার বিশেষ ভক্ত। মেয়েটা বিপদে পড়েছে দেখে ফাঁকতালে তার সঙ্গে প্রেম করতে চাইছে।
বাহ! বেশ খবর এনেছো। এবার বলো চুল কই? বাহবা দিলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ।
এই নাও বাবা, এনেছি। অমনি দুগাছি চুল এগিয়ে দেয় উর্বী। এবার নবনীর চুল আর খুনের স্পটে পাওয়া চুল- এইদুটো মিলিয়ে দেখবার জন্যে ডিএনএ প্রোফাইলিং করতে হবে। তাতে অন্তত আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় চাই। সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দিকে ফোন লাগান অলোকেশ।
বলুন স্যার, আপডেট কী? নতুন কিছু কি পাওয়া গেল? এনি ক্লু!
চুল পেয়েছি। লম্বা চুল। আপনি এক্ষুনি একজন লোক পাঠান। আমি চুল পাঠাচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এর ডিএনএ প্রোফাইলিং রিপোর্ট চাই। স্পটে পাওয়া চুলের সঙ্গে মিলে গেলে ভাল, নইলে পুরোটাই গেল। একশ^াসে কথাগুলো বললেন অলোকেশ।
জি স্যার। মাই বয় উইল মিট ইউ সুন। ফোন রাখলেন ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দি।

বিজ্ঞাপন

০৫.
ভিকটিম বেবির লাশের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেল।
তাতে লেখা রয়েছে, ‘ডেথ বাই গ্রিভাস অ্যাটাক উইদ সাম শার্প উয়েপন। টু কাট মার্কস- ডিপ অন দ্য নেক, এন্ড অন দ্য ফ্রন্ট পার্ট অফ দ্য স্কাল’।
আর বিশেষ কিছু নেই। থাকার কথাও নয়।
বস্তুত, পিএম রিপোর্ট থেকে তেমন কিছু জানার জো নেই। স্পটে বঁটি পাওয়া গেছে। বঁটিতে আঙুলের ছাপ তত স্পষ্ট নয়। রিপোর্টের একটা কপি তক্ষুণি ভাইভারে অলোক তার এক বন্ধুকে পাঠালেন। তিনি ডিএমসি’র বিশিষ্ট ফরেনসিন স্পেশালিস্ট কমলেশ ভাদুড়ি।
কেসটা কী হতে পারে, শুভ?
কোন কেস?
এই যে বেবি খুন হলেন! মেয়েটা নাকি বেশ ভালো অভিনয় করতো। মডেল হিসেবেও নাম কামিয়েছিল।
আক্রমণের বিষয়ে আমার অনুমান- খুন যেই করে থাকুক, সে জেনেবুঝেই কাজটা করেছে। যাকে বলে ঠান্ডা মাথায় খুন। সে এও জানতো, বেবি তখন একলা থাকবে বাসায়। অর্থাৎ খুনি তার অচেনা কেউ নয়। অথবা বেবি তাকে না চিনলেও খুনি তাকে বেশ ভালো করেই চেনে।
গুড। ভেরি গুড পয়েন্ট, শুভ। তারপর বল, খুনটা কী করে হল!
সম্ভবত তখন ঘরের দরজা খোলা ছিল। তাই খুনির ঘরে ঢুকতে মোটেও অসুবিধা হয়নি। বেবিকে খুঁজতে খুঁজতে সে কিচেনে চলে এলো। বেবি তখন কিচেনে বিজি। এই সুযোগে বঁটি তুলে নিয়ে বেবির পেছন থেকে সে প্রথম কোপটা বসালো। হয়তো জায়গামতো লাগেনি, লেগেছে ঘাড়ে। স্বভাবতই বেবি তখন সামনে ঘুরলো, মুখোমুখি হল খুনির, কিন্তু ভিকটিম বাধা দেবার আগেই খুনি বেবির মাথায় মারলো কোপ। পিএম রিপোর্ট অনুযায়ী ‘ফ্রন্ট পার্ট অফ দ্য স্কাল’। দ্বিতীয় কোপে মেঝেতে ঢলে পড়লো বেবি। বলতে গেলে স্পট ডেড।
হুম। আমার অনুমান, ইউ আর রাইট শুভ। কেসটা ঠিক এমনই ঘটেছিল। কিন্তু আপসোস কী জানিস- উদাস চোখে তাকান ডিটেকটিভ অলোকেশ।
কী?
পুরো ভবনের কোথাও কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। থাকলে খুনি ঠিক ধরা খেত। তুই একদম ঠিক বলেছিস শুভ। খুনি দূরের কেউ নয়। বেবি বা ডক্টর কামরানকে সে ভালো করেই চেনে।
কিন্তু কে সে? হু ইজ দ্য কালপ্রিট!
লাখ টাকার প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর দেবে কে?
ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির কী খবর? তিনি কি কিছু খুঁজে পেলেন? এনি ক্লু? শুভ বলল।
মাথা নাড়লেন অলোকেশ। নাহ্ কোনো অগ্রগতি নেই। পুলিশ তো সেই ঐকিক নিয়মে খুনি খুঁজছে। ইন্সপেক্টর আপাতত ডক্টর কামরান আর তার স্ত্রী বেবির কললিস্ট ঘেঁটে দেখছেন। যদি সেখান থেকে কোনো ক্লু পাওয়া যায়!
তোর কী মনে হয় অলোক? কামরানের সহকর্মী ডক্টর নবনীতা এ-কাজ করতে পারে?
ঠিক জানি না। চুলের রিপোর্টটা পেলে বোঝা যেত।
***
আরো দুটো দিন কেটে গেল। চুলের রিপোর্টের জন্য ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দিকে বারবার তাগাদা দেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। অবশেষে রিপোর্ট পাওয়া গেল। কিন্তু সেই রিপোর্টে আশার খবর নেই, পুরোটাই হতাশা।
কী, রিপোর্ট কি ম্যাচ করেনি? ফোনে জানতে চায় উর্বী।
নাহ, রিপোর্টটা মেলেনি। অলোক জানালেন। অর্থাৎ প্রেম করলেও নবনীতা খুনি নয়। ভালোবেসে খুনি হতে হয়, এ-কথা সত্যি নয়।
উর্বী প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল, আমিও তাই ভেবেছিলাম। নবনীর মতো একটা নরম, মিষ্টি মেয়ে আর যাই হোক, বঁটি দিয়ে কুপিয়ে কাউকে খুন করতে পারে না। ইটস টোটালি অ্যাবসার্ড।
তাতে বিরক্ত হন অলোকেশ। তার মতে মানুষ স্বভাবতই অপরাধী। সময় সুযোগ পেলে মানুষের পক্ষে যেকোনো ক্রাইম করা সম্ভব। নেহাত আইনের ভয় বা সোশাল ট্যাবুর কারণে অনেকে ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকে।
একটা ব্যাপার খুব ধন্ধে ফেলে দেয় অলোককে। এই কেসের বাদী অর্থাৎ ভিকটিমের স্বামী কামরানের তদন্তের ব্যাপারে যেনো কোনো আগ্রহ নেই! ডক্টর কামরান নিজে থেকে একবারও কেসের খোঁজ নেননি, বা খুনি ধরা পড়লো কিনা সেই ব্যাপারে আদৌ কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তার মানে কী দাঁড়ালো? স্ত্রী বেবি খুন হওয়াতে কি তিনি কষ্ট পাননি!
মোহাম্মদপুর মডেল থানার এসিপি’র রুমে বসে কথা হচ্ছিল। সেখানে কেসের আইও ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দিও উপস্থিত ছিলেন।
তারপর ডিটেকটিভ, কেসের কিনারা কিছু হল? সিঙাড়ার সিঙে কামড় বসিয়ে বললেন এসি হারিসুল।
নট ইয়েট ব্রাদার। মাথা নাড়লেন অলোকেশ। সত্যি বলতে, বেবি খুনের কেসটা নিয়ে আমি বেশ চিন্তিত। এমন কানাগলিটাইপ কেস আগে আর কখনও পাইনি। এত চেষ্টা করেও জবরদস্ত কোনো ক্লু কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি।
হারিসুল তার সাবঅর্ডিনেট অফিসার মুৎসুদ্দির দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালেন। কী ব্যাপার ইন্সপেক্টর, একেবারেই নো ইমপ্রুভমেন্ট! কী করে সম্ভব?
এই কেসে সিরিয়াস কেলো আছে স্যার। মুখ ফসকে বলে বসলেন মুৎসুদ্দি।
কী আছে বললে? কীসের কেলো! তার মানে তুমি আজকাল কাজকাম বাদ দিয়ে নিয়মিত ইন্ডিয়ান সিরিয়াল গিলছো! জি বাংলা!
না না স্যার, কাজ তো করছিই। কিন্তু কিছুতেই ফোঁড়ার মুখ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইন্সপেক্টর বললেন।
ব্যাটার কাব্যজ্ঞান প্রখর। এমন সব তুলনা দিচ্ছে সে! মনে মনে বললেন অলোকেশ। কেস তো নয়, পাকা ফোঁড়া।
হারিসুল এবার বললেন, কই দেখি তো, বাদী আর ভিকটিম- দুজনের কললিস্ট আমাকে দেখাও। শুধু চুল দিয়ে খুনি ধরা কঠিন হবে আমি জানি।
এসি হারিস আর ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি বসে কললিস্ট চেক করছেন। আর ডিটেকটিভ অলোকেশ নবনীকে নিয়ে ভাবছেন। উর্বীর দেয়া তথ্যমতো মেয়েটা ডক্টর করিমের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল, বোঝা যায়। হয়তো সে করিমের ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে অনেক কিছু জানে। আচ্ছা, মেয়েটাকে একবার বাজিয়ে দেখলে হয়। সেক্ষেত্রে তাকে উর্বীর হেল্প নিতে হবে।
উর্বীকে ছোট্ট একটা টেক্স পাঠালেন অলোকেশ। লিখলেন, প্লিজ ট্রাই টু মেক অ্যান অ্যাপয়েন্টমেন্ট উইদ নবনীতা। অ্যাস্যাপ!’
‘অ্যাসাপ’ মানে অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। ডিজিটাল বাংলা যাকে বলে।
বস আর তার সাবঅর্ডিনেট মিলে দুটো নাম্বার আলাদা করলেন। একটা নম্বর মুৎসুদ্দির চেনা। ডক্টর কামরানের ড্রাইভার আবদুল এই ফোনের মালিক। গাড়ি বেশির ভাগ সময় তার স্ত্রী বেবিই ব্যবহার করতেন। আরেকটা নম্বর কার?
এখনও জানি না স্যার। এই নম্বর থেকে মাঝে মাঝে বেবির ফোনে কল এসেছিল। বাংলা লিংক নম্বর। ফোনদাতার পরিচয়টা জানতে পারলে হত।
হুম। ডু ইট ফাস্ট। এসি হারিসুল নির্দেশ দিলেন।
এসিসাহেব বেরিয়ে গেলে অলোকেশ ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করলেন।
আচ্ছা ইন্সপেক্টর, আপনার কী মনে হয়, খুনি কি মহিলা?
ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি চুপ। যেন তার কিছু বলবার নেই।
আমি কিন্তু এখনও নিশ্চিত যে, খুনি একজন মহিলাই হবে। অকুস্থলে পাওয়া চুল ভিকটিম বেবির নয়। তার চুল লেয়ার কাট, আর সেই স্যাম্পল চুল বেশ লম্বা, প্রায় দু’ফুট।
কিন্তু স্যার, ওই চুল তো উড়েও আসতে পারে? দুম করে বলে বসলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি।
না, তা পারে না। আমি বেবির কিচেন খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছি মুৎসুদ্দি। সেখানে কিচেনহুড লাগানো আছে, তাই জানালাটা প্রায়শ বন্ধই থাকে। এগজস্ট ফ্যানও নেই। জানালা খুলে দিলে আগুন উড়ে যাবে। ওইরকম একটা কিচেনে বাইরে থেকে চুল উড়ে আসাটা একটু কঠিন বৈকি।
অলোকেশ নিজে থেকেই আবার বললেন, আরো একটা কারণ আছে ইন্সপেক্টর।
কী কারণ স্যার?
ওই যে, খুনের হাতিয়ার। আমি বিশ^াস করতে পারি না, কোনো পেশাদার খুনি বঁটি দিয়ে কাউকে মেরে ফেলতে পারে।
হুঁ। তাও তো ঠিক স্যার। মুৎসুদ্দি বলল। বঁটি-টটি মেয়েদের ডিপার্টমেন্ট।
ঠিক তখনই একটা টেক্সট এলো অলোকের ফোনে। ভেবেছিলেন উর্বী মেসেজ পাঠিয়েছে। কিন্তু আদতে তা নয়। টেক্সট এসেছে ফরেনসিক স্পেশালিস্ট কমলেশ ভাদুড়ির ফোন থেকে।
ভাদুড়ির স্পষ্ট বক্তব্য, ইউ আর রাইট অলোক। খুনি মহিলাই হবে। কারণ আঘাতের ধরন ও গভীরতা প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি বঁটি দিয়ে কোপ মেরেছিল তার হাইট তত বেশি নয়। তাই সে খুব জোরে আঘাত করতে পারেনি। বঁটিখানা দেখতে পেলে আমি আরো নিশ্চিত হতে পারতাম।’
ভাদুড়ির পাঠানো শর্ট টেক্সট মেসেজ ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির সামনে তুলে ধরলেন অলোকেশ। দেখুন ইন্সপেক্টর, ফরেনসিক স্পেশালিস্ট কী লিখে পাঠিয়েছেন।
তার মানে মিস বেবির খুনি হিসেবে আমরা একজন মহিলাকেই খুঁজছি! ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি বললেন।
ইয়েস ইন্সপেক্টর। স্পটে পাওয়া চুল আর মিস্টার ভাদুড়ির অভিমত তাই বলে।

০৬.
এর ঠিক দেড়দিন পরে ধানমন্ডির চা-বারে বসে কথা হচ্ছিল।
ডিটেকটিভ অলোকেশ ছাড়া আরো আছে উর্বী আর ডক্টর কামরানের সহকর্মী নবনীতা।
মেলা ভ্যানতাড়ায় না গিয়ে অলোকেশ সরাসরি বললেন, দেখুন নবনীতা, আমরা বেবি খুনের ব্যাপারে আপনার হেল্প চাই।
মেয়েটা এমনিতে ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আছে। উর্বী নিশ্চয়ই তাকে সোজা রাস্তায় রাজি করাতে না পেরে শেষে পুলিশের ভয় দেখিয়েছে। দুই শ্রেণির মানুষ পুলিশকে ভয় পায়। এক যারা চরম অপরাধী, আর যারা খুব বেশি নরমসরম। নবনীতা দ্বিতীয় দলে পড়েছে। ওর আঙুলের ডগা কাঁপছে। উত্তেজনা কমাতে সে আঙুলে ভেলভেটি ওড়না জড়াচ্ছে।
প্লিজ নবনী, আপনি একদম ঘাবড়াবেন না। আপনার কোনো দোষ নেই আমি জানি। আপনি শুধু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন। অলোকেশ অভয় দিয়ে বললেন।
এবার একটু সহজ হতে পারলো নবনীতা। বলল, বলুন কী জানতে চান?
প্রথমের সম্পর্কের কথায় আসি। ডক্টর কামরানের সঙ্গে আপনার রিলেশন কেমন?
নরমাল। মাথা ঝাঁকায় নবনীতা।
আর কিছু? আমি কিন্তু জানি নবনীতা, কামরানের বাসায় আপনার নিয়মিত দাওয়াত থাকতো। যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক না হলে এমন কিন্তু সচরাচর হয় না! অমনি একখানা ডাউট দিয়ে বসলেন অলোকেশ। উর্বী কিছু বলছে না, সে শুধু কথা গিলছে।
ওর বাসায় আমি যেতাম মাঝে মাঝে। নিরুত্তাপ গলায় নবনীতা বলল।
এবার তাহলে বলুন, বেবির সঙ্গে ডক্টর কামরানের সম্পর্ক কেমন ছিল?
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যেমন থাকে।
কিন্তু অলোক নবনীর উত্তরে খুশি হতে পারলেন না। বললেন, শুধু এইটুকু? কিন্তু আমাদের কাছে খবর আছে, বেবির সঙ্গে ডক্টর কামরানের রিলেশন আদৌ ভালো ছিল না। কী মনে হয় আপনার, কামরান কি ভাড়াটে কিলার দিয়ে কাজটা করতে পারে!
তাতে শিউরে ওঠে নবনীতা। এসব কী বলছেন আপনি! কামরান ভাই মোটেও অমন লোক নয়।
এবার তাহলে বলুন, রমিজ কে হয় আপনার?
আমার কাজিন।
উর্বী অমনি চোখ মটকে বলল, সবটা খুলে বলুন নবনী। আমি তো জানি, রমিজ আপনার বিশেষ ভক্ত। এও জানি, খুব শিগগিরই সে আপনাকে প্রোপোজ করবে।
ব্যস, যেন জোঁকের মুখে নুন। একেবারে বাক্যহারা হয়ে যায় নবনীতা। সে হয়তো ভাবছে, রমিজের কথা জানা মানে কামরানের সঙ্গে নবনীর কী সম্পর্ক তাও জেনে গেছে উর্বী।
বলো না, খুলে বলো নবনী। চাপ দেন অলোকেশ। ভয় পেও না, খুনটা তুমি না করে থাকলে আমরা তোমাকে ফাঁসাবো না। কামরানের আরও কোনো অতীত আছে কিনা সেটা আমাদের জানা প্রয়োজন, বুঝলে!
কিন্তু মুখ খোলে না নবনীতা। ভাবখানা এমন যেন সে ভাঙবে, তাও মচকাবে না। ওদিকে নাছোড়বান্দা অলোকেশ। তার কেবলই সেই চুলের কথা মনে পড়ে। খুনি একটা মেয়ে বা মহিলা। এই অ্যাঙ্গেলে একটাই ভাবনা তার মাথায় আসে, ত্রিভূজ প্রেম। এমন একজন আছে, যে কিনা ডক্টর কামরানের জীবন থেকে তার স্ত্রী বেবির ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়। একেই বলে সেলফিশ প্রেম। খাবি খা, সবাই মিলেমিশে একত্রে খা!
বলো নবনীতা, তুমি ছাড়া কামরানের জীবনে আর কেউ আছে, বা ছিল কি? উর্বী তেতো গলায় বলল।
নবনী চুপ। সে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। ফলে অলোকেশের মনে সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়। এই মেয়ে এমন কিছু জানে যার সঙ্গে বেবি খুনের কোনো না কোনো সম্বন্ধ আছে।
বাস্তবে নবনীকে বেশ কিছুক্ষণ চাপাচাপি করেও কোনো লাভ হল না। কিছুক্ষণ পরে তার সেই কথিত কাজিন রমিজ এলো তার খোঁজে। তার মানে চা-বারে আসবার আগে রমিজকে সে ঠিকানা দিয়ে এসেছে। হয়তো এও বলেছে যে, এই সময়ের মধ্যে না ফিরলে তুমি আমাকে নিতে এসো।
রমিজ লোকটি বিশেষ ঘোড়েল। একে ঘেঁটে কোনো লাভ নেই। অলোক বুঝলেন। তিনি উর্বীকে ইশারা করলেন, চলো যাই। মিছে সময় নষ্ট করার মানে নেই। রিমান্ডে ছাড়া এই মেয়ে মুখ খুলবে না।
চা-বার থেকে বেরিয়ে ডিটেকটিভ অলোকেশ বললেন, উর্বী, চলো যাই।
কোথায়?
স্পটে। বেবি যেখানে খুন হয় সেখানে।
এখন! বিনা নোটিশে! উর্বী কিছুটা বিস্মিত হয়। এই অলোককে সে চেনে না। যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা ছাড়া অলোকেশ কিছু করেন না।
উর্বীর মালিকানাধীন পিংক-রঙ মোপেডে চড়ে কাটাসুরে বেবির বাড়িতে এলেন অলোকেশ। সবচে বড় ভুল এই যে, এ বাড়িতে কোনো সিসিটিভ ক্যামেরা বসানো নেই। তাহলে অন্তত জানা যেত, কে কে বাড়িতে ঢুকেছিল।
কী ভেবে অলোক বললেন, আচ্ছা উর্বী, আবার এমন নয় তো, খুনি এই আটতলা দালানেই কোনো এক ফ্ল্যাটে থাকে!
যাহ্! তাই আবার হয় নাকি? নাকচ করে দেয় উর্বী।
কেন হয় না শুনি? বরং তাতেই খুনির সুবিধা হয় বেশি। কেউ জানলো না, শুনলো না, কাজ করে ফেলল। ভুলে যেও না উর্বী, খুনি বেবির অচেনা কেউ নয়। কারণ, খুনিকে সম্ভবত সে নিজেই দরজা খুলে দেয়, বা দরজা খোলা ছিল।
রাইট। এই পয়েন্টটা তো আগে ভেবে দেখিনি। উর্বী সহমত ঘোষণা করে।
ভবনের মালিক থাকেন তিনতলায়। শরীফ সাহেব। ওরা দুজন সোজা মালিকের ফ্ল্যাটে গেলো। অলোকেশ বুঝতে পারছেন, এই কেসের আইও ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি ইনিশিয়াল কাজগুলো তেমন করেননি। খুনের সময় বেবি একাই ছিলেন বাসায়, তার কাজের মেয়ে টুসি আর মেয়ে বুলবুলি ছাদে ছিল বলে জানা যায়। সেক্ষেত্রে মুৎসুদ্দির উচিত ছিল আটতলা ভবনের সবগুলো ফ্ল্যাটের খোঁজখবর করা। কে বলতে পারে, এই ভবনেই হয়তো বেবির খুনি ঘাপটি মেরে আছে!
শরীফুল হক বয়স্ক মানুষ। অন্তত পঞ্চান্ন পার করেছেন তিনি। অলোকেশ নিজের পরিচয় দিয়ে এই ভবনের সকল ভাড়াটের তথ্য জানতে চাইলেন। প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও পরে ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তিনি সবার তথ্য দিতে রাজি হন। বেশির ভাগ চাকুরে, তিনজন ব্যবসায়ী, আর একজন আছে, কাঠবেকার।
চিলেকোঠায় কেউ থাকে? অলোকেশ মনে করে বললেন।
থাকে। ডক্টর কামরানের ড্রাইভার আবদুল।
ওহ! তার ফ্যামালি আছে? নাকি সে একলাই থাকে? উর্বী জানতে চায়।
আছে, আবদুলের বউ আছে। তবে সে নিঃসন্তান। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রী খিটিমিটি লেগেই থাকে। বাচ্চা না হবার জন্য তারা একে অপরকে দোষারোপ করে।
ভাড়াটেদের তথ্যসম্বলিত কাগজ পকেটে পুরতে পুরতে অলোক বললেন, এতবড় বাড়ি আপনার, সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাননি কেন? সিসিটিভি থাকলে এই খুনের কিনারা করতে মোটেও বেগ পেতে হত না। ডিএমপি’র নির্দেশনা আপনি শোনেননি?
কাঁচুমাচু মুখ করে থাকেন শরীফুল হক। তিনি বুঝতে পারছেন, এটা বেআইনি। ভবনের সিঁড়িতে ও মূল ফটকে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা বাধ্যতামূলক।
সিঁড়ির ডানদিকে ডক্টর কামরানের বাসা, এর ঠিক উল্টো দিকে বাঁ পাশের দরজায় নক করলেন অলোকেশ।
আবার এখানে কেন? বিরক্ত হয় উর্বী। তার যাবার তাড়া আছে। অথবা সে টায়ার্ড।
ওয়েট। প্রতিবেশীর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি।
এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। বয়স খুবজোর পঁয়ত্রিশ, বেশ স্মার্ট দেখতে।
সৌজন্য বিনিময় করে অলোকেশ বললেন, আমি বেবি খুনের কেসটা নিয়ে কাজ করছি। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
ওহ্ ফেলুদা! বলুন কী জানতে চান? স্মার্টলি বললেন ভদ্রমহিলা। তার নাম লিজা।
না না, ফেলুদা নয়, আমি অলোকেশ। দয়া করে একটু বলুন তো, ঘটনার দিন বিকেলে, এই ধরুন সাড়ে তিনটা বা চারটার দিকে কাউকে আপনি বেবির ঘরে ঢুকতে দেখেছেন!
উর্বী রাগে গজগজ করছে। এটা কোনো প্রশ্ন হল! কেউ কি নিজের ঘরের দরজা মেলে বসে থাকে, অন্যের বাসায় কে এলো বা গেলো তা দেখার জন্য! যত্তোসব উদ্ভট প্রশ্ন।
কিন্তু উর্বীকে চমকে দিয়ে লিজা বললেন, নাহ্ তেমন উল্লেখযোগ্য কাউকে দেখিনি, তবে…!
কী তবে, বলুন লিজা! অলোককে খুব আগ্রহী মনে হয়।
সেদিন আত্মীয়ের বাসায় আমার নিমন্ত্রণ ছিল। আমি সেজেগুজে বেরিয়ে যাবার সময় একজনকে দেখলাম। এক মহিলা। বয়স আমার মতোই। তবে খুব ‘ক্ল্যাসি’ বলে মনে হয়নি।
মহিলা! কে, কে বলুন তো? বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠলো অলোকের।
তাকে তো আমি চিনি না। আগে কখনও দেখিনি। লিজা বললেন।
আবার দেখলে চিনতে পারবেন? জেরার সুরে বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ।
তা হয়তো পারবো। ঘাড় নাড়লেন লিজা।
আচ্ছা, সেই মহিলাকে চোখে পড়বার মতো বা মনে রাখার মতো কোনো মার্ক বা চিহ্ন ছিল কি?
হুঁ। তা ছিল একটা। তার নাকের কাছে একটা সাদাটে দাগ দেখেছিলাম। শে^তি বা লেপ্রসি টাইপ অসুখ হতে পারে। আর তা না হলে হয়তো রান্নার সময় গরম তেল ছিটকে গিয়ে নাকের কাছে চামড়া পুড়েছিল।
লিজার অবজারভেশন দেখে চমকে যান অলোকেশ। ভদ্রমহিলা বেশ বুদ্ধিমান। বললেন তিনি।
ওটা বুদ্ধিমান নয়, বুদ্ধিমতী হবে। চাপাস্বরে বলল উর্বী। তার কণ্ঠে রাগ আর বিরক্তির যুগপৎ উপস্থিতি।
লিজাকে অজ¯্র ধন্যবাদ দিলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তিনি যেন টানেলের ওধারে হঠাৎ আলোর ফুটকি দেখতে পেলেন। ঘটনার কাছাকাছি সময় বেবির বাসার সামনে একজনকে দেখা গেছে। তিনি মহিলা। আবার বেবির খুনি হিসেবে তিনি একজন মহিলাকেই খুঁজছেন। আপাতত তার হদিস পাওয়া কঠিন। তবে এটুকু অন্তত জানা গেছে যে, সেই মহিলার নাকের কাছে শে^তীর মতো সাদা দাগ রয়েছে। লেপ্রসি অর অয়েল বার্ন।

০৭.
আরো দুটো দিন কাটলো।
এই কেসের সঙ্গে কেমন করে যেন পুলিশের এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা জড়িত হয়ে গেলেন। ফলে ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির উপরে এখন সীমাহীন চাপ রয়েছে। যেমন করেই হোক, বেবিখুনের রহস্য তাকে উদ্ঘাটন করতে হবে। সময় মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা।
দিকদিশে না পেয়ে প্রায় ক্যাঙারুর মতো ছুটতে ছুটতে অলোকের ডেরায় এলেন মুৎসুদ্দি।
স্যার, আমাকে বাঁচান। প্লিজ, সেভ মি! একই কথা বাংলা-ইংরেজি দুটো ভাষায় বলা মানে অবোধ বাঙালি চরম বিপদে পতিত হয়েছেন।
রিপোর্টার শুভ আর অলোক তখন চিঁড়েভাজার সাথে ডিমের ওমলেট খাচ্ছেন আর যানজট নিয়ে গুরুতর আলাপ করছেন। সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টিও বাদ যাচ্ছে না। অলোক মনে করেন, অন্তত চল্লিশ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ পথচারী নিজে। এরা আইন মানার পক্ষে নয়, লাইসেন্সবিহীন চালকদের মতো এদেরও কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।
কেন, কেন, পথচারীরা আবার কী করলো?
কী করেনি তাই বল শুভ! দেখবি একশ্রেণির গাধা আছে, এরা ভুলেও ফুট ওভারব্রিজে উঠবে না, ডিভাইডারের উপর দিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হবে, তাতে তাদের মুষ্ক, মানে অ-কোষ ফাটুক কি কাটুক, কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাবখানা এমন যেন ওভারব্রিজের উপর পেরেক পোঁতা আছে, হাঁটলে পায়ে ফুটবে।
এমনকি, এই কাজে মহিলারাও পিছিয়ে নেই। গাড়ির সামনে দিয়ে তারা আরামসে দৌড়ে রাস্তা পার হয়, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে ছেলেমেয়েকে টেনে নিয়ে রাস্তা দিয়ে ছোটে। ইন ফ্যাক্ট, গাড়ি আসতে দেখলে এই শ্রেণির গর্দভের রাস্তার ওপারে যাবার ইচ্ছা আরো প্রবল হয়। এদের কাছে সবকিছুর দাম আছে, শুধু প্রাণের দাম নেই।
কেউ কেউ আবার হাত তুলে গাড়িকে থামতে বলে। না থামলে চোখ গরম করে। ভাবখানা এমন যেন, গাড়ি নয়, রাস্তা কেবল মানুষ পারাপারের জন্যে। যখনতখন যেখানে সেখানে। হাউ ফানি!
তা, কী শাস্তি দেয়া যায় অলোক? মজা করে বলল শুভজিত।
কিছুক্ষণ ভেবে অলোকেশ শেষে বললেন, ইয়েস, পেয়েছি। যারা ওভারব্রিজে না উঠে দৌড়ে রাস্তা পার হবে, তাদের ধরে অন্তত ছ’ঘণ্টা লোহার খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখতে হবে। সবাই তাকিয়ে দেখবে যেন, আইন ভেঙে খাঁচার মধ্যে শিম্পাঞ্জি আটকা পড়েছে।
হা হা হা! যা বলেছ গোয়েন্দা। দমফাটা হাসি হাসে রিপোর্টার শুভ।
আরো কতক্ষণ এই অলোচনা চলত কে জানে! ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি এসে পড়ায় ওদের যানজটসংক্রান্ত গুরুতর আলাপে ছেদ পড়লো।
ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির করুণ আর্তি অলোককে বিচলিত করে। তিনি কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, দেখুন ভাই মুৎসুদ্দি, বেবির কেসটা সত্যি জটিল। এখনও তেমন কোনো ব্রেক-থ্রু যাকে বলে, আসলে তা মেলেনি। এটুকু বুঝতে পারছি খুনি বেবির পরিচিত, এবং সে মহিলা। আপনি ডক্টর কামরানের কললিস্ট থেকে কি কিছু পেলেন?
নাহ্ তেমন কিছু নয়। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি।
আমার কাছে একটা তথ্য অবশ্য আছে, কিন্তু তত কাজের নয়। তবে আপনি খতিয়ে দেখতে পারেন। নিজে থেকে বললেন অলোকেশ।
কী? কী তথ্য, বলুন স্যার। জানেন তো, ডুবন্ত পিঁপড়ে যা পায় তাই আঁকড়ে ধরে। আমার হয়েছে এখন সেই দশা। বলুন প্লিজ।
শুনুন তাহলে। নড়েচড়ে বসলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। ঘটনার দিন বিকেলে বেবির বাসার সামনে একজন মহিলাকে দেখা গেছে। বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ, শ্যামাঙ্গী, মাঝারি হাইট, সবচে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল তার নাকের কাছে একটা সাদামতোন দাগ আছে। শে^তি বা আগুনে পোড়া দাগ বলে মনে হয়।
কী বললেন! দাঁড়ান, দাঁড়ান স্যার! অমনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন মোহাম্মদপুর থানার ইন্সপেক্টর আরমান মুৎসুদ্দি।
শুভ অবাক হয়ে দেখলো, ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির কথামতো উঠে দাঁড়ালেন ডিটেকটিভ অলোকেশ।
তাতে মুৎসুদ্দি তুতুলে গিয়ে বলল, স্যার, আমি মনে হয় তাকে দেখেছি।
কাকে! কোথায় বলুন তো! কে সে? উত্তেজিত অলোকেশও।
সে বেবির বাসার চিলেকোঠায় থাকে। ডক্টর কামরানের গাড়িচালক আবদুলের বউ। ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি ঘর্ঘরে গলায় বলল।
তাতে খানিকটা দমে যান ডিটেকটিভ অলোকেশ। অংকটা প্রায় মিলে গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ ফরমুলাটা কেমন যেন উল্টে গেল। অলোক বললেন, দিলেন তো ছাই গরমভাতে জল ঢেলে! ড্রাইভারের বউ বেবিকে মারতে যাবে কেন! মোটিভ কী?
কিন্তু ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি সমানে ফুটছেন। মোটিভ আছে স্যার, থাকতে পারে। মানুষের মন বড়ই আজব। মনে মনে কে কী ভাবছে, কে বলতে পারে!
ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি তখনই একটা কাজ করলেন। ডক্টর কামরানকে ফোনে বললেন এক্ষুনি যেন তিনি তার ড্রাইভারকে সিটি হাসপাতালে এনে রাখেন। আবদুলের সঙ্গে কথা আছে। জরুরি বাত।
কী কথা স্যার? ফোনের ওপার থেকে ডক্টর কামরান শুধোলেন।
আছে আছে, কথা আছে। প্রায় ধমকের সুরে ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি বললেন, আর কোনো প্রশ্ন নয়, আমি যা বলছি তাই করুন ডক্টর। রাইট নাউ।
তখন বিকেল মরে গিয়ে প্রায় সন্ধ্যা। ইন্সপেক্টর বললেন, আপনারাও চলুন স্যার। আপনার কথা যদি ঠিক হয় তাহলে খুনির খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। কান টানলে মাথা আসে। আবদুলকে পেলে তার বউকে পাবো, আর সেই মহিলাকে পেলে খুনের মোটিভ কী, তাও জানতো পারবো স্যার।
শুভ’র দিকে তাকান ডিটেকটিভ অলোকেশ। কি রে, যাবি নাকি?
জো হুকুম জাঁহাপনা! চলুন তবে যাওয়া যাক। কুর্নিশের ভঙ্গি করলো শুভজিত।
অলোকেশ বুঝতে পারেন না, ড্রাইভারের বউ কেন তার মালকিনকে মারতে যাবে। হোয়াই!
***
সিটি হসপিটালের ক্যান্টিন, ধানমন্ডি। ধমক খেয়ে ড্রাইভারকে নিয়ে ওসির জন্য বসেছিলেন ডক্টর কামরান করিম।
ওরা যেতেই উঠে দাঁড়ান ডক্টর কামরান। বললেন, এই হল আবদুল। আমার গাড়িচালক।
ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি ড্রাইভারকে আগে থেকেই চেনেন, অলোক বা শুভ এই প্রথম দেখলো।
ব্যাটা আবদুল চোরের মতো মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কেসটা কী, খুলি কও তো আবদুল! মাঝারি গোছের ধমক দিলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি।
আবদুল চুপ।
কী হল, জবাব দাও। মুখে ঠুসি দিয়া থাকলে কাম হইবো না। কতা কইতে অইবো।
জি স্যার।
খুনটা কি তোমার বউ একলা করছে, নাকি লগে তুমিও ছিলা আবদুল? সরাসরি কাজের কথায় এলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি।
এসব কী কন ছার! আমার বউ ক্যান ম্যাডামরে খুন করবো? তার লাভটা কীসে!
তাইলে কে করছে? তুমি?
না, না ছার, আমি করি নাই। ঝগের বেগে মাথা নাড়ে ড্রাইভার আবদুল।
তাইলে কেডা? তোমার বউ? একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। এও এক কৌশল বৈকি। বারবার একই কথা বলতে বলতে একসময় মুখ ফসকে সত্যিটা বলে দেয় খুনি।
কিন্তু আবদুল তত কাঁচা পাবলিক না, ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি যেমনটি ভেবেছিলেন। ফলে তিনি তার কর্মপন্থা ঠিক করে ফেললেন। ফোনে কাউকে কিছু একটা নির্দেশ দিলেন।
আর অলোককে উদ্দেশ্য করে বললেন, চলুন স্যার, থানায় চলুন। ওখানে গিয়ে এককাপ কফি খাবেন। ডক্টরসাহেব, আপনিও চলুন।
কথায় বলে, বেদেয় চেনে সাপের হাঁচি। ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির মনের কথা বুঝে নেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। শুভকে নিয়ে তিনি গাড়িতে উঠে বসলেন। গন্তব্য এখন মোহাম্মদপুর থানা।
ওরা গিয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই আরেকটা গাড়ি এসে থানা কম্পাউন্ডে ঢুকলো। দুজন লেডি কনস্টেবল সেই মহিলাকে ধরে নামালো, যার নাকের ঠিক ডান পাশে সাদা দাগ, দেখে শে^তি বলে ভ্রম হয়। লেপ্রসি।
ওই তো, তোমার স্ত্রী এসে গেছে আবদুল। এবার কবুল করো, কীভাবে, আর কেন তোমরা কাজটা করলে! ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি মোলায়েম গলায় বললেন, যেন বিয়ে উপলক্ষে পাত্র দেখা চলছে।
বউকে দেখে হকচকিয়ে যায় আবদুল। ওর সেই প্রতিক্রিয়াটুকু লক্ষ্য করলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। তার মানে ঠিক সময় ঠিক লোকেদের সঙ্গেই আছেন তারা। বেবি খুনের কেসের কিনারা কিছু হবেই।
চোখের ইশারা করলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। কনস্টেবলরা আবদুলের বউ রোকসানাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। তাকে আলাদা রুমে নিয়ে রাখা হল।
আবদুল মোটে ভাঙছে না দেখে অলোক আর ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি এবার তার বউকে নিয়ে পড়লেন।
বলুন তো, কাজটা আপনি কেন করলেন? মালকিন বেবি আপনার কী এমন পাকাধানে মই দিয়েছিল? বলুন, বলুন, একদম সময় নষ্ট করবেন না। ঘাঁউ করে উঠলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি।
মহিলা চুপ। সে ঘাড় গোঁজ করে বসে আছে।
কী হল! কথা সরছে না কেন মুখে! মারবো নাকি এক থাপ্পড়? ইন্সপেক্টর বললেন। তিনি ইশারা করতেই দুজন লেডি কনস্টেবল মহিলার দুটো হাত পেছনে এনে মৃদু মোচড় দিল। অমনি ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে আবদুলের বউ রোকসানা।
ডিকেটিভ অলোকেশ এবার তার খেলা দেখালেন। খুক খুক কেশে বললেন, দেখো রোকসানা, চুপ থেকে লাভ নেই, তোমার কা-কীর্তি সব তোমার স্বামী আবদুল অলরেডি ফাঁস করে দিয়েছে। কাজটা যে তুমি একাই করেছ, তাও কিন্তু সে বলেছে। তোমার পাপের ভাগ সে নেবে না, বুঝলে!
বোকা মহিলা!
অলোকের কথা শুনে সে অমনি ফুঁসে উঠলো।
তা তো সে কবেই। শয়তান ছুঁচো একটা! মালকিন মারা গেলে তার পেয়ারের নাগর আর কই পাইবো? অর কারণেই তো…! কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় রোকসানা। হয়তো সে হুঁশে ফিরে আসে।
কী হল? বলো বলো। ঠুস কইরা কয়া ফেলাও রোকসানাবিবি! আমারে কষ্ট যত কম দিবা, তত তোমার লাভ। কামডা যে তুমিই করছো, তা কি আর আমি জানি না! আবদুলের ভাষা নকল করে বললেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি।
একটু থেমে ইন্সপেক্টর আবার বললেন, তাছাড়া একজন তো তোমারে দেখছেও। তোমার নাকে সাদা দাগ, তোমার চুলে রক্ত। দেখে নাই ভাবছো! অন্যায় করলে তার কিছু না কিছু চিহ্ন থাকবোই।
ওদিকে লেডি কনস্টেবল পিছমোড়া করে ধরা হাতে ক্রমশ চাপ বাড়ায়। তাতে কঁকানি বাড়ে রোকসানার। শেষমেশ সে খোলা কলের মতো গলগল করে সব উপড়ে দেয়।
‘মারুম না ক্যা, কন তো দেহি! ওই মালকিনের লাইগা আমার আবদুলে দেওয়ানা হয়া গেছে। তার মতোন সুন্দরী মাগি নাকি আর হয় না। তার চোখ সুন্দর, তার বুক সুন্দর, তার চুল সুন্দর, গতরের চামড়া সুন্দর, চলন-বলন সুন্দর। মালকিনের বেবাক সুন্দর। আর আমি? আমি নাকি বুড়া পানিতাল! এই কথা সওন যায়, আপনেই কন সাব!’
ব্যস, মোটিভ পরিষ্কার। নারী কেবল নারীর শত্রু নয়, এক নারী কখনও অন্যের প্রশংসা বা সৌন্দর্য সইতে পারে না। নিজের অজান্তে শত্রু ভাবতে শুরু করে। কিন্তু অলোক কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না, আবদুলের বউ রোকসানা কেন বেবিকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করলো! তাদের তো ক্লাস ভিন্ন।
ফিচেল হাসলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। স্যার, আপনারা ভদ্রলোক মানুষ। আপনারা জানেন না, মানুষ কত হারামি হয়! দিনভর চোর-গু-া-বদমাশ আর দুষ্টুলোক ঠেঙিয়ে বুঝতে পারছি মানুষ কত রকম হতে পারে! মানুষ, সত্যি, বিচিত্র এক প্রাণী! গিরগিটির চেয়েও বহুরূপী, স্যার।
এবার বলো রোকসানা, বেবিকে তুমি কী করে মারলে? মারবে বলে ঠিক করেই গিয়েছিলে? অলোক প্রশ্ন করলেন। এখনও তিনি মানতে পারছেন না, ড্রাইভারের স্ত্রী তার মালকিনকে জড়িয়ে নিজের গাড়িচালক স্বামীকে দোষারোপ করতে পারে! এ কোন্ জামানা আইলো রে!
রোকসানা চুপ। সে মনস্থির করেছে, সে আর কিছু বলবে না।
চুপ থাকলে কেমনে আইবো রুকু! কও, সবটা ভাইঙা কও। স্পটে তোমার মাথার চুল পাওন গেছে। তুমি তো ধরা! রামধরা যারে কয়।
অমনি ফুঁসে উঠলো রোকসানা। বলল, মালকিনের কৈ মাছের পরাণ। এককোপ খাইয়াও সে আমারে আটকাইতে গেছিল। চুল টানছিল মাথার। আমিও ছাড়ি নাই তারে। পরের কোপ মারলাম মাথায়। ব্যস, খেইল খতম। সে জায়গায় ব্রেক।
মহিলার কথা শুনে প্রায় হেসে ফেলল শুভ। একেই বলে ড্রাইভারের বউ। তাই সে বলল, জায়গায় ব্রেক। ব্রেক মানে গাড়িঘোড়ার ব্যাপার।
কথাবার্তা সব শেষ। হাঁক দিলেন ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। কই রে কামাল, আসো, হাতকড়া নিয়া আসো। রোকসানার হাতে চুড়ি পরিয়ে দাও। বলদা বেটি স্বামীরে সন্দেহ করে মালকিনরে কুপিয়ে মারলো। তাও আবার দিনেদুপুরে, মাছ কাটা বঁটি দিয়ে। মানে হয়!
নাটক শেষ। ডিটেকটিভ অলোকেশ বললেন, আমরাও যাই তাহলে, ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দি। পরে আবার কখনও দেখা হবে। বললেন বটে, তবে তার একটা কৌতূহল তখনও রয়ে গেল। তিনি মুৎসুদ্দির কানে কানে বললেন, চলেন তো দেখি, আবদুলের সাথে একটু কথা বলি।
কী কথা স্যার?
চলেন, আপনার সামনেই বলছি।
পাশের রুমে কাঠের বেঞ্চিতে বসে দুলছে আবদুল। সে খুনটা করেনি, তাই তার ভয় নেই। তাকে পেয়ে একটা অদ্ভুত কথা বললেন অলোকেশ। আচ্ছা আবদুল, তুমি কি তোমার বেবি ম্যাডামকে সত্যি সত্যি ভালোবাসতে?
সব্বাইকে চমকে দিয়ে আবদুল বলল, জে স্যার। বাসতাম। অনেক।
তোমার কি চাকরির মায়া নাই? ফের বললেন ডিটেকটিভ অলোকেশ।
না, নাই। অমন মেয়ের জন্যি আমি জেবন দিতি পারি।
এরপর আর কথা চলে না। বড় অদ্ভুত এই মানবজনম! জীবন তো একজনের গেলই। তবে ড্রাইভার আবদুলের নয়, তার মালকিন বেবির।
বিদায়বেলায় মুৎসুদ্দি বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। এই কেসের আপনিই মহানায়ক। স্পটে মেয়েদের চুল না পেলে, আর পাশের বাসার ভদ্রমহিলার কাছ থেকে রোকসানার খোঁজ না নিলে এই কেসের কিনারাই হত না। সো ইউ আর দ্য বস!
অলোকেশ হাসলেন। কেসের কিনারা করতে গেলে কপালও লাগে। সবসময় বুদ্ধিতে কুলোয় না।
রোকসানা, তোর কপাল খারাপ, তাই তুই ফাঁইস্যা গেলি।
ইন্সপেক্টর মুৎসুদ্দির সাথে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে এলেন অলোকেশ। সত্যি, বড়ই বিচিত্র প্রাণী এই মানুষ! এরা ভালোবেসে মরতে জানে, আবার মারতেও।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন