বিজ্ঞাপন

ঐক্যফ্রন্টের ‘সরকারি চাকরির বয়সসীমা’য় বিশৃঙ্খলা বাড়ার শঙ্কা

December 19, 2018 | 7:42 pm

।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ২০১৮ সাল পুরোটাই কেটেছে সরকারি চাকরিতে প্রবেশে কোটার পক্ষ ও বিপক্ষের প্রশ্নে। প্রায় সারাবছর কোটাবিরোধী অবস্থানে রাজপথ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরব থাকায় অবশেষে ৩ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সব সরকারি চাকরি থেকে কোটা বিলোপ প্রস্তাব অনুমোদন দেয় মন্ত্রীসভা। এর পরেই আবার শুরু হয় কোটা পুনর্বহালের আন্দোলন। এই আন্দোলনগুলো স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে সরকারি চাকরির বাজারটার প্রতি কর্মপ্রার্থীদের মরিয়া প্রচেষ্টার কথা। সেই প্রচেষ্টার সূত্র ধরে এই দুই আন্দোলনের সঙ্গে সমান্তরালে চলে আরেকটি আন্দোলন—সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ থেকে উন্নীত করে ৩৫ বছর করার আন্দোলন।

আন্দোলনের মুখে একবার প্রস্তাবও উঠে বয়সসীমা ৩২ বছর করার। অবশেষে এই আন্দোলনের পালে বাতাস লাগে গত ১৭ ডিসেম্বর ঐক্যফ্রন্ট যখন তাদের ইশতেহারে ঘোষণা দেয়—পুলিশ ও সামরিক বাহিনী বাদে অন্য কোনো ধরণের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য কোনো বয়সসীমা থাকবে না। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন সীদ্ধান্ত সরকারি চাকরিতে আনবে আরও বিশৃংখলা, বাড়বে স্বজনপ্রীতি ও বিতর্ক।

কেন বয়সসীমা?

বিজ্ঞাপন

সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা রাখার মূল কারণ পুরো বিষয়টিকে একটি নিয়মের মধ্যে রাখা—বলেন, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরি। তিনি বলেন, ‘এখানে চাকরিতে শুধু প্রবেশই মূল কথা নয়। এখানে যারা কাজ করেন তাদের মূল কাজ রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যা একটি নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে আসে, ফলে এক একটি ধাপে তারা নিজেদের ক্ষেত্রটিকে বুঝতে পারে এবং এগিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের চাকরি ব্যবস্থাপনাটা এখনো সেই ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলের। চাকরির ক্ষেত্রে বয়সীমার বিষয়টিও তাদের তৈরি করে দেওয়া, যেটা আমরা এখনো অনুসরণ করছি।’

বয়সসীমা কেন ৩০ বছর, সেটাকে কেন ৩৫ বছর চাই?

বিজ্ঞাপন

সরকারি চাকরিক্ষেত্রে প্রবেশের যে বয়সসীমা ৩০ বছর তা পাকিস্তান শাসন আমলে ছিল ২৫ বছর। পরে দক্ষতার প্রশ্নে তা ২৭-এ উন্নীত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, সেশন জট, চাকরির পরীক্ষাগুলোর দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি কারণে ১৯৯১ সালে তা বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। তবে ৩০ বছরের পক্ষেও নয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ। তারাই মূলত ৩৫ বছর করার দাবিটা করে আসছে বহুদিন ধরে। এমনকি চলতি বছর অগাস্টে যখন ৩২ বছরে তোলার প্রস্তাব বিবেচনা করে সরকার, তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ৩২ নয় ৩৩ নয় ৩৫ বছরই করতে হবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা।

ঐক্যফ্রন্টের যুক্তি কী?

ঐক্যফ্রন্ট তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে বয়সসীমা তুলে দেয়ার বিষয়টি তুলে আনলে তা আলোড়িত করে দেশের প্রায় সব মহলের মানুষদের। সাংবাদিকদের একাধিক প্রশ্নের জবাবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরি জানান, পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোনো বয়সসীমা নেই। তাছাড়া বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কর্মসংস্থান মোট কর্মসংস্থানের খুব কম অংশ। তিনি আশা করেন, এতে বেসরকারি চাকরির প্রতিও তরুণদের আগ্রহ তৈরি হবে এবং বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রও বৃদ্ধি পাবে। এবং সরকারি কর্মক্ষেত্রও যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষ লোকের সন্ধান পাবে।

তরুণদের আশা তরুণদের হতাশা

বিজ্ঞাপন

ঐক্যফ্রেন্টের এই প্রস্তাবে একদিকে যেমন আশাবাদী তরুণরা তেমনি হতাশও অনেকে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী সারাবাংলাকে বলেন, যেহেতু আমাদের দেশের কাজে ঢোকা অনেকটা যুদ্ধ জয়ের মতোই এই ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নেওয়ার একটি সময় পাওয়া যায়।

কিন্তু ঠিক একই কারণে হতাশ তরুণরা। তাদের অনেকেই ভাবছেন অধিক বয়স পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ—সদ্য চাকরিবাজারে যুক্ত হওয়া তরুণদের জন্য সুযোগ সীমিত করে দিবে। এ ছাড়াও বার বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণে বাড়বে হতাশা এবং কমবে অন্য কর্মক্ষেত্রে ঢোকার আগ্রহ, যা সেই ক্ষেত্রগুলোর জন্যেও ক্ষতিকর হবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

বিশেষজ্ঞরা কী বলেন?

বিশ্বের অন্যান্য দেশে চাকরি ক্ষেত্রে বয়সসীমা না থাকার পক্ষে ঐক্যফ্রন্টের যুক্তিকে মেনে নিয়ে রাশেদা কে চৌধুরি বলেন, ‘এটা ঠিক যে অনেক দেশে চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমাটা নেই। তবে সব দেশেই চাকরি করার একটি উর্ধ্বসীমা আছে—যে সময়ে সবাইকে অবসরে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে তা কী হবে সেটা নিশ্চিত করা দরকার ছিল বলে তিনি মনে করেন। যদি তা না হয় তবে এটা একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে বলেও মত দেন রাশেদা কে চৌধুরি।

তবে ‘বিদেশের সরকারি চাকরিতে প্রবেশে’-এর যুক্তি মানতে রাজি নন সাবেক আমলা জিনাইদা ইরফাত। বাংলদেশ সরকারের সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া যায়, যারা সরকার ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন দিকের সন্ধান দেবে।’ এর জন্য সকল প্রবেশকালীন বয়সসীমা তুলে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই বলেই তার মত।

এই ক্ষেত্রে তিনি ১৯৮৪ সালে এরশাদের শাসন আমলে বয়সসীমা তুলে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের উল্লেখ করে বলেন, ‘সে বছর প্রায় ৬ শ ৫০ জন সরকারি আমলা নিয়োগ দিয়ে পরে গুণগত মান কম হওয়ায় এই পদ্ধতি আর পুনরাবৃত্তি করা হয় না।’

এসব ছাড়াও বয়সসীমা তুলে দেওয়ার এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে তা দুর্নীতিকে প্রভাবিত করবে বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের কর্মক্ষেত্রে ইতোমধ্যে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আছে এবং তা বন্ধ করা সব সময়ই কষ্টকর তাই এভাবে বয়সসীমা তুলে দিয়ে যে কোনো সময়ে কাউকে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, এটি কোনো বাস্তব সম্মত প্রস্তাব বলে মনে করছেন না তিনি।

সারাবাংলা/এমএ/এমআই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন