বিজ্ঞাপন

অটিস্টিক শিশুর জন্মে সব প্রশ্নের তীর মায়ের দিকেই!

April 2, 2019 | 5:17 pm

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: অটিস্টিক সন্তান নিয়ে সবচেয়ে বড় বিষয় যখনই এমন সন্তানের জন্ম হয়, তখন সেই মাকে পড়তে হয় হাজার প্রশ্নের মুখে। এই বাচ্চা এমন কেন করছে, ওর রাগ কেন বেশি, ওর কান্না কেন বেশি, ও খেলে না কেন, ও কথা শোনে না কেন- এসব প্রশ্নের তীর আসে মায়ের দিকেই— বলছিলেন দেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারহানা এ রহমান।

বিজ্ঞাপন

ফারহানা এ রহমানের দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ ফারদীন রহমান আদিত একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। যার বয়স গত ১৯ মার্চে ২২ হয়েছে।

ফারহানা বলেন, ‘একজন বিশেষ সন্তানের মায়ের অনেক স্ট্রাগল, অনেক। এটা আসলে বলে বোঝানো সম্ভব না। এটা প্রতিটি মায়ের পৃথক গল্প। আমি সহযোগিতা পেলেও এমন অনেক অটিস্টিক শিশু রয়েছে যাদের মা ছাড়া আর কেউ নেই। এমনকি অনেক বাবাও সহযোগিতা করে না, এটা আমাদের পরিচিতের মধ্যেই দেখেছি।’

কম্পিউটারে কাজ করছেন আদিত

গত ৩১ মার্চ মহাখালীর বাসায় বাসায় গিয়ে কথা হয় এই মা-ছেলের সঙ্গে। জানা গেল, আদিতের একটি বিশেষ গুণ; কেউ কোনো তারিখ বললে সেদিন কি বার সে বলে দিতে পারে। কৌতূহলী হয়ে বিজয় দিবস কত তারিখ জানতে চাইতেই আদিত বলে, ১৬ ডিসেম্বর। এবার ১৬ ডিসেম্বর কী বার জানতে চাইলে সে বলে, গ্রিন পাঞ্জাবি পরবো। ‘ঠিক আছে, কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর কি বার’, আবার মায়ের প্রশ্নে আদিত বলে, সোমবার।

বিজ্ঞাপন

এরপরই কথা হয় আদিতের মা ফারহানার সঙ্গে। প্রতিষ্ঠিত এই নারী শোনালেন তার প্রথম সন্তানের জন্মের পর থেকে তার পথ চলার গল্প, তার জার্নির পুরোটা। সেখানে রয়েছে কান্না, হাসি আর সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপ।

ছোটবেলায় আদিত, বাবার সঙ্গে (ডানে)

 

বিজ্ঞাপন

কবে জানতে পারলেন আদিত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু জানতে চাইলে ফারহানা বলেন, ‘জন্মের পর সে ভালোই ছিল। ১৫ মাস বয়স পর্যন্ত অস্বাভাবিকতা ছিল না। দেখতে ছিল ফুটফুটে একটা বাচ্চা, যৌথ পরিবারে সে ছিল একমাত্র ছেলে। আদরের কমতি ছিল না, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি, এই বাচ্চার এমন সমস্যা হতে পারে। বাবা, কোক, কাক এসব বলতে পারতো। কিন্তু ১৮ মাস বয়সে সব কথা বন্ধ হয়ে গেল। পেছন থেকে ডাকলে শুনতো না, সবার সঙ্গে খেলে না। ওর অ্যাবনর্মালিটি সেখান থেকেই শুরু। পরে ফের কথা বলা শুরু করলো তিন বছরের দিকে।’

সে দুষ্টুমি করতো কিন্তু চোখের দিকে তাকাতো না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আই কন্ট্যাক্ট ছিল না। তখন তো আমি জানতামই না, আই কন্ট্যাক্ট কত গুরুত্বপূর্ণ। তারপর চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হলো। প্রথম দেখাতেই চিকিৎসক বলে দেন আদিতের অটিজম আছে। কিন্তু সেসময় অটিজম কী জিনিস আমরা বুঝিনি। আর তখন সোয়াক কাজ করছে অটিস্টিক বাচ্চাদের নিয়ে। আমি তখন সেখানে গেলাম অস্টিস্টিক বাচ্চারা কেমন হয় সেটা দেখতে। কিন্তু তারা তখন আমাকে বাচ্চাদের দেখতে দেননি, যদিও পরে আমি তাদের সঙ্গে কাজ করেছি।’

মায়ের কোলে শিশু সৈয়দ ফারদীন রহমান আদিত

‘গুলশানের একটি প্রি স্কুলে আড়াই বছর ছিল আদিত। সে সারাদিন বাইরে ঘুরে বেড়াতো, কিন্তু সেটা আমাকে জানানো হয়নি। বাচ্চা যখন ছোট থাকে তখন আমরা অনেক কিছু ইগনোর করি। বাচ্চা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, টিফিন খাচ্ছে না-এগুলো দুষ্টুমি বলেই ছেড়ে রাখা হতো, কিন্তু আমি এসব কিছুই জানতাম না। বাসায় এলে দেখতাম, তার টিফিন খাওয়া হয়নি। অথচ সেটা আমাকে তাদের জানানোর দরকার ছিল’, বলেন তিনি।

ফারহানা বলেন, ‘পরে ওখান থেকে নিয়ে ২০০৩ সালে সোয়াকে দেওয়া হলো। সেটা ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। আদিত খুব পছন্দ করলো, অনেক কিছু শিখলো। তার খুব ভালো ইমপ্রুভ হলো। আমি ওকে নিয়ে যত না কাজ করেছি, আমার ছেলে আমাকে মোটিভেট করেছে তারও বেশি। ২৪ বছরের মা আমি তখন, কীইবা জানি। আসলে স্ট্রাগলটা শুরু থেকেই ছিল, কিন্তু বুঝিনি।’

বিজ্ঞাপন

মায়ের সঙ্গে ছোটবেলায় আদিত

ছেলেকে শেখানোর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ওকে রঙ চেনানোর জন্য এক সপ্তাহ ধরে বলে গেলাম কোনটা কি রঙ, কিন্তু সে আমার দিকে তাকায়ই না। আমি খুব ডিমোটিভেটেড হলাম। কতবার বললাম, সে একটাবারও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলো না। আমি দিলাম শেখানো বন্ধ করে। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে কম্পিউটার চালু করলে সেখানে উইন্ডোজের লোগোটা ঘুরছিল। তখন শুনি আদিত চেয়ারে বসে বসে বলছে, লু (ব্লু), লিয়েলো (ইয়ালো), রেড! ও যে শিখেছে, সেটা আমি তখন বুঝলাম। সেই যে রঙ নিয়ে খেলা শুরু, এখনো তার সেই নেশাটা রয়েছে।’

তিনি বলেন, এরপর সোয়াক ছেড়ে রেগুলার স্কুলে নিয়ে এলাম আদিতকে। সেখানে ওর সঙ্গে খুব বেশি জাস্টিস হয়নি। শিক্ষার্থীদের চেয়ে তাদের বাবা-মায়েরা খুব বেশি বিদ্রোহ করতেন। অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করতেন। কিন্তু ওই স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে আমরা খুব ঋণী। তিনি সেই বাবা-মায়েদের বলেছেন, ‘আপনার বাচ্চাদের রাখেন বা না রাখেন, এই বাচ্চা (আদিত) থাকবে’।

আদিতের ক্লাস টিচার ওর জন্য রিজাইন দিয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে জানিয়ে ফারহানা বলেন, ‘আসলে আমি কাউকে দোষ দেই না। এই সন্তান (অটিস্টিক) যে ঘরে থাকে না, তারা আসলে বোঝে না। বোঝে না, এসব বিশেষ সন্তানদের জন্য একটি পরিবারের সদস্যদের কী কী করতে হয়। তার বাবা-মা-ভাইবোন যারা থাকে, তাদের কিসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।’

তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, পরিবারে একটা অটিস্টিক শিশুর জন্ম হলে তার পুরো দায় এসে পড়ে মায়ের ওপর। এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবারের প্রতিটি সদস্য থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরে সব জায়গায় এই সন্তানকে নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। অথচ একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর সঙ্গে সঙ্গে জন্ম হয় একজন বিশেষ মায়েরও।’

কথা বলার সময় মায়ের সঙ্গে আদিত

ফারহানা বলেন, ‘আমার জার্নিটা খুব কঠিন ছিল। কঠিন ছিল এজন্য যে এরকম একটা বাচ্চার অ্যাকসেপটেন্স নেই, কিন্তু ও সবকিছু বুঝতেছে। ইট ওয়াজ টোটাল আনএক্সপেকটেড। পরিবারের সার্পোট যদি বলেন… মুখে অনেকেই সার্পোট দেবে, কিন্তু অটিজম বা এই ধরনের বাচ্চার সঙ্গে তার মায়ের ঘরের ভেতরের যে স্ট্রাগল সেই জায়গায় কেউ সার্পোট দেবে না। ওই জায়গাটা আমাকে ম্যানেজ করতে হয়েছে।’

যেকোনো ২ বছরের বাচ্চাকে টয়লেটে নিয়ে যেতে হয়, কিন্তু অটিজম আক্রান্ত বাচ্চারা কোথায় আলাদা, আদিতের সঙ্গে আমার স্ট্রাগলটা কী এইটা আসলে বোঝানো সম্ভব না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি, আমার স্ট্রাগলটা মানুষকে না দেখাতে। আদিত কারও করুণা নিতে পারতো না। ছোটবেলা থেকেই সে জায়গাটা এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। যার কারণে ভেতরে যতো সমস্যাই থাকুক আমরা চেয়েছি, বাইরের মানুষ জানবে আমরা খুব ভালো আছি।’

অটিজম আক্রান্ত বাচ্চাদের দেখলে আমরা দূরে যাই, কিন্তু তাদের দেখলে বরং কাছে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ফারহানা বলেন, ‘অটিস্টিক শিশুকে নিয়ে তৈরি রেইনম্যান ছবিটি আমি বারবার দেখেছি। আমি আসলে গত ২২ বছর ধরে একটা রেইনম্যানের সঙ্গেই আছি। এই মুভি যিনি বানিয়েছিলেন, তিনি কত ভাবে, কত কাছ থেকে অটিজমকে দেখিয়েছেন সেটা বলে শেষ করতে পারবো না। রেইনম্যান না দেখলে অটিজম বুঝতে আমার কষ্ট হতো। রেইনম্যান আমাকে অটিজম বুঝতে সহযোগিতা করেছে।’

আরও পড়ুন: 
অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার অর্জনে এগিয়ে আসার আহ্বান
আগামী বাজেটে ১৪ লাখ প্রতিবন্ধী শিশু আসবে বিশেষ ভাতার আওতায়

সারাবাংলা/জেএ/এমও

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন