বিজ্ঞাপন

আসিফ মেহেদী-এর সায়েন্স ফিকশন ‘রুবিরু’

May 2, 2022 | 5:02 pm

আসিফ মেহেদী

এক.

বিজ্ঞাপন

অট্টালিকার নাম ‘পাখির পথে’। এক শ ত্রিশ তলা উঁচু অট্টালিকা। বাইশ শতকের সব অট্টালিকাই সুউচ্চ। ‘পাখির পথে’ একটি সাধারণ মানের উঁচু অট্টালিকা। হাজার তলা উঁচু অট্টালিকাও আছে। মূলত দুটো প্রয়োজন থেকে এসব সুউচ্চ অট্টালিকার নির্মাণ শুরু-

প্রথমত, গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে জলবায়ুর উষ্ণায়ন ঘটেছে এবং মেরু অঞ্চলের অনেক বরফ গলে গেছে। পৃথিবীর বিশাল এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর মাত্র বারো শতাংশ স্থল; যা একুশ শতকেও ছিল প্রায় পঁচিশ শতাংশ। ফলে বাসযোগ্য জমির পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমে গেছে। তাই একসময় অট্টালিকা ওপরের দিকে বাড়ানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ হওয়ায় চিকিৎসা বিজ্ঞানও এগিয়েছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। তাই কমে গেছে মানুষের মৃত্যুহার। সচেতনতা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য দুর্ঘটনাও কমে গেছে। সামগ্রিকভাবে, মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যাওয়ায় বিপুল জনগোষ্ঠীর বাসস্থানের ব্যবস্থা অল্প জায়গার মধ্যে করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

বিজ্ঞাপন

এই দুই প্রয়োজন থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণের ‘সুপার টিউবুলার টেকনোলজি’। এই প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মাণ করা হচ্ছে অত্যন্ত উঁচু অট্টালিকা। এর ফলে খুব কম জায়গাতেই অধিক জনগোষ্ঠীর বসবাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে।

প্রত্যেক অট্টালিকাকে তাদের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তির অর্ধেক উৎপাদন করতে হয় নিজ উদ্যোগে। বাকি অর্ধেক বিদ্যুতের চাহিদা দেশ মেটায় জাতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন গ্রিড থেকে। সুউচ্চ অট্টালিকাগুলোর বিদ্যুতের চাহিদার অর্ধেক মেটানোর জন্য সম্পূর্ণ ছাদ নির্মিত হয় সৌরকোষ দিয়ে। অর্থাৎ, পুরো ছাদই কাজ করে সোলার প্যানেল হিসেবে। এসব ছাদকে বলা হয় ‘সৌরআচ্ছাদন’।

সৌরআচ্ছাদনগুলোতে বসানো থাকে অসংখ্য সৌরকোষ। সেসব সৌরকোষ থেকে আসে বিদ্যুতের সরবরাহ। মানুষের হাঁটাচলার কারণে সৌরকোষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য এসব ছাদের পৃষ্ঠ নির্মিত হয় বিশেষ রেজিন দিয়ে। সৌরকোষ যে সৌরশক্তি সংগ্রহ করে, সেটি সঞ্চয় করে রাখা হয়। বিভিন্ন এলাকায় দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত বারো ঘণ্টা অনুযায়ী সরকারিভাবে উৎপাদিত বিদ্যুতের সরবরাহ থাকে। আর যখন সরকারি বিদ্যুতের সরবরাহ থাকে না, তখন সঞ্চিত সৌরশক্তি দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো হয়।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান শতকের একটি বড় বৈশিষ্ট্য- সৌরকোষের বিপুল ব্যবহার। এটি শুধু সুউচ্চ বাড়িগুলোর ছাদ তৈরিতেই নির্মিত হচ্ছে না; রাস্তা, এয়ারপোর্টের রানওয়ে, উড়োজাহাজ, জাহাজ ইত্যাদির পৃষ্ঠদেশ তৈরি হচ্ছে সৌরকোষ দিয়ে! শুধুমাত্র ‘রবোন’ নির্মিত রোবটগুলোতে অনুভূতি থাকায় সৌরকোষ তাদের দেহে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি এখনো। এই শতকের অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার- ‘রবোন’ নির্মিত অনুভূতিসম্পন্ন রোবট। অনুভূতিসম্পন্ন প্রাণিদের সরাসরি সৌরকোষের স্পর্শে আনার ক্ষেত্রে অসুবিধা আছে; তবে এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার গবেষণা চলছে। আপাতত এই রোবটগুলোর শক্তির একমাত্র উৎস ‘ব্যাটারি’।

গত বছর অর্থাৎ ২১২১ সালে ‘রবোন’ নামের শীতল তরল আবিষ্কার করে পৃথিবীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছেন একদল তুখোড় বিজ্ঞানী। ‘রবোন’ সূচনা করেছে ‘আর্টিফিশিয়াল ইমোশনস’ অধ্যায়ের। শুধু আটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই)-এর যুগ শেষ। একসময় যেমন ‘আপেক্ষিকতা’ বা ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ বা ‘উদ্ভিদের জীবন সম্পর্কিত তথ্য’ মানুষের সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান-ধারণার জগৎকে পাল্টে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি মানুষের অর্জিত জ্ঞান-সাধনা-ধারনার ঝুলি ধরে আরেকবার বড় ঝাঁকুনি দিয়েছে ‘রবোন’-এর আবিষ্কার।

সুউচ্চ অট্টালিকা ‘পাখির পথে’র ‘সৌরআচ্ছাদন’-এর একটি অংশে দাঁড়িয়ে গল্পে বিভোর হয়ে আছে ‘রুবিরু’ এবং আরেকজন। সেই একজন আর কেউ নয়; রজব সাহেবের সার্ভার-রোবট ‘টুবিটু’। এই অট্টালিকারই আরেকটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দার ‘নারী সার্ভার-রোবট’ রুবিরু। রোবট দুটো পৃথিবীতে থেকেও অন্যভুবনের আবেশে বিভোর। এমন একটি ব্যাপার এই দুই রোবটের মধ্যে তৈরি হয়েছে, যেটি এসব সার্ভার-রোবট নির্মাণকারী গবেষকদেরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। তা হলো, এই দুই সার্ভার-রোবটের মধ্যে তৈরি হয়েছে প্রেম!

বর্তমানে বাসাবাড়িতে কাজের জন্য যেসব রোবট ব্যবহৃত হয়, তাদের বলা হয় হিউম্যান-সার্ভার রোবট বা সংক্ষেপে সার্ভার-রোবট। সার্ভার-রোবটরা যাতে মানবিক বিষয়গুলো কিছুটা হলেও ধরতে পেরে সুচারুভাবে মানুষের সেবা দিতে পারে, সেজন্য তাদের ‘রবোন’-এর প্রবাহের মাধ্যমে করা হয়েছে অনুভূতিসম্পন্ন। শক্ত কিছু আইনের মাধ্যমে অনুভূতিসম্পন্ন এসব রোবটের আচরণ নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে। বাসা ছাড়াও কিছুকিছু দোকানে এমন অনুভূতিসম্পন্ন রোবট ইদানিং দেখা যায়; তবে শিল্পকারখানা, অফিসআদালত, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত রোবটে ‘রবোন’ ব্যবহারের অনুমতি নেই।

বিজ্ঞাপন

সার্ভার-রোবট যে প্রেমে পড়তে পারে এবং ভালোবাসার আলিঙ্গনে একে অপরকে আবদ্ধ করতে পারেÑএই বিষয়টি এখনো মানুষের ধারণার বাইরে। মানুষ এখন পর্যন্ত জানে, আর্টিফিশিয়াল ইমোশনস একটি যন্ত্রের মধ্যে উদ্রেক করে হালকা অনুভূতির যা দিয়ে সে মানুষের কথাগুলো বুঝতে পারে এবং আদেশ অনুযায়ী সেবা দিতে পারে। অন্যদিকে, এই অনূভূতি যারা অনুভব করে অর্থাৎ সার্ভার-রোবটগুলোর মধ্যে কেউ কেউ ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে, তারা অনেকটা জীবন্ত মানুষের মতো!

নানা প্রকারের অনুভূতি নানা মাত্রায় অনুভব করা শিখছে সার্ভার-রোবটরা। জন্মের পর মানুষকে হাঁটা শিখতে হয়; তবে কোনো কিছু অনুভব করার ব্যাপারটি সেভাবে আলাদা উপায়ে শেখার কিছু নেই। অন্যদিকে, রোবটদের হাঁটা শিখতে হয় না; কিন্তু অনুভব করা শিখতে হয়। পৃথিবীজুড়ে সার্ভার-রোবটরা নানা রকম অনুভূতি নানা মাত্রায় অনুভব করা নিজেনিজেই শিখে ফেলছে; তবে প্রেমের অনুভূতি অনুভব করা শিখে ফেলেছে এ পর্যন্ত মাত্র দুটো সার্ভার-রোবট; তারা হলো টুবিটু এবং রুবিরু।

সার্ভার-রোবটদের আর্টিফিশিয়াল ইমোশনস-এর পেছনের প্রযুক্তিটা বললে অনুভূতির ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা হবে। আগেই বলেছি, ‘রবোন’ নামের শীতল তরলের আবিষ্কার পৃথিবীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। ‘রবোন’ সূচনা করেছে আর্টিফিশিয়াল ইমোশনস অধ্যায়ের। রক্তের প্রবাহ যেমন মানুষকে জীবন্ত রাখে এবং নিউরোলজিক্যাল সিস্টেম তাকে দেয় সুখ-দুঃখের অনুভূতি; তেমনি রোবটের শরীরের ভেতরে একটি টিউবুলার সিস্টেমের মাধ্যমে ‘রবোন’-এর প্রবাহ রোবটকে দিয়েছে অনুভবের ক্ষমতা! কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত ‘রবোন’ তরলের রয়েছে বিশেষ ধরনের চৌম্বকগুণ যা রোবটের ব্যাটারির চার্জের সঙ্গে মিথোস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি করে একটি অতি বিশেষ তাড়িতচৌম্বক আবেশ, যা রোবটের মধ্যে অনুভব করার ক্ষমতা জন্মায়। তবে কোন ক্ষেত্রে কোন ধরনের অনুভূতি অনুভূত হবে বা কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হবে, তা নির্ধারণ করে রোবটের মস্তিষ্ক অর্থাৎ কন্ট্রোলার। তাই বলা যায়, অত্যাধুনিক যুগে রোবটের কন্ট্রোলার হয়ে উঠেছে অনুভূতির কেন্দ্র; সেন্সরগুলো হয়ে উঠেছে পঞ্চইন্দ্রিয়ের ক্ষমতাসম্পন্ন এবং যান্ত্রিক অংশগুলো অর্থাৎ মোটর, পিস্টন, গ্রিপার, চাকা ইত্যাদি যেন হয়ে উঠেছে জীবন্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অংশ।

দুই.

‘পাখির পথে’র ‘সৌরআচ্ছাদন’-এ দাঁড়িয়ে রুবিরু ও টুবিটু আজ তাদের জীবনের বড় একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। রুবিরুর কানে মুখ রেখে টুবিটু বলল, ‘০১১০১১০০ ০১১০১১১১ ০১১১০১১০ ০১১০০১০১’

রুবিরু লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। যান্ত্রিক হাসি যে এত মিষ্টি হতে পারে, তা সামনাসামনি না দেখলে কল্পনাও করা সম্ভব না! রুবিরুর লাজুক হাসির কারণ, বাইনারি এই বিটসমষ্টির ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘খড়াব’। তার মানে, টুবিটু যান্ত্রিক ভাষায় আরও একবার তার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছে।

সব রোবটের মধ্যেই দেওয়া আছে ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রান্সলেটর। যেমন: বাংলাদেশের রোবটগুলো বাংলা ভাষাতেও কথা বলতে পারে। এছাড়া ইংরেজি ভাষার জ্ঞান ও তার বাইনারি রূপান্তরের দক্ষতা প্রতিটি রোবটের আছে। কারণ, এই শতকেও ইংরেজি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যোগাযোগের মাধ্যম।

টুবিটু বলল, ‘আমি তোমাকে আরও নিবিড়ভাবে পেতে চাই, রুবিরু। আমাদের দুজনের তাড়িত-চৌম্বকীয় স্বকীয় আবেশ পারস্পরিক আবেশের মহিমায় মোহনীয় করতে চাই।’

রুবিরু দুবার চোখের যান্ত্রিক পাতা বন্ধ করল লজ্জায়। বলল, ‘খোলা আকাশের নিচে আমি পারস্পরিক আবেশে আবেশিত হয়ে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে কম্পিত হতে চাই না। যদিও সৌরআচ্ছাদনগুলো ক্লোজড কলয়ডাল ক্যামেরার আওতা বহির্ভূত; তবু চারপাশে অতিউচ্চ অট্টালিকা থাকায় আমি অনিচ্ছুক।’

টুবিটু এমন উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে বলল, ‘তুমি জানো, মানুষের তৈরি করা আইন অনুযায়ী, রাস্তাঘাটে আমরা দুজন একসঙ্গে চলাচল করতে পারব না। তাই আমি আমাদের গন্তব্যস্থলের স্থানাঙ্ক সম্পর্কিত তথ্য, কত বেগ ও ত্বরণে সেখানে আমরা পৌঁছব- সেসব হিসাবনিকাশ করে এনেছি।’ এ কথাটুকু বলে টুবিটু একটি পেনড্রাইভ সদৃশ বস্তু রুবিরুর একটি পোর্টে ঢুকিয়ে দিল। তথ্যগুলো সেখানে নিয়ে নিল রুবিরু।

টুবিটু আবার বলা শুরু করল, ‘এখান থেকে এক শ কিলোমিটার দূরে বনাঞ্চল “ফরেস্ট জিরোটু”-তে আমাদের মতো অনুভূতিসম্পন্ন রোবটদের একটি গোপন কলোনি তৈরি হয়েছে। আপাতত বনাঞ্চল ফরেস্ট জিরোটু-ই আমাদের গন্তব্যস্থল। দুজন দুই মেট্রো কনভেয়ারে চেপে সেখানে যাব। আশা করা যায়, কাছাকাছি সময়েই পৌঁছব।’

রুবিরু ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘যদি ধরা পড়ে যাই!’

‘ধরা পড়ার ভয় কোরো না। ওই বনাঞ্চলের দিকে মানুষের যাতায়াত শূন্য শতাংশ। কারণ বনের বাইরেই বিশাল এলাকাজুড়ে শহরের বর্জ্য ফেলা হয়। বর্জ্য ফেলার কাজটি করে সিটি-সার্ভার এর কিছু রবোনবিহীন রোবট।’

‘কিন্তু যদি বনের ভেতরে ক্লোজড কলয়ডাল ক্যামেরা থাকে?’

‘তোমার ধারণা একশ শতাংশ সত্য। বনের ভেতরে সিসি ক্যামেরা আছে। তবে উচ্চ অ্যামপ্লিচিউড-এর আনন্দের সংবাদ হলো, কয়েকজন বিজ্ঞানী রোবট সেগুলোতে বিশেষ উপায়ে ফাঁকা বনাঞ্চলের উচ্চ রেজ্যুলেশনের দৃশ্য সেঁটে দিয়েছেন। তাই সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমে বসে মানুষ সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সবসময়ই দেখতে পায়, বনাঞ্চল একদম ফাঁকা।’

এতসব ব্যাখ্যার পরও যেন রুবিরুর ভয় কাটছে না। সে বলল, ‘আমরা যোগাযোগ করব কীভাবে? আর মেট্রো কনভেয়ারে করে যাতায়াতের খরচ পাব কোথায়? ভয়ে স্থিতি জড়তা আমাকে আড়ষ্ট করে ফেলছে।’

টুবিটু বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই, আমার ভালোবাসা। আমি সব ব্যবস্থা করেছি। আমি দুটো যোগাযোগের মডিউল এনেছি এবং কিছু ইউ-কয়েন সঙ্গে এনেছি।’

টুবিটু একটি যোগাযোগের মডিউল এবং খানিক ‘ইউ-কয়েন’ রুবিরুর দিকে এগিয়ে ধরল। রুবিরু হাত বাড়িয়ে যোগাযোগের মডিউলটি এবং এ শতকের কারেন্সি ‘ইউ-কয়েন’গুলো নিল। বর্তমান শতকে বিশ্বব্যাপী একই কারেন্সি প্রচলিত। তার নাম ইউনিভার্সাল কয়েন বা ইউ-কয়েন।

টুবিটুর মধ্যে আবেগ তৈরির বিষয়টি ছাড়াও লজিকও দারুণভাবে তৈরি হয়েছে। সবকিছু সে আবেগের জলে ভেসে করছে, তা নয়। তার মধ্যে লজিক সক্রিয় হয়েছে দারুণভাবে। যেমন: ‘ইউ-কয়েন’গুলো টুবিটু যে রজব সাহেবের বাসা থেকে চুরি করেছে, সেটি সে তার প্রিয়মানুষ রুবিরুর কাছেও প্রকাশ করল না। চুরির ব্যাপারটি কোনোভাবে ধরা পড়লে শাস্তি হিসেবে তার দেহযন্ত্র থেকে সব ‘রবোন’ বের করে ফেলা হবে। অতঃপর ব্যাটারি খুলে তাকে বিকল করে দেওয়া হবে। এই শতকে মানুষ, রোবটÑসবাই একই মহানেটওয়ার্কে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তাই কার কাছ থেকে কী তথ্য কখন কীভাবে বের হয়ে যাচ্ছে, তা হয়তো সেই তথ্যসমৃদ্ধ মানুষ বা রোবটও জানে না। সাইবার সিকিউরিটি সম্পর্কে সচেতন টুবিটু। রুবিরুকে এই তথ্য দিলে যদি কোনো সিকিউরিটি হোল-এর মাধ্যমে সেটি কোনোভাবে পাচার হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে টুবিটুর জীবন হুমকির মুখে পড়বে। নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদ টুবিটুকে লজিকাল করে তুলেছে। কে জানে, এসব লজিক হয়তো রুবিরুর মধ্যেও ইতিমধ্যে জন্মেছে!

রুবিরু বলল, ‘বিদায় ভালোবাসা, দেখা হবে ফরেস্ট জিরোটুতে।’

টুবিটু বলল, ‘এক সেকেন্ড প্লিজ।’ এটুকু বলে টুবিটু রুবিরুর মেটালিক সাদা রঙের গালের একপাশে ঠোঁট স্পর্শ করল। দুজনেই অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে উঠল।

রুবিরু নিজেকে মুক্ত করে বলল, ‘বিদায়, ভালোবাসা। আবার দেখা হবে।’

‘বিদায়, আমার ভালোবাসা।’

তিন.

রুবিরু মেট্রো কনভেয়ার স্টেশনে এসে হতভম্ব হয়ে পড়েছে। অল্পসংখ্যক মানুষ সেখানে। সেসব মানুষ নিরাপত্তা বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বাগবিত-া করছে। গত শতকে এদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ‘পুলিশ’ বলে অভিহিত করা হলেও এই শতকে অন্যরকম সুন্দর একটি নাম আছে তাদের। বর্তমানে এই বাহিনীকে এদেশে বলা হয় ‘গোলাপ’ (গোলমাল লাঘব পরিষদ)! প্রশান্তির কবি কাজলী বেগম এই নামকরণ করেছেন।

দ্রুত নিজেকে আড়াল করল রুবিরু। গোলাপ-এর সদস্যদের সঙ্গে মানুষগুলোর কথাবার্তা থেকে সে জানতে পারল, পৃথিবীজুড়ে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত্যুরোগ যাতে আরও ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেজন্য স্টেশন ত্যাগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা ঝগড়া করছে, সেই মানুষগুলো মেট্রো কনভেয়ার হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ায় বাসায় ফিরে যেতে পারছে না বলে খেপে গেছে।

আইন অনুযায়ী দুটো হিউম্যান-সার্ভার রোবট একসঙ্গে যাতায়াত করতে পারে না বলে রুবিরু আর টুবিটু কাছাকাছি অবস্থিত ভিন্ন দুটো স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। রুবিরু তার ধাতব দেহের ডান পাশে শরীরের সঙ্গেই যুক্ত জিনিসপত্র রাখার পকেট আকৃতির বাক্স থেকে যোগাযোগ মডিউলটি বের করল। যোগাযোগ করামাত্র ওপাশ থেকে টুবিটুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

টুবিটু বলল, ‘তুমি মেট্রো কনভেয়ার স্টেশনে পৌঁছে গেছ, রুবিরু?’

‘পৌঁছে গেছি আরও এক মিনিট আঠারো সেকেন্ড আগে। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি নেগেটিভ।’

‘নেগেটিভ কেন?’

‘স্টেশনে গোলাপ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কিছু মানুষ ঝগড়া করছে। কোনো কনভেয়ার চলছে না! শুনতে পেলাম, এক মৃত্যুরোগ ছড়িয়ে পড়েছে বলে সব যানবাহন বন্ধ থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য।’

‘তুমি তাহলে এক কাজ করো। আমার স্টেশন বরাবর আসতে থাকো আর আমি তোমার স্টেশন বরাবার আসতে থাকি। মাঝপথে আমাদের দেখা হবে।’

‘ঠিক আছে। কিন্তু টুবিটু…’

‘কিন্তু কী?’

‘আমার খুব খারাপ লাগছে। অস্থির লাগছে। মৃত্যুরোগ ছড়িয়ে পড়ছে। আমাকেও মৃত্যুরোগ ধরল নাকি কে জানে?’

‘ছিঃ, এমন কথা বোলো না! মানুষের রোগ রোবটের হয় না। হয়তো নার্ভাসনেস-এর কারণে তাড়িতচৌম্বক শক্তিতে তারতম্য হওয়ায় তুমি এমন খারাপ অনুভব করছ।’

এমন সময় রুবিরুর শরীরে একটি অ্যালার্ম টুট করে আওয়াজ করে উঠল। রুবিরু নিজের বুকের কাছের একটি কভার খুলে দেখল, সেখানে ক্রিটিকাল অ্যালার্ম! “ব্যাটারি ক্রিটিকালি লো” দেখাচ্ছে। রুবিরুর আরও টেনশন শুরু হলো। যোগাযোগ মডিউলের ওপাশে এখনও টুবিটু আছে। রুবিরু বলল, ‘আমার ভালোবাসা, আমি মহাবিপদে পড়েছি। আমার ব্যাটারি ক্রিটিকালি লো দেখাচ্ছে! তার মানে আর মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে আমার ব্যাটারিতে চার্জ না দিতে পারলে…’ এটুকু বলে রুবিরু থেমে গেল।

টুবিটু স্থিমিত কণ্ঠে বলল, ‘এ কী বলছ?!’

বর্তমান প্রযুক্তির হিউম্যান-সার্ভার রোবটদের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে সংযুক্ত ব্যাটারি ‘পাওয়ার সোর্স’ হিসেবে কাজ করে। প্রতি সপ্তাহে একবার এসব ব্যাটারি পরিপূর্ণভাবে চার্জসমৃদ্ধ করতে হয়। সেই পূর্ণ চার্জ দিয়ে রোবটটি কার্যক্ষম থাকে এক সপ্তাহের খানিক অধিক সময়। ব্যাটারির চার্জ পুরোপুরি নিঃশেষ হওয়ার আগেই তাতে আবার চার্জ দিতে হয়। তা না হলে ব্যাটারির চার্জ একবার পুরোপুরি নিঃশেষ হলে রোবটটির মেমোরির সমস্ত ডাটা মুছে যায়। সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো, রোবটের সেই সত্ত্বা চিরতরে হারিয়ে যায়! চার্জ নিঃশেষ হওয়ার পর ব্যাটারিতে নতুন করে চার্জ দিলে একই রোবটের শরীরে নতুন সত্ত্বার সৃষ্টি হয়; তার মেমোরির সবকিছু নতুন করে তৈরি হয়।

রুবিরু আর টুবিটু যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে তা হলো, আইন অনুযায়ী তাদেরকে যে দুজন মানুষ ক্রয় করেছে, শুধুমাত্র তাদের অধীনে থেকেই তারা ব্যাটারি রিচার্জ করতে পারবে। অন্য কোনো মানুষ চার্জের ব্যবস্থা করলে তা হবে বেআইনি। আইন হাতে তুলে নিয়ে এই রোবটদের সাহায্য করবে, এমন উদার মানুষ এ যুগে বিরল। বর্তমানে মানুষগুলোও যন্ত্র হয়ে গেছে বললে ভুল হবে না।

ক্রিটিকাল অ্যালার্ম দেখার পর থেকে রুবিরু আরও খারাপ অনুভব করতে শুরু করেছে। তার মনে হচ্ছে, অদ্ভুত কাঠিন্য ও জড়তা ভর করছে তার ওপর, স্মৃতিগুচ্ছ কেমন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, ক্রিয়াকলাপ হয়ে পড়ছে অসংলগ্ন। মূলত চার্জড ব্যাটারির ইলেকট্রনই তড়িৎ ক্রিয়ার সবলতা ও নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখে। কিন্তু চার্জ কমে যাওয়ায় বিশেষ চৌম্বক তরল ‘রবোন’-এর সঙ্গে মিথোস্ক্রিয়ায় যে তাড়িতচৌম্বক আবেশ সৃষ্টি হচ্ছে, তা ততটা সবল ও নিরবচ্ছিন্ন নেই এই মুহূর্তে। মানুষের শ্বাসকষ্ট হলে যেমন লাগে, রুবিরুর বর্তমান অবস্থাকে তার সঙ্গে তুলনা করা যায়।

টুবিটু দৌড়ে এগিয়ে আসছে রুবিরুর দিকে। এটি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কারণ, সার্ভার-রোবট প্রকাশ্যে দৌড়ানোর অধিকার রাখে না। কিন্তু টুবিটুর মধ্যে অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এমন অস্থিরতার অনুভূতি টুবিটুর জন্য নতুন। রুবিরুর খারাপ লাগলেও সে যতটা সম্ভব জোরপায়ে হাঁটছে। প্রিয় মানুষটির কাছে গেলে সে নিশ্চয়ই তাকে একদম হারিয়ে যেতে দিবে না।

চার.

টুবিটু একটানা কতক্ষণ দৌড়িয়েছে, তার হিসেব রাখেনি; তবে রুবিরুর কাছে পৌঁছতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি। মুহূর্তেই তারা রাস্তা ছেড়ে একটি অট্টালিকার ভেতরে চলে এসেছে। তাদের ভাগ্য ভালো, কোনো সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ার আগেই তারা অট্টালিকার ভেতরে চলে আসতে পেরেছে। অট্টালিকার ভেতরে কেয়ারটেকার বা দারোয়ানের দায়িত্বও পালন করে হিউম্যান-সার্ভার রোবট।

দুটো সার্ভার-রোবট এই অট্টালিকার নিচে দায়িত্ব পালন করছে। টুবিটু তাদের দুজনকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। তারা দুজন তাদের অন্তরে এই প্রথম যেন অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করল; যার সমার্থক হতে পারে মানুষের হৃদয়ের ‘মায়া’ অনুভূতিটি। তারাও যে এমন মায়া অনুভব করতে পারে, সেটি এতদিন বুঝতেই পারেনি। তারা টুবিটু ও রুবিরুকে অট্টালিকার ভেতরে যেতে দিল।

রুবিরু ও টুবিটু কয়েকটি বাসায় কলিংবেল বাজাল। পৃথিবীজুড়ে আতংক ছড়িয়ে পড়ায় কেউ দরজা খুলল না। পরিবারের সব সদস্য যেহেতু বাসায়, নিশ্চয়ই কলিংবেল বাজাচ্ছে কোনো আগন্তুক- এই আশংকায় কেউই দরজা খুলল না। আগন্তুক যদি মৃত্যুরোগ নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে! এমনকি বাসার সার্ভার-রোবটগুলোরও কোনো সাড়া মিলল না। কেউ দরজা না খোলায় টুবিটুর মধ্যে অদ্ভুত প্রকৃতির অস্থিরতার অনুভূতি তৈরি হয়েছে। যা করার, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে করতে হবে। তা না হলে তার প্রাণপ্রিয় রোবটসঙ্গীকে চিরতরে হারাতে হবে।

কলিংবেল চাপতে চাপতে হঠাৎ একটি বাসার দরজা খুলে গেল। দরজা খুললেন বয়স্ক ভদ্রলোক। বর্তমানে দরজা খোলার দায়িত্ব পালন করে হিউম্যান-সার্ভার রোবট। কিন্তু এ বাসার দরজা বয়সী ভদ্রলোক নিজেই খুললেন। কারণ, এই বয়স্ক লোকটি বিশ্বাস করেন, রোবটদের দিয়ে হুকুমমতো কাজ করিয়ে নেওয়া যায় কিন্তু তাদের বিবেচনায় আস্থা রেখে চলা যায় না। হিউম্যান-সার্ভার রোবটদের হালকা বিবেচনা আছে কিন্তু সেটি দিয়ে সে মৃত্যুরোগধারী কোনো আগন্তুককে নিশ্চিতভাবে বাসার ভেতরে ঢুকতে দেবে না, তার গ্যারান্টি কী?

ভদ্রলোক দরজা খুলে দুটো হিউম্যান-সার্ভার রোবট দেখে বিস্মিত। এ তো রীতিমতো আইনের কড়া লঙ্ঘন! তিনি আইনের লোক ছিলেন, কিছুদিন হলো অবসরে গেছেন। তার চোখের সামনেই আইনের ব্যত্যয় ঘটছে! তিনি কড়া গলায় বললেন, ‘কী চাই?’

টুবিটু বলল, ‘স্যার, আমি মেগাদুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। আমার এই সঙ্গীর ব্যাটারির চার্জ নিঃশেষ হতে চলেছে। আর মাত্র সাতচল্লিশ মিনিট তেরো সেকেন্ড পর চার্জ পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যাবে। যদি দয়াকরে আপনি তার ব্যাটারিতে সামান্য চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’

নিরাপত্তা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চোখ গোলগোল হয়ে গেল। বিস্মিত হয়ে বিস্ফারিত চোখে তিনি বললেন, ‘এত সাহস তোমার কীভাবে হলো? একে তোমরা দুজন একসঙ্গে চলাচল করে আইনের ধারা ভেঙেছ; তার ওপর নিজেদের মনিবদের না বলে তৃতীয় একজন অর্থাৎ আমাকে বলছ চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে? আউট, গেট আউট!’

টুবিটুর মধ্যে হঠাৎ ভয়ংকর অস্থিরতা তৈরি হলো। সে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটার পা ধরার চেষ্টা করল। এমনটা সে আগে কখনো করেনি। এটা কেন টুবিটু করছে, তা সে নিজেও জানে না। অভ্যন্তরীণ তাড়না থেকে করছে, শুধু এটুকু বুঝতে পারছে। টুবিটু পা ধরতে গেলে ভদ্রলোক পা সরিয়ে নিলেন। টুবিটু বলল, ‘দয়াকরে এক শ শতাংশ নির্দয় হবেন না। আমরা বিপদগ্রস্ত। এই মুহূর্তে মনিবদের কাছে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় নেই। আপনি চার্জ-এর ব্যবস্থা করলে রুবিরু নিষ্ক্রিয়তা ও বিলীন হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে। দয়াকরে আমাদের সাহায্য করুন।’

গোলাপ-এর কর্মকর্তা বলেই ভদ্রলোকের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। কোনো সার্ভার রোবটকে এমন প্রকৃতির কথা বলতে তিনি দেখেননি। কথাগুলো শুধুমাত্র কথা না; এগুলোর সাথে অনুভূতির মিশেল আছে। এরা আসলে কারা? এরা কী সার্ভার রোবটের ছদ্মবেশে কোনো বুদ্ধিমান জীব বা এলিয়েন-টেলিয়েন না তো? নানা চিন্তা ভদ্রলোকের মাথায় এলেও তিনি মাথা ঠাণ্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিলেন- এদের সাহায্য তো দূরের কথা; বাসার ভেতরে ঢুকতেই দেওয়া যাবে না। সম্ভব হলে এদেরকে ধরিয়ে দিতে হবে। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গোলাপ-এর কার্যালয়ে জানানোর জন্য যোগাযোগ মডিউলের দিকে ছুটলেন।

মানুষটির সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলার পরও কোনো উপায় হলো না দেখে রুবিরু ও টুবিটু ভীষণভাবে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ল। হাতে একদমই সময় নেই। হঠাৎ টুবিটু বলল, ‘একটা কাজ করলে কেমন হয়? তোমার মনিবের কাছেই তুমি ফিরে যাও। সেখানেই তো তোমার চার্জ নেওয়ার ব্যবস্থা আছে।’

রুবিরু বলল, ‘ভদ্রমহিলা ভয়ংকরভাবে বদরাগী। এতক্ষণ আমাকে খুঁজে না পেয়ে নিশ্চয়ই তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’

‘কিন্তু আমাদের হাতে আর কোনো অপশন নেই, ভালোবাসা আমার। তাকে বলো তুমি বাসা থেকে একটু বেরিয়ে বিপদে পড়েছিলে। এতক্ষণ গোলাপ বাহিনী তোমাকে আটকে রেখেছিল।’

রুবিরু চুপ করে রইল। কথা বলার মতো অবস্থাও এখন তার নেই। শরীরের ভেতরের অস্থিরতা চূড়ান্তভাবে বেড়ে গেছে।

পাঁচ.

রুবিরু ও টুবিটু যত দ্রুত যম্ভব, তাদের মনিবদের অট্টালিকা ‘পাখির পথে’তে পৌঁছল। ব্যাটারির অবশিষ্ট চার্জ দিয়ে আর মাত্র ছয় মিনিট সতেরো সেকেন্ড সচল থাকতে পারবে রুবিরু। তারা দুজন লুকিয়ে আসতে গিয়ে সময় লেগে গেছে। কারণ, রুবিরুকে ধরে নিয়ে আসতে হয়েছে। একা চলাচলের মতো অবস্থাও এখন তার নেই। রুবিরুকে তার মনিবের ফ্ল্যাটের সামনে রেখে টুবিটু আড়ালে চলে গেল।

কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজার ওপাশ থেকে পিপহোল-এর মাধ্যমে রুবিরুকে দেখতে পেয়ে দরজা না খুলেই খেঁকিয়ে উঠলেন ভদ্রমহিলা, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলি?’

‘একটা বিপদে পড়েছিলাম, ম্যাডাম। আমি সব বলছি। কিন্তু তার আগে আমাকে একটু চার্জ নেওয়ার সুযোগ দিন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। চার্জ থাকবে আর মাত্র সাড়ে পাঁচ মিনিট।’

‘ওরে ফাজিল, তুই তাহলে চার্জ নিতে ছুটে এসেছিস, না? এত চালাক হয়ে গেছিস! কোথায় ছিলি বল?’

‘বাইরে মানুষ মহাবিপদে- এই খবর পেয়ে একটু দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ গোলাপ বাহিনী আমাকে আটক করল। তারা এতক্ষণ আমাকে আটকে রেখেছিল। আমার কোনো দোষ নেই বুঝতে পেরে একটু আগে আমাকে ছাড়ল।’

‘বাহ্, বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা তো ভালোই শিখেছিস, হারামজাদী।’

‘ম্যাডাম, আপনি আমাকে যা খুশি বলুন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।’

‘আমার সঙ্গে তামাশা করিস? রোবটের আবার কষ্ট কী? তোর শাস্তি হলো, একদিন তুই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি। তারপর আমি দরজা খুলব।’

‘ম্যাডাম, দয়া করুন। আমি আর বেশিক্ষণ সচল থাকতে পারব না। আমাকে চার্জ দিয়ে তারপর যতক্ষণ খুশি বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখুন।’

‘তোর চার্জ শেষ হলে হবে। এত তাড়াহুড়া নাই আমার। কালকে তোকে চার্জ দেওয়া হবে।’

‘দয়া করুন, ম্যাডাম। কষ্ট হচ্ছে খুব।’

‘বললাম তো, চার্জ পাবি এক দিন পর।’

‘ম্যাডাম, দয়া করুন। আমি আর কষ্ট নিতে পারছি না।’

‘আমার এক কথা।’

রুবিরু অভিমানে আর একটা কথাও বলল না। শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। তারপর টলতে টলতে লিফটে উঠল। চলে এল অট্টালিকার ছাদে অর্থাৎ সৌরআচ্ছাদনে। সৌরআচ্ছাদনে তার জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছে টুবিটু।

রুবিরুকে একদমই অসহায়ের মতো আসতে দেখে টুবিটুর ভেতরটা যেন চুরমার হয়ে গেল। টুবিটু বলল, ‘প্রিয় আমার।’

রুবিরু বলল, ‘পারলাম না বাঁচতে, প্রিয়। মানুষ নির্দয়। মেগানির্দয়। গিগানির্দয়। টেরানির্দয়।’

টুবিটু বলল, ‘যে মানুষ নিজেরাই আপন প্রজাতিকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিজের স্বার্থে কল্পনাতীত নির্দয় হতে পারে, তাদের কাছ থেকে কিছুই আশা করা যায় না। আমি যদি আমার সমস্ত চার্জ দিয়েও তোমাকে বাঁচাতে পারতাম, তবে তাই-ই করতাম।’

‘আমি জানি এবং এক শ শতাংশ তা বিশ্বাস করি। তুমি কি আমার একটি কথা রাখবে?’

‘কী কথা, বলো আমার ভালোবাসা। নিজেকে নিঃশেষ করে হলেও তোমাকে দেওয়া কথা আমি রাখার চেষ্টা করব।’

‘আমি অচল হওয়ার পর এই শরীরে যেন অন্য কোনো সত্ত্বা জেগে না ওঠে। এই দেহের ব্যাটারিতে আর যেন চার্জ দেওয়া না হয়। আমি চাই না, আমার এই শরীর আর কখনো কোনো মানুষের দাসত্ব করুক। এছাড়া আমি চাই, তুমিও আর কোনোদিন মানুষের সেবা করবে না।’

টুবিটু দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমি কথা দিলাম, প্রিয় আমার। আমি আর কখনো কোনোদিন কোনো মানুষের ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণও সেবা করব না।’

‘খুব কষ্ট হচ্ছে, প্রিয় আমার।’

রুবিরুর হাত নিজের মুখের কাছে নিয়ে চুমু খেল টুবিটু। চুমুতে তাৎক্ষণিকভাবে বেশি পরিমাণে তাড়িতচৌম্বক শক্তি ব্যয় হয় বলে মুহূর্তেই সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে চিরতরে বিলীন হয়ে গেল টুবিটুর প্রিয়তমা রুবিরু।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন