বিজ্ঞাপন

প্রত্যাশা পূরণ হয়নি পোশাক শ্রমিকদের, শঙ্কায় মালিকেরাও

January 14, 2019 | 11:51 pm

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: নতুন করে সমন্বয় করা বেতন কাঠামোতেও পোশাক শ্রমিকদের প্রত্যাশার পরিপূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, নতুন সমন্বয় করা এই বেতনও জীবনযাত্রার সঙ্গে  অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ওপরের গ্রেডের চেয়ে নিচের গ্রেডে বেতন কম বেড়েছে। এদিকে শ্রমিক নেতারা বলছেন, প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি। তবে যেটুকু বাড়ানো হয়েছে, তা মেনে নিয়েই সবার কাজে যোগ দেওয়া উচিত। তাদের মতে, সোমবারই (১৪ জানুয়ারি) আন্দোলন প্রশমিত হয়ে গেছে। আর তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন (বিজিএমইএ) বলছে, সমন্বয় করা বেতনে পোশাক খাতের টিকে থাকা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শ্রমিক, বায়ার ও সরকারসহ সব মহলের সহযোগিতায়ই কেবল টিকে থাকতে পারে দেশের অর্থনীতির প্রধান এই খাত।

প্রসঙ্গত, আন্দোলন-বিক্ষোভের মুখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঘোষিত পোশাক শ্রমিকদের জন্য গঠিত নতুন বেতন কাঠামোয় ১৩ জানুয়ারি পরিবর্তন আনা হয়েছে। সপ্তম গ্রেড বাদে বাকি ৬টি গ্রেডেই নতুন করে সংশোধন এনেছে সরকার। দাবির মুখে বেড়েছে মূল ও সর্বমোট বেতনও। গ্রেডভেদে সর্বনিম্ন বেতন বেড়েছে ১৫ টাকা,  সর্বোচ্চ ৭৮৬ টাকা।

আরও পড়ুন- পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয়, ৭ম গ্রেডে বেতন বাড়েনি

বিজ্ঞাপন

এদিকে, সপ্তম গ্রেডের মজুরি ৮ হাজার টাকাই রাখা হয়েছে, যা ন্যূনতম মজুরি হিসেবে বিবেচিত। ২০১৩ সালের কাঠামোতে সর্বনিম্ন গ্রেডে বেতন ছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা। অর্থাৎ কোনো শ্রমিক বর্তমানে পোশাক খাতে প্রবেশমাত্রই আগের চেয়ে ২ হাজার ৭০০ টাকা বেশি বেতন পাচ্ছেন। আর সমন্বয়ের পর প্রথম গ্রেডে ২০১৩ সালের চেয়ে বেতন বেড়েছে ৫ হাজার ২৫৭ টাকা এবং ২০১৮ সালের কাঠামো থেকে বেতন বেড়েছে ৭৪৭ টাকা। দ্বিতীয় গ্রেডে ২০১৩ সালের চেয়ে বেতন বেড়েছে ৪ হাজার ৫১৬ টাকা ও ২০১৮ সালের তুলনায় ৭৮৬ টাকা। তৃতীয় গ্রেডে সমন্বয়ের পর বেতন বেড়েছে ২৫৫ টাকা ও ২০১৩ সালের তুলনায় ৩ হাজার ৪০ টাকা। ২০১৩ সালের তুলনায় চতুর্থ গ্রেডে বেতন বেড়েছে ২ হাজার ৯২৭ টাকা ও সমন্বয়ের পর বেড়েছে ১০২ টাকা। পঞ্চম গ্রেডে সমন্বয়ের পর বেতন বেড়েছে ২০ টাকা ও ২০১৩ সালের তুলনায় ২ হাজার ৮৩৩ টাকা। চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডে আগের কাঠামোর তুলনায় বেতন বেড়েছে ১০২ ও ২৫৫ টাকা। ষষ্ঠ গ্রেডে সমন্বয়ের পর বেতন বেড়েছে মাত্র ১৫ টাকা আর ২০১৩ সালের চেয়ে ২ হাজার ৭৪২ টাকা। তবে ন্যূনতম বেতন কাঠামোয় সপ্তম গ্রেডে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

এর আগে, সরকার গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করে। নভেম্বরের শেষ দিকে বর্ধিত বেতনের গেজেট প্রকাশিত হয়। ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা ধরে ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, বছরের শুরু থেকে বর্ধিত কাঠামোয় বেতন পাবেন শ্রমিকেরা। তবে, নির্বাচনের আগে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কয়েকটি কারখানায় বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। নির্বাচনের পর নতুন বছরে বেতন পাওয়ার সময়ে গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন কারখানায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় নেমে আসেন শ্রমিকেরা। সরকার ও বিজিএমইএ-এর দাবি, এই আন্দোলনে তৃতীয় কোনো পক্ষের হাত ছিল। একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে শ্রমিকদের অসচেতনতাকে পুঁজি করেছে। তবে শ্রমিকরা বলে আসছিলেন, নতুন কাঠামোয় বৈষম্য রয়েছে। টানা আন্দোলনের মুখে বেতন কাঠামোর ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে শেষ মুহূর্তে (১৩ জানুয়ারি) ৬ টি গ্রেডেই সমন্বয় করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শ্রম আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছর পর পর মজুরি কাঠামো পর্যালোচনা করতে হয়। সে লক্ষ্যে নতুন মজুরি কাঠামো করতে গত বছরের ১৪ জানুয়ারি মজুরি বোর্ড গঠন করেছিল সরকার।

আরও পড়ুন- প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত

সমন্বয়ের পরও পোশাক শ্রমিকদের বেতন ‘খুব একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’ মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমন্বয়ের পর নিচের গ্রেডগুলোয় যে হারে বেসিক ও অন্যান্য সুবিধা বেড়েছে, তা ওপরের গ্রেডগুলোর তুলনায় কম। আমরা আগেও বলেছি, ২০১৮ সালের মজুরি কাঠামোয় শ্রমিকদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। নতুন করে সমন্বয়ের মাধ্যমেও যে তার খুব একটা প্রতিফলন ঘটেছে, তা নয়।’  তিনি বলেন, ‘ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, সমস্যাটি দ্রুতই চিহ্নিত করা গেছে। সমাধানেরও চেষ্টা করা হয়েছে। আন্দোলনে এবার সবার মাঝে নতুন যে বিষয়টির উপলব্ধি ঘটেছে, তা হলো, দক্ষ শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোয় আরও নজর দিতে হবে। ভবিষ্যতে অবশ্যই এই বিষয়টি আমলে নেওয়া হবে বলে আমরা মনে করি।’ সমন্বয়ের মাধ্যমে বেতন বাড়ানোর প্রকৃত তথ্য পোশাক শ্রমিকদের কাছে তুলে ধরতে সংশ্লিষ্টদের সভা-সেমিনার করা উচিত বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এখনো প্রকৃত মজুরি বাড়েনি উল্লেখ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘মজুরি কাঠামোয় সমন্বয়ের পরও সত্যিকার অর্থে প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। সংখ্যাগতভাবে মজুরি বেড়েছে ঠিকই, তবে এটি নামমাত্র।’ তার মতে, ‘মূল্যস্ফীতির সমন্বয় করে প্রতিবছর মজুরি বাড়ানো দরকার।’

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর সারাবাংলা’কে বলেন, ‘এই বৃদ্ধিটা খুবই সামান্য। এটি শ্রমিকদের কাজে আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যেটা বেড়েছে, সেটা মূল মজুরি। সবমিলিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আন্দোলনকে প্রশমিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে শ্রমিকদের কল্যাণ সেভাবে নিশ্চিত করা হয়নি।’

শ্রমিক নেতারা বেতন কাঠামোর সমন্বয়কে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। আগামীকাল থেকেই সবার কাছে ফিরে যাওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন তারা। টেক্সটাইল গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল সারাবাংলাকে বলেন, ‘মজুরি বাড়ানোর নামে বৈষম্যমূলক গেজেট করা হয়েছিল, সে কারণেই শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তারা হাতাশা থেকে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কোনোক্রমেই বেতন কমানোর সুযোগ নেই, কোনো আইনেও নেই, সেটা শ্রমিকরা মেনে নিতে পারেননি। সর্বশেষ সরকার উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতিতে শান্ত করার জন্য ন্যূনতম মজুরিতে যে সংশোধন এনেছে, এই সংশোধনটার মধ্যেও বেতন অনেক কম আছে, ঘাটতি আছে। কিন্তু তারপরে এটা মেনে নিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হবে, কাজ করতে যাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।’

আরও পড়ুন- পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়বে, থাকবে আরও কিছু সুখবর

এক প্রশ্নের উত্তরে অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল আরও বলেন, ‘যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেড়েছে, ওই হারে শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে শ্রমিকরা সংগঠিত নন। শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে যান, কেউ কাউকে চেনেন না। এই অবস্থায় যা হওয়ার, হয়েছে। আমরা মনে করি, এখন শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ অধিকার আদায়ের জন্যও ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত।’

সারাবাংলাকে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘শ্রমিকদের প্রতিবাদের মুখে প্রত্যেকটি গ্রেডে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।  আমাদের প্রত্যাশা ছিল, আরও বেশি। যেহেতু কিছু বেড়েছে, এখন সন্তুষ্ট হওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘এরপরও যদি কারখানায় শ্রমিকরা বেতন নিয়ে সমস্যায় পড়েন, তাহলে প্রথমে গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষকে জানান। এরপর বিজিএমইএ ও আমাদের জানান। কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে আমরা তা দূর করবো।’

বিজিবি মোতায়েন

এই শ্রমিক নেতা আরও বলেন, ‘আমার আশাবাদী সবাই কাজে ফিরে যাবেন। ক্ষোভ ও বিক্ষোভ অনেকাংশেই কমে গেছে। যারা এখনও আন্দোলনে আছেন, আশা করি, তারা আগামীকালই কাজে ফিরে যাবেন।’

শ্রমিক সংগঠন ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্সের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমন্বয়ের মাধ্যমে যে মজুরি বাড়ানো হয়েছে, এটা ঠিকই আছে। যে তিনটি গ্রেডে বাড়ানোর কথা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি গ্রেডে বাড়ানো হয়েছে। আমরা সবাইকে কাজে ফিরে যাওয়া আহ্বান জানিয়েছি। কয়েকটি কারখানা ছাড়া সব জায়গায় কাজ চলছে। আমরা আশা করছি, কাল থেকে সবাই কাজে ফিরে যাবেন।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক মন্টু বলেন, ‘মজুরি যদি ১০০ শতাংশ পর্যন্তও বাড়ানো হয়, তবু একটি পক্ষ সন্তুষ্ট হবে না। যেটুকু হয়েছে, এটা কম হয়নি। নতুন করে সমন্বয় করতেও প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।’

আরও পড়ুন- আজও সড়কে পোশাক শ্রমিকরা

জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করতেই আমাদের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সমন্বয়ের মাধ্যমে সেখানে আবারও বেতন বাড়ানো হয়েছে। আমরা আশা করি, এখন সবাই কাজে ফেরত যাবেন। কাজ কারার ক্ষেত্রে সবাই যদি ঠিকমতো সহযোগিতা করেন, বিদেশি বায়াররা এগিয়ে আসেন, তাহলেই এই ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকবে। না হলে হুমকিতে পড়বে পোশাক খাত।’

এক প্রশ্নের উত্তরে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘মজুরি সর্বনিম্ন ২ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ২০১৩ সালে যেভাবে সমন্বয় করা হয়েছে, এবারও সেভাবে করা হয়েছে। বেতন ১ হাজার ২০০ টাকার নিচে কারও বাড়ানো হয়নি। বেতন যদি বাড়ানো হয়, আমরা যদি দিতে না পারি, তাহলে বেতন বাড়িয়ে লাভ কী?’ আশুলিয়ার ৪টি কারখানা বাদে সব জায়গায় যেহেতু সবাই কাজে ফিরে গেছেন, বাকিরাও কাজে ফিরে যাবেন বলেও তিনি  আশা প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন-

সাভারে আজও রাস্তায় পোশাক শ্রমিকরা

পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ নিরসনে বৈঠক চলছে

পোশাক শ্রমিকদের কম বেতন যোগ-বিয়োগের ভুল: শ্রম প্রতিমন্ত্রী

সারাবাংলা/ইএইচটি/এমএনএইচ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন