বিজ্ঞাপন

ইকবাল খন্দকার-এর গল্প ‘একজন প্রহরী’

May 2, 2022 | 7:18 pm

মতিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে খোঁজা হচ্ছে তাকে।
সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে খোঁজা হয়ে গেছে তিন-চারবার করে।
সম্ভাব্য জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তপনের চায়ের দোকান। চায়ের তেষ্টা পেলে এখানে সে আসবেই। শুধু চা না, বিস্কুট-কলাও খাবে। তার হাস্যময় ভাষ্যমতে, শুধু চা খেলে পেটে গিয়ে চায়ের একা একা লাগে। এই জন্য চায়ের সঙ্গে টাও খেতে হয়। এতে পেটে যাওয়ার পর চা আর সঙ্গীহীনতায় ভোগে না। বিস্কুট, কলা, পাউরুটি, কেক ইত্যাদির সঙ্গে গল্প-গুজব, ঠাট্টা-মশকারা করে সময় কাটাতে পারে।

বিজ্ঞাপন

মতি প্রথম যেদিন তার এই হাস্যময় ভাষ্য উপস্থাপন করেছিল, সেদিন হাসতে হাসতে চোখ পানিতে ভরে ফেলেছিল তপন। হাসছিল নানা বয়সী কাস্টমাররাও। তবে মতি ছিল নির্বিকার। সে কথাগুলো বলেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চা খাওয়ায় মনোযোগ দিয়েছিল। কিন্তু অন্যদের সেই উপায় ছিল না। হাসির দমকে কাপ নড়ছিল, জামা-কাপড়ে গরম চা ছিটে ছিটে পড়ছিল।

মতি মানুষকে হাসাতে পারে, তা তার নিজেরই জানা ছিল না। যখন জানলো, তখন লোভ তাকে পেয়ে বসলো। লোক-হাসানোর লোভ। তাই ওইদিনের পর যখনই সে তপনের দোকানে আসত, চেষ্টা করত মজার মজার কথা বলে দোকানদার এবং কাস্টমারদের হাসাতে। কিন্তু চেষ্টা ফলপ্রসূ হতো না বললেই চলে। হ্যাঁ, কোনো কোনো কথায় হয়তো কেউ কেউ হাসতো, তবে চোখ পানিতে ভরে ফেলার মতো কিংবা স্বাভাবিকভাবে কাপ ধরে রাখতে না পারার মতো হাসি কাউকে হাসতে দেখা যেত না।

চেষ্টা ফলপ্রসূ না হওয়ার দুঃখে টিভিওয়ালাদের মতো কাজ করত মতি। মানে টিভিওয়ালারা যেমন তাদের ‘হিট’ অনুষ্ঠানগুলো বারবার পুনঃপ্রচার করে, সেও তার ওই কথাটা দুদিন বাদে বাদেই বলত, যেটা শুনে হাসতে হাসতে সবাই গড়াগড়ি খাওয়াটা বাকি রেখেছিল। কিন্তু প্রথমবারের মত হাসি আর কেউ হাসত না। তপন যতটুকু হাসত, সেটা মতিকে খুশি করার জন্য। কারণ, সে বেচারার মন বুঝতে পারত।

বিজ্ঞাপন

শুধু মতির মনই না, সবার মনই বুঝতে পারে তপন। কার চায়ে কতটুকু চিনি দিতে হবে, কে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খাবে আর কে পাউরুটি খাবে, সে ধারণা করে ফেলতে পারে অবলীলায়। তাই কাউকে মুখ ফুটে চাইতে হয় না। চাওয়ার আগেই তপন এগিয়ে দেয় তাদের হাতের কাছে। তার এই গুণটার জন্য মতি তাকে বিশেষ পছন্দ করে। আর বিশেষ পছন্দ করে বলেই সে লোকের বাঁকা-ত্যাড়া কথাকে গায়ে মাখে না।

বাঁকা-ত্যাড়া কথার কারণ তপনের ধর্ম ভিন্ন। সে হিন্দু। মুসলমান হয়ে মতি কেন হিন্দুর হাতের বানানো চা খাবে, এই প্রশ্ন প্রথম তুলেছিল তার সহকর্মী আতা। তারপর তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল স্টেশন এলাকার অনেকেই। উত্তরে মতি বলেছিল, সবাই খায়, তাই সেও খায়। তখন আতা বলেছিল লোকাল কয়টা মানুষে খায়? যারা খায়, তারা তো প্রায় সবাই দূরদূরান্তের ‘পেসেন্দার’। তপনে যে হিন্দু, এইটা তারা জানে না বইলা খায়। তুই জাইন্যা-শুইন্যা ক্যামনে খাস? ঘিন্না লাগে না?

না, মতির ‘ঘিন্না’ লাগে না।

বিজ্ঞাপন

কেন লাগে না, সে নিজেও জানে না।

হয়ত তার কাছে মানুষের চেয়ে ধর্ম বড় নয় বলেই লাগে না।

মতি এই স্টেশনের নৈশপ্রহরী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে প্রায় সাত বছর আগে। কাজের প্রতি সে দারুণ নিষ্ঠাবান। রাত একটু গভীর হলে তার সহকর্মীরা ঝিমুতে শুরু করে। কেউ কেউ তো খাম্বায় হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়েও নেয়। কিন্তু মতি এসব কোনোদিনই করেনি। যতক্ষণ ডিউটিতে থাকে, ততক্ষণ বিশ্রামের নাম মুখে নেয় না। চা খাওয়ার সময়টা ছাড়া বাকি সময় সে পা চালাতেই থাকে, চালাতেই থাকে।

পা চালানোর পাশাপাশি গলাও চালায় মতি। ‘হুঁশিয়ার’ ‘সাবধান’ তো বলেই, নানারকম গানও ধরে। আধ্যাত্মিক গান তার বেশি পছন্দ। যেমন পরের জাগা পরের জমি ঘর বানায়া আমি রই, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া ইত্যাদি। মতির গানটা বেশ উপকারী। চোর-ছিনতাইকারীরা ভয় পায়। চুপচাপ ডিউটি করলে হয়তো এই ভয়টা পেত না। ভাবত কেউ জেগে নেই।

বিজ্ঞাপন

প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে মতি হাঁকও ছাড়ছে না, গানও গাইছে না। ব্যাপারটা প্রথম থেকেই স্বাভাবিক লাগছিল না আতার কাছে। তাই সে নিজের ডিউটি বাদ দিয়ে ছুটে গিয়েছিল তপনের দোকানে। তপন জানে, হিন্দু ধর্মের মানুষ হওয়ার অপরাধে আতা তার বানানো চা খায় না, খাবে না। তবু জিজ্ঞেস করেছিল, চা দেবে কি না। আতা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিল মতি চা খেতে এসেছিল কি না।

তপনের ডানে-বামে মাথা নাড়ানো দেখে তখনকার মতো বিদায় নিয়েছিল আতা। আর খুঁজতে চলে গিয়েছিল আশপাশের সম্ভাব্য অন্য জায়গাগুলোতে। কিন্তু একটু পরেই আবার ফিরে এসেছিল। মতি সম্পর্কে সেই প্রশ্নটা আবার করেছিল। এবার আর ডানে-বামে মাথা নাড়ায় না তপন। হাতের কাজ বন্ধ রেখে উদ্বেগ প্রকাশ করে। তবে তার উদ্বেগকে গুরুত্ব দেয় না আতা। চলে যায় দক্ষিণদিকে।

তপন দোকান বন্ধ করে দিয়েছে।
অথচ অন্যদিন তার দোকান প্রায় সারারাতই খোলা থাকে।
আজ সে দোকান বন্ধ করেছে মতিকে খোঁজার কাজে শামিল হওয়ার জন্য।
যাদের সঙ্গে সে শামিল হয়েছে, তাদের একজন একটু আগেই চাচ্ছিল পুলিশকে ফোন করতে। কিন্তু আরেকজনের আপত্তিতে মোবাইল হাতে নিয়েও আবার পকেটে রেখে দিয়েছে। কারণ, ওই একজন ছাড়া বাকি সবাই পুলিশি ঝামেলাকে ভয় পায়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে পুলিশ কার পিন্ডি কার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে, বলা তো যায় না! এরচেয়ে অনেক ভালো নিজেরা নিজেরা খোঁজা। যদিও খুঁজতে খুঁজতে তারা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। তবু পুলিশকে জানানোর চেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিজেরাই আবার খোঁজাখুুঁজি শুরু করাকে তাদের কাছে উত্তম মনে হচ্ছে।

: একটা কথা কই। কথাটারে কেউ আবার অইন্যভাবে নিয়েন না। বিশ্রামের পর বসা থেকে উঠতে উঠতে বলে জহুর আলী। সে ঝালমুড়ি বিক্রেতা। ষোল বছর ধরে এই স্টেশনে ঝালমুড়ি বিক্রি করে। ঘুমায়ও এখানেই। তাই আতাদের কাছে সে তাদের সহকর্মীর মতোই।

: কী? আতার প্রশ্ন।

: আমি কিন্তু মানুষ চিনি। কারণ, ‘ডেলি’ শয়ে শয়ে মানুষের সাথে আমার কারবার।

: কী কইতে চাও, ফটাফট কইয়া ফালাও। কারবার-দরবারের কিচ্ছা হোনায়া লাভ নাই। মোসলেম ফরাজী বলেন। তিনি ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। স্টেশনের যাবতীয় বৈদ্যুতিক সমস্যা সমাধান হয় তার হাত দিয়ে। বলা চলে চব্বিশ ঘণ্টাই ডিউটি করেন তিনি। অথচ বয়স ষাট পেরিয়েছে আরও তিন-চার বছর আগেই।

: আমরা এই রাইতের বেলা আরামের ঘুম হারাম কইরা ক্যান ঘুইরা বেড়াইতাছি? মতি মিয়ারে খোঁজার লাইগা না?

: জ্বী না। হাওয়া খাওয়ার লাইগা। ফুরফুইরা হাওয়া। এইবার কও কী কইবা। মোসলেম ফরাজীর গলায় মাত্রাছাড়া বিরক্তি।

: ভাইছাব মনে অয় চেইত্যা গেলেন গা? এইডা কিন্তু ঠিক না ভাইছাব। আমি একটা কথা কইতে চাইতাছি, আর আপনে চেইত্যা বইয়া রইছেন।

: ধুরু মিয়া! তোমার খালি আজাইরা প্যাঁচাল। যা কইতে চাইছিলা, সেইটা কও। নাইলে অফ থাহো। মিজাজ-মর্জি কিন্তু খারাপ আছে।

: না, মানে কইছিলাম কী, আমরা যে আরামের ঘুম হারাম কইরা ঘুইরা বেড়াইতাছি, এইটা মনে অয় ঠিক অইতাছে না। কারণ, যার লাইগা ঘুইরা বেড়াইতাছি, এইরহমও তো অইতে পারে, সে মউজ-মস্তিতে ব্যস্ত আছে। অইতে পারে না? পারে, পারে।

এতক্ষণ সবাই বিভিন্ন দিকে তাকিয়ে থাকলেও এবার তাকায় জহুর আলীর দিকে। জানতে চায় সে কিসের মউজ-মাস্তির কথা বলছে, কার মউজ-মাস্তির কথা বলছে। জহুর আলী নামমাত্র হেসে নিয়ে বলে কার কথা কইছি, সেইটা সবাই বুঝছেন। তারপরেও যদি না বোঝার ভান করেন, কই যামু। একটা কথা আছে না, ঘুমের মানুষেরে ডাইক্যা সজাগ করুন যায়। জাগনা মানুষেরে কিন্তু সজাগ করুন যায় না। ডাইক্যা গলা ভাইঙ্গা ফালাইতে পারবেন, কোনো কাজ অইবো না।

মোসলেম ফরাজী আবারও মাত্রাছাড়া বিরক্তি প্রকাশ করেন। জহুর আলী বলে এইরহমই অয় ভাইছাব। পয়লা যখন কওয়া অয়, তখন কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। গালিগালাজ করে। বিরক্ত তো অয়ই, পারলে মারতে আহে। কিন্তু পরে যখন দেহে কথা সইত্য, তখন এইরহম শরমিন্দা অয়, আর মুখ দেহাইতে পারে না। আপনেও দেইখেন, মুখ দেহাইতে পারবেন না। কারণ, আজকা হোক কালকা হোক, সইত্য বাইর অইবোই অইবো। বিশ্বাস না অইলে আমার কথাডা কাগজে টুইক্যা রাখতে পারেন।

: আপনে কি কইতে চাইতাছেন মতি মিয়ার কোনো বিপদ-আপদ হয় নাই? রাগ এবং বিরক্তিমুক্ত শীতল গলায় জিজ্ঞেস করে আতা।

: বিপদ-আপদ অইলে কি মানুষে মউজ-মস্তি করতে পারে? পারে না কিন্তু। এর লাইগাই কই কী, আসেন সবাই গিয়া ঘুম দেই। সে মউজ করবো আর আমরা হুদাই এইদিক সেইদিক ঘুইরা বেড়ামু, এইটা তো হইতে পারে না।

: তুমি কি মতি মিয়ারে সন্দে করতাছো? গলা এবং চেহারা থেকে বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন মোসলেম ফরাজী।

: আমি কিন্তু ভাইছাব আগেই কইছি, আমি মানুষ চিনি। ক্যান মানুষ চিনি? কারণ, শয়ে শয়ে মানুষের সাথে আমার কারবার। মতি মিয়ার যা বয়স, এই বয়সটা কিন্তু খুব খারাপ। মানুষ নিজেরে ‘কন্টোল’ করতে পারে না। এই জইন্য বাপ-মার উচিত সময়মতো ফরজ কামডা, মানে বিয়াডা করায়া দেওয়া। কিন্তু মতি মিয়ার বাপ-মায় সেইটা করায় নাই। এই জন্য তার খাসলত নষ্ট অইয়া গেছে গা।

: মতি মিয়ার যে খাসলত নষ্ট অইছে, এইটার কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?

: এইটাই তো সমস্যা। কোনো প্রমাণ নাই। যদি থাকতো, তাইলে কি আর এত ঘোরায়া-প্যাঁচায়া কথা কইতাম? ‘ডাইরেক’ কইয়া ফালাইতাম, মতি মিয়া একটা লুইচ্চা। সে ডিউটি ফালায়া এইখানে সেইখানে লুইচ্চামি করতে যায়।

অধিক উত্তেজনায় গলার স্বর তুঙ্গে উঠে যায় জহুর আলীর। তুঙ্গে উঠতে চায় মোসলেম ফরাজীর স্বরও। কিন্তু তিনি উঠতে দেন না। নিজেকে বোঝান, বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের স্বর, মেজাজ সবই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতে হয়, রাখতে হয়। নইলে কনিষ্ঠদের কাছ থেকে সম্মান পাওয়া যায় না। মোসলেম ফরাজী তার গলার স্বর আড্ডারত বন্ধু-বান্ধবের স্বরের মতো আন্তরিক বানিয়ে বলেন, মতি মিয়া যে লুইচ্চামি করতে গেছে, কোনো ধরনের বিপদ-আপদে যে সে পড়ে নাই, এইটা যদি প্রমাণ করতে পারো, তাইলে বকশিশ পাইবা। আর যদি প্রমাণ করতে না পারো, তাইলে ঝামেলা হইতে পারে।

মোসলেম ফরাজীর কথার জবাবে জহুর আলী কিছু বলতে যাবে, এমন সময় দেখে কেউ একজন আসছে। গাছপালার ছায়ার জন্য মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে হাঁটার ধরন বলছে, মতি। আতা এগিয়ে যায়। দেখে, সত্যিই মতি। সে প্রশ্নের ঝড় তুলে দেয়। মতি ঝড়ে বিচলিত হয় না। সবার সামনে সে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। এতক্ষণ জহুর আলী সবার পেছনে ছিল। হঠাৎ সে মতির গালে কী যেন দেখতে পায়। ডান গালে। একটা দৌড় মারে জহুর আলী। সবার পেছন থেকে চলে যায় সামনে। তারপর মতির অবনত মুখটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলে যেইটা সন্দে করছিলাম, সেইটাই।

: মানে? মোসলেম ফরাজীর অবাক জিজ্ঞাসা।

: মানে মানে না কইরা একটু চোখ খুইলা চাইয়া দেহেন। ও, আপনের তো আবার চোখের পাওয়ার কম। যার চোখের পাওয়ার ঠিক আছে, সে একটু দেহুক। তারপরে কথা কই।
চেহারায় নেতা নেতা ভাব ফুটিয়ে তুলে চার পা পিছিয়ে যায় জহুর আলী। আর তার জায়গায় এসে দাঁড়ায় আতা। সে মতির মুখের কাছে চোখ নিয়ে দেখে তার গালে কালচে দাগ। সহজেই বোঝা যায়, দাগটা ঘুষি বা কিলের। তবু আতা জিজ্ঞেস করে দাগটা কিসের। এবার জহুর আলী খোঁচাত্মক হাসি দিয়ে বলে কিসের আবার! আদরের। সোহাগের। সোহাগের চোডে খালি চাপায়ই দাগ বসছে, নাকি দুই-চাইট্টা দাঁতও ভাইঙ্গা গলা দিয়ে পেডের ভিত্রে ঢুইকা গেছে, কেডা জানে।

বলেই জহুর আলী খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে থাকে। আর তাকায় সবার মুখের দিকে। দেখে কে কে হাসছে। কিন্তু কারও মুখে হাসি দেখে না। তাই সে নিজের খ্যাঁকখ্যাঁকানি থামিয়ে দিয়ে বলে খোদার কাছে শুকরিয়া, আমি যা কইছি, তার প্রমাণ দিতে পারছি। এখন আপনেরা চিন্তা কইরা দেখেন কী করবেন। আমার তো আর বেশি কিছু চিন্তা করার অধিকার নাই! কারণ, আমি আপনাগো মতন ‘ইস্টাফ’ না। যদি ‘ইস্টাফ’ হইতাম, তাইলে দেখতেন এখন করি কী! তুমি মিয়া লুইচ্চামি করতে যাইবা আর আমি ঘুম হারাম কইরা তোমারে খুঁজমু, এইডা কি তামশা পাইছো? ঘুইষ্যায়া তামশা বাইর কইরা ফালামু না?
প্রথমবারের মতো মুখ এবং চোখ তুলে তাকায় মতি।

আর তাকায় জহুর আলীর দিকে।
তাকে সে সময় নিয়ে দেখে।
মোসলেম ফরাজী অপেক্ষা করেন তার বক্তব্য শোনার জন্য। কিন্তু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরও যখন সে কিছু বলে না, তখন নিজেই শুরু করেন কথা। জানতে চান আতা যে একটু আগে এতগুলো প্রশ্ন করলো, কেন কোনোটির উত্তর দেয়নি। আরও জানতে চান, জহুর আলী যা বলছে, তা সত্য কিনা। মতি এবার মোসলেম ফরাজীর দিকে তাকায়। তবে জহুর আলীকে সময় নিয়ে দেখলেও তাকে সেভাবে দেখে না। বরং তাকিয়েই দৃঢ়কণ্ঠে একটা শব্দ উচ্চারণ করে না।

মতি চলে যেতে চায়। কিন্তু মোসলেম ফরাজীর জন্য পারে না। তিনি তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, কথা শেষ হওয়ার আগে সামনে এগোতে দেবেন না। তারপর দু পা দুদিকে আরও ছড়িয়ে দিয়ে বলেন তুমি লুইচ্চামি করতে যাইবা নাকি চুরি-ডাকাতি করতে যাইবা, সেইটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তোমারে খুঁজতে গিয়া এই যে এতগুলা মানুষ হয়রান হইলো, এইটা খালি তোমার ব্যাপার না। আমাগোরও ব্যাপার। আর এই জন্যই সবার মুরুব্বি হিসাবে আমি জানতে চাই, তুমি কার ঘরে লুইচ্চামি করতে গিয়া মাইর খাইয়া আইছো।

: মোসলেম ভাই, মানুষ কি খালি লুইচ্চামি করতে গিয়াই মাইর খায়? মতির প্রশ্নে অকৃত্রিম বিনয়।

: মানুষের কথা বাদ। তোমার কথা কও। তুমি ডিউটি ফালায়া থুইয়া কারো ঘরে লুইচ্চামি করতে গেছিলা, ফিরছো মাইর খাইয়া। কথা কি সইত্য?

: আমি বুঝতাছি না মোসলেম ভাই, লুইচ্চামির কথাটা এইখানে ক্যান আইতাছে। আমি তো গাড়ির সাথে ঠুস খাইয়াও ব্যথা পাইতে পারি। পারি না? হাইজ্যাকারের হাতেও মাইর খাইতে পারি। পারি কিনা বলেন।

মোসলেম ফরাজী উত্তর দেন না।
তার নীরবতার সুযোগকে কাজে লাগায় জহুর আলী।
বলে তোমার মতো ম্যালা নাইটগাডের লগে আমার পরিচয় আছে। খাতিরও আছে। কথায় কথায় আমি তাগোর পেট থেইকা গোপন কথা বাইর কইরা ফালাই। সব কথা মোসলেম ভাইয়ের সামনে কওয়া যাইবো না। মুরুব্বি মানুষ। তয় খালি এইটা কই, নাইটগাডেরা নিজের মুখে স্বীকার করছে, গভীর রাইতে ডিউটি করার সময় নাকি চান্স লয়। সবার বাড়ির ল্যাট্টিন তো আর ঘরের ভিত্রে না। বাইরেও আছে। যখন দেখে কোনো মাইয়া মানুষ ল্যাট্টিনে যাইতাছে, গিয়া জাইত্তা ধরে। কপাল ভালা হইলে খায়েশ মিডাইতে পারে, ভালো না হইলে পারে না। আর কপাল বেশি খারাপ হইলে ধরা পইড়া ধোলাই খায়। এই যেমন তুমি খাইলা। হোনো, ঐ ধরনের দুই-চাইট্টা ঘটনা যদি জানা না থাকতো, তাইলে তোমারে আমি সন্দ করতাম না। যেমন ধরো মোসলেম ভাই, আতা, তারা তোমারে সন্দে করে নাই ক্যান? কারণ, তাগোর ওই ধরনের ঘটনা জানা নাই। এই জন্যই সবকিছু জানতে হয়। জীবনে অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

এবার আর কারো কোনো বাধা মানে না মতি। শোনে না পিছুডাকও। সোজা চলে যায় নিজের রুমের দিকে। জহুর আলী তার পেছন পেছন যেতে চায়। কিন্তু মোসলেম ফরাজী তাকে ধমক মেরে থামিয়ে দেন। বলেন যতটুক করছো, ততটুকের মইধ্যেই থাকো। এরচে বেশি করতে যাইও না। এই যে ইস্টিশনে ঘুমাও, একজন নাইটগাড হিসাবে মতি কিন্তু তোমারে ডান্ডা দিয়া পিডায়া ওঠায়া দিতে পারে। এই ক্ষমতা তার আছে। এই জন্যই কইতাছি, নিজের ভালা চাইলে মুখে তালা লাগাও। আর মতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লাইগা আমরা আছি। তুমি উইড়া আইসা জুইড়া বসার ফন্দি কইরো না।

পরদিন সন্ধ্যা।
চা খেতে আসে মতি।
তপন তার দিকে চোরাচোখে তাকায়।
গালের কালচে দাগটা আজ আরও কালচে দেখাচ্ছে। হয়তো ফোলা বেড়েছে। ‘হয়তো’ না, অবশ্যই বেড়েছে। পুরো গালটাই এখন ফোলা লাগছে। মতি চা চায় না। বসে থাকে পায়ের স্যান্ডেলের ফিতার দিকে তাকিয়ে। তপন তবু তার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মতি হাত বাড়ায় না। সে যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই বসে থাকে। এবার তপন ডাক দেয়। মতি সাড়া দেয় না। নড়াচড়াও করে না। জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে তোমার কী ধারণা? আমি লুইচ্চামি করতে গিয়া মাইর খাইছি?

তপন কী উত্তর দেবে, আদৌ উত্তর দেবে কিনা, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। শুধু অন্যান্য কাস্টমারের দিকে তাকায়। দেখে কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে কি না, কথা শোনার জন্য কান খাড়া করে রেখেছে কি না। কাস্টমারদের অবস্থান এবং অবস্থা দেখে নিরাপদ বোধ করে তপন। কারণ, অল্প যে কজন এখন চা খাচ্ছে, তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলা নিয়ে ব্যস্ত। এছাড়া কাছাকাছি কেউ নেই। বসে আছে সবচেয়ে দূরের বেঞ্চ দুটোতে। অথচ মতির সঙ্গে তার দূরত্ব মাত্র দেড় বা পৌনে দুই হাতের। অতএব উত্তর দেওয়াই যায়।

: কী মিয়া, কইলা না? স্যান্ডেলের ফিতা থেকে চোখ তুলে তপনের দিকে তাকিয়ে বলে মতি।

: ভাই, কেডা কী কইল, আমি ওইগুলা বিশ্বাস করি নাই, করমু না। আমি বিশ্বাস করমু আপনের কথা। আপনে যেইটা কইবেন, এইটাই সইত্য, এইটাই ফাইনাল।

: কিন্তু তোমার নিজের কি একটা আইডিয়া আছে না?

: ভাই, জহুর আলী যেইটা কইছে, এইরকম কিন্তু হয়। অনেক নাইটগাড রাইত-বিরাইতে আকাম-কুকাম করে। আমি জানি, জহুর আলীর সাথে আপনের পুরানা একটা ঝামেলা আছে। আপনে একবার তার ঝালমুড়ির বোল লাত্থি মাইরা ফালায়া দিছিলেন।

: লাত্থি কি এমনি এমনি মারছিলাম? সে অজ্ঞান পার্টির সাথে হাত মিলায়া ঝালমুড়ির সাথে অষুইধ মিশাইবো, পেসেন্দার গো অজ্ঞান কইরা তাগো বারোটা বাজাইবো আর আমি জাইনা-শুইনা সেইটা সইহ্য করমু, তা তো হইতে পারে না।

: সব ঠিক আছে। আপনের গালে যদি ঘুষির দাগ না থাকতো, তাইলে তার কথারে কেউ পাত্তা দিত না। সবাই মনে করতো পুরানা শত্রুতার কারণে সে এইসব কইতাছে।

: বুঝছি। তুমিও শিওর হইয়া গেছো, আমি লুইচ্চামি করতে গিয়া মাইর খাইছি। ঠিক আছে, আমার আর কিছু বলার নাই।

: রাগ কইরেন না ভাই, একটা কথা কই। কোনো কারণে কারো উপরে যদি কোনো অপবাদ আসে, তাইলে তার উচিত নিজেরে নির্দোষ প্রমাণ করা। আপনের কিন্তু এই কাজটা করতে হইবো ভাই। তবে দুঃখের বিষয় হইল, ক্যান জানি আপনে কাজটা করতে চাইতাছেন না।

মতি গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। তন্দ্রাচ্ছন্নদের মতো চোখ আধখোলা করে রাখে সে। তাকে দেখে মনে হয়, এখনই বুঝি ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু সে ঘুমায় না। বরং আধখোলা চোখ পুরোপুরি খুলে বলে, তোমারে একটা কথা জিগাই। তুমি যদি দেখো কোনো কবরে… ওহ, তোমরা তো কবর কও না। শ্মশান কও। যা-ই হোক, তুমি যদি দেখো কোনো শ্মশানে কেউ মদ-গাঞ্জা লুকায়া রাখতাছে, তারপরে সময় মতো এইখান থেকে বাইর কইরা নানান জায়গায় সাপ্লাই দিতাছে, তোমার কেমন লাগবো?

: কিন্তু শ্মশানে রাখবো ক্যান? কবর কন আর শ্মশান কন, এইগুলা তো পবিত্র জায়গা। এইসব জায়গায় কেউ মদ-গাঞ্জা রাখে?

: বাড়ি-ঘরে রাখলে ঝামেলা। পুলিশের হাতে ধরা খাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু কবরে রাখলে কোনো ভয় নাই। পুলিশে চিন্তাও করতে পারে না, এইরকম পাক-পবিত্র জায়গায় কেউ এই জিনিস রাখতে পারে।

: বুঝলাম। কিন্তু আৎকা আপনে এইসব কথা কইতাছেন ক্যান? এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে নাকি?

: যদি ঘটে, তোমার কেমন লাগবো? তুমি কি বাধা দিবা? নাকি দেইখ্যাও না দেখার ভান কইরা পবিত্র কবর অপবিত্র হইতে দিবা?

তপন উত্তর দিতে যাবে, এমন সময় জহুর আলী সিগারেট নিতে আসে। মতি তাকে দেখে উঠে চলে যায়। আর এই যাওয়াই হয় তার শেষ যাওয়া। কারণ, পরদিন সকালে চেয়ারম্যানবাড়ির গোরস্থান এলাকায় তার লাশ পাওয়া যায়। গলায় প্লাস্টিকের দড়ি প্যাঁচানো লাশ।

এক মাস পর।
রাত আড়াইটার দিকে তপন দোকানের বাইরে বের হয়।
কারণ, সে কারো ফিসফিসানির শব্দ শুনতে পেয়েছে।
তপন দেখে তার দোকানের পেছনের প্রায় অন্ধকার জায়গাটায় চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। তাদের মধ্যে একজন পরিচিত। লায়েস। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত নৈশপ্রহরী। মতির জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাকে। তপন পা টিপে টিপে এগোয়। তারপর একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে পায় মতিরে কিন্তু আমরা সাবধান করছিলাম। একদিন কিল-ঘুষিও মারছিলাম। কিন্তু তার শিক্ষা হয় নাই। আমাগোরে ফাঁসায়া দেওয়ার ধান্ধা করছিল। তোমারেও সাবধান করতাছি। শিক্ষা হইলে ভালো, না হইলে আমাদের কাছে কিন্তু প্লাস্টিকের দড়ির অভাব নাই।

তপন গাছের আড়াল থেকে মাথা বের করে মানুষগুলোকে চেনার চেষ্টা করে। আচ্ছা, গলার দুপাশে গামছা ঝুলে থাকা লোকটা কে?
ঝালমুড়িওয়ালা জহুর আলী কি?

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন