বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অভিযানে ৩ হাসপাতালে মিলল নানা অনিয়মের তথ্য

August 1, 2021 | 10:50 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত শিনশিন জাপান হাসপাতাল। নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমিতদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে নানা অনিয়ম ও সরকার কাছে তথ্য না দেওয়ার অভিযোগে ‘অনুমতি ছাড়াই চলছে করোনা চিকিৎসা, তথ্য যাচ্ছে না সরকারি তালিকায়’  শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয় সারাবাংলা ডটনেটে।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (৩১ জুলাই) এই হাসপাতালে অভিযান চালায় কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয় তদারকি ও নজরদারির জন্য গঠিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিটি। অনুমতি না নিয়েই চিকিৎসা দেওয়াসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে শিনশিন জাপান হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. শরিফুল ইসলাম অভিযানিক দলকে বলেন, ‘অনুমতি নিয়ে চিকিৎসা করলে তো সরকারের কাছে তথ্য দিতে হবে। তাই পিসিআর পজিটিভ হলেও আমরা সাসপেক্ট হিসেবে এখানে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকি।’

সারাবাংলায় প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়- উত্তরাতেই অবস্থিত রেডিকেল হাসপাতাল ও আল আশরাফ হাসপাতাল নামে আরও দুইটি প্রতিষ্ঠানের অনুমতি না নিয়েই চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে। এই হাসপাতালগুলোতেও অভিযান চালায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি দল। অনুমতি না নিয়েই চিকিৎসা দেওয়া, সরকারের কাছে কোনো প্রকারের তথ্য না দেওয়া, বিল নিয়ে অসঙ্গতি, অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ নেওয়া, ট্রায়াজ ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া থেকে শুরু করে নমুনা পরীক্ষা নিয়েও নানা অসঙ্গতি পায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয় তদারকি ও নজরদারির জন্য গঠিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিটি। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে খুব দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন: অনুমোদন ছাড়া করোনা চিকিৎসা, অভিযানে নামছে স্বাস্থ্য অধিদফতর

বিজ্ঞাপন

শনিবার (৩১ জুলাই) সকালে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ চিকিৎসাসেবার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত বিষয় তদারকি ও নজরদারির জন্য গঠিত স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিটির সদস্যরা প্রথমেই যায় রেডিক্যাল হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে কোনো ধরনের ট্রায়াজ সিস্টেম ছাড়াই চিকিৎসা দেওয়ার প্রমাণ পায় কমিটির সদস্যরা। হাসপাতালটি যে বিল্ডিংয়ে অবস্থিত সেখানে ব্যাংকসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও আছে। হাসপাতালটির দুই তলায় অবস্থিত মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চ। একটি মাত্র লিফটে এখানে হাসপাতালের রোগী ও কর্মচারীদের সঙ্গে ব্যবহার করে থাকেন ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও।

রেডিক্যাল হাসপাতালে গিয়ে কমিটির সদস্যরা দেখেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমতি ছাড়াই হাসপাতালটিতে কোভিড চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। একইসঙ্গে কোভিড রোগী সংক্রান্ত কোনো তথ্যাদি সংশ্লিষ্ট দফতরে না পাঠানোর তথ্যও তারা নিশ্চিত হন। রেডিক্যাল হাসপাতালে ১০ বেডের আইসিইউ ইউনিট পরিচালনা করার কথা বলা হলেও সেখানেও দেখা যায় নানা অনিয়ম।

বিজ্ঞাপন

রেডিক্যাল হাসপাতালের ষষ্ঠ তলায় দেখা যায় রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে উপসর্গযুক্ত দাবি করে। কাগজে কলমে এখানে রোগীদের পিসিআর টেস্ট ও এইচআরসিটি টেস্ট করতে বলা হলেও চিকিৎসক জানান, নমুনা পরীক্ষা করা ছাড়াও চিকিৎসা দেওয়া যায়। এ সময় সেখানে থাকা চিকিৎসক দাবি করেন যেহেতু পিসিআর টেস্টের ফলাফল শতভাগ সঠিক আসে না তাই সিটি স্ক্যান করেই কোভিড-১৯ সংক্রমণের চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। এ সময় চিকিৎসক দাবি করেন রোগীর পিসিআর টেস্ট হয়নি বলে। তবে রোগীর স্বজনরা জানান ভিন্ন কথা। তারা বলেন, চিকিৎসক ও হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট রোগীর তথ্য লুকিয়ে রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন তাই আসলে কিছু বলতে পারছেন না।

রেডিক্যাল হাসপাতালে দুইটি রুমে পাঁচটি করে বেড স্থাপনের মাধ্যমে আইসিইউ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও এটিকে অনুপযুক্ত বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কমিটি। একইসঙ্গে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও জনবল ছাড়াই সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। সেখানে ম্যানিফোল্ড অক্সিজেন সিস্টেমের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হলেও সেটি ছিল অপর্যাপ্ত। একইসঙ্গে হাসপাতালের সামনে বিপজ্জনকভাবে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখতে পান কমিটির সদস্যরা।

হাসপাতালে অক্সিজেনের মূল্য তালিকা দিয়ে রাখলেও সেখানে অতিরিক্ত বিল নেওয়ার প্রমাণও পায় অভিযানিক দল। এছাড়াও কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসায় জাতীয় ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন না মানার প্রমাণও পান স্বাস্থ্য অধিদফতরের অভিযানিক দল।

প্রায় একই অবস্থা আল আশরাফ হাসপাতালেও। এখানে দুলু মিয়া নামে এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার কথা বলে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালে হঠাৎ করেই তাদের জানানো হয় আর অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব না আর তাই দ্রুত অন্য কোথাও নিতে হবে রোগীকে। এ সময় তিন দিনে এক লাখ ৯১ হাজার টাকার একটি বিলও দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে দেখা যায়, এই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ চিকিৎসার নামে আছে শুধুমাত্র একটি বেড, বালিশ ও অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং একটি মনিটর। এই আইসিইউ বেডে সেবার দেওয়ার নামেই ১০ হাজার টাকা চার্জ নেওয়া হয় রোগীদের কাছ থেকে। একই সঙ্গে আলাদাভাবে নেওয়া হয় কেবিন চার্জ থেকে শুরু করে দিনে দুইবার কনসালটেন্ট চার্জ। ডা. মোস্তাফিজুর রহমান আকাশ নামে একজন সহযোগী অধ্যাপক এই হাসপাতালের আইসিইউ চিকিৎসা দিয়ে থাকেন বলে দাবি করলেও সরেজমিনে তিনদিন গেলেও তাকে একদিনও দেখা যায়নি। একই ভাবে হাসপাতালে নরসিংদী থেকে আসা সিএনজি চালক আল আমিনের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্যাচুরেশন ৮৪ এবং শ্বাসকষ্ট থাকলেও রোগীর এখনো পিসিআর টেস্ট করা হয়নি। চার দিন হলেও গেলেও কোনো নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে কোভিড-১৯ চিকিৎসা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের বেসরকারি কোভিড-১৯ হাসপাতাল মনিটরিং কমিটি আল আশরাফ হাসপাতালে গিয়েও দেখেন ট্রায়াজ ব্যবস্থা নেই। একই সঙ্গে বিল সংক্রান্ত নানা রকমের অনিয়ম ছাড়াও কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়ার তথ্য না জানানোর প্রমাণও পান। চিকিৎসাসেবার নামে অতিরিক্ত বিল আদায়সহ নানারকম অনিয়ম খুঁজে পায় কমিটি।

উত্তরার আরেকটি প্রতিষ্ঠান শিনশিন জাপান হাসপাতাল। এই প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মনিটিরং টিম নানা অনিয়ম পায়। আদালতের নির্দেশ অমাণ্য করে কোনো মূল্য তালিকা ঝুলানো ছাড়াই এ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয় রোগীদের। একই সঙ্গে বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষার দামও অতিরিক্ত নেওয়া হয়ে থাকে রোগীদের কাছ থেকে। অক্সিজেনের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও এখানে অতিরিক্ত বিল নেওয়া হয়ে থাকার প্রমাণ পায় কমিটি। এছাড়াও সরকারের কাছে কোনো তথ্য না দেওয়ার প্রমাণও পায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মনিটরিং টিম।

এ ছাড়াও তিনটি হাসপাতালেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই চিকিৎসা চালানোর প্রমাণ পায় কমিটি। প্রয়োজনীয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, ভেন্টিলেটর ও হাই ফো ন্যাজাল ক্যানুলা ছাড়াই কোভিড রোগীদের জন্য আইসিইউ ইউনিট পরিচালনা করার প্রমাণও পায় মনিটরিং কমিটি। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ছাড়াই হাসপাতালগুলোতে কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে যেখানে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা নির্দেশিকা।

এই তিনটি হাসপাতালে প্রায় ১০০ জন কোভিড রোগী মৃত্যুবরণ করলেও তার তথ্য কোথাও সন্নিবেশিত হয়নি বলেও প্রমাণ পায় কমিটি।

অভিযানের পরে শিনশিন জাপান হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার শরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা এতোদিন অনুমতির বিষয়টি বা তথ্য কোথায় দিতে হবে তা জানতাম না। আমরা খুব দ্রুতই আবেদন করব।

প্রায় একই কথা বলেন রেডিক্যাল হাসপাতালের ম্যানেজার আমজাদ হোসেন রিয়াদ।

আল আশরাফ হাসপাতালের পরিচালক জাহিদুর রহমান বলেন, এখানে চিকিৎসকদের পরামর্শে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের অক্সিজেন সংকটের বিষয়টি আমরা রোগীদের জানিয়েছে।

তবে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই কিভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে প্রশ্নের জবাবে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি জাহিদুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে উপসর্গ থাকা রোগীদের চিকিৎসা দেই। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে চিকিৎসক ভালো বলতে পারবেন।’

তিনটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতর বা সরকারের কাছে কোনো তথ্য দেওয়া হয় না। এমনকি তিন হাসপাতালে প্রায় ১০০ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগী মারা গেলেও তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে জানানো হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল-৩) ডা. হাবিব ইসমাইল ভূইয়া বলেন, ‘এই তিন হাসপাতালে নানা রকমের অনিয়মের প্রমাণ আমরা পেয়েছি। খুব দ্রুতই তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

উল্লেখ্য, দেশে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়া বাবদ অতিরিক্ত বিল নেওয়া, মানহীন সেবাসহ রোগীদের পক্ষ থেকে নানা সময় অভিযোগ করা হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ তদারকি ও নজরদারি করার জন্য একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ৪ মে গঠন করা ওই কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাসহ সাতজন সদস্য রয়েছেন।

এর আগে ৯ মে কমিটির সদস্যরা প্রথমবারের মতো রাজধানীর উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও রেডিক্যাল হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।

জানতে চাইলে ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে বদ্ধপরিকর। এ জন্য কোনো ধরনের অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। সরকারিভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে চিকিৎসা দিয়ে যাওয়ার জন্য। একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালেও গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তারপরেও নানা রকমের অভিযোগ আসে। সেগুলো দূর করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে যা কোভিড-১৯ চিকিৎসার মান ও ব্যয় সংক্রান্ত নানা বিষয় তদারকি ও নজরদারি করবে।’

সারাবাংলা/এসবি/একে

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন