বিজ্ঞাপন

ইতিহাসের অনুসন্ধানী এম আব্দুর রহমান

May 3, 2022 | 4:22 pm

আবু রাইহান

স্বাধীনতা-উত্তর এই দুই সম্প্রদায়ের মিলন-সূত্র নানাভাবে ব্যাহত করার চেষ্টা করলেও কিছু আলোকিত মানুষ প্রতিনিয়ত মিলনের পথকে প্রসারিত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ইতিহাস অনুসন্ধানী এম আব্দুর রহমান অন্যতম। তিনি ছিলেন বীরভূমের নিমড়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান। এম আব্দুর রহমান গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সব ধরনের লেখা লিখেছেন। তিনি অগ্নিযুগের মানুষ, স্বাধীনতা আন্দোলন দেখেছেন। কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে এসে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। গান্ধীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে ডাক্তারি পড়া ছেড়ে চরকা কিনে গ্রামে ফিরেছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ আব্দুর রহমান গ্রামে ফিরে এসে ‘শান্তি আশ্রম’ নামে একটি সংস্থা স্থাপন করলেন। এই সংস্থা যথাক্রমে চরকাকেন্দ্র, তাঁতস্থাপন ও খদ্দর উৎপাদনের কাজ শুরু করলো। পূর্ণ উদ্যমে কাজ চলতে লাগলো। এর মধ্যে একদিন কীর্ণাহারের মন্ডপতলায় অনর্গল ধারায় ভাষণ দানের অপরাধে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছিলেন ডাক্তারি পড়া ছাড়ার কারণে ডাক্তার হতে না পারলেও পরবর্তীতে তিনি আইনজীবী হয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি বছর দুই কলকাতার তৎকালীন তৃতীয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুসাহিত্যিক এস ওয়াজেদ আলী’র আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর মাসিক গুলিস্তা পত্রিকায় কাজ করেছেন। এই সময়কালে একদিন কমরেড আব্দুল হালিমের ভাই আবুল কাশেম প্রথমবারের মতো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে তাঁকে নিয়ে যান। বিদ্রোহী কবিকে দেখে তাঁর হৃদয় মন প্রাণ ভরে ওঠে। তিনি অনুপ্রাণিত হন। গণবাণী অফিসে আলাপ হওয়ার সময়েই বিদ্রোহী কবি তাঁকে বলেছিলেন, গ্রামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে। কারণ, বইপত্রের মাধ্যমেই একটি জাতির আত্মিক উন্নতি সম্ভব। যুবক আব্দুর রহমান কবিকে বলেন, তাহলে আপনিই প্রথমে লাইবেরির জন্য কিছু বই দিন। নজরুল ইসলাম কিছু বই উপহার দিলেন। নিজের জন্মভূমি নিমড়া গ্রামে যে পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন সেখানে বহু দুর্লভ গ্রন্থ ও পুঁথি পত্র সংগ্রহ করেছিলেন। সম সময়ে আলাপ হয় শিক্ষাবিদ লেখক হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে। যাঁর পরামর্শে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথকে চিঠি লেখেন এম আব্দুর রহমান। অধ্যাপক স্মিথ তাঁকে ‘মডার্ন ইসলাম ইন ইন্ডিয়া’-সহ বেশ কিছু বই পাঠান।

বর্ধমানের কাটোয়ায় বসে ওকালতি, সাহিত্যচর্চা এবং ইতিহাস গবেষনা সমান্তরালভাবে চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজ আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকায় শিক্ষাদীক্ষাহীন এবং সংস্কৃতিরচর্চাবিহীন হয়ে নিরাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এই সমাজকে জাগাতে গেলে, মুসলিম সমাজের আলোকিত ব্যক্তিত্বদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে। তিনি বেদনাহত হয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রচলিত যে ইতিহাস রচিত হয়েছে সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলিম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম সচেতনভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি সেই অনালোচিত দিক নিয়েই কঠিন এবং দুরহ কাজ শুরু করেছিলেন। কাটোয়া কোর্টের এক অন্ধকার ঘরে বসে ওকালতি সামলে একবুক হতাশা নিয়ে তিনি অবহেলিত জাতির ইতিহাসের অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম অনুসন্ধান সমিতি’। ১৯৯৩ সালে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই কলমের সৃজনশীলতা সক্রিয় ছিল। বারোটি গবেষণা গ্রন্থ, কবিতা ও পদ্য সঙ্কলন চারটি, নজরুল বিষয়ক গ্রন্থ তিনটি, একটি নাটক এবং চারটি জীবনী গ্রন্থসহ চব্বিশটি সাধনার ফসল রেখে গিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। প্রস্তুত ছিল আরও অনেকগুলি গ্রন্থের পান্ডুলিপি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তার মৃত্যুর পরে সেই পান্ডুলিপিগুলি বই আকারে প্রকাশ করতে এখনো কেউ এগিয়ে আসেননি।

এম আব্দুর রহমানের প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে রয়েছে ‘কিশোর নজরুল’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল’, জীবনীগ্রন্থ ‘বিদ্রোহী ফকির নায়ক মজনু শাহ’, ‘শহীদ বীর তিতুমীর’, ‘সীমান্ত গান্ধী’, ‘লিয়াকৎ-রসুল-সিরাজী’, ‘বীরাঙ্গণা কবি সরোজিনী নাইডু’, ‘মাওলানা আকরম খাঁ’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী সপ্ত সাংবাদিক’, ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম নারীদের অবদান’, ‘পয়গম্বর প্রিয়া’, ‘হযরত কেরমানি’, ‘দাতা মহবুব শাহ’, ‘তিন মহিলা দরবেশ’, ‘সাত্তার স্মৃতিকথা’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ইতিহাস’, ‘মুসলিম সাময়িক পত্রের ইতিহাস’, কাব্যগ্রন্থ ‘কারবালার বাণী’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘ফরিয়াদ’, সম্পাদিত কবিতা সংকলন ‘বল্লরী’, নাটিকা ‘বীরভূমির সিংহাসন’ ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী মহৎপ্রাণ আলোকিত ব্যক্তিত্ব মনীষী এম আব্দুর রহমানের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম নারীদের অবদান’ নামক বই। বইটিতে রানী লালবিবি, বিদ্রোহী বেগম হযরত মহল, বীরজননী বি আম্মা, জ্যোতির্ময়ী রোকেয়া খাতুন, অগ্নিনাগিনী মিসেস এম রহমান, বিপ্লবী বেগম দৌলতউন্নিসা এবং দেশসেবিকা হোসনে আরা বেগম, এই সাতজন মুসলিম মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করেছেন। আমাদের দেশের সরকারিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়লে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, বিদেশি ইতিহাস লেখক এবং আমাদের দেশের ভাড়াটে ইতিহাস রচয়িতারা অত্যন্ত সচেতনভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের অবদানকে মুছে ফেলার চেষ্টায় অবিরাম লিপ্ত রয়েছে। ইতিহাসের এই বিকৃতি দেখে স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্যেন সেন তাঁর ‘ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা’ পুস্তকে লিখেছেন, ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের অবদানকে অবহেলা করে বিস্তৃতির তলায় চাপা দেওয়া এক জাতীয় অপরাধ’। সত্যানুসন্ধানী মনীষী এম আব্দুর রহমান চাপা পড়ে থাকা ইতিহাসের এই উজ্জ্বল অধ্যায়কে আমাদের সামনে তুলে ধরতে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাসকে তুলে আনতে সারা জীবন ধরে এই কঠিন গবেষণালব্ধ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনিই প্রথম আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে অগ্নিযুগের বিপ্লবী হিসাবে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে পুরুষরাই শুধু নয়, মুসলিম নারীরাও এগিয়ে এসেছিলেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উপেক্ষিতা এই বীরাঙ্গণা নারীদের কথা তিনিই প্রথম স্বীকৃতির আলোয় তুলে ধরলেন।

১৯৭২ সালে কলকাতার বুলবুল প্রকাশনী থেকে ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম নারীদের অবদান’ নামক পুস্তকটি প্রকাশিত হওয়ার পর, দৈনিক বসুমতি সংবাদপত্রে পুস্তকটির আলোচনায় লেখা হয়েছিল, ‘সাতজন মুসলিম দেশ প্রেমিকা মহিলার জীবনী প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থখানির মধ্যে। আজাদী যুদ্ধের নেপথ্য নায়িকাদের জীবনের কাহিনী আমাদের বিস্মিত করে। পড়তে পড়তে স্থান বিশেষে রোমাঞ্চিত হয় শরীর। ওয়েস্ট বেঙ্গল মুসলিম রিসার্চ সোসাইটির সম্পাদক গ্রন্থকার আব্দুর রহমান বহু পরিশ্রম ও গবেষণার ফল স্বরূপ এই গ্রন্থ আমাদের কাছে উপস্থিত করেছেন।’ পরবর্তীতে পুস্তকটির নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম বীরঙ্গনা’ নামে প্রকাশিত হয়।

উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক অধ্যায় দখল করে আছে খেলাফত আন্দোলন। অসাধারণ এক সাহসী বীরাঙ্গনা মায়ের নাম আবিদা বিবি ওরফে বি আম্মা। বি আম্মার দুই সন্তান মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী ছিলেন খেলাফত আন্দোলনের তুখোড় নেতা। ইতিহাসের পাতায় আলী ভ্রাতৃদ্বয় নামেই গৌরবোজ্জ্বল পরিচিতি ক্ষণজন্মা এই সহোদর জুটির। ব্রিটিশ ভারতের মজলুমের অন্যতম কারিগরদের তালিকায় আজও শোভা পায় চাঁদতারা খচিত তুর্কি টুপিতে উন্নত শির ভ্রাতৃযুগলের জোড়া ছবি। ১৯২১সালে তাঁর দুই পুত্র মুহাম্মদ আলী এবং শওকত আলীর ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর চারিদিকে গুজব রটে যে তাঁর পুত্ররা ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মুক্তিলাভ করতে যাচ্ছেন। একথা শুনে রাগে আর অপমানে তেজস্বিনী জননী বি আম্মা দুই সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করতে চেয়ে হাজির হয়েছিলেন কারাগারের ফটকে। যদিও মায়ের কাছে আসা ওই সংবাদটি ছিল ভুল। পরাধীন ভারতের মানুষজন সেদিন এই অগ্নিগর্ভা নারীর অটলতায় পেয়েছিলেন ইস্পাতকঠিন অনুপ্রেরণা। বি আম্মা হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিপাগল সর্বস্তরের মানুষের আম্মাজান। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সারা ভারতে ঘুরেছেন, মেয়েদের যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। ১৯১৭ সালে কলকাতায় যখন কংগ্রেসের অধিবেশন চলছে তখন তাঁর দুই পুত্র মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা মোহাম্মদ আলী কারাগারে। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে সাত বছরের জন্য অন্তরীণ করে রাখে। কংগ্রেসের আহ্বানের তাঁর পুত্রদের প্রতিনিধিরূপে বি আম্মা স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনীসহ যোগদান করেছিলেন এই কলকাতা অধিবেশনে। এই সভায় তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ সুন্দর ভাষণ দিয়েছিলেন। ভারতের নারীদের তিনি ডাক দিয়েছিলেন দেশ সেবায় বীরমাতা রূপে ভূমিকা গ্রহণ করার জন্য। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য স্বামী-পুত্রদের প্রয়োজন হলে পাঠাতে হবে জেলে এবং নিজেদেরও ভয়-দ্বিধা পরিহার করে বরণ করে নিতে হবে কারাগার’। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানরা স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কারাবরণ করেছে, এজন্য জননী হিসেবে আমি গৌরব বোধ করছি’। বালগঙ্গাধর তিলক বি আম্মার উক্তির প্রতিধ্বনি করে বলেছিলেন, ‘এদেশে যেন বি আম্মার মত বীর জননীর অভাব না হয়! জননী হওয়া গৌরবের বটে কিন্তু বীর জননী হওয়া অধিকতর গৌরবের। দেশকে আজাদ করতে হলে বি আম্মার মত হাজার হাজার বীর জননী প্রয়োজন’।

বিজ্ঞাপন

মহাত্মা গান্ধী ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে প্রচারকার্যে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ও তার আগে বাংলাদেশে পরিভ্রমণ করেন। এই সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বি আম্মা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত বহু সভায় ও বৈঠকে তিনি যোগদান করেছিলেন। বি আম্মার বাংলা পরিভ্রমণের ফলে বাংলায় মুসলিমদের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব আলোড়ন, উদ্দীপনা, চাঞ্চল্য ও উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছিল। আর তার ফলে বাংলার মুসলিমরা বিনা দ্বিধায় দলে দলে যোগদান করেছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে। হিন্দু মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন মৈত্রী গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় বি আম্মার অবদান অনস্বীকার্য। ভারতের সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষকে তিনি আপন সন্তানের মতো মনে করতেন। মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাকে ‘আম্মা’ বলে সম্বোধন করতেন ও আপন মায়ের মতোই শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। এই বীর জননী মারা যান ১৯২৪ সালের ১২ নভেম্বর।

তিনি শুধুমাত্র নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের বেগমই নন, ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহে আওধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই গড়ে তুলেছিলেন বিদ্রোহী বেগম হজরত মহল (১৮২০- ৭এপ্রিল ১৮৭৯)। বেগম হযরত মহল ছিলেন এক অভিজাত ও পর্দানশীন মহিলা। যিনি বাস করতেন লখনৌ এ অবস্থিত অযোধ্যার শাসক ওয়াজেদ আলী শাহ’র জমকালো প্রাসাদের চার দেওয়ালের মধ্যে। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে কীভাবে এই মহিলা তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র ও রূপান্তরিত হয়েছিলেন এক অকুতোভয় স্বাধীনতার সৈনিকে। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে যখন কলকাতায় নির্বাসনে পাঠানো হয়, তখন আওধের দায়িত্ব তিনি নিজেই তুলে নিয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। হিন্দু-মুসলিমকে একজোট করে লড়াই গড়ে তুলেছিলেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। লর্ড ডালহৌসি অপশাসনের অজুহাতে ১৮৫৬ সালে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে রাজ্যচ্যুত করেন। পুত্র বীর্জস কাদির তখন এগারো বছরের বালক। বেগম হজরত মহল এই নাবালক পুত্রের অভিভাবকরূপে অযোধ্যার শাসনতান্ত্রিক ও সামরিক দায়িত্ব হাতে নেন। তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা রূপে যাঁরা পরিচিত ছিলেন তাঁরা হলেন, রাজা মান সিং, জয়নাল সিং, রঘুনাথ সিং, উমরাও সিং ও মুন্সি মাতাদিন। বেগম হজরত মহল প্রথম থেকেই ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আর এই উদ্দেশ্যে তিনি বৃটিশের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করেন। সেখ সুকুল, ওয়াজিদ আলি খান, জাহাঙ্গীর খান, রাজমন্ড তেওয়ারি, সগেম সিং, সুরজ সিংহ ও মীর কাসেম আলীকে নিয়ে সামরিক বাহিনী গঠিত হয়। বেগম হযরত মহল ঘোষণা করেন অযোধ্যা একমাত্র অধীন ও অনুগত থাকবে দিল্লীশ্বর দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর নিকট, যিনি একাধারে হিন্দু-মুসলিম সকলের দ্বারা অভিনন্দিত হয়েছেন ভারত সম্রাটরূপে।

এই প্রকাশ্য ঘোষণা থেকে প্রমাণিত হয় কতটা যথার্থ ও স্বভাবজাত ছিল তাঁর স্বাধীনতাবোধ ও জাতীয়তার অনুভূতি। অবশেষে ১৮৫৭’র ১০ মে মিরাটে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। আর লখনৌতে বিদ্রোহের পতাকা ওঠে ১৮৫৭’র ৩০ মে। একে একে অযোধ্যার বিভিন্ন শহরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বেগম হযরত মহল উপলব্ধি করেন যে চরম মুহূর্ত আসন্ন। সাম্রাজ্যের বেড়া থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, চড়লেন সৈনিকের বেশে হাতির পিঠে। বেগম হযরত মহল-এর প্রভাবে সমগ্র অযোধ্যায় লাখ লাখ মানুষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র তুলে নেয়। এদের মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ মানুষের ছিলনা অস্ত্রশিক্ষা। যারা বেগম হযরত মহল এর প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে যুদ্ধে অংশ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মি.নিল ও ক্যাপ্টেন চিপকে নিহত করেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি বেগম হযরত মহল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিরুপায় হয়ে বেগম হযরত মহল তাঁর অনুগামী ও পুত্রকে নিয়ে নেপালে আশ্রয় নেন। অবশেষে কাঠমুন্ডুতে ১৮৭৯ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু আমৃত্যু তিনি বৃটিশের বশ্যতা স্বীকার করেননি। বেগম হযরত মহল ব্রিটিশদের উচ্ছেদে সফল হননি ঠিকই, তবে তাঁর প্রবল আত্মপ্রত্যয় নির্ভীকতা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে। ১৮৭৯ সালে কাঠমান্ডুতে তাঁর মৃত্যু হয়। বেগম হজরত মহলের কবর কাঠমান্ডুর কেন্দ্রে জামে মসজিদের নিকটে অবস্থিত। ১৯৮৪ সালের ১০ মে ভারত সরকার তাঁর সম্মানে ডাকটিকেট প্রকাশ করে।

বাঙালি মহিলাদের মধ্যে যারা অসহযোগ আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে গাইবান্ধার (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত) দৌলতুন্নেসা খাতুন (জন্ম ১৯১৮ সালে)’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দৌলতুন্নেসা ছিলেন লেখক, বাগ্মী, সমাজকর্মী এবং গান্ধীজীর অনুসারী। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘লবণ আইন’ পাস করলে, ১৯৩০ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে দৌলতুন্নেসা লবণ আইন অমান্যের উদ্দেশ্যে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ সভায় ও মিছিলে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন।দেশ জননীর সেবা করতে গিয়ে তাঁকে বহু লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। তবুও তিনি পিছিয়ে যাননি। স্বদেশের সেবাকার্যে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। বাংলায় প্রথম ‘মহিলা সমিতি’ তৈরি করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী দৌলতুন্নেসা (১৯১৮-১৯৯৭)। ১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি ‘গাইবান্ধা মহিলা সমিতি’ গড়ে তুলেছিলেন। যদিও বয়স তখন তাঁর মাত্র ১৪ বছর, দায়িত্বজ্ঞানে ও কর্মভার গ্রহণে তিনি পরিণত বয়সের পরিচয় দিতেন। এই সমিতি সভা, শোভাযাত্রা, পিকেটিং, ১৪৪ ধারা অমান্য ও প্রচারকার্য ইত্যাদি পূর্ণদমে করতে থাকেন তিনি। গাইবান্ধা মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বাংলার নারী সমাজকে অংশগ্রহণে উৎসাহীত করেন। দৌলতুন্নেসা প্রাণের আবেগে বক্তৃতা দিয়ে সকলকে আন্দোলনে যোগ দিতে আহবান করতেন। ব্রিটিশ সরকার বিরোধি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তাঁকে একাধিকবার কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তাঁকে রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি ও বহরমপুর জেলে বন্দি করে রাখা হয়। শুধু তাই নয় ইংরেজ সরকার তাঁর স্বামীর ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত করে তাঁকে গাইবান্ধা এলাকা থেকে বহিস্কৃত করেছিল। পরে গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গেও দৌলতুন্নেসার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে তিনি একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। দৌলতুন্নেসা গান্ধীর অনুসারী হিসেবেই অধিক স্মরণীয় হয়ে আছেন।

বিজ্ঞাপন

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন নেতৃস্থানীয় সকল ব্যক্তিই যখন কারাগারে, এই সংকটময় মুহূর্তে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে অকুতোভয় জাতীয় পতাকা হাতে দৃঢ় পদক্ষেপে যে সকল মুসলিম মহিলা আইন অমান্য করে বন্দীজীবন বরণ করে নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হোসনে আরা। চব্বিশ পরগনার হাড়োয়ার পায়রা গ্রামের দেশসেবিকা হোসনে আরা বেগম (১৯১৬-১৯৯৯) ছিলেন একাধারে দেশ ও সমাজ সেবিকা এবং কবি। তিনি ছিলেন বিপ্লবী কবি ও শিশু সাহিত্যিক। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও কাজী নজরুল ইসলামের ভাবধারা হোসনে আরা’র জীবনে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিদেশি দ্রব্য বর্জন এবং সেইসঙ্গে স্বদেশের কুটির শিল্পের উজ্জীবন, উন্নয়ন ও প্রচারে তিনি উল্লেখযোগ্যভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সভা সমিতিতে তিনি প্রকাশ্যে যোগ দিতেন। বিদেশি শাসন তাঁর কাছে ছিল গ্লানিকর। দেশ স্বাধীন করতে হলে মেয়েদেরকে পুরুষের পাশে থেকে কাজ করতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, কারাবরণ করতে হবে- এই ছিল হোসনে আরা’র ঘোষণা। ১৯৩২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি কলকাতা ময়দানে ব্রিটিশবিরোধী জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করার কারণে তাঁকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং ৬ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। ব্রিটিশ বিরোধীতার জন্য তাঁকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। আলিপুর ও বহরমপুর দুই সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল। কারাগার থেকে মুক্তি পেলে নেতাজি তাঁর কাছে অভিনন্দন বার্তা পাঠান।

মূলত তিনি ছিলেন এক বিপ্লবী কবি। তাঁর কবিতাশৈলির মধ্যে তাঁর স্বদেশপ্রীতি ও তেজবত্তা বারেবারে ফুটে উঠেছে-
নূতন দিনের দীপ্ত আলোয় ভরেছে ভুবনখানি
আঁধার-পুরীর আগল ভেঙেছে
অন্ধ পেয়েছে আঁখি!
বন্দিনীগন বাঁধন ছিঁড়েছে-
মুক্ত হয়েছে নাকি?…

নূতনের গান, নূতন কাহিনী মোদের গাইতে হবে!
বৃদ্ধা ঘরনী ধ্বসিয়া পড়েছে শত অনাচারভারে-
পাপ-পঙ্কিল দেহখানি তার হয়েছে দুর্বিষহ!
আজিকে তাহার শেষের সমাধি মোদের রচিতে হবে-
(‘মুক্তির বাণী হয়নি আজিও রক্ত আখরে লেখা’- মাসিক সওগাত)

বিপ্লবের লাল দিন ঘনাইয়া আসে-
নূতনের অভিযান শুরু হয়ে যায়
শুরু হয় ঘোরতর সমর সংঘাত
সাম্য আর অসাম্যের সাথে!
(‘ভবিষ্যৎ’- মাসিক মোহাম্মদী)
হোসনে আরা বেগম আইন অমান্য আন্দোলনের সময় যে দুঃসাহসী কর্মতৎপরতা দেখান তা এদেশের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।

মিসেস এম রহমান ছিলেন মুসলিম নারী জাগরণের অন্যতম সৈনিক এবং একজন সাহিত্য সেবিকা। মাসুদা খাতুন ওরফে অগ্নিনাগিনী মিসেস এম রহমান (১৮৮৫-১৯২৬) ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে নারীবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতায় পথপ্রদর্শকদের কাতারে। মিসেস এম রহমান নারীদের অধিকার এবং নারীবাদ চর্চার উপর লিখেছেন। তিনি সমালোচনা করেছেন রক্ষণশীল মুসলমানদের। তিনি ছিলেন একজন দৃঢ় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মুসলিম মহিলা। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিষের বাঁশী’ কবিতাটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁকে অগ্নি নাগিনী সম্বোধন করে। ‘বাংলার অগ্নিনাগিনী মেয়ে মুসলিম মহিলা গৌরব মোসাম্মাৎ মাসুদা খাতুনকে’, যিনি তৎকালীন মুসলিম সমাজে নারী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই কাব্যগ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতা ও গানগুলি একদিকে দেশপ্রেমের উদ্দীপনায় যেমন ভরপুর অপরদিকে পরাধীনতার গ্লানিতে শিকল ছেঁড়ার রোষে জোশে উত্তপ্ত উদ্দীপ্ত। নজরুল ‘মিসেস এম রহমান’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সুলেখিকা রূপেও তাঁর একটা পরিচিতি ছিল। রোষ, জোশ, প্রেরণা ও উদ্দীপনা দেখা যায় মিসেস এম রহমানের রচনাতেও।

তিনি শুধু সংগ্রামী সাহিত্য সেবিকা ছিলেন না, ছিলেন ঘরছাড়া আর লাঞ্ছিত দেশসেবক ছেলেদের পালক মাতা। বহু দুস্থ সাহিত্যিক ও দেশপ্রেমিক তরুণ তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে মাতৃস্নেহ। একসময় বিপন্ন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে তিনি বিহগ শিশুর মতো ডানা মেলে স্থান দিয়েছিলেন। নজরুলের মতো অনেক দেশভক্ত যুবক তাঁর স্নেহের ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছে। আর মেয়েরা পেয়েছে আলোর পথের সন্ধান, দেশ স্বাধীন করার প্রেরণা ও উৎসাহ। এই মহীয়সী নারীর জন্ম ১৮৮৪ সালে এবং মৃত্যু ১৯২৬ সালে। তাঁর স্বামী ছিলেন বিখ্যাত স্বদেশী বিপ্লবী ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা এম রহমান।

রোকেয়া অর্থ জ্যোতির্ময়ী। রংপুরে মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মানো জ্যোতির্ময়ী রোকেয়া খাতুন (১৮৮০-১৯৩২) ছিলেন বিদ্যাসাগর চেতনার মানুষ। ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ চিন্তার রূপায়ণে কেবল মুসলমান সমাজে নয়, সারা ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি সার্থক সামাজিক আন্দোলনের দিশারী, সর্বজনের সর্বকালের প্রেরণা। চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক রোকেয়া খাতুন ছিলেন বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী। নারী উন্নয়ন, বিশেষ করে মুসলিম নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য তিনি সারাজীবন নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। ‘মুক্তিফল’ নামক পুস্তকে তিনি দেখিয়েছেন যে, নারীর সহায়তা না পেলে একা পুরুষের চেষ্টায় দেশের স্বাধীনতা আনা সম্ভব নয়। ‘অবরোধবাসিনী’ পুস্তকে তিনি বাংলা ও বিহারের অবরোধবাসিনী মহিলাদের জীবনের যে বেদনাময় চিত্র তুলে ধরেছেন তা সমাজব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত হানার জন্য প্রেরণা যুগিয়েছে। এদিক থেকে তিনি একজন বিপ্লবী।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ এবং বাঙালি মুসলিম নারীদের সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা। প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান না করলেও অনগ্রসর সমাজে নারীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাবার যে প্রচেষ্টা তিনি সারাজীবন ধরে করে গেছেন তার মূল্য কম নয়।

বীরভূমের রাজনগর রাজ পরিবারের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের কথা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনের ইতিহাসে সেভাবে উঠে আসেনি। এম আব্দুর রহমানই প্রথম লিখেছিলেন ‘আজাদি যুদ্ধের নেপথ্য নায়িকা রানী লালবিবির কথা। রানী লালবিবি ছিলেন রাজনগরের রাজা আসাদুজ্জামান খাঁ’র স্ত্রী। রানী লালবিবির জন্ম ১৭৩৫ সালে। তার বাবার নাম বাহরাম খান এবং মাতা চাঁদ বিবি। রূপে-গুণে-জ্ঞানে-কর্মে-বীরত্বে ও তেজস্বীতায় রানী লালবিবি ছিলেন সেকালের নারী সমাজের শিরোমণি। তাঁর আজাদী মানসিকতা স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম তাকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে। রানী লালবিবি দেশে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে স্বামীর হাতে ও পরবর্তীকালে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের ব্যক্তিগত ধনভাণ্ডারের সমস্ত অর্থ, এমনকি হীরা, জহরত পর্যন্ত। সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের প্রধান নায়ক মজনু শাহ রানী লালবিবির কাছ থেকে প্রচুর অর্থসাহায্য পেয়েছিলেন। মূলত মজনু শাহ-এর আজাদী যুদ্ধে প্রেরণার মূল উৎসস্থল ছিল বীরভূমের রাজনগরের রাজবাড়ী। সপ্তদশ শতকের ছয় ও সাতের দশকে আসাদুজ্জামান খাঁ নবাব মীরজাফর ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত (১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ) ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম সীমানায় এবং কড়িধ্যা ও হেতমপুরে বেশ কয়েক বার মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। দেশের জন্য লড়েছিলেন। চুনাখালি দুর্গ জয় করে তিনি ইংরেজ বাহিনীর ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এম আব্দুর রহমানের বর্ণনায়- ‘মুর্শিদাবাদের এই বিষাদের দিনে বীরভূমের রাজনগরে চলছে আনন্দ উৎসব। তাঁদের প্রিয় রাজা আসাদুজ্জামান খাঁ ‘চুনাখলি’ জয় করে মুর্শিদাবাদ অভিযানে চলেছেন…। বীরভূম রাজ্যের রানী লালবিবি’র আনন্দ সকলের চেয়ে বেশি। খুশিতে বাগ বাগ তিনি। দু হাতে দান করছেন দীন, দুখী, অনাথ, আতুর আর ফকির সন্ন্যাসীদের। প্রার্থনা করছেন স্বামীর পূর্ণ বিজয় আর দেশের আজাদির জন্য।’

ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্বামী আসাদুজ্জামানকে তিনি সর্বতোভাবে সাহায্য করতেন। মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে সেনা সংগ্রহের লালবিবি প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন। সারা বীরভূমজুড়ে ইংরেজ বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এই অভিযোগে বড় লাট ওয়ারেন হেস্টিংস রানী লালবিবি কে ক্ষমতাচ্যুত করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি মাত্র তিন বছর রাজনগরের রাজ্য পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় সম্ভবত ১৭৮৫-১৭৯০ সালের মধ্যে।

এম আব্দুর রহমান সম্পর্কে সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘অবিভক্ত বাংলায় বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের সংখ্যা বড় কম ছিলনা। দেশ বিভক্তির পর তাঁদের অধিকাংশই পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। যারা থেকে যান, তাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী আবদুল ওদুদ, হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সৈয়দ আইয়ুব ও এম আব্দুর রহমান। এম আব্দুর রহমান এককালে স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। সেইজন্যে তাঁর প্রিয় বিষয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমান। লোকের ধারণা মুসলমানরা স্বাধীনতা সংগ্রামে বড় একটা যোগ দেননি। রহমান সাহেব বিস্তর গবেষণা করে এ ধারণা খন্ডন করেছেন। বাংলার মুসলমানরা সহজে পরাধীন হতে চায়নি। প্রায় ১০০ বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন নামে সংগ্রাম করেছে। এম আব্দুর রহমান স্বদেশপ্রেমিক, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি জাতিকে তিনি ভালোবাসেন।’

সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছেন, ‘এম আব্দুর রহমানের গবেষণাধর্মী রচনাগুলো পড়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছি। শুধু আমি কেন যাঁরা তাঁর ‘ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান’ এবং ‘ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম মহিলাদের অবদান’ এই জাতীয় রচনাগুলো পড়বেন তাঁরা এম আব্দুর রহমান সাহেবের মধ্যে একজন নিরলস জীবনকর্মী গবেষককে আবিষ্কার করে বিস্ময় বোধ করবেন। বিস্ময় এই কারণে যে, এতদিন তিনি চোখের আড়ালে পড়ে থাকলেন কি করে! গত ৫০ বছরের উপর ধরে তিনি বাঙালি সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক অর্থাৎ মুসলিমদের নানা অবদানের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে আসছেন, অথচ সেগুলো আমাদের নজরে পড়েনি, এর চাইতে বিস্ময়ের ব্যাপার আর কি হতে পারে?’

আর কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ লিখেছেন, ‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি কোন হিন্দু পন্ডিত হিন্দু ধর্মতত্ত্ব, পুরান, সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করলে তাঁর সম্পর্কে ধারণা একরকম! আবার কোন মুসলিম পন্ডিত ইসলামী তত্ত্ব, মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করলে তাঁর সম্পর্কে ধারণা অন্যরকম হয়ে থাকে! অর্থাৎ মুসলিম পন্ডিত বৃহত্তর সংস্কৃতিবান সমাজে সম্পূর্ণ অবহেলিত থেকে যান এবং অনেক সময় তাঁকে সেক্টারিয়ান বলে অপাংক্তেয় করে রাখা হয়। এই অদ্ভুত বিচারের পেছনে অবশ্যই এক ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতা ও অবচেতন ভেদবুদ্ধি ক্রিয়াশীল। পশ্চিমবাংলার বিদগ্ধ গবেষক ও পন্ডিত জনাব এম আব্দুর রহমান এক্ষেত্রে সেই অবহেলিতদের একজন। তাঁর প্রতি বৃহত্তর সংস্কৃতিক্ষেত্রে ঔদাসীন্য খুব দুঃখজনক ঘটনা। কোনো তত্ত্ব, দর্শনবোধ, ভূত সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান কোনো বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করলেই অর্জিত হয় না। জ্ঞান অর্জনের জন্য নিরলস অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, গবেষণা ও ধী শক্তির প্রয়োজন হয়। জনাব রহমান মুসলিম ধর্মে জন্মসূত্রে তাঁর বৈদগ্ধ আপনাআপনি লাভ করেননি। তাঁকে বিস্তর পরিশ্রম ও নিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বৈদগ্ধ অর্জন করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর মূল্য পাননি, এটা মর্মান্তিক দুর্ভাগ্যজনক।

সরল সত্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশের জন্য শ্রদ্ধেয় এম আব্দুর রহমানের মতো সংস্কৃতিবান মানুষের প্রয়োজন আছে। এঁদের সমকালে উপেক্ষিত হলেও কিছু যায় আসে না। কারণ, এঁরা যে কর্মে লিপ্ত আছেন, তা তুচ্ছ যশের জন্য নয়- আপন মানসিক ধর্মের কারণে। নদীকে কেউ যদি বলে নদী, তুমি কেন বয়ে যাচ্ছ? নদী বলবে, বয়ে যাওয়াই আমার জীবন। তাই সাধকরা সেই নদীর মতো।’

লেখক: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, দৈনিক দিনদর্পণ, কলকাতা

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন