বিজ্ঞাপন

‘ডেঙ্গুর ক্ষতিকর ধরনে আক্রান্তদের প্লেটলেট দ্রুত কমছে’

August 29, 2021 | 10:00 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশে এবার বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু’র চারটি সেরোটাইপ আছে। এগুলো হলো-ডেনভি–১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪। দেশে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে প্রথম দু’টি সেরোটাইপ পাওয়া গেলেও ২০১৭ সালে প্রথম ডেনভি-৩ শনাক্ত হয়। বর্তমানে ডেঙ্গুর এই ক্ষতিকর ধরণ ডেনভি-৩–এ বাংলাদেশের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গুর এই ধরনের কারণে দ্রুত রোগীদের রক্তের কণিকা প্লেটলেট কমে যাচ্ছে। সে কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের হাসপাতালে নিতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২৯ আগস্ট) রাজধানীর বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) আইএফআরডি অডিটোরিয়ামে ডেঙ্গু’র জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটির জিনোমিক গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ। আর গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন সংস্থাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক সেলিম খান।

গেটসনোটসের এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে সেলিম খান বলেন, ‘পৃথিবীতে মশার কামড়ে মানুষের বেশি মৃত্যু হয়। মশার কামড়ে প্রতিবছর মারা যায় ৭ লাখ ২৫ হাজার, সেখানে মানুষের দ্বারা মানুষ খুন হয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার। আর সাপের কামড়ে মারা যায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।’

তিনি বলেন, ‘ডেনভি-৫ বা ৬ সামনে আসতে পারে। প্রাকৃতিকভাবেই ভাইরাসটির রূপান্তর (মিউটেশন) হয়েছে। এবার ডেঙ্গু অন্যান্য বারের চেয়ে ভয়াবহ। এবার দেখা যাচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি রক্তের প্লেটলেট পড়ে যাচ্ছে, রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হচ্ছে।’ মায়ের বুকের দুধ ও রক্ত আদান-প্রদানের মাধ্যমেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে বলে সাম্প্রতিক এক গবেণষণায় তথ্য মিলেছে বলে জানান সেলিম খান।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানে বিসিএসআইআর’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আফতাব আলী বলেন, ‘ডেঙ্গুর মিউটেশন সংক্রান্ত তেমন গবেষণা না থাকায় এসব মিউটেশনে ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের জুলাইয়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হলে এর ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে ২০ জন ডেঙ্গু রোগীর কাছ থেকে নমুনা নিয়ে জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গুর নমুনাগুলো জিনোম সিকোয়েন্স করে প্রতিটিতেই ডেনভি–৩ সেরোটাইপ মিলেছে। তবে ডেঙ্গুর মিউটেশনবিষয়ক উল্লেখযোগ্য গবেষণা না থাকায় এই ভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।’

আফতাব আলী বলেন, ‘সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো- ডেঙ্গু হওয়ার পর রক্তের প্লেটলেট দ্রুত নেমে যাচ্ছে। আগে যেটা ধীরগতিতে নামত। বর্তমানে ৯৫ শতাংশ রোগী ঢাকার। শিশুরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। উপসর্গও ভিন্ন ভিন্ন পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স করা হলে ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য আরও ভালোভাবে জানা যাবে।’

বিজ্ঞাপন

ড. মো. আফতাব আলী বলেন, ‘ডেঙ্গু ভাইরাস ফ্লাভিভাইরাস গ্রুপের অন্তর্গত একটি পজিটিভ সেন্স আরএনএ ভাইরাস। ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ বাংলাদেশে আছে। এগুলো হলো, ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ এবং ডেনভি-৪। ভাইরাসের এই চারটি সেরোটাইপের মধ্যে ৬৫% -৭০% এমিনো এসিড সিকুয়েন্সের মিল আছে। ভাইরাসটি এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায় এবং মশার মাধ্যমে মানবদেহে সংক্রমিত হয়।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায় এবং এটি বাংলাদেশে সংক্রমিত রোগের মধ্যে অন্যতম। যদিও বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হয়, তবে ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশে মহামারি আকার ধারণ করে।’

অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ জানান, ডেঙ্গুর মিউটেশনবিষয়ক উল্লেখ্যযোগ্য গবেষণা না থাকায় এসব মিউটেশন ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাব শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু নমুনাগুলো শুধুমাত্র ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে পাওয়া, সেহেতু সারাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তৃতি জানার জন্য আরও বেশি সংখ্যক জিনোম সিকুয়েসিং করা প্রয়োজন।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফুল্লাহ মুন্সী বলেন, ‘২০১৩ থেকে আমাদের দেশে সেরোটাইপ-১ এবং ২ অনেক ছিল। সেরোটাইপ-৩-এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ধীরে ধীরে ১ এবং ২ শেষ হয়ে গেল, এখন আবার ৩ এর মাধ্যমে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। তাহলে এই যে জনগোষ্ঠীর যারা ১ এবং ২-এ আক্রান্ত হয়েছিল, তারা কিন্তু এখন অন্য একটি সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে মানুষের যে হেমারেজ বা শক হয়, আক্রান্ত হওয়ার পর তাতে সম্ভাবনা বেড়ে গেল। এটা চিকিৎসকদের জন্য কিন্তু অ্যালার্মিং।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘ডেনভি–১–এ আক্রান্ত হলে শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে ওই ব্যক্তি ডেনভি–২, ৩ ও ৪ সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হলে আগের ওই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উল্টো ক্ষতিকারক হয়। এর জন্য নিয়মিত ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘জিনোম সিকোয়েন্স করে জানা গেল, দেশে ডেনভি–৩ দিয়ে প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। এই শনাক্তকরণ পিসিআর পদ্ধতিতে সম্ভব হয় না। এর জন্য জিনোম সিকোয়েন্স করা লাগে। ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন গবেষণায় এটি কাজে আসবে।’

ডেনভি-৩ ধরণের ভয়াবহতা বিষয়ে জানিয়ে ডা. সাইফ মুন্সী বলেন, ‘ভয়াবহতার দিক দিয়ে ডেনভি–২ ও ডেনভি–৩ বেশি ভয়াবহ, অন্য দুটির চেয়ে। ভয়াবহতা কমবেশি হয়। কারণ, জিনোম সিকোয়েন্সে দেখা যায়, কিছু কিছু প্রোটিন এই দুই সেরোটাইপে আলাদা। এ কারণে ক্ষতিকারক।’

তিনি বলেন, ‘যারা ডেনভি-১ ও ২ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন, তারা পুনরায় ডেনভি-৩ এ আক্রান্ত হলে তাদের রক্তক্ষরণ, রক্ত জমাট বাধা, পেট ব্যাথা, পেট ফুলে যাওয়া- এ লক্ষণগুলো বেশি দেখা যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে জ্বর ছাড়া তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ হয় না। কিন্তু দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে এই ভাইরাসে মৃত্যুহার বেড়ে যাবে।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসান বলেন, ‘প্রাণীর শরীরের জিনে সব জিনগত তথ্য থাকে। জিনোম সিকোয়েন্স করলে বিশেষ বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করা যায়। এতে জিনগত ত্রুটি নির্ণয় ও নির্মূল করা সম্ভব হয়।’

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জিনোমিক গবেষণাগারের সাতজন বিজ্ঞানী ডেঙ্গু ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সের গবেষণা চালান। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদেরা এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন। ডেঙ্গু ভাইরাসের একেকটি নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স করতে ৭০ হাজার টাকা করে প্রায় ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন- বিসিএসআইআরের সদস্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ শওকত আলী, সদস্য (উন্নয়ন) মোহাম্মদ জাকের হোছাইনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আইইডিসিআর’র গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৬ সালের আগে সেরোটাইপ ডেনভি-১, এবং ডেনভি-২ এর মাধ্যমে মহামারি সংঘটিত হয়, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বাকি ২টি সেরোটাইপ শনাক্ত হয়নি। ২০১৭ সালে ডেনভি-৩ প্রথম শনাক্ত হয়। ২০১৮ সালে ডেনভি-৩ এর সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং ২০১৯ সালে এটি মহামারি আকার ধারণ করে।

এতে জানানো হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ২৯ জন মারা যান। যদিও ২০১৯ সালে ডেঙ্গু ভাইরাসের একটি মাত্র নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়, সেখানে সেরোটাইপ-২ শনাক্ত হয়। এবছর এখনও পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

অধিদফতরের তথ্যমতে, এ বছর জুলাই থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হলে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য বিসিএসআইআর’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখের সার্বিক নির্দেশনায় ডেঙ্গু ভাইরাসের নমুনার জিনোম সিকুয়েন্সিং-এর কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়।

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন