বিজ্ঞাপন

গ্রেনেড হামলায় ‘কোমায়’ বিএনপি, চূড়ান্ত ক্ষতি গণতন্ত্রের

August 21, 2020 | 9:43 pm

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে বিএনপি কোমায় চলে গেছে। সাময়িকভাবে লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে চূড়ান্ত বিচারে দেশের জনগণ ও মানবাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারাত্মকভাবে হোঁচট খেয়েছে গণতন্ত্র। এর প্রভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একক দলের প্রাধান্য। আর এ হামলা রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নিকৃষ্ট উদারহরণ। সহিংস এমন অপকর্মের মধ্য দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য সুবিধা পাওয়া গেলেও জঘন্যতম এমন কূটচাল চূড়ান্ত বিচারে যে বুমেরাং হয় তারও উদাহরণও ২১ আগস্টের এ হামলা।’

বিজ্ঞাপন

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়ে এমন মন্তব্যই এসেছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলা ২৪ জন মারা যান। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ নেতা-কর্মী আহত হন। সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।

সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে বিকেল ৫টায় পৌঁছালে, একটি ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে তিনি কুড়ি মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসতে থাকেন। ঠিক এমন সময় শুরু হয় মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন।

বিজ্ঞাপন

এ ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক জিয়া, চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৫২ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে অন্য মামলায় মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড হওয়ায়, তিনজন ছাড়াই বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

মন্তব্য জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নিকৃষ্ট উদাহরণ। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে তার প্রকট দৃষ্টান্ত এটি। তৎকালীন রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা শক্তি তার প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে, এই ঘটনা ঘটানোর পেছনে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও ব্যবহার করেছিল। এটি একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে দেশীয় সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছিল। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। বিচার কাজ সম্পন্ন হচ্ছে, এই ঘটনায় তৎকালীন সরকার যে সুরক্ষা দিয়েছিল তা বিভিন্ন তথ্য প্রমাণে উঠে এসেছে, রাজনৈতকি সদিচ্ছায় বিচারকাজ এগিয়ে চলছে। এটি আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে যে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় থেকে যদি দুর্বৃত্তায়ন করা হয় তাহলে হয়ত সময়িক সময়ের জন্য কিছু সুবিধা পাওয়া যায়, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে তা বুমেরাং হতে বাধ্য। এ ঘটনা তাই প্রমাণ করে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে যে নৃশংসতা, তার মাপকাঠিতে বিচার করলে ২১ আগস্ট আর ১৫ আগস্ট এক সূত্রে গাঁথা বলে আমি মনে করি।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কারণে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ লাভবান হয়েছে। এটা আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। বিএনপি যেভাবে ব্যাকফুটে গেছে, কোনো মিরাকল না ঘটলে তাদের ফিরে আসা কষ্টকর। তবে চূড়ান্ত বিচারে এটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটি গণতন্ত্রের জন্য ভালো হয়নি। এর ফলে বিএনপির যত না ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এদেশের নাগরিকদের। এর ফলে গণতন্ত্র মারাত্মকভাবে হোঁচট খেয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘দেশের রাজনীতিতে এই হামলা একটি বড় ঘটনা। গণতন্ত্রের জন্য  ৮০ এর দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমরা তাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। পরবর্তীতে দুই শক্তি পালাক্রমে এক অপরের বিরুদ্ধে রাজপথে হামলা, পাল্টা হামলা, সংসদ বয়কট, রাজপথে সরকার উৎখাতের ঘোষণা, হিংসা-বিদ্বেষের রাজনীতি করেছে। আর এর চূড়ান্ত বিস্ফোরণই আমরা দেখেছি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা কিন্তু হঠাৎ করে হয়নি। প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে এটি হয়েছে। এ হামলা গণতান্ত্রিক চর্চা দারুণভাবে ব্যাহত করল।’

এ হামলার মধ্য দিয়ে বিএনপি কোমায় চলে গেছে মন্তব্য করে এই বিশ্লেষক বলেন, ‘দ্বিদলীয় যে রাজনীতি ছিল, সেখানে এখন এক দলের প্রাধান্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা আর থাকল না। কারণ এখন তো একটি দলের প্রাধান্য। বিএনপি কল্পনা করতে পারেনি তারা ক্ষমতায় থাকবে না। কল্পনায় থাকলে তো এমন ঘটনা ঘটাতে পারত না। নিজেদের কাঁধে দায়টা তারা নিয়ে নিয়েছে। সাময়িকভাবে রাজনৈতিকভাবে তো আওয়ামী লীগ লাভবান হয়েছে। আর এ হামলার ফলে বিএনপি কোমায় চলে গিয়েছে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশ সম্পর্কে সহিংসতার বার্তা দিয়েছিল। পাকিস্তান ছাড়া কেউ এটিকে ভালো চোখে দেখেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ১৫ আগস্ট হত্যা করতে পারেনি বলেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক  উদ্দেশ্যেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আমরা তিন ধরনের উপদান দেখতে পাই। যারা হামলা করেছে তারা হুজির জঙ্গি। হুজির জঙ্গিদের ব্যবস্থা করেছে নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনী। আর এই হামলার পরিকল্পনা করেছেন রাজনীতিবিদরা। অর্থাৎ এই হামলার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল।’

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ ও বিপক্ষের শক্তি এবং পাকিস্তানের প্রভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাকাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে পাকিস্তান একটি লজ্জায় পড়ে। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনা পাকিস্তানের কাছে একটি লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাকিস্তানের অভ্যন্তরের রাজনীতিও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তারা ভেবেছিল  বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু মুক্ত করা যায় কিনা, তারা ভেবেছিল ফেডারেল স্টেট করা যায় কিনা। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে পাকিস্তান সহায়তা করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীরা কয়েক দশক বাংলাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল। রাজনীতিতে শেখ হাসিনা আসার পর তিনি তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেন। তাই তারা শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।’

বিজ্ঞাপন

নিরাপত্তা বিশ্লেষক রশিদ বলেন, ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বিশ্বের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিশ্ব জনমত এই হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ফলে তখনকার সরকার বাধ্য হয় তাদের, তাদের অবস্থান পাল্টাতে। এই হামলার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি যে ফয়দা উঠাতে চেষ্টা করেছিল, শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় তা ব্যর্থ হয়েছিল। বিএনপি রাজনৈতিকভাবে এখনও এই হত্যাকান্ডের বিরোধিতা করেনি। তারা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যেভাবে লাভবান হতে চেয়েছিল সেভাবে লাভবান হতে পারনি, হয়তো লক্ষ্যপূরণ না হওয়ায়। বিএনপি এখনও এটাকে কনডেম করেনি। এটা ধরে রাখতে চেয়ছিল। এই হামলা জনসমর্থন পায়নি বলেই জনগণকে আওয়ামী লীগকে ভোটের মাধ্যমে বেছে নিয়েছিল।’

জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ফলে রাজনৈতিকভাবে কেউ লাভবান হয়নি। এটি একটি নিন্দনীয় ঘটনা। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এটি একটি চরম বিপর্যয়ের ঘটনা। বিশ্বে এর মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদ বা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন সম্পর্কে খারাপ বার্তা গিয়েছিল। এমন ন্যাক্কারজনক হামলা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল। এটি গণতন্ত্রের জন্যও চরম বিপর্যয়।’

এ মামলার বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কেন জানি এ দেশে সব বিচার দেরি হয়। এই বিচারে যখন বাধা ছিল, তখন বাধা ছিল- এখন তো নেই। এই বিচার পরিচালনায় রাষ্ট্র তো এখন সহায়তা করছে। শুধু এই মামলা নয়, অনেক চাঞ্চল্যকার মামলারই গতি শ্লথ। এর ফলে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি, কিছু ঘটলেই মানুষ বলে বিচার পাব না, এটা আমাদের দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।’

আরও পড়ুন

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: মুখে কুলুপ এঁটেছে বিএনপি

 

সারাবাংলা/ইএইচটি/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন