Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে বেসরকারি খাত বিপদে পড়ে যাবে

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১২ জুন ২০২২ ২২:৫৯

ঢাকা: ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে ব্যাংক খাতে সরকার এত বিপুল অঙ্কের ঋণ নিলে সেটি বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমিয়ে দেবে এবং তাতে বেসরকারি খাত বিপদে পড়ে যাবে বলে মনে করছেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, সরকারের ব্যাংক খাত থেকে এত ঋণ নেওয়ার ফলে বেসরকারিখাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার প্রতি ব্যাংকগুলোর কম থাকবে। কারণ সরকার ব্যাংক থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নেবে। তাছাড়া বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারকে ঋণ দেওয়া ঝুঁকিমুক্তও। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ না দিয়ে সরকারকে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো উৎসাহিত হবে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় সংসদে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে রোববার (১২ জুন) সারাবাংলার সঙ্গে আলাপে এমন মন্তব্য করেন পিআরআই‘র নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। আলাপে প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে অভিমত তুলে ধরেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা ঘাটতি প্রাক্কলন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা মোট বাজেটের ৩৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এই ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়। এই লক্ষ্যমাত্রা চলমান ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় অনেক বেশি। এই অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।

বিজ্ঞাপন

প্রস্তাবিত বাজেটে এভাবে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ক্রমবর্ধমান পরিমাণে ঋণ নেওয়াকে দুইটি দিক থেকে বিপজ্জনক মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, প্রথমত, সরকারকে ঋণ দিলে ব্যাংকগুলো ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারবে। কারণ এই ঋণ খেলাপি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রভিশনও করতে হবে না। ফলে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ না দিলেও তাদের কোনো সমস্যা হবে না। এতে বেসরকারি খাত বিপদে পড়ে যাবে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে।

সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার দ্বিতীয় নেতিবাচক দিক তুলে ধরে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে বেসরকারি খাতে ঋণ দিয়ে থাকে। এখন ব্যাংকগুলো ৮ শতাংশ কিংবা সাড়ে ৭ শতাংশ সুদেও যদি সরকারকে ঋণ দেয়, তাহলেও তাদের লাভ হবে। কারণ সরকার ঋণ নিলে ঝুঁকি নেই। আর সরকারের ঋণ চাহিদা থাকায় বেসরকারি খাতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ মিলবে না। এতে ঋণে সুদের হার বেড়ে যেতে পারে। অনেক ব্যাংকই এই সুযোগ নিতে পারে।

চলতি অর্থবছরের তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার কারণে এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, বাজেটে সরকার বলছে যে এনবিআর থেকে প্রত্যক্ষ কর ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে বরাবরের মতো এবারও রাজস্ব ঘাটতি হবে। সেটি প্রতিবছরই হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। আর রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকলে যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, সেটি অর্জন করা সম্ভব হবে না।

প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এর জন্য বাজেটে ৮২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ রাখার কথা বলা হয়েছে। ভর্তুকির এই পরিমাণকে অপর্যাপ্ত মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটাও সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে বলে অভিমত তার।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশীয় পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সারে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেশি দেওয়া হয়েছে। ১০০ টাকা কেজি দরে সার কিনে ১৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যৌক্তিক হতে পারে না। সারে ভর্তুকির পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে আনা যেতে পারত। কারণ বর্তমানে কৃষক তার উৎপাদনে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন। এখন প্রতি মণ ধানের দাম ১২শ থেকে ১৩শ টাকা।

তবে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত বাজেটে চালের দাম বাড়িয়ে ১০ টাকা কেজির পরিবর্তে ১৫ টাকা করে ৫০ লাখ পরিবারের কাছে চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত সঠিক বলে তিনি মন্তব্য করেন। তার মন্তব্য, এই চালটা কেউ খেতে  পারেন না। চালের মান খারাপ হওয়ায় গরু-ছাগলকে খাওয়ানো হয়। দাম বাড়ানোর কারণে কিছুটা হলেও অপচয় কমবে।

তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ আরও বেশি আশা করেছিলেন বলে জানালেন পিআরআইয়ের এই নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, সামজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত ছিল। প্রতিবন্ধী ভাতা ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এটি ভালো হয়েছে। পাশাপাশি বয়স্ক ভাতা ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা করা হলে ভালো হতো। এখানে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেই চলত। তবে রেমিট্যান্স খাতে নগদ আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। রেমিট্যান্স খাতে সরকারের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি লাগছে। এই টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হলে বেশি কাজে লাগত।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশে পাচার করা অর্থ কর দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বাজেট প্রস্তাবনার ব্যাপক সমালোচনা করেছে। একই সমালোচনা করছেন আহসান এইচ মনসুরও। তিনি বলেন, ৭ থেকে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে আনার সুযোগ দেওয়াটা অনৈতিক। এ ধরনের সুযোগ দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পাশাপাশি এই সুযোগ কেউ কাজে লাগাবে বলেও মনে হয় না। মানুষ এতো বোকা না যে পাচার করা টাকা আবার দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।

চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি সমালোচনার বিপরীতে প্রস্তাবিত বাজেটের বেশকিছু ইতিবাচক দিকও দেখছেন আহসান এইচ মনসুর। এ ক্ষেত্রে সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদা কমানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়াকে ভালো উদ্যোগ বলে মনে করছেন তিনি। বেসরকারি খাতের জন্য দেওয়া সুবিধাগুলোর কারণেও দেশীয় শিল্প উপকৃত হবে বলে মত তার।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম দ্রুত বাড়ছে। এ অবস্থায় আমাদের বিলাসবহুল পণ্যের চাহিদা কিছুটা কমিয়ে আনা দরকার। আবার দেশীয় শিল্প সম্প্রসারণ ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এতে করে দেশীয় শিল্প উপকৃত হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। ফলে সরবরাহ বাড়বে। এই জায়গাগুলোতে বাজেট ভালো হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট করহার কমানোকেও সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন তিনি। বলেন, সব ধরনের কোম্পানির কর আড়াই শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।

ব্যক্তি আয়কর সীমা আগের মতোই ৩ লাখ টাকায় স্থির রাখতে বাজেট প্রস্তাবনার সমালোচনা করছেন অনেকেই। তবে বাজেটের এই প্রস্তাবনার পক্ষেই রয়েছেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ব্যক্তি আয়কর সীমা বাড়ানোর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক গড় আয়ের তুলনায় এখনো করমুক্ত ব্যক্তি আয়সীমা বেশি আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের তুলনায় তাদের করমুক্ত আয়সীমা বাংলাদেশের চেয়ে কম।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট আহসান এইচ মনসুর কেমন হলো বাজেট পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট পিআরআই বাজেট ২০২২-২৩ বাজেট প্রতিক্রিয়া

বিজ্ঞাপন

সাগরে লঘুচাপ, কমছে তাপমাত্রা
২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৩৩

ঢামেকে অভিযানে ২১ দালাল আটক
২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:২০

আরো

সম্পর্কিত খবর