বিজ্ঞাপন

মনি হায়দার-এর গল্প ‘রক্ত মাখামাখি’

May 2, 2022 | 2:01 pm

রাজবাড়িতে জ্বললো আলো।

বিজ্ঞাপন

জ্বললো আলো কত বছর পর? প্রশ্ন মুখে মুখে।

অনেক অনেক বছর পর। অনেক অনেক মানে কত বছর? কত বছর পর রাজবাড়িতে জ্বললো আলো? নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না কেউ। কেউ বলে ষাট বছর, কেউ বলে একশ বছর। আবার কেউ বলে হাজার বছর পর।

রাজবাড়ির রাজ নর্তকীরা এতদিন এতরাত অপেক্ষায় ছিল। সে কী অপেক্ষা! অসহনীয় তীব্র অপেক্ষা! জনম জনম ধরে অপেক্ষা। কামনা সিন্ধুর সকল প্রদীপ বুকের গহীনে জ্বালিয়ে রেখে পলকের পর পলক অধীর অপেক্ষা। অপেক্ষা করতে করতে সবুজ বন ধূসর রঙ ধরেছে। রাজবাড়ির রাজকীয় জৌলুস হারিয়ে গেছে। বিশাল বিশাল প্রাসাদের দেয়ালে পড়েছে কালো কালির দাগ। এখানে সেখানে ঝুলছে মাকড়সার জাল। রাজবাড়ির শীর্ষ শিরে নেই সোনার চকচকে ঘড়ি। কোথাও বাজছিল না নহবত। জ্বলছিল না ধূপ। কেউ গাইছিল না মল বাজিয়ে গান… পিয়া পিয়া রে…।

বিজ্ঞাপন

সেই রাজবাড়িতে হঠাৎ জ্বলে উঠল আলো। রাজবাড়ির চারপাশের প্রজাসাধারণ হতবাক। কৌতূহলের বাজনা পরে কেউ কেউ এগিয়ে আসতে থাকে রাজবাড়ির দিকে। এত দিবস-রজনী পার হয়ে কে জ্বালালো আলো? রাজবাড়িতে আলো জ্বলবে, বাদ্য বাজবে, বাজবে সানাই, হবে হল্লা— ভুলেই গিয়েছিল। প্রজারা চিরকালের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল আশা। ভেবেছিল, রাজবাড়িতে আর জ্বলবে না আলো। বাজবে না বাদ্য। গাইবে না গান রাজনর্তকী। অনেকের মন থেকেই হারিয়ে গিয়েছিল রাজবাড়ি। মৃত প্রায় সেই বাড়িতে আলো জ্বলে উঠল!

সূর্য অস্তপারের দিকে, লালিম ম্লান আলোর সময়ে প্রধান ফটকের প্রহরী রাজবাড়ির দরজায় এক পথিককে দেখেতে পেয়ে উৎফুল্ল। শত শত বছর কোনো পথিক রাজবাড়ি অভিমুখে আসেননি। পথিকেরা রাজবাড়ির দেড় ক্রোশ দূর থেকে ত্রিমুখী পথে এসে যে যার মতো হারিয়ে গেছেন, অথবা চলে গেছেন গন্তব্যে। ত্রিমুখীর তৃতীয় পথ ধরে রাজবাড়ির দিকে কেউ আসেননি। রাজবাড়ির পথে পথে গজিয়েছে ঘাস। দু’পারে জন্ম নিয়েছে ঘন বিস্তৃত গাছপালা। গাছপালাকে ঘিরে ধরেছে সোনালি শূন্যলতা। পথটাকে ঘাস এবং গাছপালা প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে। একজন আগন্তুকের আসার অপেক্ষায় থেকে থেকে রাজবাড়ির প্রধান প্রহরী যখন প্রধান ফটকে ঝিমুচ্ছিল, ঠিক তখন সামনে এসে দাঁড়ান বিবর্ণ রঙের একজন পথিক। পথিককে দেখে প্রধান প্রহরী গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ায়। বিস্মিত চোখে তাকায় সামনে দাঁড়ানো পথিকের দিকে। বিনম্র কুর্নিশ জানিয়ে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কোথা থেকে এসেছেন জনাব?

আমি মহা দূর থেকে এসেছি।

বিজ্ঞাপন

মহা দূর?

মেহমান কথা না বলে ধীর লয়ে ঘাড় নাড়েন।

মহাদূর থেকে এসছেন! প্রধান প্রহরী আপন মনে বলেন।

কিন্তু আগন্তুক গ্রাহ্য করে না প্রধান প্রহরীর মন্তাজ। আপন মনে আগুন্তুক বলেন, আমি ক্লান্ত। কম তো নয় পথ। সেই কবে যাত্রা করেছি… কেবল পায়ে হেঁটে হেঁটে আসা…।

বিজ্ঞাপন

কার কাছে এসেছেন আপনি?

প্রদীপ্ত ক্লান্ত মুখে মৃদু হাসির রেখা আগন্তুকের, রাজবাড়ির প্রধান নর্তর্কীর কাছে এসেছি আমি।

প্রধান নতর্কীর কাছে এসেছেন! বিস্ময়ে বিস্মিত প্রধান প্রহরী আবারও কুর্নিশ করে, হে মহামান্য অতিথি, এই ক্ষয়িষ্ণু রাজবাড়ির, রাজবাড়ির প্রতিটি ইট ধূলিকণা কেবল আপনারই আগমনের আশায় অপেক্ষা করে আছে।

আমারই অপেক্ষায়? ক্লান্ত অবসাদগ্রস্থ পথিক অস্ফূট স্বরে বললেন। তাকান এলোমেলো।

জ্বী জনাব। আপনার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রাজবাড়ির সকল আলো নিভে গেছে। সরাইখানা বন্ধ। আপনার আগমনের আশায় প্রাসাদের নর্তকীরা অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। গভীর থেকে গভীরতর সেই ঘুম। আমার প্রতি আদেশ আছে, আপনি এলেই ঘুম ভাঙানোর ঘণ্টা বাজিয়ে সকলের ঘুম ভাঙাব। আমি এখনই ঘণ্টা বাজিয়ে কালো ঘুমে ঘুমন্ত সকলের ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছি।

প্রধান প্রহরী দেয়ালের সুলুকে রাখা ঘণ্টার দড়ি ধরে টান দেন, পর পর তিনটি। মরচে পড়া দড়ি টেনে রাজবাড়ির ভেতরের ঘণ্টা বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজবাড়ির ঘুমন্ত নর্তকীদের ঘুম ভেঙে যায়। এক অপার্থিব আনন্দে কলহাস্যে রাজবাড়ি রঙিন হয়ে ওঠে। বিশাল রাজপ্রাসাদের কোঠরে কোঠরে জল্বে ওঠে আলো। হরেক রঙের আলো। লাল আলো। নীল আলো। সবুজ আলো। বেগুনি আলো। হলুদ আলো। মনে হচ্ছে— রাজবাড়ি জুড়ে আলোর ফোয়ারা বইছে। আলো জ্বলে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে রাজদরবারে বাজতে থাকে নহবত। ফোয়ারায় ফোয়ারায় উঠছে ঝিরঝিরে পানি। ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। নিশুতির পাখিরা ডাকছে কোঁয়া কোঁয়া। পানির ফোয়ারা থেকে ভেসে আসছে নির্মল সুগন্ধ। চারপাশটা বিহব্বল আনন্দে অবগাহনে টইটুম্বর।

প্রধান নর্তকী ডেকে পাঠায় প্রিয় সখি কনিষ্কাকে। ওলো সখি দেখে আয় অতিথিকে একটিবার। সেই কখন এসে একলা অপেক্ষায় আছেন তিনি।

কনিষ্কা নাচতে নাচতে চলে যায় প্রধান ফটকে। উঁকি দিয়ে কনিষ্কা দেখে, অতিথি মলিন মুখে বসে আছেন। অতিথির দু’টি পায়ে অনাদিকালের ধুলো। শরীরের পোশাক ময়লা। ভাজ ভেঙে গেছে। মুখ বিষণ্ন। গোলগাল মুখ। মুখে হালকা কাঁচাপাকা দাড়ি। দেখলেই মনে হয়, অতিথি এসেছেন দূর বিদগ্ধ নগরীর প্রান্ত ছুঁয়ে। কিন্তু চোখ? অতিথির চোখজোড়া অবাক আকর্ষণীয়। মনে হচ্ছে, অতিথি চোখ দিয়ে চারপাশের যাবতীয় রঙ প্রকৃতি আর সুন্দর শুষে নিচ্ছেন। মেহমান রাজবাড়ির দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে আছেন সূদুরপানে। বসার ঢঙে অলৌকিক কালের মৌন ধ্যানির সংকেত বাজছে। প্রধান ফটকে অপেক্ষারত অতিথিকে এক পলক দেখেই কনিষ্কা মুগ্ধ। ধ্যানমগ্ন মৌন মানুষ এত সুন্দর হয়! এত আত্মভোলা মানুষও বাস করে মানুষের দুনিয়ায়?

পলকমাত্র। মুগ্ধ কনিষ্কা দৌড়ে প্রধান নর্তকীর কাছে যায়।

কনিষ্কা, তুমি হাঁপাচ্ছ কেন? প্রধান নর্তকী শরীরের পোশাক ছাড়ছিলেন। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে শতক সেবিকা।

প্রধান নর্তকী, আমি এক দৌড়ে রাজবাড়ির ফটক থেকে এসেছি আপনার কাছে।

কী করছেন মহামান্য অতিথি?

দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন তিনি। মনে হচ্ছে…

কী মনে হচ্ছে তোর?

মনে হচ্ছে অতিথি বসে নেই, তিনি ধ্যান করছেন!

প্রধান নর্তকীর বাঁকা ঠোটে ঝিকমিকি হাসি— তাই?

হ্যাঁ।

তোকে দেখেছে?

দেখবে কী করে? মহামান্য অতিথি নির্নিমেষ তাকিয়ে আছেন সূদুরের পানে। তার দৃষ্টি রাজবাড়ির দেয়াল ভেদ করে গন্ধর্ব নগরী ছাড়িয়ে সাত সমুদ্দের ওপারে, যেখানে মেঘেরা রচনা করেছে ফুলশয্যা।

তুই তাকে একলা রেখে এলি কনিষ্কা! প্রধান নর্তকীর কণ্ঠে হাহাকার— শীঘই যা। ভেতরে নিয়ে আয় অতিথিকে। খুলে দিতে বল অতিথিশালা। সুমেরীয় কালের রাজকীয় পালঙ্কে বসতে দে। বিছানায় রাখিস রক্তগোলাপ। রাজ রন্ধনশালায় খাবারের আয়োজন করতে আদেশ পৌঁছে দাও একজন।

আমি এখনই যাচ্ছি অতিথিকে আনতে— কনিষ্কা ছোটে প্রধান ফটকের দিকে। মায়াবিনী হাঁটছে রন্ধনশালায়। গৌরিকা যায় শালায়।

পেছনে ফিরতেই ডাকে প্রধান নর্তকী, কনিষ্কা?

বলুন প্রধান রাজনর্তকী, ফিরে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় কনিষ্কা।

অতিথি কি…

থামলেন কোন, বলুন।

অতিথি কি আমার সর্ম্পকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে? প্রধান নর্তকীর চোখে-মুখে ঈষৎ লজ্জার আভা ফুটে ওঠে পাকা বেলের মতো। পারেন না চাইতে চোখ তুলে। সখিরা হেসে গড়িয়ে পড়ে। অনিন্দ্য মুখটাকে মখমলের কাপড়ের আড়ালে নিয়ে মৃদ কণ্ঠে ধমক দেয় সখিদের, তোরা হাসছিস কেন?

সখিরা আরও জোরে হেসে ওঠে। রাজবাড়িজুড়ে হাসির লাখ লাখ পায়রা উড়ে বেড়াচ্ছে। দেয়ালে দেয়ালে পবিত্র হাসিরা ছবি আঁকতে থাকে।

তোদের সামনে আমি কোনো কথাই বলব না, কপট রাগ দেখিয়ে প্রধান রাজনর্তকী নিজেকে লুকানোর জন্য মহড়া কক্ষ ছেড়ে চলে যান। আড়ালে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সখিরা কোমড় বেঁধে নাচতে শুরু করে… সখি মান করো না…। কনিষ্কা নিজেও হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে প্রধান ফটকে গিয়ে অতিথির সামনে দাঁড়ায়। অতিথি সামনে সুসজ্জিত রাজনর্তকী দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ হয়ে তাকিয়ে এক ধরনের অপ্রস্তুত বিনম্র ভঙ্গিতে দাঁড়ান।

আমার সঙ্গে ভেতরে চলুন আপনি, মৃদু কটাক্ষের দাগ টেনে বলেন কনিষ্কা।

কোথায় যাব আমি?

খিল খিল হাসে কনিষ্কা, রাজবাড়ির ভেতরে চলুন। আপনার জন্য গোটা রাজবাড়ি শত শত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে। হাজার বছরের করুণ অপেক্ষার শেষে আপনি এলেন, আমরা ফিরে পেলাম প্রাণ। রাজবাড়িতে জ্বললো আলো, রাজবাড়ির হলো পুনরুত্থান। শুরু হয়েছে আপনাকে বরণের আয়োজন। চলুন।

আমি কোথায় যাব? বিহব্বল কণ্ঠ অতিথির।

আপনি রাজবাড়ির ভেতরে প্রবেশ না করলে আমরা নাচ দেখাব কাকে? আমাদের প্রধান সখি আপনার জন্য… থেমে যায় প্রগালভ কনিষ্কা।

আমার জন্য কী?

আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন শুধু আপনার জন্য। আপনি আসবেন, আপনার পূণ্য পায়ের ধুলিতে স্নাত হবে এই পুরনো মরচে পড়া রাজবাড়ি। আমরা ফিরে পেলাম যৌবন-জৌলুস আর পেখম মেলে নাচবার নাগ পূর্ণিমা।

অবাক পথিক আরও অবাক হলেন, আমার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি?

হ্যাঁ।

কিন্তু কেন?

আবারও হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে কনিষ্কা— মান্যবর অতিথি, আগে আপনি চলুন ভেতরে। রাজপ্রসাদের ভেতরে গেলেই আপনি সব জানতে পারবেন।

চলুন।

কনিষ্কার পেছনে পেছনে রাজবাড়ির ভেতরে ঢোকেন অতিথি। কনিষ্কার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে তাকিয়ে বিস্মিত— এই ধরনের একটি প্রাসাদ তিনি কোথায় যেন দেখেছেন! কোথায় দেখেছেন? প্রাসাদগুলোর দেয়াল সাদা। মনে হচ্ছে চকখড়ি দিয়ে তিনিই কোনো এক নিস্প্রদীপ সময়ে এঁকে গেছেন দেয়ালগাত্রে মর্মর সাদা শ্লোক। কোন সময়ে একেঁছিলেন? মনে করতে চাইছেন, কিন্তু এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেন না। বিভ্রান্ত অতিথি চতুর্দিকে তাকাচ্ছেন আর হাঁটছেন। হাঁটছেন আর তাকাচ্ছেন। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছেন, অতুলনীয় প্রাসাদ কোন কাব্যকলার নির্যাস থেকে গ্রহণ করা হয়েছে? নাকি বিভ্রম বিভঙ্গের মৈথুন লগ্নের উদ্ভাস! রাজবাড়ির এই কলাবতী কন্যা কে? রাজনর্তকী আমার অপেক্ষায় শত শত বছর? কেন? আমি কি নিঃসঙ্গ দিনযাপনের কাপালিক? পথ ভুল করেছি কপালকুণ্ডলার সন্ধানে? নাকি আমাকে ডাকছে হৈমন্তী? হৈমন্তী কেন হবে? মেয়েটি চমক লাগানো অনল সরলতা ঠিক ঠিক রাজলক্ষীকে মনে করিয়ে দেয়। শ্রীকান্তকে যে বারবণিতা দিয়েছিল আশ্রয়সেবা, প্রেম এবং নিদারুন অবহেলার পাটখড়ি। রাজবাড়ির রাজনর্তকীরা কি কপালকুণ্ডলা, হৈমন্তী বা রাজলক্ষীদের প্রতিনিধি? অতিথি দেখতে পেলেন চারদিকের নিঃসীম আলোর ভেতরে কল্পনার অসীম হিমাগুন কারুকাজ।

রাজবাড়ির বিশাল আয়াতন পার হয়ে কনিষ্কা দাঁড়ালেন মূল প্রাসাদের দরজায়। মেহগনি কাঠের বিশাল দরজা আপনার শক্তির দেরাজে খুলে যায়। কনিষ্কা ঘুরে দাঁড়িয়ে আবারও কুর্নিশ জানায়— হে আরাধ্য অতিথি, আপনি প্রবেশ করুন।

আপনি?

মূল প্রাসাদে প্রবেশ করা আমাদের নিষেধ।

বিস্মিত অতিথি ততধিক বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন রাখেন, কেন?

খিল খিল হাসিতে শরীর শর্বরী উথলে ওঠে কনিষ্কার। অতিথি দেখছেন নারীর মখমলে শরীরে কীভাবে হাসির বাদ্য বাজে রিনিক ঝিনিক তালতরঙ্গে।

আপনি কি জানেন না বারঙ্গনাদের পবিত্র প্রাসাদে যেতে নেই?

কেন যেতে নেই?

শাস্ত্রে নিষেধ আছে।

শাস্ত্র?

হ্যাঁ, শাস্ত্র।

কে বানিয়েছে এই শাস্ত্র? অতিথি হঠাৎ ক্ষেপে ওঠেন। মাটির এই পৃথিবীতে বারাঙ্গনাদের চেয়ে পবিত্র আর কী আছে, যারা দেয় দেহের সৌরভ খুলে মাংসের কস্তুরী তোরণ? এইসব কস্তুরী নারী ছাড়া কি চলে পৃথিবী এক মুহূর্ত? যারা এই শাস্ত্র বানিয়েছে তারাই তো বেশি ভোগ করে বারাঙ্গনাদের, খাবলে খাবলে খায় মাংশ পাশবিক। তারাই দখল করে রাখে দুনিয়ার সকল হেরেমখানা। তারা সকল বিলাস ভোগ করে মাটির মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয় ভ্রান্তি। তাদের ছড়ানো ভ্রান্তির কূটজালে আটকে যায় সকল মন, মানুষ আর মদিরা।

আসুন হে মহামান্য অতিথি, মূল প্রাসাদের প্রধান অতিথি সেবক কুমারী নমিতা কুর্নিশ করে দাঁড়ায়। অতিথি সামনে দাঁড়ানো কুমারী নমিতাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারেন না। পাষাণে খোদিত মোমের মূর্তি— অবাক চোখ তুলে তাকিয়ে আছেন। বিহব্বলতায় আক্রান্ত অতিথি তাকান কনিষ্কার দিকে। কনিষ্কা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অনড়। বিভ্রান্ত মেহমান কনিষ্কার দিকে একবার তাকান। একবার তাকান কুমারী নমিতার দিকে। দুই পাশে দুটো দুধ সাদা ধারালো তরবারি দাঁড়িয়ে কাটছে অতিথিকে। কিন্তু রাজকীয় ফরমানের কারণে কনিষ্কাকে পিছিয়ে যেতে হয়। কনিষ্কা পুনর্বার কুর্নিশ জানিয়ে পর পর তিন পা পিছিয়ে উল্টো ঘুরে চলে যায়। মনে হচ্ছে শুভ্র তুষারের চলমান ঝলক যাচ্ছে চোখের তারায় নাচের মুদ্রা আঁকতে আঁকতে। কনিষ্কার জন্য অতিথির ভেতরের কোমল হৃদয় কেমন এক করুণ বাঁশি বেজে ওঠে। সেই বিষণ্ন সুরের মধ্যেই কুমারী নমিতা প্রাসাদের ভেতরে আবারও আহ্বান জানান, আসুন মান্যবর অতিথি। আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে রাজকীয় খাদ্য। প্রস্তুত শত বছরের প্রতীক্ষায় থাকা কোমল পালঙ্ক। আসুন, হে ঘুম ভাঙানিয়া জাগরণের অতিথি আমাদের…

এতক্ষণে খেয়াল হয় অতিথির— কুমারী নমিতার কণ্ঠের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ তালতরঙ্গে সুরের মূর্ছনায় পুষ্পবোটা থেকে যেন ঝরে ঝরে পড়ে তীব্র অুনরাগের মতো কামনার শীষে বাজিয়ে বীণ। পথশ্রান্ত পথিক আরও বিভ্রান্ত— আমি এ কোথায় এলাম? আমি কি দ্রাক্ষার কোনো বনে হারিয়েছি পথ? নাকি ছলনার পাশা খেলায় হেরে যাওয়া আমি বিভ্রান্ত পথিক এক! আমাকে খুঁজে ফিরছে রাজবাড়ির হাজার সৈন্য হাতে নিয়ে উন্মক্ত কৃপাণ? আমি কে? কে আমি ধূপলাগা সন্ধ্যার মহেন্দ্রক্ষণে এসেছি উজ্জায়িনীর পথ বেয়ে কুমারী নমিতার আশ্রয়তলে? কুমারী নমিতাই বা কে? দু’জনের কে আমি? পাষাণের কোন বিভ্রমকুসুমের অতল থেকে উঠে এসেছি এই নিঝুম উৎপ্রেক্ষাতলায়?

মুখে মিহি হাসি ফোটে কুমারী নমিতার, মান্যবর অতিথি কি কোনো কারণে চিন্তিত?

নিজেকে নিজস্ব চেতনার বর্ম থেকে মুক্ত করেন তিনি। পাল্টা হাসিতে প্রশ্ন করেন, কেন এমন মনে হলো আপনার?

অনেকক্ষণ ধরে মূল রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি। ভেতরে প্রবেশ করছে না। মনে হচ্ছে আপনি কোনো বিষয়ে চিন্তায় আকুল। তাই জিজ্ঞাসা আমার।

পেছনে ফিরে একবার তাকালেন তিনি, দেখতে চাইলেন খলবল আধারের ভেতরে আলোর উৎসব। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন সামনে, কুমারী নমিতা অপলক তাকিয়ে আছেন। চোখে সমুদ্রের নোনা সফেন। ঠোটে তাম্বুলের চর্চিত রাগ রস লেপ্টে শিল্পের প্রকাশে কাটছে আঙুল। না, আমি কিছুই চিন্তা করছি না। চলুন।

কুমারী নমিতার সঙ্গে প্রবেশ করেন অতিথি। প্রবেশ করেই অতিথির মনে আবারও প্রশ্ন জাগে— এমন সৌরভিত চাকচিক্যময় প্রাসাদ আমি কোথায় দেখেছি? যতই প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন ততই নিজের ভেতর থেকে আকুল হয়ে প্রশ্ন করেন— আমি কোন কুহকের অলীকতলায় প্রবেশ করছি?

প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করে বিশাল বারান্দা পার হয়ে সিঁড়িতে ওঠেন অতিথি। দোতলায় ওঠার পর ডান দিকে নিয়ে যান কুমারী নমিতা। ডান দিকের পাল্লা খুলতেই তিনি দেখতে পান, সামনে বিশাল জলাধার। জলাধারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিশ জন রাজনারী। প্রত্যোকের হাতে মসলিনের তহবন। জল থেকে আসছে ঘৃতকুমারীর সবুজ সৌরভ। এগিয়ে আসেন জলকন্যা লহরী— আাসুন হে মান্যবর অতিথি। আমরা আপনারই অপেক্ষায়, সেই কবে সাজিয়ে রেখেছি স্নানের সকল আয়োজন। পানি কুসুম গরম…

লহরী মুগ্ধ কটাক্ষে বিদ্ধ করেন অতিথিকে, নিমেষে খুলতে শুরু করেন অতিথির পোশাক। হতবিহব্বল অতিথি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন। পোশাক খুলে নেবার পর এগিয়ে আসেন পোশাককন্যা কুমকুম হেনা। স্নানের পোশাক পরাতে শুরু করেন তিনি।

প্রধান রাজনর্তকীকে ঘিরে নাচছে সখিরা। গাইছে গান— হলদি বাটো মেন্দি বাটো বাটো ফুলের মৌ…। গোটা রাজবাড়ি প্রাণের বিপুল স্পন্দনে জাগছে সাড়া সমুদ্র সফেনে, বিম্বিসার বনে কৃষ্ণের বাঁশির সুরে। প্রধান নর্তকী সজাল হাসিতে নিজেকে ভাসিয়ে রেখেছেন হাওয়ায় হাওয়ায়। নাচ-গান শেষে তাকে ঘিরে ধরেছেন সখিরা। কলহাস্যে চাপল্যে গোটা প্রাঙ্গণ মুখরিত। গোল চাকতির মধ্যে একটা পাখি তিনি— সখিদের পায়ের তালে তালে পা রেখে এগুচ্ছেন তন্দ্রালু চন্দ্রযান উড়ালের ছন্দে।

প্রিয় সখি কঙ্কনা ছুটে আসেন কাছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করেন, সখি, তোর মনে কি উঠেছে ঝড়! এতদিন পরে তোর এসেছে নাগর, জানি— অপেক্ষায় অপেক্ষায় তোর পুড়ছে কাঁচা ঘর। আজি কামনা আগুনে ভাঙবে বহ্নি চেতনার চর… বাসনার ঠোঁটে যখন মিলিবে ঠোঁট, ভাঙবে অথৈ পাথর, নেমে যাবে শরীরের সর থেকে যাবে মিহি কাঁকড়…।

লজ্জায় আরক্ত প্রধান নর্তকী হাত ধরে কঙ্কনার, সখি— ফিসফিসিয়ে বলে, সত্যি আর পারছি না নিজেকে সামলাতে। শরীরে আমার নেই যে শরীর, মনে নেই মন… একটি কথাই জিজ্ঞাসিব তারে, কেন কাটিল সে মান্দারের বন…।

গানে গানে নাচে নাচে প্রধান রাজনর্তকীকে নিয়ে যাওয়া হলো হেরেমের সবচেয়ে বড় হাম্মামখানায়। স্বচ্ছ কাছের মতো হাম্মামখানার পারে দাঁড় করায় রাজনর্তকীকে, সখিরা। খুলে নেয় সখিরা শুভ্র শরীরের নিঃস্ব পোশাক। তিনি দাঁড়িয়ে অনড় বন্যরাজসিক গৌরবে। সখিরা জলে মেশায় কস্তরীর সৌরভ। কোমর জলে নামিয়ে প্রধান রাজনর্তকীর শরীরের ভাজে ভাজে ওরা করে লেহন, এতদিনের শ্রান্ত ঘাম গন্ধ শরীরের কোষ থেকে ঝরে যেতে থাকে।

রাজনর্তকীর নিজেকে লাগছে ঝরা পালকের মতো হালকা… দূরের মেঘদলের মতো। হায় দিন হায় রাত্রি… কত বেদনার বিষাদসিন্ধু পার হয়ে তুমি এলে হে! সুরভিত চন্দনচূর্ণে শরীরে করে দলিত-মথিত। শেষে সব সখিদের সঙ্গে সাঁতার কাটেন প্রধান রাজনর্তকী। সাঁতারের পর ফুরফুরে অঙ্গে জোছনার প্লাবন নিয়ে কূলে উঠে আসেন। সখিরা শরীর মুছিয়ে দেয় মখমলে কাপড়ে। সখি তিলোত্তমা জড়িয়ে ধরে চুম্মন করে তার রঙিন ঠোটে, সখি তোকে একটু পরখ করে নিলাম।

সখিগন হেসে ওঠে।

কেমন লাগল হে তিলোত্তমা প্রধান রাজনর্তকীর ঠোঁট— জিজ্ঞেস করে প্রতিদ্বন্দ্বী নর্তকী উর্মিলা ব্যাস।

হাসে তিলোত্তমা— ঠিক কর্পূর দিয়ে বানানো বেনারসি নাড়ুর মতো স্বাদ ওই ঠোঁটের। একবার পুরুষের ঠোঁট মিললে বেচারা বেহুঁশ হয়ে যাবে।

সখি আমাদের যায় যায় যায় হারিয়ে যমুনার জলে… সখিরা গাইতে গাইতে নাচতে নাচতে প্রধান রাজনর্তকীকে নিয়ে যায় সজ্জাকক্ষে। কতভাবে যে সখিরা সাজায় রাজনর্তকীকে— বর্ণনায় শেষ করা যায় না। অপরূপ সাজে সাজিয়ে দাঁড় করায় যখন, মাটির ওপরের লালিত্য লালিমা হারায় লজ্জায়, তুমি এত সুন্দর!

সখিরা হাওয়ায় উড়িয়ে রাজনর্তকীকে সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করে রাজকীয় নৃত্যশালায়। বেজে ওঠে মৃদঙ্গ, ঢোল, কাঁসা, তবলা, এস্রাজ, বেহালা…। বিশাল নৃত্যশালা সুরের বাজনার নাচের ঝংকারে ঝংকারে যখন কেঁপে কেঁপে উঠছে, খুলে যায় রাজকীয় দ্বার। থেমে যায় নাচ, তাল তরঙ্গ-সঙ্গত। পুরো রাজপ্রাসাদ জুড়ে নেমে আসে অসীম নীবর নিস্তব্ধতা। দ্বার সম্পূর্ণ খুলে গেলে অতিথি এসে দাঁড়ান। চোখে বিক্ষত দিনের গভীর আশা আর অনুভবের রক্ততিলক। তাকিয়ে আছেন অতিথি অবিচল নিষ্ঠা, অনুরাগে আর কল্পনার সরল উপমায়, কবিতার সকল দ্রাঘিমা যোগ-বিয়োগ সরল-ঐকিক ঐকান্তিক চোখে…।

প্রধান রাজনর্তকী বসেছিলেন বাম পা মুড়ে, ডান পা সামনে বাড়িয়ে, নাচের ভঙ্গিমায়, মুখের অর্ধেক ঢেকে রঙিন কাপড়ে প্রসারিত ডান হাতে। মুখের কাপড় সরিয়ে তাকালেন অতিথির দিকে, নাটোরের বনলতা সেন পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে বললেন, কবি এতদিন পরে এলেন!

জীবনানন্দ দাশ অবাক। ভেতরে ভেতরে উল্লসিত, আমি হাজার বছর ধরে পথ হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে নাটোরের বনলতার কাছে এসে পৌঁছুতে পারলাম! তিনি আরও ভাবছেন, এখন যদি দু’দণ্ড শান্তি পাই— খুন খারাবি আর পাপ ধর্মোন্মাদনার দুনিয়ায়!

কবিকে রাজনর্তকীরা লহমায় ঘিরে নাচতে থাকে। বিমোহিত জীবনানন্দ দাশ। কবি কবিতায় কতভাবে নারীর বন্দনা করেছেন। নারীর শরীরের গোপন কামরাঙ্গাকে কত উপমায়, উৎপ্রেক্ষায় শব্দে শব্দে নিবেদন করেছেন। কিন্তু কোথাও কারও কাছ থেকে তিনি এমন অনুরাগের যোগ পাননি। নাটোরের রাজনর্তকীর এই অনিন্দ্য রাজকীয় আয়োজনে জীবনানন্দ বাকরহিত।

নাচতে নাচতে কবিকে নিয়ে যায় সখিরা রাজনর্তকীর কাছে। রাজনর্তকী হাত ধরেন কবির, তাকান বিভঙ্গ দৃষ্টির বিলোল কটাক্ষে। কবি এঁকে নেন নতুন এক কবিতার খসড়া, যে কবিতায় তিনি আরও নিপুণ ঐশ্বর্য্যে বর্ণনা করবেন বনলতার অনুরাগ, প্রেমের গৌবর। রাজনর্তকী নিজের হাতে কবিকে বসান পাশে। নিজেও বসেন। আবার বেজে ওঠে বাদ্য-ঢোল, নহবত-মৃদঙ্গ। সখিরা এলায়িত ছন্দে বিহ্বল চিত্তে নাচতে থাকে জীবনানন্দ দাশ ও রাজনর্তকীকে ঘিরে। সখি কনিষ্কা নিয়ে আসে এক পেয়ালা দ্রাক্ষারস। নাচ ছেড়ে সব সখিরা দাঁড়ায় দু’জনকে ঘিরে। দ্রাক্ষা রসের পেয়ালা দেয় রাজনর্তকীর হাতে। রাজনর্তকী বিনম্র লজ্জায় চোখ নিজের দিকে রেখে কবির মুখের কাছে পেয়ালা এগিয়ে ধরেন। সখিরা কবির মুখ নিয়ে আসে পেয়ালার কিনারে, কবি এক চুমুক দেন। শীতল দ্রাক্ষারসে কবির বুভুক্ষ বুক জুড়িয়ে যায়। মনে হয়— তিনি সুখ সমুদ্রের বিছানায় শুয়ে আছেন।

সখিরা পেয়ালা নিয়ে যায় রাজনর্তকীর মুখের কাছে। রাজনর্তকী এক চুমুক পান করে দ্রাক্ষা রস। ওপর থেকে পড়ছে পুষ্পবৃষ্টি।

বেজে ওঠে ঘণ্টা— দ্রিম দ্রিম দ্রিম। ভেসে আসে ঘোষণা— কবির সঙ্গে এক আসনে বসে দ্রাক্ষারস সেবনের ফলে আজ থেকে দু’জনে স্বামী-স্ত্রী। রজনর্তকী সঙ্গে সঙ্গে আনত হয়ে কবির দুই পায়ের ওপর প্রণতি জানান। কবির মুখে অভয় কল্যাণ আর শুভবোধের চির অমলিন হাসি। তিনি দু’হাতে তুলে ধরেন রাজনর্তকীর মুখ— তাকিয়ে থাকেন অপলক, নিবিড়, গভীর, অচঞ্চল।

আবার বেজে ওঠে বাদ্য… ক্রিক ক্রিক ক্রিক…।

ভেসে আসে ঘোষণা— এবার হবে যজ্ঞ।

সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায় অর্ধেক আলো। গোটা রাজদরবারে নেমে আসে আধো আলোর অন্ধকার। রাজনর্তকীর শরীর থেকে খসে যায় সকল পোশাক। জীবনানন্দ দাশ বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে দেখেন— সব নর্তকী উলঙ্গ। প্রাঙ্গণজুড়ে শোনা যাচ্ছে নাগিনীর কান্নার বিউগল।

এসব কী হচ্ছে— কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন কবি জীবনানন্দ দাশ।

বীভৎস হাসেন প্রধান রাজনর্তকী। কবি, আপনি প্রেম ও শান্তির বারতা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে কি প্রেম ও শান্তি বলে কিছু আছে? নেই। আমাদের রাজ্যেও কোনো সুখ নেই, শান্তি নেই। আছে পান, পান এবং রক্তপান। হাজার বছর ধরে তোমার অপেক্ষায়। কারণ তোমার রক্তপান করব আমরা।

মানে!

সখিরা, ধর আমার প্রিয় কবিকে। শুইয়ে দে রাজদরবারের রাজকীয় বিছানায়। প্রধান রাজনর্তকীর চোখে জল, দেখিস আমার কবি যেন এক বিন্দুও কষ্ট না পায়।

সখিরা নাচের তালে তালে কবিকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কবি জীবননান্দ দাশ হাত-পা ছোঁড়েন। নিজেকে মুক্ত করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। কিন্তু নর্তকীদের অজস্র হাতের পেষণে তিনি ক্রমশ অবশ হতে থাকেন। প্রধান রাজনর্তকীর হাতে কৃপাণ। চলে আসে কবির মাথার কাছে। জীবনানন্দ দাশ তাকিয়ে আছেন বিস্ফোরিত চোখে, এই বনলতা সেনকে কি আমি…

জীবনানন্দ দাশ আর ভাবতে পারলেন না। তার মসৃণ গলার ওপর নেমে আসে তীক্ষ্ণ কৃপাণের তীব্র হলাহল। অনিবর্চনীয় স্নিগ্ধ হাসিতে কবি জীবনান্দ দাশের গলার ওপর চালালেন কৃপাণ। জীবনানন্দ দাশ ছটফট করে উঠলেন কয়েক মুহূর্ত, সব নীরব। কাটা গলা আর মুণ্ডুর ফাক দিয়ে গরগর শব্দের সঙ্গে বের হচ্ছে রক্ত— কাব্যমণ্ডিত রক্ত, ভেজা ঘাসের রক্ত, ডাহুকের ডাকের রক্ত, হিজল আর গাঙুরের জলের রক্ত, হটি বনের বর্ণযুক্ত রক্ত… রক্ত রক্ত আর রক্ত…।

প্রধান রাজনর্তকী কৃপাণ দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রক্ত নগ্ন শরীরে মাখতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে সখিরাও মাখতে লাগলেন— নগ্ন শরীরে রক্ত মাখতে মাখতে নাচতে শুরু করে সবাই মিলে…। সেই রক্তনাচ এখনো চলছে। আইএস বলছে— এই রক্ত উৎসব চলতেই থাকবে…

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন