বিজ্ঞাপন

৬ দিনই বাইরে প্র্যাকটিস তার, বিএসএমএমইউতে হাজিরা নামকাওয়াস্তে!

December 14, 2019 | 7:41 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ডেটলাইন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বি ব্লকের ৩/১৯ হুমায়ুন রোড। সময় শনিবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টা। সেখানে এ্যাডভান্সড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রীতিমতো চেম্বার বসিয়ে রোগী দেখছিলেন ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় তলায় ২০৬ নাম্বার রুমে একজন রোগী এসে জানালেন তার ব্যাকপেইন। চিকিৎসক তার প্রেশার ইত্যাদি মেপে ব্যবস্থাপত্র দিলেন। ওষুধ লিখে দিলেন অন্তত পাঁচ রকমের। অথচ এই চিকিৎসকের ভিজিটিং কার্ডে লেখা রয়েছে তিনি চর্ম ও যৌন রোগ নিয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং (পিজিটি) করেছেন। আর এমবিবিএস করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে। এছাড়া অপথালমোলজি (চক্ষু বিষয়ক)তে ডিপ্লোমা করেছেন।

এই চিকিৎসকের বিষয়ে নানা ধরনের অভিযোগের কথা জেনে রোগী সেজে চেম্বারে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক নিজেই। দেখতে পেলেন এখানে যেকোনও রোগ নিয়ে এলেই তাদের চিকিৎসা দিয়ে চলেছেন এই ডাক্তার। ভিজিটিং কার্ডে রয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি লোগো। তবে নেই কোনো সরকারি হাসপাতালের নাম বা পরিচয়।

এবার শুরু হলো অনুসন্ধান। জানা গেলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)’র একজন মেডিকেল অফিসার এই ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার। রয়েছেন কমিউনিটি অপথালমোলজি বিভাগে।

বিজ্ঞাপন

ঠিক যেসময়টিতে তিনি ডায়গনস্টিক সেন্টারে প্র্যাকটিস করছিলেন সেটি ছিলো বিএসএমএমইউতে তার অফিস আওয়ার।

এ্যাডভান্সড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ারের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র। এতে উল্লেখ রয়েছে, রোগী দেখার সময় শুক্রবার ছাড়া সব দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা।

দেশের সবচেয়ে বড় এই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানটি সপ্তাহে ছয় কর্মদিবস। একমাত্র শুক্রবার ছাড়া অন্য কোনও দিনে এখানকার কারো ব্যক্তিগত প্র্যাকটিস করার সুযোগ নেই, এমনটাই সারাবাংলাকে জানাচ্ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ পর্যায়ের একাধিক চিকিৎসক-কর্মকর্তা।

অথচ ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার সপ্তাহের ছয় দিনই দিনের অফিস আওয়ারে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এর মধ্যে পাঁচ দিনই বসেন এই অ্যাডভান্সড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। প্রতি বুধবার তিনি গাজীপুরের মাওনায় একটি চেম্বারে বসেন।

বিজ্ঞাপন

এই প্রতিবেদক যখন রোগী সেজে চেম্বারে যান তখন এসব চেম্বার ও প্র্যাকটিস শিডিউলের কথা নিজেই জানান ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার। তবে পরবর্তীতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হলে তিনি পুরোপুরি বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এদিকে, বিএসএমএমইউ’র একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মাসের অধিকাংশ দিনই হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকেন এই মেডিক্যাল অফিসার। অথচ সপ্তাহে ছয়দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত তার বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকার কথা।

১০ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে অন্য অনেক চিকিৎসক-কর্মকর্তাকে ব্যস্ত দেখা গেলেও ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার ছিলেন অনুপস্থিত।

সেদিন একটি ভিন্ন মোবাইল নাম্বার থেকে বেলা ১২টা ৪৩ মিনিটে ফোন করা হলে যে কথপোকথন হয় তা এখানে হুবহু তুলে দেওয়া হলো।

বিজ্ঞাপন

– আগামীকাল কী আপনি চেম্বারে থাকবেন স্যার?

ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার: আগামীকাল চেম্বারে থাকবো।

– বুধবার না স্যার?

ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার: হুম, আগামীকালও থাকবো।

– কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত পাবো আপনাকে?

ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার: কোথায়, কোন চেম্বারে? আমার তো তিনটা চেম্বার।

-স্যার অ্যাডভান্সেই দেখা করতে চাচ্ছি।

ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার: অ্যাডভান্সে বিকেলের পরে পাবেন।

– এর আগে যদি আসতে চাই তবে কোথায় আসতে হবে?

ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার: এর আগে আসতে হলে অ্যাডভান্স সেন্টারেই আসতে হবে।

– আমি ১১টা থেকে ১২টার দিকে আসতে চাচ্ছি। তখন কোথায় পাবো আপনাকে?

ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার: হুম ওই টাইমেও পাবেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)র কমিউনিটি অপথালমোলজি বিভাগের এই মেডিকেল অফিসার যে কোনওভাবেই তার অফিসে বসেন না, এবং অফিস ফাঁকি দিয়ে বাইরে প্র্যাকটিস করেন তা এসব বক্তব্যেই স্পষ্ট।

এমনকি রোগী সেজে যাওয়া এই প্রতিবেদককে যখন ব্যবস্থাপত্র দেন তাতেও উল্লেখ ছিলো- ‘সকাল ৮ থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত, শুক্রবার বন্ধ।‘

পরের দিন বুধবার দিন অবশ্য এই চিকিৎসককে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাওয়া যায়নি। দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছেন ওই দিন তিনি কিছু সময়ের জন্য হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অপথালমোলজি বিভাগে যান।

সূত্র জানায়, উনার বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে, এমন সংবাদ শুনেই তিনি ওই দিন কর্মস্থলে গিয়েছিলেন।

এবার প্রকাশ্য পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদক গত ১২ ডিসেম্বর ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে জানতে চান, বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বচলাকালে তার বাইরে চেম্বার করাটা কতটুকু নৈতিক?

উত্তরে বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি হাসপাতালের ডিউটি আওয়ারে বাইরে কোনো চেম্বারেই যাই না।

অভিযোগটি মনগড়া বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ছবিতে বিএসএমএমইউ’র ব্লেজার পরে অ্যাডভান্সড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেম্বারে চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার (বায়ে), ডানে হাতে ৫০০ টাকা ফি নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখছেন এই চিকিৎসক

ভিজিটিং কার্ডে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত রোগী দেখার সময় উল্লেখ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকেদের ভুল। আমি কলম দিয়ে প্রেসক্রিপশনে ঠিক করে দেই।

প্রেসক্রিপশনেও সকাল ৮টা থেকে ৩ টা রোগী দেখার সময় লেখা আছে, এমনটা বলা হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন।

এর আগে রোগী পরিচয়ে ফোন দেওয়া এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যেসব কথা হয়, সেগুলোও তিনি অস্বীকার করেন। অথচ সবগুলো কলই রেকর্ডেড এবং তাতে চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ারের কণ্ঠ রয়েছে।

এবার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে কথা বলা হলে তারাও বক্তব্য পাল্টিয়ে ফেলে। সেখান থেকে বলা হয়- ‘আসলে ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার এখানে বিকেলের সময়ে বসেন’।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ার মোটেই তার নিজ কার্যালয়ে নিয়মিত নন।

মাসের অধিকাংশ দিনই অনুপস্থিত থকেন। আর মাস শেষে যে কোনো এক সময় এসে বেতন তুলে নেন এবং হাজিরা খাতায় উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।

এই বিষয়ে কমিউনিটি অপথালমোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শরফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে জানা যায় তিনি একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে দেশের বাইরে রয়েছেন। ফিরবেন ১৯ ডিসেম্বর।

অপথালমোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা, মো. শওকত কবীরের সঙ্গে কথা হলে প্রথমে তিনি বলেন, আমার জানা মতে আমাদের বিভাগের কেউই এমনটা করেন না। পরে প্রমাণাদি ও টেলিফোনের কথপোকথনের কথা উল্লেখ করলে এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের বিভাগীয় প্রধান দেশের বাইরে আছেন তাই আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। স্যারের সঙ্গে কথা বলাই ভালো হবে।

তবে অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই চিকিৎসক, ডা. আনোয়ারের অনুপস্থিতির বিষয়টি কিছুটা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি আগেই আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। চেয়ারম্যান স্যার এ বিষয়ে উনাকে চিঠিও দিয়েছেন।

ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ারের ভিজিটিং কার্ডে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ লেখা সরকারি লোগো রয়েছে। একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী কী সরকারি লোগো ব্যবহার করতে পারেন? এমন প্রশ্নে এই চিকিৎসক বলেন, ‘এমনটা করতে পারার কথা না। তিনি এটা ব্যবহার করতে পারেন না। আমরা কেউই এমন লোগো ব্যবহার করতে পারি না।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)’র রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল হান্নান এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের এখানে সবার অফিসের সময়সূচী সকাল ৮ টা থেকে দুপুর আড়াইটা। এ সময় সবাইকে এখানেই থাকতে হবে। এ সময় বাদেও এখানে চিকিৎসকদের বিকেলে বা রাতে দায়িত্ব পালন করতে হতে পারে। এ সময়ে বাইরে চেম্বার করা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং এটি একটি বড় অনিয়ম।

‘মেডিকেল অফিসারদের বিষয়টি দেখেন আমাদের পরিচালক (হাসপাতাল)। উনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে, বলেন রেজিস্ট্রার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডাক্তার নাজমুল করিমের কাছে ডা. চৌধুরী মোহাম্মদ আনোয়ারের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত করে যদি সত্যতা পাওয়া যায় তবে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো। তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সারাবাংলা/এসবি/এমএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন