বিজ্ঞাপন

কর্মজীবী নারীর নিরাপত্তা: বাস্তবতা ও সামাজিক প্রতিরোধ

March 10, 2018 | 4:19 pm

১.  ফাতেমা (ছদ্মনাম) পেশায় রাজমিস্ত্রি। তালাক হয়ে গেছে স্বামীর সাথে। ঘরে ছোটো ছোটো দুটি বাচ্চা। সারাদিন নির্মাণাধীন একটি ভবনের সামনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় বস্তির ঘরে ফেরে। ফেরার পথের রাস্তাটা নির্জন। অন্ধকার নেমে এলে এখানে লোক চলাচল কমে যায়। এক ভয়ংকর সন্ধ্যায় ওই রাস্তার কাছে ফাতেমার জীবন পাল্টে গেলো। তিনটি যুবক, জীবন থেকে যারা কিছুই পায়নি, মাদকের নেশায় যারা আচ্ছন্ন থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়, শহরতলির ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফেরার সময় ফাতেমাকে লক্ষ্য করে। জানা নেই, কোন্ গ্রহণলাগা চাঁদের অভিশাপ এ তিনজনকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গাঁজাভরা সিগারেট টানতে টানতে তারা ফাতেমাকে অশ্লীল ইঙ্গিতময় কথা বলে, ফাতেমার কোমরের খাঁজে চোখ রাখে, ফাতেমার চব্বিশ বছরের শরীরটাকে ছুঁতে চায়।

বিজ্ঞাপন

ফাতেমা ভয়ানক আতংকে দ্রুত হেঁটে রাস্তাটা পেরিয়ে যেতে চাইলেও তারা পেছনে ছুটে আসে। ফাতেমা কাঁদে, ফাতেমা ঘরে রেখে আসা বাচ্চাদের কথা বলে, সে ভিক্ষা চায় তাদের কাছে – তাকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু একটি ভীতা হরিণীকে ঘিরে ধরেছে যেন তিনটি হিংস্র পশু, তাদের মায়া হয় না, ফাতেমার কান্নায় তারা আমোদ পায়, হাসাহাসি করতে থাকে। এদের মাঝে একজন সাথীদের নিচু গলায় কিছু বলে, ফাতেমা আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

ফাতেমার এই ক্ষণিক আশাটি ছিলো ভুল, কারণ কথা শেষ হতেই বাকি দুজন হইহই করে ওঠে। তাদের চোখের দৃষ্টিতে খেলা করে নতুন কিছু পাওয়ার উল্লাস। পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। তিনটি যুবক ফাতেমার শরীরকে টানতে টানতে নিয়ে যায় পাশের এক পরিত্যক্ত ভবনে। সেখানে যা হওয়ার তাই হয়। ফাতেমার সাথে যা হয়- তার গালভারি নাম- গণধর্ষণ।

২.  একজন নারী চিকিৎসক। নাম তার ডা. সাজিয়া আফরিন ইভা। বাবা-মায়ের স্নেহের সন্তান, বোনের প্রিয় সাথী। মেধাবী এই চিকিৎসক স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এফসিপিএস পরীক্ষার প্রথম পর্ব পাশ করে সে কাজ করছে একটি বিখ্যাত বেসরকারি হাসপাতালে। প্রায়ই তার নাইট ডিউটি থাকে। বাবা-মা-বোনের আশঙ্কা হয়, তারা এই আশঙ্কা থেকেই ইভাকে দিনের বেলায় কাজ করতে বলে। ইভা তাদের বোঝায়- ডাক্তারদের জীবন এমনই। পুরুষ একজন ডাক্তার রাতে কাজ করতে পারলে সে-ও পারবে, ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

এই ইভাকে কিছুদিন ধরে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় ফয়সল লক্ষ্য করছিলো। রাতে ডিউটি ডক্টরের সংখ্যা কমে যায় হাসপাতালে, ভবনের কোনো কোনো ফ্লোরে একজন ডাক্তারই থাকে। গভীর রাতে নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। ওয়ার্ডবয় ফয়সল এই নির্জনতা, এই নিস্তব্ধতার সুযোগই নিতে চায়।

ডা. ইভা সেদিন কাজের পর বিশ্রাম নিতে তার ডিউটি রুমে এসেছিলো। কিছুক্ষণ পর ফয়সল দরজায় নক করে ‘ম্যাডাম ইভা’কে ডাকে। ইভার মনে হয় কোনো রোগীর কথা, রোগীর হঠাৎ আসা কোনো সমস্যার কথা।। সে সরল বিশ্বাসে দরজা খুলে দেয়। সাথে সাথে রুমে ঢুকেই ফয়সল ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। ইভা প্রবল শক্তিতে বাধা দেয়। ফয়সল বিরত হয় না। সে তখন আর মানুষ নেই। ইভা কিছুতেই ফয়সলকে বিজয়ী হতে দেয় না। ধস্তাধস্তির মাঝে ফয়সলের মাথায় অন্ধ রাগ বাসা বাঁধে। ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে এই রাগেই সে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ইভাকে।

 

বিজ্ঞাপন

৩.  “হঠাৎ খবর পাই মনে

আকবর বাদশার সঙ্গে

হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।

বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে

বিজ্ঞাপন

ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে

গেছে এক বৈকুণ্ঠের দিকে।” (‘বাঁশি’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 

অর্থাৎ নিয়তি এক। দিন এনে দিন খাওয়া ফাতেমার সাথে চিকিৎসক ইভার প্রভেদ নেই। তাদের করুণ ভাগ্য যেন এক সুতোয় গাঁথা। এর একমাত্র কারণ- দুজনই নারী। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং জীবনযাপনের মানে পার্থক্য থাকলেও দুজনকেই বলি হতে হয়েছে নির্মম পুরুষতন্ত্রের। অর্থাৎ যে তন্ত্র নারীকে কেবল ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করে, তার। শিকার যদি হয় নারী আর সময় যদি হয় রাত, তবে যৌনহয়রানি করতে, ধর্ষণ করতে শিকারী পুরুষের খুব সুবিধে হয়ে যায়।

আমাদের সমাজে কিছু নীতিবাগীশ লাঠিয়াল আছে। এরা ঘরে আছে, বাইরে আছে, অফিসে আছে, হাসপাতালে আছে, কারখানায় আছে, অনলাইনে আছে, অফলাইনে আছে। এরা নিজেদের মনে করে সমাজসংস্কারক। মেয়েরা বা নারীরা চাকরি করবে- এ নিয়ে এদের আপত্তি, কিংবা চাকরিবাকরি করলেও সন্ধ্যা বা রাতে কাজ করতে হবে- সে নিয়ে আপত্তি। এসব নীতিবাগীশ পুরুষও হতে পারে, নারীও হতে পারে। দূরের বন্ধু হতে পারে, আবার কাছের স্বজনও হতে পারে। এরা সবাই মিলে ওই একটি তন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে, সেটি- পুরুষতন্ত্র।

পুরুষতন্ত্র কখনোই নারীকে স্বাবলম্বী দেখতে চায় না, চায় না নিজের জীবিকা নারী নিজেই নির্বাহ করুক। এতে এ তন্ত্রের বাহকদের অহমে আঘাত লাগে, এজন্য তারা ছলে বলে বিপদের আভাস দিয়ে, ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে ঘরে অবরুদ্ধ করতে চায়, নারীর পায়ে পরাতে চায় কঠিন শৃঙ্খল। মূলত এ ভাবনা থেকেই পরিবার থেকে পুত্রকে যতটা স্বাধীনতা দেয়া হয়, কন্যাকে ততটা বিচরণক্ষেত্র দেয়া হয় না। আর পরিবার যেহেতু সমাজেরই অংশ, সমাজও চায় না মেয়েদের আত্মনির্ভরশীলতা।

আমরা যতই বলি- যুগ পাল্টাচ্ছে, সময় পাল্টাচ্ছে, কিন্তু আসলেই কতটা পাল্টাচ্ছে? প্রযুক্তির বিপ্লব হচ্ছে ঠিকই, মানসিক উদারতায় কতটুকু অভ্যস্ত বাংলাদেশের সমাজ? কর্মক্ষেত্রে নারী যৌনহেনস্থার শিকার হলে তাকেই বলা হয়- “ছেড়ে দাও কাজ।” আর রাতের বেলা বাধ্য হয়ে বাইরে কাজ করার সময় যদি কোনো নারী যৌনঅপরাধের শিকার হয়, দায়ী করা হয় নারীটিকেই। এই তো বাস্তবতা, এখনও।

কোনো অপরাধ ঘটলেই আমরা শুনি- “কেবল আইন দিয়ে নয়, সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমেই অপরাধ নির্মূল করতে হবে।” তা, এই ‘সামাজিক প্রতিরোধ’টি তো জাদুবস্তু নয় যে তা হঠাৎ উদয় হবে। এজন্য প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে সমাজকেই। কার জীবনে কেমন জীবিকা প্রয়োজন, সেটি নিতান্তই ব্যক্তিগত বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে কোনো বৈধ পেশায় কোনো নাগরিককেই আমরা বাধা দিতে পারি। সে পুরুষ হলেও পারি না, নারী হলেও পারি না।

আমাদের চেষ্টা থাকবে কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, রাতের বেলা তার যাতায়াতের পথকে বিপদমুক্ত রাখা। একই সাথে যৌনঅপরাধের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলে সমাজ সুস্থ হবে, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে, আর কোনো ফাতেমা বা ইভাকে জীবিকার্জনের জন্য বাইরে গিয়ে নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে- সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এটি সম্ভব নয়, পুরুষতন্ত্রের বিলোপ ছাড়া এটি কার্যত অসম্ভব।

 

 

[রোকেয়া সরণি কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]

 

সারাবাংলা/এসএস

 

 

 

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন