বিজ্ঞাপন

ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নার, রোগীরা ছড়িয়ে বারান্দাতেও

July 28, 2019 | 10:40 pm

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সেবিকার (৩৫) বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করে কিশোরী ফারজানা (১৪)। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। তবে হাসপাতালে বেড পায়নি সে। ওয়ার্ডের ফ্লোরে রেখে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

মিরপুরের বাসিন্দা সেবিকা সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক কষ্টে এখানে স্থান পেয়েছি। লবিং করেও বেড পাইনি। ওকে (ফারজানা) নিয়ে অনেক টেনশনে আছি। সবার মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। কারণ ঘরে আমার ছোট একটি মেয়েও আছে। মেয়েটাকেও নিয়ে ভয় পাচ্ছি।’

ফারজানার মতোই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের মেঝেতে জায়গা হয়েছে মোহাম্মদপুরের সবুজের। তিনি জানান, ছয় দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। এখানে এসে ভর্তি হলেও সিট পাননি। তাই ফ্লোরেই আছেন।

বিজ্ঞাপন

ফারজানা ও সবুজ ওয়ার্ডের ফ্লোরে জায়গা পেলেও সেই সুযোগও পাননি কিশোরগঞ্জের রানা। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং করছেন তিনি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বারান্দায় স্থান হয়েছে তার। ছেলের বেডের পাশে বসে মা নাসিমা বলেন, বাচ্চা যখন অসুস্থ থাকে এর চেয়ে উদ্বেগের আর কিছু নেই। ছেলে অসুস্থ শুনেই ঢাকায় চলে এসেছি। ওর বাবাসহ পরিবারের সবাই খুব টেনশনে আছি।

ফারজানা, সবুজ ও রানার মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ভিড়ে এখন তিল ঠাঁই নেই রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে প্রতিটি ওয়ার্ডেই খোলা হয়েছে ডেঙ্গু কর্নার। তবু জায়গা হচ্ছে না রোগীদের। ওয়ার্ডের বেড আর ফ্লোর ছাড়িয়ে বারান্দায় জায়গা করে নিতে হয়েছে অনেককেই। মশা নিয়ে আতঙ্কে কেউ কেউ হাসপাতালের মধ্যেই মশারি টাঙাতে বাধ্য হয়েছেন। মশার এই আতঙ্ক রয়েছে হাসপাতালের সেবিকা ও ডাক্তারদের মধ্যেও।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, দলে দলে রোগীরা ভর্তি হলেও হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে তারা সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। হাসপাতালের নার্সসহ স্টাফদের কাছ থেকেও যথাযথ সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ তাদের। বরং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে রোগীর স্বজনরা রয়েছেন আতঙ্ক আর উদ্বেগে। রোববার (২৮ জুলাই) সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এই হাসপাতালেই ভর্তি পীরেরবাগের বাসিন্দা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী হৃদয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হৃদয়ের ভাই শ্রীবাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাঁচ দিন ধরে এখানে আছি। রিপোর্ট পেতে দুই থেকে তিন দিন চলে যায়। বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে রিপোর্ট করিয়ে আনতে হয়। সিস্টারদের ডাকলেও আসে না।’

ফাল্গুনী নামে রোগীর এক আত্মীয় সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালেও প্রচুর মশা। মশারি টানানোর ব্যবস্থা নেই। সেবিকাদের কাছে সাহায্য চাইলে তারা বিরূপ আচরণ করে।’

বিজ্ঞাপন

নোয়াখালী থেকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে এসেছেন আতাউর রহমান। তিনি আট দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। আতাউরের ভাই আমিনুল সারাবাংলাকে বলেন, গতকাল (শনিবার) রাতে এখানে এসেছি। সিট পাইনি। সেবার মান মোটামুটি। প্লেটলেট ঠিক থাকলেও ওর (আতাউর) হিমোগ্লবিন কমে গেছে। তিনি বলেন, এখানে যাযাবরের মতো আছি। বাড়ি নেই, ঘর নেই। টেনশনে আমাদের ঘুমও নেই।

কাঠমিস্ত্রি জহিরুল ইসলাম কেরানীগঞ্জ থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপতালে এসেছেন। তার বোন জামাই আবু হানিফ সারাবাংলাকে বলেন, কয়েকদিন হলো জহিরুলের জ্বর ছিল। গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম। টেস্ট করানোর পর বলেছিল, আরও অবনতি হলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। বাসায় নেয়ার পর জ্বর আরও বাড়তে থাকে। পরে শনিবার তাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করাই।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের নারী ওয়ার্ডগুলোতেও দেখা গেছে ডেঙ্গু রোগীদের ভিড়। অসুস্থ আনজুমানের স্বামী কামরুল বলেন, ওয়ার্ডের ফ্লোরে স্থান পেয়েছি। সিট পাইনি। গত পাঁচ দিন ধরে এখানে আছি। চিকিৎসা ও সেবার মান মোটামুটি।

মিরপুরের বাসিন্দা শাহীনা বেগম প্রায়ই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, এই হাসপাতালে এর আগে কখনো এত রোগী দেখিনি। বারান্দায় কখনো এত রোগীকে চিকিৎসা নিতে দেখিনি। যা দেখলাম, এখানকার সবাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

হাসপাতালের সেবা নিয়ে রোগী ও রোগীর স্বজনরা প্রশ্ন তুললেও হাসপাতালের কর্মীরা বলছেন, রোগীর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় তারা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহিলা ওয়ার্ডের একজন নার্স বলেন, ‘আমরা এখানে বসে আছি, এখানেও মশা। পুরো হাসপাতলজুড়েই মশা। আমরা নিজেরাও আতঙ্কে রয়েছি।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বর্তমানে ২১৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৩২ জন। এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭২৯ জন। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইলে এসএমএস দিলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

আইসিইউ সংকট

মহাখালীর বাসিন্দা মাহবুব হাসান সজীব (২৮) জ্বরে আক্রান্ত হলে প্রথমে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে (সাবেক আয়েশা মেমোরিয়াল) চিকিৎসা নেন। গত ২৪ জুলাই রক্ত পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু ধরা পড়লে ওই দিন রাতেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে তাকে ভর্তি না করে ডাক্তাররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। পরে ২৫ জুলাই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ফের ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে যান তিনি। সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, তাকে আইসিইউতে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সাধারণ বেড, কেবিন কিংবা আইসিইউ— কোনো সিটই খালি নেই।

সজীবের স্বজন হিমেল হিমু বলেন, ওই রাতে কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ বেশকিছু হাসপাতালে যোগাযোগ করেও আইসিইউ খালি পাওয়া যায়নি। পরে তাকে মিরপুরের ডেল্টা হেলথ কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চার দিন চিকিৎসা শেষ রোবাবার বাসায় ফেরেন ডেঙ্গু আক্রান্ত ওই রোগী।

সজীব সারাবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ দেখে এসেছি। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে না পারলে হয়তো আরও অবনতি হতো। ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, মেয়ররা ফুল দিয়ে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তার ফুল নিয়েই ব্যস্ত থাকুন। তারা এত বড় মানুষ, মশার মতো ছোট বিষয় নিয়ে কাজ করবেন কেন!

মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৫১ জন ভর্তি আছেন। রাত হতে হতে এ সংখ্যা হয়তো আরও বাড়বে।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সিট খালি না থাকায় অনেক রোগী এসে ফিরে যাচ্ছেন। তাই আমরা আরও ১০টি বেড বাড়ানোর চেষ্টা করছি।

ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী আরও বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তরা কিন্তু সারাবছরই চিকিৎসা নেয়। তবে এখন প্রকোপ বাড়ায় অনেকের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। রোগীরা যদি প্রথম দিকেই আসে, তাহলে হয়তো চিকিৎসা দেওয়া যায়। কিন্তু শারীরিক অবস্থা জটিল হলে তখন কিছু করার থাকে না। জ্বর হলে প্রথম দিন থেকেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মশা যেন কামড় না দেয়, সেজন্য ফুল স্লিভ জামাকাপড় পড়া উচিত। ঘরে মশকনিধক ওষুধ স্প্রে করা উচিত।

আরও পড়ুন-

ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে

ডেঙ্গু প্রশ্নে আগাম বার্তা আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ

ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, অবশেষে স্বীকার করলেন মেয়র

ছয় শিক্ষার্থী ডেঙ্গু আক্রান্ত, ঢাবির আইন বিভাগে পরীক্ষা স্থগিত

ডেঙ্গু: ঢাকা শিশু হাসপাতালে চালু হলো ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন