বিজ্ঞাপন

মানসিক শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ানো আনোয়ারা বেগম

May 7, 2021 | 2:47 pm

জোহরা শিউলী

পুত্রবধূ কালো। শ্বশুরবাড়িতে এ নিয়ে নানা অবজ্ঞা-অবহেলা। কালো পুত্রবধূ সন্তান-সম্ভাব্য হয়ে যদি আবার কন্যাসন্তানের জন্ম দেন তাহলে তো কথাই নেই। সেই পুত্রবধূর বাড়িতে ঠাঁয় নেই। কন্যাসন্তান জন্মদানের অপরাধে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয় গ্রামের নারীকে। সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা হয় সেই নারীটির সঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

ভাবছেন মধ্যযুগের কোনো গল্পগাঁথা বলছি আপনাদের? না, এটা মাত্র দুই যুগ আগের ঘটনা। ঘটনাটি ঘটেছিল ঠাকুরগাঁওয়ের জগন্নাথপুর ইউনিয়নের জাহানারা বেগমের সঙ্গে। গায়ের রঙ কালো এবং কন্যাসন্তান জন্মদানের জন্য শ্বশুরবাড়ি, স্বামীর ঘরে ঠাঁয় হয়নি তার। বাবার বাড়িতে কন্যাসন্তানটিকে নিয়ে কোনোরকমে দিন পার করেন তিনি।

কন্যাটির নাম রাখেন আনোয়ারা। আনোয়ারা’র সঙ্গে কথা বলার সময় নিজ জন্মের, মায়ের জীবনের কথা এভাবেই বললেন। মায়ের জীবনের কষ্ট দিয়েও আনোয়ারার জীবনে সুখের সামান্যতম আলো জ্বালানো সম্ভব হয়নি। মায়ের সঙ্গে নানার বাড়িতে থেকেছেন আনোয়ারা। বড় মামা খোরশেদ আলমের কারণে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পেরেছিলেন। এরপর বিয়ে দেওয়া হয় তাকে।

শুরু হলো সংসারজীবন। মায়ের মত তারও সংসার জীবনে স্বস্তি, শান্তি ছিল না। বিয়ের পরে কেউ তাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, সে হয়ে থেকেছে পরের মেয়ে। মায়ের মত তাকেও সহ্য করতে হয়েছে লাঞ্চনা আর নির্যাতন। দিনের পর দিন কেটেছে না খেয়ে। বেশ কয়েকবার শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হতে হয়েছে তাকে। মামারা বিয়ে দিয়েছেন তাই মুখ বুঝে সহ্য করেছেন তিনি এই নির্যাতন। স্বামীসহ তাকে একসময় শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। থাকার জায়গা না থাকায় নিরুপায় হয়ে অন্যের বাড়িতে থাকতে হয় তাদের। স্বামী ছিলেন পেশায় বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি। তার সীমিত আয়ে কোনোরকমে চলে আনোয়ারা বেগমের সংসার।

বিজ্ঞাপন

করোনার সময়টাতে গ্রামবাসীর স্বাস্থ্যসচেতনতায়ও ভূমিকা রেখেছেন আনোয়ারা বেগম

বিয়ের একবছরের মাথায় ঘর আলো করে আসে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। ঘরে লোক বাড়ে কিন্তু অন্ন সংস্থান বাড়ে না। অভাবে চারদিকে ঘোর অন্ধকার, মাঝখানে নিরুপায় আনোয়ারা বেগম। বছর দুই পরে ছেলে সন্তানের জন্মের পর সংসার আর এভাবে চলতে পারে না, মনে মনে ভাবলেন তিনি। ২০১২ সালে জানতে পারেন ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’ এর সহায়তায় কিছু নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সংসারে অভাব ঘোচানোর জন্য, নিজে কিছু করার জন্য তিনি সেই নারীনেত্রী ফাউন্ডেশন কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণটি তার মনোজগতকে আন্দোলিত করে। আত্মশক্তি, আত্মবিশ্বাস, নারীর অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি প্রশিক্ষণে বুঝতে পারলেন অভাব-কষ্টের সঙ্গে নিত্য বসবাস না করে নিজের জীবনে মোড় ইচ্ছে করলেই ঘোরানো যায়।

তখন থেকেই তিনি তার মতো অবহেলিত নারীদের নিয়ে শুরু করেন একটি সমিতি। সেখানে ১০০ টাকা করে সবাই জমা দিতেন। মোট ২৫ জন নারীদের জমানো টাকা ২৫০০ টাকার মধ্য থেকে ঋণ নিয়ে নারীরা হাঁস-মুরগী পালন, বাড়ির উঠানে সবজি চাষ শুরু করেন। আনোয়ারাও শুরু করেন এভাবে। পরে ধীরে ধীরে গরু পালন, সেলাই শিখে আয় করে নিজের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেন। এখন সেলাই থেকে প্রতিদিন তার ১৫০-২০০ টাকা উপার্জন হয়। সঙ্গে নিজ খামারে গাভীগুলো থেকে ৭-৮ লিটার দুধ নিয়মিত বিক্রি করেন।

শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সময় তাদের কোনো থাকার জায়গা ছিল না। নিজ উপার্জনে আনোয়ারা বেগম বসতভিটা কিনে তাতে বাড়ি তুলেছেন। মেয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছেলে পঞ্চম শ্রেণির।

বিজ্ঞাপন

স্বাবলম্বী, পরিশ্রমে সংসারে সফলতা ফিরিয়ে আনা এই নারী বলেন, ‘নারী জনম অভিশাপ না। আমার মায়ের সংসার ভেঙে যায় আমি হওয়ার কারণে। কী কষ্টের জীবনে আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি, শুধুমাত্র নিজ ইচ্ছায়। আমার মনের মধ্যে ছিল আমার সন্তানেরা না খেয়ে থাকবে না, তারা পড়াশোনা করবে। সংসারে উপার্জন বাড়িয়ে অভাব-দুঃখের সংসারকে স্বচ্ছ্বল-সুখের সংসার বানিয়েছি। জীবনে সর্বোচ্চ পরিশ্রমটুকু করে আমি সফল হয়েছি। বুঝতে পেরেছি নারীরাও ঘরে বসে না থেকে ধরতে পারে সংসারের হাল। পরিবর্তন আনতে পারে সমাজে।’

সারাবাংলা/আরএফ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন