বিজ্ঞাপন

৩০ লাখ টাকায় লোভে মেয়েকে খুন, ৫ বছর পর রহস্য উদঘাটন

March 9, 2020 | 8:52 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: হত্যাকাণ্ডের ৫ বছর পর নরসিংদীর চাঞ্চল্যকর ইলমা বেগম (১১) হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)।

বিজ্ঞাপন

সিআইডি তদন্তে  উঠে এসেছে, ৩০ লাখ টাকায় মেয়ে ইলমাকে হত্যার ছক আটে পরিবারের সদস্যরাই। মা মঙ্গলী বেগম, বাবা মোতালেব, বোন জামাই বাবুল ও ফুফাত ভাই মাসুম মিয়াসহ ৭/৮ জন মিলে ইলমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর ধানক্ষেতে ফেলে দেয়।

মুলত শাহজাহান নামে একটি গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার ও প্রতিপক্ষ বাচ্চু গ্রুপকে ফাঁসাতেই মোতালেবের সঙ্গে তার মেয়েকে হত্যার সওদা হয় ৩০ লাখ টাকায়।

সোমবার (৯ মার্চ) দুপুরে সিআইডির মালিবাগ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ইমতিয়াজ আহমেদ ইলমা হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন।

বিজ্ঞাপন

ডিআইজি বলেন, ২০১৫ সালের ২৮ মার্চ নরসিংদীর বাহেরচর গ্রামের একটি ধানক্ষেত থেকে ইলমার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ইলমা ওই সময় বাহেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

৩১ মার্চ ইলমার বাবা মোতালেব বাদী হয়ে প্রতিপক্ষ বাচ্চু গ্রুপের বিলকিস বেগম, খোরশেদ ও নাসুসহ অজ্ঞাত নামাদের আসামী করে একটি হত্যা মামলা করেন। নরসিংদী সদর থানা পুলিশ আসামী ধরতে ব্যর্থ হলে মামলাটি সিআইডির কাছে তদন্তে যায়।

সিআইডি তদন্তের সময় তিন আসামীর দুজনকে গ্রেফতার করে। রিমান্ডে নিয়েও হত্যার কোনো ক্লু খুঁজে না পাওয়ায় তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। এখন তারা জামিনে আছেন। অন্যদিকে হত্যার রহস্য উদঘাটনে তদন্ত অব্যাহত রাখে সিআইডির কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, এরইমধ্যে ইলমার বাবা মোতালেব সিআইডির কাছে কয়েক দফা এসে আসামীদের নাম পরিবর্তন করতে বলেন। কখনো বলেন, এরা খুন করেননি। আবার কখনো কয়েকজনের নাম দিয়ে বলেন, এরা খুন করেছে আমার মেয়েকে। মামলায় তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। বাবাকে সন্দেহ হওয়ায় সিআইডি এক পর্যায়ে তার পরিবারের ওপর নজরদারি শুরু করে। সিআইডি জানতে পারে, ২০১৩ সালে একবার মোতালেব নিজের ঘর পুড়িয়ে অন্যকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তদন্তে প্রমাণিত হয়, মোতালেব নিজের ঘরে নিজেই আগুন দিয়েছিলেন। সিআইডি আরো জানতে পারে মোতালেবের ভাগিনা মাসুম আরো একটি মামলার আসামী। মাসুমের খোঁজ করতে গিয়ে সিআইডি জানতে পারে, গত ৫ বছর ধরে মাসুম এলাকায় থাকেন না। সে কোথায় থাকে সেটা কেউ বলতে পারেন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইলমা হত্যার পর থেকেই মাসুম লাপাত্তা। তাছাড়া ইলমার বোনজামাইও বিদেশে চলে যায় আর আসেননি। শেষ পর্যন্ত সিআইডি মাসুমকে গত তিন মাস ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে। মাসুমই ইলমা হত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয় সিআইডিকে। ১৬৪ ধারায় জবাবনন্দিতে মাসুম ইলমা হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দেয়।

জিজ্ঞাসাবাদে মাসুমের দেয়া তথ্য থেকে সিআইডির ডিআইজি বলেন, নরসিংদীর বাহের চর এলাকাটি একেবারেই দূর্গম এলাকা। মোঃ শাহজাহান ভূঁইয়া ও সাবেক মেম্বার বাচ্চুর নেতৃত্বে দুইটি দলের মধ্যে এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। শাহজাহান গ্রুপের সদস্য ইলমার ফুফাত ভাই মাসুমের সঙ্গে বাচ্চু গ্রুপের সদস্য তোফাজ্জলের মেয়ে তানিয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ে করার জন্য মাসুম তানিয়াকে তার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসে। টের পেয়ে তানিয়ার বাবা দলবলসহ দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে হামলা করে তানিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় তানিয়ার বাবা বাদী হয়ে মাসুম, মাসুমের ভাই খসরু ও ভাইয়ের শুশ্বর বাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে নরসিংদী সদর থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন।

বাচ্চু গ্রুপের সদস্যদের ক্ষতি করার জন্য আরেক গ্রুপের দলনেতা শাহজাহানের বাড়িতে ১ মার্চ রাতে মাসুমসহ ১৩ জন বৈঠক করে। প্রতিশোধ নিতে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বাচ্চু গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার বিষয়ে বৈঠকে সিন্ধান্ত হয়। সিন্ধান্ত অনুযায়ী শাহজাহান ভুইয়া মোতালেবকে তার মেয়ে ইলমাকে টাকার বিনিময়ে হত্যা করার প্রস্তাব করে। মোতালেব ত্রিশ লাখ টাকার বিনিময়ে মেয়েকে হত্যা করতে রাজি হয়!

চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ইলমার দুলাভাই ও অন্যরা মিলে ইলমাকে টাকা দেয় দোকান থেকে কিছু কিনে আনতে। টাকা পেয়ে ইলমা বাড়ির পাশে নুরার দোকান হতে জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফেরার পথে ইলমার দুলাভাই বাবুল ও ফুফাত ভাই মাসুমের নেতৃত্বে সাত আটজন মিলে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পাশের একটি ধানক্ষেতের পাশে প্রথমে হকিস্টিক দিয়ে মারধোর করে। এরপর ইট দিয়ে মাথা থেতলে ইলমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তারপর মাসুম নিজেই গলা কেটে হত্যা নিশ্চিত করে। এ সময় ইলমার বাবাসহ ৭/৮ জনের একটি দল পাশে অবস্থান করছিল।

বিজ্ঞাপন

জিজ্ঞাসাবাদে মাসুম সিআইডিকে জানায়, প্রতিবেশি বাতেন ও শাহজাহান গ্রুপের প্রধান শাহজাহান ভূইয়া হত্যাকান্ডের সময় উপস্থিত ছিলেন। মরদেহ ধানক্ষেতে ফেলে দেওয়ার সময় শাহজাহানের কাছে ইলমার বাবা ‘আগে টাকা দাও পরে কাম সারো’ বলে টাকা দাবি করেছিল। তবে চুক্তির ৩০ লাখ টাকা হাতে ইলমার বাবা পায়নি বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে।

সিআইডি কর্মকর্তা ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মাসুমের স্বীকারোক্তি মোতাবেক আরো চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন, বাবা আব্দুল মোতালেব, মা মঙ্গলী বেগম, প্রতিবেশি বাতেন ও শাহজাহান গ্রুপের প্রধান শাহজাহান ভূইয়া। তারা সকলেই ইলমাকে টাকার বিনিময়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। আর বোন জামাই বাবুল বিদেশে থাকায় গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এর পেছনে আর কারা জড়িত তা জানতে রিমান্ডে এনে আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এছাড়া বাকী আসামীদের ধরতে সিআইডির অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, ইলমা হত্যার ব্যাপারে মায়ের যথেষ্ট সায় রয়েছে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে ইলমা সবার ছোট ছিল। সংসারের আর্থিক অভাব মোচন হবে ৩০ লাখ টাকা পেলে। তাছাড়া এক সন্তান গেলে আরো তো সন্তান রয়েছেই বলে হত্যায় মত দেন মা মঙ্গলী বেগম।

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন