বিজ্ঞাপন

মানসিক বিপর্যয় থেকে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা, ধারণা শিমলার

September 12, 2019 | 6:05 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করতে গিয়ে কমান্ডো অভিযানে নিহত পলাশ আহমেদের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তার সাবেক স্ত্রী অভিনেত্রী শামসুন নাহার শিমলা।

বিজ্ঞাপন

তিনি জানিয়েছেন, আর্থিক ও পারিবারিক বিষয়ে পলাশের দেওয়া বেশকিছু তথ্য বিশ্বাস করে শিমলা তাকে বিয়ে করেছিলেন, যা পরে মিথ্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়। প্রতারণার শিকার হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে শিমলা তাকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পলাশ অংসলগ্ন আচরণ শুরু করেন। এমনকি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিনয়ও করেন পলাশ। বিচ্ছেদের আগে-পরে তিনি মানসিকভাবে বির্পযস্ত ছিল। বারবার চেষ্টা করেও বিচ্ছেদ ঠেকাতে না পেরে মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে পলাশ বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টার মতো ঘটনায় জড়িয়েছিলেন বলে ধারণা শিমলার।

বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়ায় সিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অফিসে আসেন শিমলা। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া শিমলাকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এসময় পলাশের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিমলা।

আরও পড়ুন- বিমান ছিনতাইচেষ্টা মামলা: অভিনেত্রী শিমলাকে জিজ্ঞাসাবাদ

বিজ্ঞাপন

রাজেশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে শিমলা জানিয়েছেন, বিয়ের আগে পলাশ আহমেদের দেওয়া বেশকিছু তথ্য বিয়ের পর অসত্য হিসেবে তার কাছে ধরা পড়ে। তখন দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এর একপর্যায়ে শিমলা নিজেই তাকে তালাক দেন। দূরত্ব তৈরির পর থেকেই পলাশ মানসিকভাবে বির্পযস্ত হয়ে পড়েন, যা বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টার ঘটনা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল বলে শিমলা দাবি করেছেন। তার এই বক্তব্য সঠিক কি না, আমরা তা যাচাই করে দেখব।’

শিমলাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহ শৈলকূপা সরকারি ডিগ্রি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর শিমলা স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। ১১ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট শিমলা এসময় চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানে গ্লোরিয়া জিনস নামে একটি কফিশপে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক রাশেদ পলাশের জন্মদিনের পার্টিতে পলাশ আহমেদের সঙ্গে শিমলার পরিচয় হয়। পলাশ তার নামি ‘মাহী বি’ এবং নিজেকে চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে পরিচয় দেন। পরিচয়ের কিছুদিন পর শিমলা নিজ থেকেই পলাশকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ২০১৮ সালের ৬ মার্চ তাদের বিয়ে হয়।

পরিচয়ের পর থেকে বিয়ে পর্যন্ত পলাশ ও শিমলা বিভিন্ন স্থানে দেখা-সাক্ষাৎ করেন এবং বেড়াতে যান। এসময় পলাশ শিমলাকে জানান, তার বাবা লন্ডনের বড় ব্যবসায়ী। তাদের পুরো পরিবার লন্ডনে থাকে। পলাশ নিজেও ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী নাগরিক। ঢাকার উত্তরায় তাদের বাড়ি আছে। নারায়ণগঞ্জেও তাদের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে।

বিজ্ঞাপন

দু’জনের পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ের পর পলাশ শিমলাকে নিয়ে বনানীর একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। এসময় শিমলা নারায়ণগঞ্জে পলাশের বাড়িতে যেতে চাইলেও পলাশ তাকে বাড়ি নিয়ে যাননি। এর আগে পলাশ বারবার শিমলাকে ডেকে চাপ দিতে থাকেন যেন সাংবাদিকদের ডেকে বিয়ের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ঘোষণা আর দেওয়া হয়নি।

সূত্রমতে, শিমলা বিয়ের আগ থেকেই ভারতের মুম্বাইয়ে আসা-যাওয়া করতেন। বিয়ের ১৫ দিন পর তিনি শুটিংয়ের কাজে মুম্বাই যান। পলাশ তাকে জানান, তিনিও লন্ডনে চলে যাবেন। শিমলা তাকে বনানীর বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও পলাশ রাজি হননি। মুম্বাইয়ে অবস্থানরত শিমলাকে ভিডিও কল করে একাধিকবার কথা বলেন পলাশ। এসময় নিজেকে লন্ডনে আছেন প্রমাণ করতে পলাশ ঢাকায় অভিজাত হোটেলে ওঠেন এবং ভিডিও কল করেন বলে পরে শিমলা জানতে পারেন বলে জানিয়েছেন পুলিশকে।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে শিমলা মুম্বাইয়ে ছিলেন। এসময় আকস্মিকভাবে পলাশও মুম্বাইয়ে পৌঁছান। মুম্বাই যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে পলাশ জানান, লন্ডনে যাওয়ার পথে ট্রানজিট হিসেবে তিনি মুম্বাইয়ে অবস্থান করছেন। কিন্তু তিন-চারদিন ধরে মুম্বাইয়ে অবস্থান করায় শিমলার সন্দেহ হয়। তিনি পাসপোর্ট দেখতে চাইলে পলাশ সেটা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। মূলত সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় সেখান থেকে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শিমলা দেশে ফিরেন। এসময় পলাশকে চাপ দিয়ে তিনি তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে যান। সেখানে গিয়ে পলাশের প্রতারণার বিষয়টি শিমলার কাছে স্পষ্ট হয়। নিজেকে প্রতারিত ভেবে হতাশ হয়ে পড়েন শিমলা। ধীরে ধীরে পলাশের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। সেটা সহ্য করতে না পেরে পলাশ অসংলগ্ন আচরণ শুরু করেন। সেপ্টেম্বর মাসের এক রাতে শিমলাকে অনেক অনুরোধ করে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে নিয়ে যান পলাশ। শিমলা গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পলাশ রাস্তায় ঢলে পড়েন। শিমলা বুঝতে পারেন, পলাশ ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিনয় করছেন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে শিমলা সেখান থেকে চলে যান। পরে পলাশের আচরণ মানসিক নির্যাতনে রূপ নিলে অক্টোবর মাসে শিমলা বনানী থানায় গিয়ে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। পুলিশ শিমলাকে মামলা করার পরামর্শ দেন।

বিজ্ঞাপন

তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে শিমলা দাবি করেন, পলাশকে ভালোবাসেন বলে তিনি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। কিন্তু দূরত্ব ঘোচাতে ও বিচ্ছেদ ঠেকাতে পলাশ রীতিমতো তার ওপর মানসিক নির্যাতন শুরু করেন।

সূত্রমতে, নভেম্বর মাসে শিমলা আবারও মুম্বাইয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে ৫ নভেম্বর পলাশকে তালাকের নোটিশ দিয়ে যান তিনি। এরপর পলাশ তাকে বারবার ফোন করে বিরক্ত করতেন। মোবাইলে মেসেজ দিতেন। কিন্তু শিমলা সাড়া দেননি। এরপর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুম্বাইয়ে থাকা অবস্থায় বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করতে গিয়ে পলাশ আহমেদের মৃত্যুর খবর পান শিমলা।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চলে যাওয়ার সময় শিমলা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি ডিভোর্স দেওয়ার পর সে (পলাশ আহমেদ) মেন্টালি ডিস্টার্বড ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। ঘটনা (বিমান ছিনতাইচেষ্টা) শোনার পরও আমার সেটিই মনে হয়েছে। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও সেটি বলেছি। এমনকি তদন্তেও তার মানসিক সমস্যার বিষয়টি এসেছে বলে আমি জানতে পেরেছি।’

ডিভোর্স কেন হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় কোনো কারণ ছিল, সেজন্য ডিভোর্স দিয়েছি। কিছু মানসিক সমস্যা ছিল পলাশের।’

এর আগে, ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট ময়ূরপঙ্খী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। বিকেলে ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পর পলাশ আহমেদ নামে এক যাত্রী ফ্লাইটটি ‘ছিনতাইয়ের উদ্দেশে’ বিভিন্ন ঘটনা ঘটান। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিমানটি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের পর সন্ধ্যার দিকে মাত্র ৮ মিনিটের কমান্ডো অভিযানে নিহত হন পলাশ এবং এই ছিনতাই কাণ্ডের অবসান ঘটে।

এ ঘটনায় নগরীর পতেঙ্গা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত প্রযুক্তি সহকারী দেবব্রত সরকার। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পতেঙ্গা থানায় দায়ের হওয়া মামলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০১২-এর ৬ ধারা এবং বিমান নিরাপত্তাবিরোধী অপরাধ দমন আইন, ১৯৯৭-এর ১১ (২) ও ১৩ (২) ধারায় পলাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। মামলায় নিহত পলাশ আহমেদ ও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়।

আরও পড়ুন-

শাহ আমানতে অস্ত্রধারী আটক

৮ মিনিটেই ‘পরাভূত’ উড়োজাহাজ ছিনতাইকারী

লাশ শনাক্তে চট্টগ্রামে নেওয়া হচ্ছে পলাশের বাবাকে

কমান্ডো অভিযানে উড়োজাহাজ ‘ছিনতাইকারী’র মৃত্যু

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে সন্ত্রাসীর কবলে বিমানের উড়োজাহাজ!

বিমান ছিনতাইচেষ্টাকারীর কাছ থেকে উদ্ধার করা ‘খেলনা পিস্তল’ জমা

কিভাবে উড়োজাহাজে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ, বলতে পারছেন না মন্ত্রী-সচিব

৪ মাস আগে তালাক দিয়েছি পলাশকে, এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে সিমলা

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন