বিজ্ঞাপন

হালকা প্রকৌশল শিল্প: করোনায় বর্ষপণ্যের প্রভাব মিলছে না

October 5, 2020 | 12:40 pm

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বর্ষপণ্য ঘোষণা করা হলেও দেশের হালকা প্রকৌশল শিল্পে দৃশ্যমান কোনো প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে না। বছরের শুরুতে খাতটি নিয়ে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, করোনাভাইরাসের ছোবলে তা ফিকে হয়ে গেছে। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘ প্রায় চার মাস বন্ধ থাকার প্রভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এখনো বন্ধ রয়েছে ছোট কিছু ওয়ার্কশপ ও কারখানা। চালু থাকা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারাও বলছেন, তাদের বেচাকেনা নেমে এসেছে অর্ধেকে। আর সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও ছোট উদ্যোক্তারা তার সুফল পাচ্ছেন না। উদ্যোক্তাদের পুঁজি ও জায়গার সংকট রয়েছে এখনো।

বিজ্ঞাপন

হালকা প্রকৌশল শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট্ট আলপিন থেকে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আধুনিক সব যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করে থাকে। খাতটির কারিগররা তৈরি করেন শিল্প-কারখানার চালিকাশক্তি মৌলিক যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। খাতটিতে বর্তমানে কৃষি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, মেরিন যন্ত্রাংশ, মোল্ড অ্যান্ড ডাই, টেক্সটাইল যন্ত্রাংশ, জুটমিল যন্ত্রাংশ, চা বাগান ও মিলের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, নির্মাণ শিল্পের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, বেকারি শিল্পের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, মেটাল ফার্নিচার, কাগজ মিলের যন্ত্রাংশ, পশু পালন শিল্পের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ ও অটোমোবাইলের যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।

দেশের সবচেয়ে পুরোনো এই শিল্পের অমিত সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে বছরের শুরুতে হালকা প্রকৌশল শিল্পকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খাতটির উন্নয়নে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন তিনি। এর ফলে উদ্যোক্তাদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে মন্ত্রণালয়গুলো খাতটির জন্য চমকপ্রদ তেমন কোনো উন্নয়ন দেখাতে পারেনি। বরং এই সময়ে করোনার প্রভাবে ছোট ছোট উদ্যোক্তারা নতুন করে হুমকির মুখে পড়েছেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির (বাইশিমাস) সভাপতি আবদুর রাজ্জাক সারাবাংলাকে বলেন, ‘খাতটির অবস্থা বেশি ভালো নয়। সারাদেশে করোনার কারণে আমাদের অবস্থা যায় যায়। এছাড়া ভ্যাটের কারণে আমাদের অবস্থা ভালো না। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করলে ভ্যাট দিতে হচ্ছে না, কিন্তু দেশে উৎপাদন করলে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ভ্যাট অব্যাহতির আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আমাদের যে সাতটি শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা, ভ্যাট ও করের সমস্যা, অবকাঠামো, পরিবেশের ঝামেলা রয়েছে। খাতটির জন্য বর্তমানে কোনোকিছুই ইতিবাচক নয়। বর্তমানে সবকিছুই নেতিবাচক।’

বিজ্ঞাপন

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই আমাদের কাছে। তবে ৭৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই খারাপ, আর ২৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কোনোরকমে টিকে আছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন জায়গার ভাড়া দিতে পারছে না। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছে না।’

আরেক প্রশ্নের উত্তরে বাইশিমাস’র সভাপতি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হালকা প্রকৌশল শিল্পকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করায় আশার সঞ্চার হয়েছিল। জানুয়ারিত ঘোষণা, মার্চেই বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়ে গেল। বছর প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখনো তো সবকিছু স্বাভাবিকই হয়নি।’

যা বলছেন উদ্যোক্তারা

রাজধানীর টিপু সুলতান রোডের সেন্ট্রাল মোল্ডিং ওয়ার্কশপের মালিক মঞ্জুর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘খাতটি ধ্বংস হয়ে গেছে। লকডাউনের পর থেকে অবস্থা আরও খারাপ। কাজ নেই। আগের চেয় ৭০ শতাংশ আয় কমেছে। খাতটিকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করা হলেও আমরা এর কোনো সুফল পাইনি। আমরা কোনো ব্যাংক ঋণের জন্যও আবেদন করিনি। এখন কোনোরকমে টিকে আছি।’

বিজ্ঞাপন

একই এলাকার হাফিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘অবস্থা খারাপ। ক্রেতা আসে না। কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। প্রধানমন্ত্রী এই খাতটিকে বর্ষপণ্য ঘোষণা করেছেন— এটি আমি শুনিইনি। জানিও না। আর সরকারের যত সুবিধা, তা তো বড় বড় ওয়ার্কশপের জন্যে। আমরা কোনো সুবিধা পাইনি।’ মাহবুব ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের দেখভালের দায়িত্বে থাকা হৃদয় বলেন, ‘মাসে আগে ৫০ হাজার টাকার কাজ হলেও এখন তা ৩০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।’

নারিন্দার সেলিম মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের স্বত্বাধিকারী ও বাইশিমাসের পরিচালক সাব্বির আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘খাতটির অবস্থা ভালো নেই। বেচাকেনা একেবারেই নেই। যেখানে বেচাকেনেই নেই, সেখানে বিক্রি কতটুকু কমেছে— সেই প্রশ্ন অবান্তর।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, প্রণোদনা বা ব্যাংক ঋণের কোনো সুবিধা পাননি তারা। আর মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ায় বর্ষপণ্য ঘোষণার কোনো সুফলও মেলেনি। খাতটিতে বর্ষপণ্য ঘোষণার কোনো প্রভাবই পড়েনি বলে মনে করেন তিনি।

বাইশিমাসের আরেক পরিচালক তাহের বাগ লেনের আনোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের স্বত্বাধিকারী আনোয়ারুল হক আনসারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘ প্রায় চার মাস সব বন্ধ ছিল। ওয়ার্কশপের বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। অনেকের হাতে এখন টাকা নেই। অনেকেই পেমেন্ট করতে পারছে না। আবার চীনের পণ্য আমদানি তো হচ্ছেই। সবমিলিয়ে আমাদের বেচাকেনা খুবই কম রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রণোদনা আমরা পাচ্ছি না। ব্যাংকগুলো আমাদের কাছে স্টেটমেন্ট চায়। ছোট উদ্যোক্তাদের তো ব্যাংকের সঙ্গে সেভাবে লেনদেন নেই। আবার মেশিনারিজের সঠিক মূল্যও ব্যাংকগুলো সেভাবে নির্ধারণ করতে পারে না। তাই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ পেতে আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পুঁজি ও জায়গার সংকট রয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অভাব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বর্ষপণ্য ঘোষণা করেছেন, কিন্তু মার্চ থেকেই করোনা। আমরা যে কিছু আদায় করে নেব, সেই সুযোগটাই পাইনি। প্রধানমন্ত্রীকে এই খাতের কিছু করে দেখাব, কোনো মেলা আয়োজন করব— এসবের সুযোগ হয়ে উঠেনি। কেরাণীগঞ্জে যে শিল্প পার্ক আছে, সেটির কাজ এখনো কিছুটা বাকি। তারপরও যদি সেটি আমাদের কাছে দ্রুত হস্তান্তর করা হয়, সেখানে ওয়ার্কশপগুলোকে একত্রিত করা যাবে। তাহলে খাতটির উন্নয়ন একটু হলেও দৃশ্যমান হবে।’

হালকা প্রকৌশল শিল্প খাতে করোনা পরবর্তী অবস্থা

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায়ও খাতটির দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, হালকা প্রকৌশল শিল্পসহ দেশের এসএমই খাতে বিক্রির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। এখনো প্রায় ৪০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এক-তৃতীয়াংশের বেশি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মঘণ্টা (কাজের সময়) কমিয়ে দিয়েছে।  ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ৭৫ শতাংশ এন্টারপ্রাইজ মালিক।

বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, লকডাউনের সময় লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এন্টারপ্রাইজের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ পুরোপুরি এবং ২৯ শতাংশ আংশিকভাবে খোলা ছিল। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর ৬১ শতাংশ এন্টারপ্রাইজ পুরোপুরি খুলেছে এবং এক-তৃতীয়াংশের বেশি তাদের নিয়মিত কাজের সময় কমিয়ে এনেছে। কাজের পরিমাণ বাড়লেও ক্ষুদ্র ও অপ্রাতিষ্ঠানিক এন্টারপ্রাইজে কোভিড-১৯-এর আগের সময়ের চেয়ে বিক্রির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। এছাড়া লকডাউনের পর তুলনামূলক কম পুঁজির এন্টারপ্রাইজের ৪৯ শতাংশ ধ্বসের মুখে পড়েছে, উল্টোদিকে বেশি পুঁজির এন্টারপ্রাইজে এই হার ২৫ শতাংশ। প্রায় ২০০০ লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং (হালকা প্রকৌশল) প্রতিষ্ঠানের ওপর ওই গবেষণা পরচালিত হয় বলে বিআইজিডির দাবি।

জানতে চাইলে শিল্প সচিব কে এম আলী আজম সারাবাংলাকে বলেন, ‘হালকা প্রকৌশল শিল্পকে সরকার বর্ষপণ্য ঘোষণা করায় খাতটি নিয়ে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। উদ্যোক্তাদের বিভিন্নভাবে প্রণোদনা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। উদ্যোক্তারা কোনো না কোনোভাবে প্রণোদনায় সামিল হচ্ছেন। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসএমই মেলার সঙ্গে সঙ্গে হালকা প্রকৌশল শিল্পের জন্যও মেলা করা হবে। আর সব জায়গায় আমরা হালকা প্রকৌশল শিল্পের জন্য ডেডিকেটেড শিল্প পার্ক করার উদ্যোগ নিয়েছি।’

সরকারের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়, শিল্প পার্কে সম্ভাবনা

এদিকে, হালকা প্রকৌশল শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দেশের পাঁচ জেলায় ডেডিকেটেড লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প পার্ক স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, বগুড়া ও নরসিংদী জেলায় শিল্প পার্কগুলো স্থাপন করা হবে। শিল্প পার্কগুলোয় স্থাপিত শিল্প-কারখানার জন্য দক্ষ জনবলের সরবরাহ নিশ্চিত করতে একইসঙ্গে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটও স্থাপন করা হবে। সেপ্টেম্বর মাসে এই ঘোষণা এসেছে মন্ত্রণালয়টির পক্ষ থেকে।

খাতটির উন্নয়নে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা জানিয়ে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির (বাইশিমাস) সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, বিশ্বে হালকা প্রকৌশল শিল্পের সাত ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার, সেখানে বাংলাদেশের অবদান এক শতাংশেরও অনেক কম। রফতানিতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প উজ্জীবিতকরণ নামের কমিটি করা হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আছে, যদিও ব্যাংকগুলো সেভাবে সহযোগিতা করছে না। বর্তমানে শিল্পের জন্য বিটাপ একটি ভালো প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়িয়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। আমরা ওদের কাজ থেকে টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট পাই। এই সুবিধা এখন কেবল ঢাকাতে আছে। কিন্তু দেশের যেখানে যেখানে হালকা প্রকৌশল শিল্প গড়ে উঠেছে বা ক্লাস্টার তৈরি হয়েছে, সেখানে বিটাপের এই সুবিধা সম্প্রসারণ করা দরকার। শিল্প মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগটি নিয়েছে।

আব্দুর রাজ্জাকসহ এই খাদের উদ্যোক্তারা বলছেন, এছাড়া বিসিক থেকে দীর্ঘদিন ধরে আমরা কোনো সুবিধা পাচ্ছিলাম না। সম্প্রতি তারা হালকা প্রকৌশল শিল্পের জন্য আধুনিক সুবিধা সম্বলিত আলাদা শিল্প পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালেয়র অধীন এসইআইপি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে বিদেশি প্রশিক্ষক এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। তবে সরকারের নেওয়া উদ্যোগের দৃশ্যমান কোনো প্রভাব এখনো মাঠ পর্যায়ে পড়েনি বলে মনে করেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।

হালকা প্রকৌশল শিল্পের সূচনা

দেশে হালকা প্রকৌশল শিল্পের যাত্রা শুরু হয় স্বাধীনতার পরে। তখন শিল্প ও যানবাহনের কিছু কিছু যন্ত্রাংশ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হয় পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকার টিপু সুলতান রোডের কারখানায়। মূলত উদ্যোক্তারা তখন কলকারখানা ও অবকাঠামো মেরামতে প্রয়োজনীয় সেবা দিতেন। সব কারখানা মিলে দুয়েক মিলিং মেশিন, তিন থেকে চারটি শেপিং মেশিন, ২৫-৩০ লেদ মেশিন, ড্রিল, ওয়েল্ডিং ও টুলস গ্রাইডিং মেশিন ছিল।

পরে আশির দশকে এ শিল্পের উন্নয়নে ধোলাইখাল-জিঞ্জিরা প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে ওই প্রকল্পের নামে ৫ কোটি টাকার ঋণ বরাদ্দ দেওয়ার পর এ খাতের বিকাশ হতে শুরু করে। তখন উদ্যোক্তাদের বন্ধক ছাড়াই ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হতো। গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সাবকন্ট্রাকটিং ব্যবস্থাও চালু করা হয়। এতে দেশি কারখানাগুলোতে চাহিদার অন্তত শতকরা ২৫ ভাগ যন্ত্রাংশ স্থানীয়ভাবে সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়। এতে এ খাতের উদ্যোক্তারা উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন যন্ত্রাংশ ও যন্ত্র তৈরির কাজ বাড়িয়ে দেন। পরে মডেল প্রকল্পে আরও ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

খাতটির বর্তমান অবস্থা

বাইশিমাস’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে সারাদেশে প্রায় ৫০ হাজার কারখানা রয়েছে। খাতটিতে দক্ষ-আধা দক্ষ মিলিয়ে সরাসরি প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান প্রায় ৬ লাখ। জিডিপিতে খাতটির অবস্থায় প্রায় ৩ শতাংশ।  খাতটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪২৮ কোটি ডলার। অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য ও সেবা বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। খাতটির রফতানিকে উৎসাহিত করতে সরকার ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খাতটিতে দ্রুত সময়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব। হালকা প্রকৌশল শিল্পের বিশ্ববাজারের পরিমাণ প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন (৬ লাখ কোটি) ডলার। ভারতের সেভেন সিস্টারস, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মধ্যপ্রাচ্য ও অফ্রিকার দেশগুলোতে ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশীয় লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো গড়ে উঠেছে ঢাকার ধোলাইখাল, বগুড়া, পাবনা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, যশোর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে।

প্রতিবন্ধকতা

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাতটিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষিত লোকের অভাব রয়েছে। স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তির সমস্যাও প্রকট। অভাব রয়েছে গবেষণা ও উন্নয়নের। খাতটির উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবও রয়েছে। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের অভাব, মান নিয়ন্ত্রণের জন্য টেস্টিং সুবিধার অভাব, কাঁচামাল ও কাটিং টুলের অভাব, উন্নত মানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের অভাব ও ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের জন্য আলাদা শিল্প পার্কের অভাব রয়েছে। এসব সমস্যা দূর হলে খাতটি আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদ উদ্যোক্তাদের।

রফতানি বাণিজ্য

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য রফতানি হচ্ছে। কৃষি যন্ত্রপাতি, বাইসাইকেল, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, এয়ার কন্ডিশন ও বিভিন্ন শিল্পের যন্ত্রাংশ রফতানি হচ্ছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, প্রায় এক যুগ ধরে ১৮০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে এই খাতের রফতানি আয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাতটির রফতানি আয় ছিল ৩১৯ মিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় ছিল ৩২৭ মিলিয়ন ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৬৮৮ মিলিয়ন ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫১০, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৪৭, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৬৬, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৬৭, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৭৬, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২২১, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩১১, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৮৯ ও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২১৯ মিলিয়ন ডলার আয় ছিল। ভবিষ্যতে এই রফতানি আয় আরও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন খাতটির উদ্যোক্তারা।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন