June 27, 2019 | 2:01 pm
ঘরকুনো মানুষের সমস্যা হলো তারা একবার প্রকৃতির স্বাদ পেয়ে গেলে আর ঘর ভালো লাগে না। বেশ কিছু বছর আগে একবার ছোট্ট একটা ছুটিতে দার্জিলিং যাওয়ার পরে এই ঘরকুনো ছেলেটা পাহাড়ের প্রেমে পড়ে যায়। এরপর থেকে পাহাড় তাকে টানে। প্রতি বছরই সে পরিকল্পনা করে এবার বেশ লম্বা ছুটি নিয়ে শুকনো, রিশপ বা রামতাংয়ের কোনো গ্রামে গিয়ে দুচার রাত কাটিয়ে আসবে। কিন্তু হয় না। ছুটি নেই অথবা যাবার সাথী নেই। একা ঘুরতে যাবার মজা হয়তো আলাদা, কিন্তু আমার বেড়াতে গেলে হই-হুল্লোড় ভালো লাগে।
মেঘ পিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলেই কুয়াশা হয়, ব্যকুল হলে তিস্তা
গানটা শুনলে মনে হয়—যাই না, একাই চলে যাই। ঝুম বৃষ্টিতে যখন নতুন বিয়ে করা কাপল, অবসর কাটাতে আসা পর্যটকের ভিড় থাকবে না। আমার মতো একা মানুষ যারা আরও একা হতে চায়, তারা থাকবে শুধু। পাহাড় বেয়ে ঢল নামবে, রাস্তা থাকবে বন্ধ, অফিস থেকে ১০-১৫ দিনের ছুটি নিয়ে চলে যাবো পাহাড়ে। অথবা খুব ঠান্ডা যখন হবে, পাহাড়ের কালো মাটি আর কালো থাকবে না, হয়ে যাবে সাদা ধবধবে স্বর্গের দরজার মতো, তখন এক কাপ চা বা কফি হাতে কোনো একটা হোটেল রুম থেকে সাদা দৈত্যটার দিকে চেয়ে থাকবো।
যাই হোক, গত বছর থেকে আবারও দার্জিলিং যাওয়ার পরিকল্পনা করে যাচ্ছি। কিন্তু ছুটি মিলছে না। মন খুব খারাপ। দার্জিলিংয়ের পর ভূটান যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেললাম। এক্সেল-এ, ওয়ার্ড-এ আইটেনারি ও তৈরি। বেশ কয়েকজন জানালো যে তারাও যাবে। কিন্তু ছুটিটাই মিলছে না। মন খুব খারাপ। ঠিক এর মাঝখানে সিকিমের দরজা বাংলাদেশিদের জন্যে খুলে দেওয়া হলো।
আহা বরফ! সাদা সাদা বরফ পাহাড়ের খাঁজে-ভাঁজে পরে আছে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে একদল মানুষ বরফ নিয়ে খেলছে! ফেসবুকে মানুষের এমন সব ছবি দেখি আর আমার মনটা হুহু করে ওঠে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত চলে আমার ছুটি নিয়ে যুদ্ধ। ভিসা রেডি রাখি। আমার অনেক সহমকর্মী এর মধ্যে দুইবার করে ভারত ঘুরে চলে আসে যাদের ভিসা আমার পরে রেডি হয়। এমনকি তাদের ভিসার সময় আমি সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু আমারই ছুটি মেলে না।
শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত সেই ছুটি মেলে এপ্রিলের ১৫-১৭ তারিখ। সঙ্গে ১২ থেকে ১৪ এপ্রিলের সরকারি ছুটি মিলে মোট ছয় দিনের ছুটি। কিন্তু এবার অন্য সমস্যা দেখা দেয়। ভ্রমণসঙ্গী মাত্র একজন। এদিকে সিকিমের যত রিভিউ পড়ি, সবাই বলে ৬-৭ জন হলে ভালো হয়। ফেসবুকে পোস্ট করি এই ToB তেই। কয়েকজন সাড়া দিলেন। রাকিব ভাই নামে একজন তো পুরো ছয়জনের গ্যাং নিয়ে আমাকে বল্লেন সঙ্গে যেতে। আমি ও রাজী। যাক এবার তাহলে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে!
কিছু জরুরি বিষয়
এদিকে আমি সৌন্দর্য বর্ণনায় একদমই অপটু। সুন্দর কোনো জায়গায় গেলে হা করে তাকিয়ে থাকা পর্যন্তই পারি। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় না গিয়ে আমি ভ্রমণের দিনক্ষণ অনুযায়ী কিছু তথ্য দিতে চেষ্টা করবো-
রাত ১: (১১ই এপ্রিল)
যাওয়া নিয়ে কোনো চাপ নিতে চাচ্ছিলাম না, তাই ট্রেন বেছে নিলাম। রাত ৮টায় কমলাপুর থেকে ছেড়ে সকাল আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছানোর কথা। ট্রেন ঠিক ৮টায় ছাড়লো। টানা তিন দিনের ছুটি তাই সাধারণ বগীতে খুব ভিড়। আমাদের স্নিগ্ধা কম্পার্ট্মেন্টে টিকিট ছাড়া কোনো লোক না থাকায় ভিড় ছিল না। আপাতত আমি আর আমার কলিগ এই দুইজনই রওনা হলাম। একদিন পর আমাদের সঙ্গে রাকিব ভাইদের জয়েন করার কথা। উনারা এই ১১ তারিখের জনসমুদ্র এড়াতে একদিন পরে যাবেন।
দিন ১: রাত ২ (১২ই এপ্রিল)
ট্রেন যথারীতী লেট করে সকাল ৯টায় পঞ্চগড় পৌঁছালো। এর মধ্যে আমার সহযাত্রী মিতন ভায়ের দুই ফ্রেন্ড তাকে জানালো তারাও সিকিম যাচ্ছেন। কিন্তু তারা পঞ্চগড় আসছেন বাসে। আমি ভাবলাম, মোর দ্যান মেরিয়ার। তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে নেই। ভাগ্য ভালো যে আমরা যখন ট্রেন থেকে নামি, তারাও ঠিক সেসময়ই পঞ্চগড় পৌঁছান।
রেল স্টেশন থেকে বাংলাবান্ধা সীমান্ত বেশ দূর। বাসে প্রায় ২ ঘণ্টার কাছাকাছি লাগে যেতে। আপনারা স্টেশন থেকে অটোতে করে বাস স্টেশন এ চলে যেতে পারেন, সেখান থেকে প্রতি ১৫-২০ মিনিট পরপর তেতুলিয়া হয়ে বাংলাবান্ধার বাস পাবেন। আমরা ঢাকা থেকেই যোগাযোগ করে একটা মাইক্রো ঠিক করে নিয়েছিলাম দুজনের জন্যে। তবে মিতন ভায়ের ফ্রেন্ডরা চলে আসায় আমরা চারজন মাইক্রোতে করে চলে আসলাম মাত্র ৪০ মিনিটে।
এখানে সব খাপছাড়া বর্ডারে। কোন রুম থেকে কোন রুমে যাবে, কেনো যাবেন সেটা খুবই ধাঁধাঁর মতো একটা ব্যাপার। আপনি ইমিগ্রেশনে সিল নিয়ে কাস্টমস ক্লিয়ার না করেও যদি বের হয়ে যান, বা ট্রাভেল ট্যাক্স না দিয়ে ও যদি বের হয়ে যান, কেউ যেনো আপনাকে আটকানোর নেই। কিন্তু টাকা কি দিলেন না দিলেন সেটা দেখার লোকের অভাব নাই। এখানে ক্যামন সময় লাগে তা খরচ এর হিসাব দিলে বোঝা যাবে। আমি খরচের হিসাবটা দেই।
যাই হোক ১০টা ৪৫ নাগাদ দুই পোর্টের কাজ শেষ করে আমরা টাকা ভাঙালাম, রেট এখানে খুব খারাপ। ৮১ টাকা করে পেয়েছিলাম বাংলা টাকা, আর ডলার নিলে ধরা খাওয়ার সুযোগ বেশি।
আরও পড়ুন,
সিকিমের দিন-রাত্রি: পর্ব-৩; সাঙ্গু ও কাটাওয়ের পথে
লেখক – ফিরোজ খান তুষার, পর্যটক
সারাবাংলা/আরএফ