বিজ্ঞাপন

মেলায় লাখো মানুষের ঢল

February 21, 2018 | 2:51 pm

এসএম মু্ন্না ।।

বিজ্ঞাপন

পথে পথে ব্যানার। তাতে ভাষা সংগ্রামী ও মনীষীদের মহান উক্তি লেখা। শিশুর গালে-কপালে রঙে আঁকা বর্ণমালা, শহীদ মিনার, জাতীয় পতাকা। হাজারো তরুণীর বসনে কালো পাড়ের সাদা শাড়ি, কারও কপালে বড় কালো টিপ। সাদা-কালো ফ্রক, ফতুয়া পরে মা-বাবার হাত ধরে হাঁটছে ছোট্ট সোনামণিরাও। ছেলেদের পাঞ্জাবিতেও বিষণ্ণতা ছড়ানো কালো। হাতে সদ্য কেনা বইয়ের ব্যাগ। কী মেলায় ঢুকতে, কী বই কিনতে-সবখানেই দীর্ঘ সারি। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই সকাল থেকে বারবার আছড়ে পড়ছে বইপ্রেমী মানুষের স্রোত। মেলার ভেতর মেলা। বাইরেও মেলা। লাখো মানুষের মিলন মেলা। শহীদ মিনার থেকে ভেসে আসা কালজয়ী সেই গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি …।’ ভাষা শহীদদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মুখর হয়ে উঠেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

এক ঘণ্টা নয়, দুই ঘণ্টাও নয়, এক টানা ১৩ ঘণ্টা- বই বেচাকেনার উৎসব চলবে আজ বুধবার রাত ৯টায় মেলার কেন্দ্রীয় আলো ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত। বই বেচাকেনার এই উৎসবে শামিল হতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসছেন লাখো মানুষ। হৃদয়ে একুশের চেতনাকে ধারণ করে প্রাণে প্রাণে মিলে একাকার হয়ে গেছে মেলা প্রাঙ্গণ।

বিজ্ঞাপন

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো শেষে মানুষের গন্তব্য হয়ে উঠেছিল গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণ। প্রভাত ফেরিতে আসা সকল মানুষ ছুটে এসেছিলেন মেলায় সকাল বেলাতেই। একুশে স্মরণে বাংলা একাডেমি আয়োজিত এই মেলা বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছে একুশের সমার্থক।

গ্রন্থমেলার বাইরে একুশের দিন অনির্ধারিত লোক মেলা বসে গেছে আশপাশের এলাকাজুড়েও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশের সড়ক জুড়ে চুড়ি, ফিতা, খেলনাপাতি, মাটির দ্রব্য আর নানা রকম মণ্ডা-মিঠাইয়ের পসরা সাজিয়ে অন্যরকম আরেক মেলা জমিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। মধ্য রাত অবধি থাকবে এই বারোয়ারি মেলা।

মেলার প্রবেশপথ খুলে দেওয়া হয় সকাল ৮টায়ই। কিন্তু ভিড়ের শুরু তো সেই প্রথম প্রহর থেকেই। প্রভাতফেরির পর শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে মানুষ পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে, তরুণ-তরুণীরা সদলবলে ছুটে আসেন মেলাতে। শিশুসন্তানও ছিল অনেক মা-বাবার কোলে। আবেগ দীপ্ত কোমল কৌতূহলে শিশু-কিশোররা এসেছিল তাদের সংস্কৃতির শিকড়ের টানে, মাতৃভাষার শহীদদের প্রতি ভালোবাসা জানাতে। শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা প্রাঙ্গণ আজ রাত সাড়ে ৮টা থাকবে মানুষের ঢল। একদিকে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর। অন্যদিকে দোয়েল চত্বর। আরেকদিকে সেই নীলক্ষেত।

বিজ্ঞাপন

সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে কঠোর তল্লাশির মধ্য দিয়ে মানুষ প্রবেশ করছেন মেলাপ্রাঙ্গণে। উপচে পড়া ভিড় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও একাডেমির মেলাপ্রাঙ্গণ। সাধারণত খুব ভিড় দেখলে মনে হয়, বই তেমন বিক্রি হচ্ছে না। কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করা গেল, বিভিন্ন স্টলের কর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন, ক্রেতাদের কেনাকাটার জোগান দিতে।

মানুষের স্রোত বয়ে গেছে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মধ্যখানে সড়ক বিভাজকসহ বহিরাঙ্গনেও। ফুটপাতে বসে অনেকেই জমিয়ে তুলেছেন সঙ্গীতের আসর। হেঁড়ে গলায় গানে তারা যেমন আনন্দ পেয়েছেন, তেমনি আনন্দ পেয়েছেন মেলায় আগত অন্যরাও। এ দেশের শহীদ দিবসে মানুষের ঢল দেখে অভিভূত হয়েছেন বিদেশিরা। বাঙালির ভাষা প্রেম দেখে তারাও উদ্দীপিত হয়েছেন নিজ নিজ ভাষার ভালোবাসায়। মেলায় এসে পুরনো অভ্যাসে প্রথমেই একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েছিল উত্তর মানিকদীর এক পরিবার। ভুল ভাঙতে নতুন করে উদ্যানমুখী লাইনে দাঁড়াতে হলো তাদের। একটু বিরক্তি আর ক্লান্তি চোখেমুখে ফুটে উঠলেও বই কিনে বাড়ি ফেরার তৃষ্ণা পরিবারটির সবার চোখে-মুখে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বইয়ের প্রতি এই আকুতিই নতুন মাত্রা দিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে।

কেমন হচ্ছে একুশের দিনের মেলা? এ প্রশ্নের একাধিক প্রকাশক ও স্টলের বিক্রয় প্রতিনিধি সন্তোষজনক মন্তব্য করেছেন। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও অন্য প্রকাশ এর প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই একটি দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকি আমরা প্রকাশকরা। অন্য দিনের চেয়ে ভালো বিক্রি হচ্ছে। সময় যত গড়াবে, ভিড়ও বাড়বে তত। বিক্রিও ভালো হবে’। সময় প্রকাশনের প্রধান নির্বাহী ফরিদ আহমদ সারাবাংলাকে বলেন ‘আজকের দিন তো শুধু বই কেনাবেচার না। একুশের চেতনায় শানিত মানুষ আসছে, এটাই তো বড় পাওয়া ।’ অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাৎ হোসেনের প্রত্যাশা, ‘এবার মেলার পরিসর বেড়েছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য সুবিধা। তাই এবার মেলার শুরু থেকেই জমজমাট। আজ বুধবার আরও ভালো বিক্রির আশা করছি।’ অবসর এর ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা বলেন ‘বিক্রিটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে ভিড়ও।’

শহীদ বেদিতে ফুল অর্পণ আর মেলায় এসে বই কেনা যেন একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে সপরিবারে, ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে মা-বাবা, ছোট ভাইবোনকে নিয়ে বড় ভাই-বোন মেলা প্রাঙ্গণকে ভরিয়ে তুলছিলেন। কথা হলো তেমনি এক পরিবারের সদস্য সামাদ উল হাসানের সাথে। তিনি বললেন, ‘এই দিনে ভাষা শহিদের শ্রদ্ধা জানাতে শহিদ মিনারে আসবো না, তা কি হয়, সেই ছোটবেলা থেকে কাকা সায়েম উল হাসানের হাত ধরে প্রথম শহিদ মিনারে এসেছিলাম। এখন তিনি নেই। কিন্তু তার দেখানো পথে হাঁটছি নতুন প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে। যতই কষ্ট হোক, শহিদ মিনারে প্রতি বছর আসবো। আর ফেরার পথে বইমেলায় গিয়ে নতুন বই তবেই বাড়ি ফিরবো।’

বিজ্ঞাপন

একুশে স্মারক বক্তৃতা : বিকেল চারটায় একাডেমির মেলামঞ্চে ‘একুশে ফেব্রুয়ারির লক্ষ্য কী, অর্জনের পথ কোন দিকে?’ শীর্ষক একুশে স্মারক বক্তব্য রাখবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তার আগে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান। এর আগে মেলা মঞ্চে ছিল কবিতা পাঠের আসর। বাংলাদেশের প্রায় দেড় শতাধিক কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছেন। সভাপতিত্ব করেন কবি কামাল চৌধুরী। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এই ম্যারাথন কবিতা পাঠের আসর চলে। সন্ধ্যায় রয়েছে গণসংগীতের আসর।

সারাবাংলা/এসএমএম/এমএ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন