বিজ্ঞাপন

রাফিউজ্জামান সিফাত-এর বড় গল্প ‘কার্নিভোরাস প্ল্যান্ট’

May 3, 2022 | 4:06 pm

-স্যার, লাঠিটা একটু দেবেন?

বিজ্ঞাপন

-কেন?

-পিঠটা বড় চুলকায়।

-তো আমার লাঠি দিয়ে কি করবেন?

বিজ্ঞাপন

-বাধ্য হয়েই চাইলাম স্যার। এমন জায়গায় চুলকাচ্ছে, হাতটা যাচ্ছেই না। তাই লাঠিটা দিয়েই…

-সরকারি লাঠি তো আপনার পিঠ চুলকানোর জন্য না, আপনি হাত দিয়ে কাজ চালান।

-এতক্ষণ ধরে সেই চেষ্টাই করছিলাম স্যার, কিন্তু জুত মতো হচ্ছে না। বড্ড চুলকাচ্ছে অথচ চুলকাতে পারছি না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে স্যার।

বিজ্ঞাপন

-ডান পাশের পিঠ ডান হাত দিয়ে চুলকালে তো হবে না, বাম হাত ব্যবহার করেন।

-সেটাই করতাম স্যার কিন্তু সমস্যা হল আমার বাম হাতটা বেশ দুর্বল। ছোটবেলা থেকেই হাতটাতে জোর পাই না।

-পোলিও-টোলিও হয়েছিল নাকি?

-না স্যার, সেসব কিছু না। রোগ-বালাই আমার হয় না। শুনলে অবাক হবেন স্যার, বিগত প্রায় পৌনে তিন দশক ধরে আমার সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসটাইপ জ্বরটরও হয় নাই।

বিজ্ঞাপন

-বাহ, আপনার বডি তাহলে সাংঘাতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে নিয়েছে!

-তাই হবে হয়তো। অবশ্য একদম ছোট থাকতে বাড়াবাড়ি রকমের জ্বরে ভুগতাম। একবার হল কি স্যার, সুপারি গাছ থেকে পড়ে গেলাম। প্রাইমারিতে পড়ি তখন। দাদীজানের ছিল কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খাওয়ার অভ্যাস। স্কুল থেকে সবে ফিরেছি, দাদীজান ডেকে বললেন, ‘ওরে বন্ধু, দাদীজান আমাকে উনার বন্ধু বলেই ডাকতেন… সে যাই হোক, উনি আমাকে ডেকে বললেন, বন্ধু পান আছে, সুপারি নাইক্যা। দিবি আমারে কয়ডা সুপারি পাইড়া?’ আমি তখন ভালোই গাছ বাইতে পারতাম। তরতর করে উঠে গেলাম পুকুর পাড়ের সুপারি গাছে। কিন্তু নিচে নামার সময়ই ফ্যাকরাটা বাঁধল। মনে হল কে যেন আমার পা ধরে টানছে, ছাড়াতে চাই, ছাড়েই না। কোথাকার কোন হ্যাঁচকা টানে গেলাম পড়ে নিচে। সেবার জানে বেঁচে গেলাম। অসুবিধার মধ্যে বাম হাতখানা অকেজো হয়ে গেল কিন্তু স্যার, সেদিনের পর থেকে আমার শরীর থেকে জ্বরটর একেবারে হাওয়া!

-একে সৌভাগ্য বলব নাকি দুর্ভাগ্য?

-দুর্ভাগ্যই বলুন। আমার দাদীজানটা মরে গেল।

-হুট করেই মরে গেল?

-অনেকটা তাই। আমার অকেজো হাতের জন্য দাদীজান নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করলেন। উনার কাঁচা সুপারির জন্যই তো আমি গাছে চড়েছিলাম। আমি পড়ে যাওয়ার দুঃখে তিনি কাঁচা সুপারি ছাড়লেন। কিছুদিন পর ছাড়লেন পৈতৃক দমখানাও। অবশ্য গাঁয়ের দুষ্ট লোকেরা বলে কাঁচা সুপারি না খেয়ে খেয়ে দাদীজান মারা গেছেন। সে যাই হোক, সুপারি গাছ থেকে পড়ার মাস তিনেক পর ঘুমের মধ্যেই দাদীজান মারা যান। আমকে খুব আদর করতেন তিনি। আদর করে ডাকতেন বন্ধু মনু।

-দুঃখজনক।

-দুর্ভাগ্যটা স্যার এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও পারত।

-থামেনি?

-না স্যার, আমার জীবনে পরপর বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এরপর থেকে ঘটতে লাগল।

-যেমন, আপনার বাবার মৃত্যু?

-জী স্যার। দাদীজান মারা যাওয়ার মাস দু’খানেক বাদে বাবা হার্ট অ্যাটাক করেন। এশার নামায আদায় করতে পাঁচ ব্যাটারির টর্চ হাতে পুকুরের পাড় ঘেঁষে তিনি মসজিদের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। যেতে আর পারেননি, পথেই মারা যান। বাবার দেহটা উল্টে পুকুরে পড়ে ছিল। সকালে গোসল করতে গিয়ে একজন দেখতে পায় উল্টানো মৃত দেহটা। অনেকের মতে বাবা ভয় পেয়েছিলেন, ভয়ের কারণে তার মৃত্যু ঘটে।

-ভয়টা কিসের?

-দাদীজান মারা যাওয়ার পর থেকেই গাঁয়ের সবাই বলাবলি করত, উনাকে নাকি পুকুর পাড়ের সুপারি বাগানের আশেপাশে কাঁদতে দেখা যায়। কাঁচা সুপারি খাওয়ার তৃষ্ণাতেই তিনি সেখানে ঘুরে বেড়াতেন। এরপর যা হয় আর কি, সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করে দিল দাদীজানের আত্মা গ্রামে ভর করেছে। আমার বাবা আগে নামাজ-কালাম তেমন পড়তেন না। দাদীজানের মৃত্যুর পর তিনি বেশ ধর্মভীরু হয়ে যান। নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেন। নামাজ পড়তে যেয়েই হার্টঅ্যাটাকে উনার মৃত্যু হয়।

-আসলেই কি আপনার বাবা কিছু দেখেছিলেন?

-কি করে বলি স্যার! আমি কখনও কিছু দেখিনি। তবে বাবার মৃত্যুর পর মা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে তিনি আর গ্রামের বাড়িতে রাখতে চাননি। ঢাকায় মামার কাছে পাঠিয়ে দেন।

-আপনার মামা মানে জনাব সৈয়দ ইয়াকুব হকের কাছে?

-হুম, বাইরের সবাই মামাকে সৈয়দ ইয়াকুব হক নামেই চিনত। বাড়িতে আমরা ডাকতাম পিন্টু মামা।

-ইয়াকুব সাহেব পূবালী ব্যাংকে চাকরি করতেন, লোন সেকশনে। অর্থ কেলেঙ্কারিতে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়, রাইট?

-স্যার, পিন্টু মামাকে ফাঁসানো হয়েছিল। তিনি ভীষণ সহজ সরল মানুষ ছিলেন। গরুর মাংস খেতে খুব পছন্দ করতেন। মামীর হাতের গরুর মাংস ছাড়া উনার আর কোন দাবি-দাওয়া ছিল না।

-শুনেছি আপনার মামার দারুণ জুয়ার নেশা ছিল!

-নেশা ছিল তবে ওইটাকে জুয়া বলা ঠিক হবে না। পিন্টু মামা দুর্দান্ত তাস পেটাতেন। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে খেলতেন না, তার কাছে খেলাটাই ছিল মুখ্য। পিন্টু মামাকে টুয়েনটি নাইনের সম্রাট বলা হতো। মামাই আমাকে তাস খেলাটা শেখান। তিনি এমন কিছু ট্রিকস জানতেন, কার্ড ফেলার আগেই বলে দিতে পারতেন সামনের চালগুলোতে কার কি হবে।

-আপনার মামার তো কোন সন্তানসন্তানাদি ছিল না?

-মামীর খুব ইচ্ছে ছিল একটা সন্তানের। ডাক্তার, কবিরাজ, মাজার, দরগা কম ছুটাছুটি করেননি তিনি, কিন্তু লাভ হয়নি।

-আপনার মামা ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করলেন কেন?

-অর্থ কেলেঙ্কারির পর ব্যাংক থেকে মামার নামে পুলিশ কেইস হয়। জোরেশোরেই শুরু হয় তদন্ত। মামাকে ধরে নিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন তিনি জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান। অপমানটা উনার খুব গায়ে লেগেছিল। এক সন্ধ্যায় পিন্টু মামা ছাদ থেকে লাফ দেন।

-আপনার মামী তখন কোথায় ছিলেন?

-বাসাতেই। ঘুমাচ্ছিলেন। বিকেলে মামীর ঘুমানোর অভ্যাস ছিল। মামাও সাথে শুয়ে ছিলেন। কোন সময় উঠে ছাদে গেলেন আর লাফ দিলেন মামী বলতে পারেন না। আমিই ডেকে তুলে মামীকে প্রথম খবরটা দেই।

-আত্মহত্যার?

-জী স্যার।

-আত্মহত্যার সময় আপনি ছিলেন কোথায়?

-গাছ থেকে পড়ে বাম হাত অকেজো হয়ে যাওয়ায় আমি কারও সাথে আর মিশতে পারিনি। এক হাতে কোনদিন খেলতে নেমেছেন স্যার? হেভভি টাফ। কিছুতেই কিছু হয় না। ওরা মাঝেমধ্যে দয়া দেখিয়ে খেলায় নিত কিন্তু দূরে বসিয়ে রাখত, মাঠে নামতে দিতে চাইত না। ওভাবে বসে থাকতে আমার ভীষণ লজ্জা লাগত। তখন আমাকে পড়ার নেশা পেয়ে বসল। প্রচুর বই পড়তাম। গ্রামে থাকতে স্কুল লাইব্রেরি, শহরে মামার কাছে আসার পর বাসার কাছে পেলাম বিশাল লাইব্রেরি। মামার আত্মহত্যার সময় আমি রাস্তার ওপাশের লাইব্রেরিতেই ছিলাম। দিনের অধিকাংশ সময় ওখানটাতেই কাটত আমার।

-খবরটা আপনি কীভাবে পেলেন?

-এলাকার পরিচিত এক মহিলা আমাকে খবর দেয় মামা রাস্তায় পড়ে আছে। আমি দৌড়ে যাই ঘটনাস্থলে। দেখি পিন্টু মামার মাথা ফেটে চৌচির, রক্তে ফুটপাত ভিজে গেছে।’

-আর আপনি উপরে গিয়ে মামীকে খবর দেন?

-জ্বী স্যার। মামীকে আমি ঘুম থেকে ডেকে তুলি আর মামার আত্মহত্যার খবরটা জানাই।

-স্যার?

-বলুন।

-লাঠিটা কি কয়েক সেকেন্ডের জন্যও দেয়া যায় না?

-এখনও চুলকানো কমেনি?

-না স্যার, জ্বালাচ্ছে খুব। আচ্ছামত না চুলকাতে পারলে শান্তি পাচ্ছি না। এই এক পিঠ চুলকানোতেই আমার একমাত্র সুখ। এ ছাড়া আমার কোনো নেশা-টেশা নেই। অনেকের থাকে না, পান বিড়ি তাসের নেশা? আমার নেশা পিঠ চুলকানো।

-এলার্জি নেই তো? ফুসুরি টুরুসি? এসবে ঘামাচি চুলকানো ট্যালকম পাউডারে ভালো হয়ে যায়।

-ওসব কিছু না স্যার। আমার এমনিতেই চুলকায়। বাবার থেকে পেয়েছি। আমি বাবার পিঠ চুলকে দিতাম। বাবা বলত, পিঠের মাংসের নখের অনুপাত মেপে ঠিকঠাক চুলকে দিতে পারাটাও কিন্তু একটা আর্ট।

-আর্ট বললেন? সামান্য পিঠ চুলকানোকে এক্কেবারে আর্টের মর্যাদা!

-আলবৎ! আর্টই হবে স্যার। যে কোনো কাজ মন লাগিয়ে ঠিকমতো করতে পারলে তার থেকেই সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।

-কিন্তু মনোয়ার সাহেব, আমি যে লাঠিটা আপনাকে পিঠ চুলকানোর জন্য দিতে পারছি না, মাফ করবেন।

-তাহলে স্যার আমার একটা উপকার করুন, প্লিজ? আমার মেয়ের শোবার ঘরের ওয়্যারড্রোবের দ্বিতীয় তাকে সবুজ রঙের প্ল্যাস্টিকের একটা হাতল আছে। পিঠ চুলকানোর হাতল। আমার স্ত্রী কিনে এনেছিল আমার জন্য। আমরা বাপ-মেয়ে দুজনেই ব্যবহার করি। বাইরে দাঁড়ানো আপনার কনস্টেবলকে বলে হাতলটা একটু এনে দিতে পারবেন?

-আপনার মেয়ের শোবার ঘর? করিডর ধরে এগোলে হাতের ডান পাশের দ্বিতীয় ঘরটিই তো?

-একদম ঠিক বলেছেন স্যার। সেখানেই সবুজ রঙের পিঠ চুলকানোর হাতলটি আছে। একটু এনে দিন না! একটু শান্তি মতো পিঠটা চুলকে নেই। আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিলে আর তো শান্তি মতো চুলকাতে পারবো না।’

-জেলেই যাবেন এমনটা ধরে নিচ্ছেন কেন? আপনার নামে এখনও ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়নি। এক্ষুনি আপনাকে হয়ত জেলে যেতে হবে না। তবে তদন্তের প্রয়োজনে থানায় আসতে হতে পারে।

-উফ! বাঁচালেন স্যার। জেল হাজত বড় নোংরা। সর্বত্র পেশাবের গন্ধ।

-এইবার আমাকে বলুন তো, আপনার শ্বশুড়ের কোম্পানি ছেড়ে আপনি চলে এলেন কেন?

-চলে আসিনি, আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তারা অবশ্য উচিৎ কাজটিই করেছে। আমার হাত অবশ, কাজটাজ পারতাম না। অফিসের লোকজন হাসাহাসি করত। শুধু শুধু জামাই কোটায় বড় পদে বসে আমি কোম্পানির ক্ষতিই করছিলাম। তারা বরং ভদ্রতা দেখিয়ে আমাকে দেরিতে সরিয়েছে। আরও আগেই আমাকে ছাঁটাই করা উচিৎ ছিল।

-কোম্পানি থেকে ছাঁটাইয়ের পর আপনি কি করলেন?

-কিছুই না। পুরোপুরি বাসায় বসে গেলাম। কিছুই না করতে পারাটা আমি বেশ ভালো পারি।

-পারুল ইসলামের সাথে আপনার প্রেমের বিয়ে ছিল, তাই না?

-পারুলের মতো এমন স্মার্ট সুন্দরী মেয়েরা আমার মতো গর্ধবদের প্রেমেই বেশি মজে। হুট করেই পারুল আমার প্রেমে পড়ে গেল। কেন পড়ল আমি জানি না। পুরোটাই আমার কপাল আর পারুলের নিয়তি।’

-আর নিয়তির ম্যারপ্যাচে আপনার শ্বাশুড়ি মিসেস শরিফা ইসলামের মৃত্যু ঘটল?

-কী যে একটা বাজে দুর্ঘটনা স্যার, কী বলব! তা না হলে এভাবে গলায় ভাত আটকে কেউ মারা যায়, বলুন তো!

-আপনার শ্বশুর বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব দেলোয়ার ইসলাম, তিনিও তো গলায় ভাত আটকেই মারা গিয়েছিলেন?

-আপনি স্যার সব খোঁজখবর নিয়েই এসেছেন। ভাত না স্যার, তিনি গাজর খেতে গিয়ে মারা যান। ওসব বহু বছর আগের কথা। আমাদের বিয়েরও প্রায় সাত আট বছর আগে হবে। পারুলের তখন ষোল সতেরো বছর বয়স। শ্বশুর সাহেবের অবশ্য নানান অসুখ-বিসুখ ছিল। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। উনার সাথে সবসময় একজন লোক থাকত সেবা করবার জন্য। খাইয়ে দিতে হত। সেদিন বাসায় কেউ ছিল না, তিনি নিজে নিজে গাঁজর খেতে গিয়ে মারা যান।

-কিন্তু আপনার শ্বাশুড়ি তো সুস্থ ছিলেন। শরিফা ইসলামের বয়স সাতান্ন চলছিল, মেডিক্যাল রিপোর্টে তার কোন শারীরিক অসুস্থতার বিবরণও পাওয়া যায়নি। শক্ত সামর্থ্য মহিলা। তার এভাবে গলায় ভাত আটকে মারা যাওয়াটা কী অস্বাভাবিক না?

-অস্বাভাবিক তো বটেই। শ্বশুর সাহেবকে আমি দেখিনি, উনার কথা বলতে পারবো না তবে আমার শ্বাশুড়ি আম্মার সবকিছুতেই অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো ছিল। তিনি স্থিরভাবে কোন কাজ করতে পারতেন না। সবসময় একটা ব্যস্ততার মধ্যে থাকতেন। আসলে আমার শ্বশুর সাহেব অসুস্থ হবার পর কোম্পানিটা তিনি নিজ হাতেই টিকিয়ে রেখেছিলেন। ভীষণ কাজ পাগল মহিলা ছিলেন আমার শ্বাশুড়ি।

-আপনাকে ছাঁটাই করলেও উনার মেয়ে আই মিন আপনার স্ত্রী পারুল ইসলাম কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে ছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই মাকে সাহায্য করতেন।

-পারুল নামে মাত্র পদে ছিল। আমার মেয়ে বকুল ছাড়া আমার শ্বাশুড়ি কাউকে তেমন বিশ্বাস করতেন না। যেদিন তিনি মারা গেলেন সেদিন সকালে উনার একটা মিটিং ছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাত খাচ্ছিলেন। দ্রুত গিলতে গিয়েই ঝামেলাটা হল। গলায় ভাত আটকে গেল। আশেপাশে কেউ ছিল না, ডাকও দিতে পারছিলেন না। গ্লাসে অবশ্য পানি ভরেছিলেন। পানিতে চুমুক দিতে পারেননি। দম আটকে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। ট্র্যাজেডি স্যার, এক নিদারুন ট্রাজেডি!

-আপনার শ্বাশুড়ি যখন মারা যান তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

-বারান্দায় ছিলাম। বাসার বারান্দায় নতুন পুঁইশাকের বীজ বুনেছিলাম। সদ্য পাতা ছাড়ছিল। ওই গাছগুলোতেই আমি পানি দিচ্ছিলাম। গাছ আমার ভীষণ প্রিয়।

-আর আপনার স্ত্রী পারুল ইসলাম?

-পারুল বাথরুমে ছিল। গোসলে। সকাল সকাল ওর হালকা কুসুম গরম পানিতে গোসলের অভ্যাস।

-শরিফা ইসলাম মারা গেছেন, খবরটা আপনি প্রথম কার কাছে থেকে জানতে পারলেন?

-আমার মেয়ে, বকুল। ও ছুটে এসে আমায় জানায়।

-সময়টা মনে আছে?

-সকাল আনুমানিক দশটা কি সোয়া দশটা হবে। সঠিক বলতে পারছি না স্যার। অপরাধ মাফ করবেন।

-বকুল সেদিন স্কুলে যায়নি কেন? ওর তো সকাল আটটা থেকে ক্লাশ শুরু হয়।

-সেদিন ওর শরীর খারাপ ছিল। মেয়েদের যা হয় আর কি।

-বকুল তো এবছর চৌদ্দ’তে পড়ল, তাই না?

-জ্বী স্যার। গতমাসে মেয়েটার জন্মদিন ছিল। ওর নানুমণি বকুলের জন্য চৌদ্দ পাউন্ডের বিশাল এক কেক নিয়ে আসে। খুব আদর করত নাতনীকে। ঐ যে বললাম না নাতনী ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস পর্যন্ত করতেন না। বকুলও নানুমণি বলতে অজ্ঞান ছিল। মায়ের চেয়ে ও তার নানুমণির কাছেই বেশি থাকত। আমার শ্বাশুড়ির অফিস রুমে বকুলের জন্য আলাদা একটা ডেস্কও রাখা ছিল। বকুল যখন তখন সেখানে গিয়ে বসে বসে ছবি আঁকত। ওর নানুমণি মারা যাওয়ার পর বকুলটা ভেঙে পড়েছে খুব।

-আর আপনি?

-আমি কী স্যার?

-শাশুড়ির মৃত্যুতে আপনার খারাপ লাগেনি?

-আমি একজন অপদার্থ মানুষ। আমার অনুভূতির মূল্য কী!

-মনোয়ার সাহেব শুনুন, আমার সামনে এখন অনেকগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া গল্প পড়ে আছে। ছেঁড়া হলেও সবগুলো গল্পে একটা হারমোনি তৈরি হয়। আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তবে ছেঁড়া গল্পগুলো আমি জোড়া লাগানোর চেষ্টা করতে পারি।

-লজ্জা দিচ্ছেন স্যার, আপনি পুলিশের কত বড় অফিসার। আপনাকে আমি আর কীইবা সাহায্য করতে পারি! তবে আমি যতটুকু জানি উত্তর দিতে চেষ্টা করবো। আপনি প্রশ্ন করুন।’

-অতটুকুই দরকার। বলে রাখি আমার সব ধারনার শক্ত প্রমাণ এই মুহুর্তে হাতে এসে পৌঁছায়নি, অনেক কিছুই হবে আমার অনুমান নির্ভর। তবুও আমি একটি সারমর্ম দাঁড় করাচ্ছি, তো শুরু থেকেই শুরু করি, কি বলেন?

-প্লিজ স্যার…

-ঢাকা বিজনেস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মিসেস শরিফা ইসলামের মৃত্যুর গুরুত্ব অনুধাবন করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন দপ্তরে কেইসটি আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং দায়িত্বটা আমি পাই।

-স্যার, আমাদের পরিবারের জন্য আনন্দের সংবাদ যে কেইসটি আপনি ডিল করছেন। আমার কাছে আপনাকে অত্যন্ত পারদর্শী একজন তদন্তকারী মনে হচ্ছে।

-লোকাল ডাক্তারের মাধ্যমে যে মেডিক্যাল রিপোর্ট আমরা হাতে পাই সেখানে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণের কথা উল্লেখ থাকলেও ঘটনার মোড় ঘোরাতে শুরু করে পারুল ইসলামের মেইলে আসা কয়েকটি ছবি। এর জন্য সর্বপ্রথম ধন্যবাদ প্রাপ্য আপনার শ্বশুর বাড়ির অদ্ভুত খেয়াল, স্বর্ণের প্রতি উনাদের পরিবারের আসক্তি।

-বুঝলাম না স্যার, একটু খোলাসা করবেন!

-মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক পর মিসেস শরিফা ইসলামের লাশের বেশকিছু ছবি তোলা হয়। ছবিগুলো পারুল ইসলাম আমাদের দিয়েছিল। কে ছবিগুলো তুলেছে তিনি জানতে পারছেন না। পারুল ইসলামের মেইলে বেনামীতে ছবিগুলো পাঠানো হয়। বাসায় তখন অনেক মানুষ। মৃত্যুর খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই চলে এসেছিল। ছবিটা যে কেউ তুলতে পারে, তবে যেই তুলেছে সে মিসেস শরিফা ইসলামের কন্যা পারুল ইসলামকে একটা মেসেজ দিতে চায়।

-কী মেসেজ?

-মায়ের মৃত্যুর দিন পারুল ইসলাম স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না বলেই হয়তো খেয়াল করেননি কিন্তু তিনদিন পর মেইলে আসা ছবিগুলোতে তার প্রথমেই নজর পড়ে শরিফা ইসলামের হাতের মুঠিতে ধরা রাখা একটা সোনার চেইনের প্রতি। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায় শরিফা ইসলামের গলায় ও হাতের মুঠিতে একটা একটা করে একই ডিজাইনের মোট দুইটা সোনার চেইন। এর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, মৃত্যুর আগে শরিফা ইসলাম তার সামনে থাকা হত্যাকারীর গলা থেকে টান দিয়ে চেইন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। পারুল ইসলামের ধারণা হত্যাকারী এ বাসারই কেউ, কারণ এ বাসার সবাই একই ডিজাইনের সোনার চেইন পরে।

-পারুলই আপনাদের অভিযোগ করে?

-তিনি গোপনে আমাদেরকে জানায়, উনার অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত শুরু করি।

-আমি তাই অনুমান করেছিলাম, আজ নিশ্চিত হলাম। ভালোই হয়েছে। মনে সন্দেহ জন্ম নিলে, সেটি দূর করা উচিত। সন্দেহ সাপের চেয়েও ভয়ংকর।

-পারুল ইসলামের অনুমতি সাপেক্ষে আমরা শরিফা ইসলামের লাশ কবর থেকে উঠিয়ে পুনরায় ময়না তদন্তের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কী হল, আপনি কি অবাক হচ্ছেন?

-লাশ কবর থেকে উঠানো হল অথচ আমি তার কিছুই জানতে পারলাম না! পারুল আমাকে এতটা অবিশ্বাস কবে থেকে করা শুরু করল! মাকে আমি নিজের মায়ের মতোই দেখতাম!’

-যাই হোক, আপনাকে প্রধান সাসপেক্ট ধরে সেই অনুযায়ী আমরা আপনার সম্বন্ধে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া শুরু করি।

-স্যার, আমার সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার কীইবা আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমিই সব বলে দিতাম।

-তাই কি? আপনি এতক্ষণ ধরে আমাকে যা যা বললেন তার প্রায় সবই মিথ্যে বলেছেন। আপনি সুকৌশলে সত্য এড়িয়ে গেছেন মনোয়ার সাহেব।

-আমি কোনও মিথ্যে বলিনি স্যার!

-মনোয়ার সাহেব, আপনার মা এখন কোথায় আছেন?

-দুঃখিত স্যার, এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে চাইছি না। আমার বৃদ্ধ মাকে এখানে অযথা টেনে আনছেন কেন?

-তিনি শুরু থেকেই এই কেইসের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। মনোয়ার সাহেব, আপনার মা লতিফুন্নেসা বেগম কোথায় আছেন?

-তিনি এখন কাশিমপুর কারাগারে। ডাবল মার্ডারের আসামী হয়ে আমার মা যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন।

-সেই খুন হওয়া ব্যাক্তি দুজন কারা কারা?’

-প্রথমজন আমার দাদীজান আর দ্বিতীয়জন আমার বাবা।

-এই তথ্যটা আপনি আমাদের কাছে লুকালেন কেন?

-আমি বিশ্বাস করি না, আমার মা এমন কিছু করতে পারেন।

-কিন্তু আমি যদি বলি আপনি ভালোমতোই জানেন, আপনার মা একজন খুনি?

-সে আপনি বলতেই পারেন কিন্তু আমি স্বীকার করছি না।

-আপনি কি তবে এইটাও অস্বীকার করবেন যে, আপনার মেয়ে বকুল মিসেস শরিফা ইসলামের হত্যাকারী না?

-স্যার আপনি কিন্তু খুবই গুরুতর একটা অভিযোগ করছেন। কোন প্রমাণ আছে আপনার হাতে?

-আমি শুরুতেই বলেছি, সব এভিডেন্স এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। কিন্তু ঘটনার পারস্পারিকতায় আমি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাচ্ছি। আর সেজন্যই আপনার সাহায্য আমার একান্ত কাম্য।

-আমার মেয়ের নামে এত বড় একটা অপবাদ দিয়েও আপনি আশা করছেন আমি আপনাকে সাহায্য করবো?

-করছি, কারণ ইতোমধ্যে আপনি আমাদেরকে সাহায্য করেছেন।

-আমি কীভাবে কখন আপনাকে সাহায্য করলাম!

-আপনার কি শরিফা ইসলামের লাশ দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের রেজাল্ট জানতে ইচ্ছে করছে না?

-তিনি দ্রুত ভাত খেতে গিয়ে গলায় ভাত আটকে…

-আপনার শ্বাশুড়িকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে আর শুরু থেকেই আপনি কথাটা জানতেন। অল্প কিছুক্ষণ আগে আমার মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে আপনার মেয়ে বকুলের ঘরের ওয়্যারড্রোবের ভিতর থেকে সবুজ রঙের প্ল্যাস্টিকের পিঠ চুলকানো হাতলের পাশাপাশি একটি বিষের শিশি উদ্ধার করা হয়েছে। আপনি শুরু থেকে এই জন্যই পিঠ চুলকানোর কথা বলে বকুলের রুমের দিকে আমাদের ইঙ্গিত করছিলেন।

-মোটেই না। আমি এমনটা কেন করবো? আর উইথ ডিউ রেস্পেক্ট আপনি স্যার সোনার চেইনের ব্যাপারে ভুল ব্যাখ্যা দাড় করাচ্ছেন।

-কোথায় ভুল করছি, বলুন তো শুনি।

-আমার শাশুড়ির শরীরে একটাই সোনার চেইন পাওয়া যায় যা লাশ গোসলের শেষে পারুলের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি গলায় সোনার চেইন পরতেন। সেই গলার চেইনটাই পারুল হাতে পায়।

-না। সেদিন যারা শরিফা ইসলামকে গোসল করিয়েছিল তাদের সাথে কথা বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে ওইদিন শরিফা ইসলামের গলায় তারা কোন সোনার চেইন দেখেনি। যে চেইন তারা পারুল ইসলামে হাতে লাশ গোসল করানোর পর তুলে দিয়েছিল সেটি শরিফা ইসলামের হাতের মুঠোতে থাকা চেইন, উনার গলার চেইন নয়।

-কিন্তু ছবিতে পারুল দুইটা চেইন দেখেছে। তাহলে আরেকটা চেইন কোথায়?

-মোচড়টা তো সেখানেই মনোয়ার সাহেব!

-স্যার, আপনি ভীষণ হেঁয়ালি করছেন। একবার বলছেন ছবিতে দুইটা চেইন দেখা গেছে, আবার বলছেন গোসলকারীরা পারুলকে একটাই চেইন দিয়েছে যা ছিল আমার শ্বাশুড়ির হাতের মুঠিতে ধরা রাখা! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! যেমনটা বুঝতে পারছি না, এসবের সাথে আমার মায়ের সম্পর্ক কোথায়? তিনি এই আলোচনায় কেন?

-ভালোবাসার মানুষগুলোকেই নিজ হাতে খুন করে ফেলার অতি অদ্ভুত এক সাইকোপ্যাথ পেশেন্ট ছিলেন আপনার মা লতিফুন্নেসা বেগম। আপনার দাদীজানের কোন মেয়ে ছিল না, খুব অল্প বয়সে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে বালিকা লতিফুন্নেসা বেগমকে তিনি ঘরে নিয়ে এসে মেয়ের শখ পূরণ করেন। একমাত্র ছেলের বউকে তিনি নিজের মেয়েই ভাবতেন। মায়ের আদর সোহাগ দিয়ে বড় করেন। কিন্তু আপনার মা রুপি দাদীজানকে নিজ হাতে খুন করেন আপনার মা। পর্যায়ক্রমে খুন হয় আপনার বাবা। মনোয়ার সাহেব আপনি মাথা নিচু করে রেখেছেন কেন? আপনি কি আমার কথা শুনছেন?

-শুনছি স্যার। আপনি বলুন।

-একসময় আপনার মা বুঝতে পেরেছিলেন নিজের ভিতরকার ভয়াবহ এই অসুস্থতার কথা। অতঃপর তিনি নিজেই থানায় আত্মসমর্পণ করে বিস্তারিত জানান। উনার ভয় ছিল তার কাছে থাকলে হয়তো আপনিও উনার হাতে খুন হয়ে যেতে পারেন।

-আমার মা খুনি ছিলেন, সেই সাজা তিনি পাচ্ছেন। কিন্তু বকুলকে জড়াচ্ছেন কেন স্যার?

-বকুল জড়িয়ে গেছে। সেদিন বকুলের মুখে শরিফা ইসলামের মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে লাশের কাছে গিয়ে আপনি দেখতে পান উনার মুঠিতে ধরা একটা চেইন, কিন্তু বকুলের গলা খালি। দুয়ে-দুয়ে চার মেলাতে আপনার অসুবিধা হবার কথা নয়। আপনি বুঝতে পেরেছিলেন আপনার কন্যা বকুল আপনার মায়ের পথে হাঁটছে। ভালোবাসার মানুষকে খুনের নেশা পেয়েছে বকুলকে। কিন্তু শত হলেও বকুল আপনার মেয়ে। আপনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন। ইতোমধ্যে দাফনের সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। শেষ মুহূর্তে আপনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বকুলকে থামানো প্রয়োজন। কিন্তু নিজের মেয়ের নামে খুনের অভিযোগ দিলে কেউ আপনাকে বিশ্বাস করত না। এমনকি আপনার স্ত্রীকে বললে তিনিও কোনদিন তা মেনে নিতেন না। তাই আপনি নিজের জীবনের উপর জুয়াটা খেললেন। আপনি নিজেই অপরাধী সেজে বাসায় পুলিশ ডেকে আনলেন। আপনার বিশ্বাস ছিল শরিফা ইসলামের মতো হাই প্রোফাইল কেইস ইনভেস্টিগেশন হিসেবে আমাদের হাতে এসে পড়বে। পারুল ইসলামকে পাঠানো সেই মেইলে আপনি তদন্তকারী অফিসার হিসেবে আমার নাম সাজেস্ট করেন। পারুল ইসলাম আপনার সাজানো খেলায় পা দেন। নিজের মেয়েকে সন্দেহ না করলেও স্বামীকে সন্দেহ করাই যায়। পারুল ইসলাম আপনাকে সন্দেহ করে খুনের আসামী হিসেবে আমাদের উপর তদন্তের দায়িত্বভার দেয়। শরিফা ইসলাম আপনাকে কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। প্রতিশোধ হিসেবে তাই আপনি উনাকে খুন করেন বলে পারুল ইসলামের ধারনা জন্মায়।

-কিন্তু আমার শ্বাশুড়ির গলার চেইন তবে কোথায়? সেই রহস্যের সমাধান কি?

-চেইনটা বকুলের গলায়। ঘটনার দিন শরিফা ইসলাম মারা যাওয়ার আগে টান দিয়ে বকুলের গলা থেকে চেইনটা ছিনিয়ে নেয়। মৃত শরিফা ইসলামের মুঠি ধরা হাত থেকে বকুল চেইনটা আর ছুটাতে পারছিল না। সে বুঝতে পারছিল বাসার মানুষজন তার খালি গলা দেখলে সে ধরা পড়ে যাবে। এদিকে বাসা ভর্তি লাশ দেখতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছিল। বকুল একফাঁকে শরিফা ইসলামের গলা থেকে চেইন খুলে নিজের গলায় পরে নেয়। শরিফা ইসলামের হাতে বকুলের নিজের চেইনটা পড়ে থাকে। গোসল দেওয়ার সময় তাই শরিফা ইসলামের গলায় কোন চেইন দেখা যায়নি। গোসল দেওয়া মেয়েগুলো মুঠিতে ধরা চেইন ফেরত দেয় পারুল ইসলামকে। ফরেনসিকে আমরা চেইন দুইটা ইনভেস্টিগেট করে সেই সত্যতা পেয়েছি।
-আমি যে বকুলকে ধরিয়ে দিয়েছি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন?-আপনি জানতেন বকুল যেভাবেই হোক চেইন সরানোর চেষ্টা করবে তাই লাশ দেখার কিছুক্ষণের মধ্যে আপনি লুকিয়ে শরিফা ইসলামের গলার আর হাতের চেইনের বেশ কিছু ছবি তুলে রাখেন প্রমাণ হিসেবে। বেনামী মেইলে সেই ছবিগুলো আপনি পারুল ইসলামের কাছ পাঠান।

-ছবিগুলো আমিই পাঠিয়েছি প্রমাণ কি?

-প্রমাণ আপনি নিজেই রেখে দিয়েছেন। যে আইডি থেকে মেইল পাঠানো হয়, তার সূত্র ধরে আইপি এড্রেস ট্রেস করা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। আপনি জানতেন পুলিশ তদন্ত করলে খুব সহজেই আপনি ধরা পড়বেন। দক্ষিণ নাখালপাড়ার যে সাইবার ক্যাফে থেকে আপনি মেইল পাঠিয়েছেন সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ আমরা সংগ্রহ করেছি। নিজেকে লুকানোর কোন চেষ্টাও আপনি করেন নাই। আপনি চেয়েছেন যেন আমরা আপনাকে খুঁজে পাই। আপনি জানতেন আপনার মাধ্যমে আমরা পৌঁছে যাব আপনার মেয়ের কাছে। মানতেই হবে ব্রিলিয়ান্ট স্ট্র্যাটেজি মনোয়ার সাহেব! কি হল, চুপ করে আছেন যে?

-এইসব কথা পারুল জানে? ওকে জানাবেন না। ও সহ্য করতে পারবে না।

-এখনও কিছু জানানো হয়নি।

-স্যার বকুলের চোখটা অবিকল আমার মায়ের মত শীতল আর খুনে। আমি আর কী-ইবা করতে পারতাম স্যার, বলুন তো? বকুলের হাত থেকে মানুষ বাঁচাতে হলে ওকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া ভিন্ন কোন পথ খোলা ছিল না। এতে বকুলটাও বেঁচে গেল। জেলের সংশোধনাগারে চিকিৎসা পেলে ও ভালোও হয়ে যেতে পারে। ওর গায়ে আর খুনের রক্ত লাগবে না।’

-হুম

-বকুল কোথায় স্যার? আমার মেয়েটা কোথায়? আমার সোনামানিকটাকে আমি এক নজর দেখতে চাই।

-পাশের রুমে আছে। তাকে মনিটরিং-এ রাখা হয়েছে।

-স্যার, বকুল কিন্তু এখনও মাইনর, বাচ্চা একটা মেয়ে। প্লিজ দেখবেন স্যার ওর শাস্তিটা যেন কম হয়, আমার মেয়েটা যেন কষ্ট না পায়।

-বকুলের শাস্তি হবে না

-মাইনর বলে?

-না। বকুলের শাস্তি হবে না কারণ খুনটা বকুল করেনি।

-কী বলছেন? আপনিই তো বললেন বকুল খুন করেছে!

-বকুল খুন করেনি। তাকে খুনি সাজানো হয়েছে।

-তাহলে খুন কে করেছে?

-খুন করেছেন আপনি।

-আপনি একজন বাবার কষ্ট নিয়ে হেঁয়ালি করছেন স্যার?

-মনোয়ার সাহেব আপনি খুবই বুদ্ধিমান একজন মানুষ। কোন বুদ্ধিমান ব্যাক্তি যদি নিজের বুদ্ধির ক্ষমতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন হয়ে উঠে তার চেয়ে ভয়ংকর শক্তিশালী আর কেউ হয় না।

-আমাকে বলছেন? বাহ, ভালো তো! আমি নিজেকে সারাটা জীবন একজন অপদার্থ ভেবে এসেছি। মজা করেই না হোক, এই প্রথম কেউ আমাকে বুদ্ধিমান বলল। কৃতজ্ঞতা স্যার।

-এখন পর্যন্ত আমি আপনার দেখানো পথেই পথ চলছিলাম, আপনি যেভাবে আমাকে পরিচালিত করেছেন ঠিক ঠিক সেভাবেই আমি বলে গেছি। হয়তো এভাবেই আমি সব মেনে নিয়ে মাত্র চৌদ্দ বছরের মেয়েটিকে খুনের আসামী হিসেবে ঘোষণাও করে দিতাম। কিন্তু বাধ সাধল আপনার মামা সৈয়দ ইয়াকুব হকের আত্মহত্যা!

-স্যার আপনি আবারও বাজে বকছেন! আপনার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে আমি উঠব।

-আহা, বসুন বসুন, পিঠ চুলকালে আমার লাঠিটা এখন নিতে পারেন, নেবেন?

-পিঠ চুলকাবো না।

-ঠিক আছে, আমাকে শুধু বলুন, ইয়াকুব হক যে বছর আত্মহত্যা করেন ঠিক একই বছর মারা যান আপনার স্ত্রীর বাবা জনাব দেলোয়ার ইসলাম। ব্যাপারটা কি একেবারেই কাকতালীয়?

-অবশ্যই কাকতালীয়। পিন্টুমামা যে বছর খুন হয় আরও অনেক মানুষ সে বছর মারা গেছে, এর মাধ্যমে কি প্রমাণ হয়?

-কি বললেন? ইয়াকুব হক খুন হয়েছেন?

-খুনই তো। নিজেকে নিজে খুন করেছে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা, এইটাও কি খুন নয়?

-অথবা তাকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে।

-কে হত্যা করেছে? কে?

-হত্যা করেছে আপনার স্ত্রী পারুল ইসলাম।

-আমি উঠব। এখানে আর এক সেকেন্ডও আমি বসব না।

-পারুল ইসলামের সাথে আপনার প্রথম পরিচয় কিশোর বয়সে, লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরির সদস্য বইয়ে সেই সময়ে আপনাদের নাম খুঁজে পাওয়া গেছে।

-তো?

-ঘটনাচক্রে দুই কিশোর-কিশোরী একে অপরের কাছাকাছি এসে বুঝতে পারে উভয়ই প্রিয়জনদেরকে খুনের নেশায় মত্ত। আপনি ইতোমধ্যে দাদী আর বাবাকে খুন করে ঢাকায় এসেছেন। পারুল হত্যা করেছে তার বাবাকে। দুই সাইকোপ্যাথ এক হয়ে যায়। পরবর্তীতে আপনারা দুজন একসাথে হত্যা করেন আপনার মামা ইয়াকুব হককে। আপনারা ভেবেছিলেন বকুলও আপনাদের মতোই ফ্যামিলি সাইডে যুক্ত হবে। কিন্তু যখন বুঝলেন সে আপনাদের মতো নয়, তখন নিজের চৌদ্দ বছরের মেয়েকে ফাঁসাতেও আপনাদের স্বামী-স্ত্রী কারো বুক কাঁপেনি। আপনারা দুজন ভয়ংকর সাইকোপ্যাথেটিক সিরিয়াল কিলার। ভাগ্য আপনাদের দুজনকে একসাথে মিলিয়ে দেয়।

-বকুলের গলার চেইনের ব্যাখ্যা কি? ফরেনসিকে বকুলের গলার চেইন আমার শাশুড়িরটা বলে প্রমাণিত হয়েছে।

-হয়েছে। তবে সব কিছুই হয়েছে আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর দুর্দান্ত প্ল্যানিংয়ের কারণে। রাতে ঘুমানোর আগে বকুল ওর সোনার চেইন খুলে বিছানার পাশে ড্রয়ারে রাখে। সেই সুযোগটা আপনারা গ্রহণ করেন। বকুলের চেইন রাতে লুকিয়ে নিয়ে আসেন নিজের কাছে, সকালে শরিফা ইসলামকে খুন করে বকুলের চেইনটা উনার হাতে গুঁজে দেন। বকুল যখন সকালে নিজের চেইন ওর মৃত নানীর হাতের মুঠোয় দেখতে পায় তখন সে আতংকিত হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত ভয়ের কারণেই হয়ত শরিফা ইসলামের হাত থেকে সে চেইনটা আর ছুটাতে পারছিল না। উপায় না দেখে সে নানীর গলার চেইন নিজের গলায় পরে নেয়। এইটাই বকুলের একমাত্র ভুল। এই ভুলটাই আপনাদের দরকার ছিল। বাবা-মা একসাথে নিজের মেয়েকে ফাঁসাচ্ছে, গল্পটা এভাবে না সাজিয়ে আপনি নিজে অপরাধী সেজে বাসায় পুলিশ নিয়ে আসেন। আপনারা জানতেন তদন্ত হলে একমাত্র বকুলই ফেঁসে যাবে কারণ ওর গলায় রয়েছে শরিফা ইসলামের চেইন।

-আমরাই যে খুনি, আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?

-আপনার মায়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। আপনার দাদীজান আর বাবার খুনের সাক্ষী আপনার মা। তিনি বহু বছর আগে আপনাকে বাঁচাতে আদালতে মিথ্যা বলে নিজের উপর সমস্ত দায়ভার তুলে নিয়েছিল। কিন্তু বকুলের কথা শুনে তিনি আমাদের কাছে সব সত্য প্রকাশ করেন। তিনি আপনাদের হাত থেকে বকুলের মুক্তি চান। আপনাদের বিরুদ্ধে নতুনভাবে মামলা দায়ের হচ্ছে। মামলার রাজসাক্ষী হতে যাচ্ছেন আপনার মা।

-হাসালেন স্যার। আমার মা এমনটা করতেই পারবে না।

-পুত্রস্নেহে পাগল মা আর কত সহ্য করবে? এতগুলো বছর ধরে তিনি আপনার খুনের বোঝা টানছেন, আপনার মাকে এবার মুক্তি দিন মনোয়ার সাহেব।

-ওসি চঞ্চল ফিরোজ উঠে দরজার কাছে এগোন। আজ তার দ্রুত বাড়ি ফেরার কথা। তার মেয়ে রুমকির আজ জন্মদিন। পিছনে থেকে তিনি শুনতে পান মনোয়ার কিছু বলছে। গুরুত্ব না দিয়ে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান।

-মনোয়ার মাথা নাড়তে নাড়তে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে মা আবারও ফিরে আসছে, এবার আর তাকে কেউ আটকাতে পারবে না’

তাতা
সমাপ্ত

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন