বিজ্ঞাপন

‘চাকরিচ্যুত’ পোশাককর্মীদের চাকরি নেই কোথাও!

May 1, 2019 | 7:53 am

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘তিন দিন জেল খেটেছি। এখনও চাকরি হয়নি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। বাসা ভাড়া আটকে গেছে। অনেক গার্মেন্টেসে গিয়েছি। সারাদিন কাজ শেষে বিকালে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার পর জানানো হয়, আপনার চাকরি হবে না। আন্দোলনে জড়িত থাকায় আপনাকে ব্ল্যাক লিস্টেড (কালো তালিকাভুক্ত) করা হয়েছে। কোনো গার্মেন্টেসেই চাকরি হয় না। বাধ্য হয়ে এখন বাসায় বসে দর্জির কাজ করছি।’ কথাগুলো বলছিলেন সাভারের একটি কারখানা থেকে চলতি বছরের শুরুতে চাকরিচ্যুত হওয়া তৈরি পোশাক কর্মী কোহিনুর বেগম (ছদ্মনাম)।

বিজ্ঞাপন

গ্রেডিং বৈষম্যের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নারায়ণঞ্জের একটি কারখানা থেকে চাকরিচ্যুত পোশাককর্মী রোখসানা (ছদ্মনাম) কান্নাজড়িত কণ্ঠে সারাবাংলাকে বলেন, ‘খুব কষ্টে আছি। কোথাও চাকরি নিতে পারছি না। তিন মাস ধরে বেকার। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েছি। লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছি না। মেয়েটা এবার পঞ্চম শ্রেণি থেকে বৃত্তি পেয়েছিল। অথচ এখন স্কুলের খরচ ঠিকমতো দিতে পারছি না।’

কেবল কোহিনুর ও রোখসানাই নয়, সম্প্রতি গ্রেডিং বৈষম্যের আন্দোলনে অংশ নিয়ে চাকরি হারানো পোশাককর্মীদের বড় একটি অংশের অবস্থাই এমন। তারা সবাই এখন বেকার। চাকরি হারিয়ে রীতিমতো দিশেহারা তারা।

কোহিনুর ও রোখসানার মতোই আরেক পোশাককর্মী নোয়াখালীর ছন্দা (ছদ্মনাম)। আট বছর ধরে আদমজী ইপিজেডের র‌্যামি হোল্ডিং নামে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। এক সন্তানের জননী ছন্দার ওপরই পরিবারের দায়িত্ব ছিল।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলাকে ছন্দা বলেন, ৫ তারিখ (৫ জানুয়ারি) ছুটি হলো। পরদিন এসে দেখি, ঝামেলা চলছে। ৭ তারিখ (৭ জানুয়ারি) নোটিশ দিয়ে দিলো। ঝামেলার সময় সবাই ছিল। আমি আর আমার এক বন্ধু পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। আর এতেই চাকরি চলে গেল। এখন বকেয়া পাওনা দিতেও টালবাহানা চলেছে। অনেক জায়গায় গিয়েছি। ফ্যাক্টরি থেকে যা দেওয়ার কথা ছিল, এখনও তা দেওয়া হয়নি।

কোনো অজুহাত ছাড়াই সম্প্রতি একটি কারখানা থেকে ছাটাই করা হয় পোশাককর্মী রমজান আলীকে (ছদ্মনাম)। সিদ্ধিরগঞ্জের পিপিলন নিট অ্যাপারেল লিমিটেড নামের একটি কারখানায় কাজ করতেন তিনি। রমজান সারাবাংলাকে বলেন, জানুয়ারির ১০ তারিখ আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে, আপনারা আর আসবেন না। অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করেন। পরের দিন বকেয়া চাওয়ার পর ১৩ তারিখ থেকেই ফ্যাক্টরিতে আমাদের আর ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শ্রমিক নেতাদের জানিয়েও বকেয়া আদায় করা সম্ভব হয়নি।

বিজ্ঞাপন

চাকুরিচ্যুত কোহিনুর বলেন, ‘আন্দোলনে তো শুধু আমি না, সবাই ছিল। সারাদেশেই আন্দোলন হয়েছে। বেতন নিয়ে আমি শুধু প্রশ্ন করেছিলাম। সেই উত্তর না দিয়ে আমাকে মামলা দেওয়া হলো। এখন কোথাও চাকরি হয় না। এখনও অনেকেই জেলে আছেন। যারা জেল থেকে বের হয়ে এসেছে, তাদেরও নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’

তৈরি পোশাককর্মীদের নতুন মজুরি কাঠামোতে গ্রেডিং বৈষম্যের প্রতিবাদে গত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আন্দোলনে নামেন এসব পোশাককর্মীরা। শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ১১ হাজারের বেশি পোশাককর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুত কর্মীদের মধ্যে এখনও পাঁচ হাজারের বেশি বেকার আছেন বলে মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) সারাবাংলার কাছে দাবি করেছেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন।

এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। এটি যৌক্তিক দাবি। অথচ সেই আন্দোলনের জন্য এখন শ্রমিকরা জেল খাটছে। চাকরিচ্যুত হওয়াদের বড় অংশটিই এখনও বেকার। আমরা ধারণা করছি, এই সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি হবে।’

এদিকে, সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই আন্দোলকে কেন্দ্র করে ৫ হাজার শ্রমিককে আসামি করে প্রায় ৩৫টি মামলা হয়েছে। এছাড়া ১৬৮টি কারখানায় প্রায় ১০ হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তবে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ দাবি করে আসছে, চাকরিচ্যুত শ্রমিকের সংখ্যা কোনোভাবইে চার হাজারের বেশি নয়।

বিজ্ঞাপন

পোশাক খাতের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে কথা হয় কয়েকজন শ্রমিক নেতার সঙ্গে। শ্রমিক সংগঠন ইন্ড্রাস্ট্রি অল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন সারাবাংলাকে বলেন, চাকরিচ্যুতদের অনেকেই এখনও চাকরি পাননি। বিজিএমইএ’র ব্ল্যাক লিস্টে নাম থাকায় নতুন কোনো কারখানায় গেলে সেখানেও তাদের নেওয়া হয় না। এখনও অনেকেই চাকরির বাইরে আছে। আবার অনেককেই মামলা নিয়ে কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, নতুন কাঠামোতে যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে কোনো শ্রমিক ভালো নেই। সেই কথা বলতে গেলে বলপ্রয়োগ করা হয়। ন্যায্য দাবিতে কথা বললে ছাটাই করা হয়। ছাটাই করে সেই নির্দেশনা আবার আশপাশের কারখানাতেও পাঠানো হয়েছে। যারা চাকরিচ্যুত হয়েছে, তাদের অধিকাংশেরই এখনও চাকরি হয়নি।

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের অনেকেই ব্ল্যাক লিস্টেড (কালো তালিকাভুক্ত) করা হয়েছে। ভাঙচুরসহ রাজনৈতিক মামলা দেওয়ায় যারা ব্ল্যাক লিস্টেড হয়েছে, তারা অমানবিক জীবনযাপন করছে।

চাকরিচ্যুত পোশাককর্মীদের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সারাবাংলাকে বলেন, শ্রমিকেরা যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছিল এবং পরবর্তীকালে যে মজুরি কাঠামো সমন্বয় করা হলো তাতে বুঝা গেল, তাদের দাবি যৌক্তিক ছিল। মজুরি কাঠামোতে যে ত্রুটি ছিল, তা সংশোধনের জন্যই ওই আন্দোলন ছিল। ফলে তাদের নামে মামলা দেওয়া এবং চাকরিচ্যুত করা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। আর শ্রমিকদের যে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তাও যথাযথ নয়।

ড. মোয়াজ্জেম আরও বলেন, বিজিএমএই যদি কোনো ডাটাবেজ করে থাকে, তাতেও তিন পক্ষের সমর্থন প্রয়োজন। বিজিএমইএকে এ বিষয়ে আরও সঠিক ও স্বচ্ছভাবে কাজ করা উচিত। কারণ ওইসব শ্রমিকেরা দোষী বলে এখনও প্রমাণিত নয়।

পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রতিনিধিরা অবশ্য শ্রমিক নেতাদের গণছাটাই ও কালো তালিকাভুক্তির তথ্য অস্বীকার করছেন। বিজিএমইএ’র নতুন কমিটির সহসভাপতি এস এম মান্নান (কচি) সারাবাংলাকে বলেন, শ্রম আইনের বাইরে গিয়ে কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার সুযোগ নেই। শ্রম আইন এখন আগের চেয়ে অনেক আধুনিক। শ্রমিকরা এর মাধ্যমেই তার অধিকার আদায় করে নিতে পারে। এরপরও যদি কোনো মালিক  শ্রম আইন মেনে না থাকেন, তার বিরুদ্ধেও মামলা হতে পারে।

এস এম মান্নান (কচি) আরও বলেন, বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে শ্রমিকদের ব্ল্যাক লিস্টেড করার কোনো সুযোগ নেই। তা করাও হয়নি।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। আর ফ্যাক্টরিগুলো এত দূর দূরান্তে অবস্থিত যে একটি থেকে আরেকটিতে গিয়ে চাকরি নেওয়া খুব একটা সমস্যার নয়। যারা ভাঙচুর করেছে, তাদের নামে হয়তো মামলা হয়েছে। তবে কোনো নিরীহ শ্রমিককে হয়রানি করা হয়নি।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র নবনির্বাচিত সভাপতি রুবানা হক সারাবাংলাকে বলেন, বিজিএমইএ কাউকে কালো তালিকাভুক্ত করেনি। যাদের বিরুদ্ধে ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে, তাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আর সেই অধিকার কারখানার রয়েছে। যদি সেসব শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে এটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন