বিজ্ঞাপন

রোখসানা ইয়াসমিন মণি-এর গল্প ‘বাজে তৃষ্ণার ঘুঙুর’

May 4, 2022 | 6:31 pm

দরজায় দুমদাম শব্দ হচ্ছে। কতক্ষণ ধরে কে জানে? কয়টা বাজে এখন? মুনিয়া বালিশের পাশ থেকে মোবাইল অন করে টাইম দেখে। রাত সাড়ে বারোটা। এতরাতে দরোজায় কে নক করতে পারে? পাশের বাসার কেউ? সে বিছানা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে আসে। আইহোলে চোখ রাখে। নাহ, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কে হতে পারে? কেউ এসেছে হয়তো। তাকে না পেয়ে চলে গেছে। কিছুক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।কোন শব্দ না পেয়ে বিছানায় চলে আসে।শুতে যাবে আবার সেই দুমদাম শব্দ। সে বিছানা থেকে ওঠে। কাজের মেয়েকে জাগায়।মেয়েটার কোন নড়াচড়া নেই। অগত্যা সে নিজেই দরজার কাছে আসে। আইহোলে চোখ রেখে দেখে কেউ নেই।সে অবাক।কেউ নেই।অথচ শব্দ হচ্ছে।কিছুটা ভয় পেয়ে বিড়বিড় করে, কে হতে পারে? এইরাতে কে আসবে? বৃষ্টির রাত। বাইরের কেউ হবার কথা নয়।
কারণ, এই এপার্টমেন্টে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে।
পুরো সাততলা সিসিটিভির নিয়ন্ত্রণে। দারোয়ান এবং মজবুত গেট টপকে ডাকাত আসবে এটা অসম্ভব। তাহলে কে হবে? পাশের বাসার কেউ এমন হেঁয়ালি করবে না। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এতরাতে তারসাথে ঠাট্টা করবে না কেউ।তাহলে কে হতে পারে? এসব ভেবে মুনিয়া আবার আইহোলে চোখ রাখে। নাহ, কেউ নেই।এবার কিছু না ভেবে সে দরজা খোলে।

বিজ্ঞাপন

দরজার ভেতর শরীর রেখে বাইরে মাথা টেনে মুনিয়া চারপাশটা দেখে। নাহ,কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কাউকে না দেখে দরজা দিতে যাবে এমন সময় সিঁড়ির ওপাশ থেকে একটি ছায়া দেখে মুনিয়া স্থির হয়ে যায়। ছায়াটা ক্রমশ তার সামনে আসে। মুনিয়া রীতিমত অবাক। জৈমিনি আপনি? এই বৃষ্টিরাতে কোথা থেকে এলেন? আমাদের গেট রাত এগারোটায় বন্ধ হয়ে যায়।আপনি কীভাবে ভেতরে ঢুকলেন? মুনিয়ার অনর্গল প্রশ্নে জৈমিনি নিরুত্তর। সে কোন কথার জবাব না দিয়ে শুধু ধীরপায়ে মুনিয়ার সামনে দাঁড়ায়।সম্পূর্ণ ভেজা, টুপটাপ জল গড়িয়ে পড়ছে ওর শরীর থেকে। জৈমিনির কাঁধ অবধি চুল। খুব ঘন আর লম্বা। বৃষ্টি ভেজা চুল তার প্রশস্ত কপাল ঢেকে দিয়েছে। চোখ ছুঁয়ে জল নেমে যাচ্ছে বুকে লেপ্টে থাকা সার্টের পাশ বেয়ে আরো নিচে। যেনো জলচূড়ার ওপর কোন মাধবকূন্ড মেঘের বাসা তৈরী করেছে। বৃষ্টিতে মাখামাখি জৈমিনিকে দেখে মুনিয়ার ভ্রম হয়। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না এই বৃষ্টিভেজা রাতে সে সমস্ত পেছনে ফেলে মুনিয়ার বাসার সামনে এভাবে দাঁড়াবে।

জৈমিনি মুনিয়ার সামনে ঝুঁকে বলে, কি ম্যাম, এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবো? কিছু বলুন? অনেকক্ষন দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। দরজা খুলতে এতক্ষন লাগে? মুনিয়ার ভ্রম কাটতেই সে জৈমিনর চোখের ওপর হাই ভোল্টেজের দৃষ্টি রেখে বলে জৈমিনি,এই রাতে কোথা থেকে এলেন,বলুন তো? গেট পেরুলেন কী করে?
জৈমিনি মৃদু হাসে। মুনিয়ার চোখের পর রহস্য রেখে বলে, চলুন মহামান্যা দেবী। আপনাকে নিতে এসেছি। কোথা থেকে এসেছি সেটা না হয় নিজ চোখে দেখবেন। আর কীভাবে সেটাও।
–মানে?
— মানে নেই। অত বকবক করো না মুনিয়া। আগে ভেতরে যেতে দাও। তারপর না হয় জেরা করো।

মুনিয়া কিছু বুঝে উঠেেত পারছে না। কী করবে সে! এদিকে ওর শরীরের জলে বাইরের অংশটা ভিজে গেছে। কিছু জলের ফোঁটা পাপোস গড়িয়ে ফ্লোর ভিজিয়ে দিয়েছে। জৈমিনি আবার বলে, যেতে দেবে না? মুনিয়া মাথা ঝাঁকায়। ওহ,চলুন। জৈমিনি ভেতরে ঢুকেই বলে,কিচেনে চলো।
মুনিয়া চোখ কপালে তোলে। মানে?
–সবকিছুতে অত মানে খোঁজো কেন মুনিয়া?
চলো আগে। ওখানে কথা বলি। সে মুনিয়ার পিছুপিছু কিচেনে যায়।
–আপনার শরীর ভেজা।
–তো কী হয়েছে? জৈমিনির উত্তর। বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করেছি। ভিজতে হবেই। না ভিজলে বুঝবে কী করে ভেজার আনন্দ? কথা বলো না বেশি মেয়ে। চা করবো।আমাকে দেখাও কোথায় কী আছে? শরীরটাকে একটু উষ্ণ করে নিতে চাই। আর এই ফাঁকে তুমি কালো জর্জেটে এসো। একদম মিহি হতে হবে। কাজল আঁকবে চোখে, কপাল খালি রাখবে। কোন টিপ পরবে না। দেখাবো তোমাকে মসৃন কপালে বৃষ্টি নামানোর আনন্দ।
— কেনো এতসব করবো?
—কেনো? আজ একটি ভ্রমণ হবে এবং এটিই সত্যি। যাও, কুইক। এসেই যখন পড়েছি পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে যাব। অপহৃত হবে তুমি। একদম আগাম পূর্বাভাস দিয়ে। বলে কয়ে লুট করবো তোমাকে,বুঝলে? চা বানানো পর্যন্ত তোমার সময়। এরপর আমাকে বাধ্য করো না তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে। এটাও আমি ভালো পারি। সো, চা বানাতে বানাতে আমি এদিকে ব্যস্ত থাকি। তাহলে তোমার ড্রেসিংরুমে যাওয়ার আমার সুযোগ হবে না। তুমি কি চাও, তোমার ড্রেসিংরুমে আমি যাই? আর হ্যাঁ,যাবার আগে একটি টাওয়েল রেখে যেও। চুল শুকাবো।
–আপনি আসলেই একটা পাগল!
জৈমিনি হেসে ওঠে এটা শুনে।এটা তো পুরনো কথা। তোমাকে একদিন বলেছিলাম না! আমি পাগলাটে,ক্ষ্যাপাটে! যখন সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমি জেগে উঠি। জেগে উঠলে আমার ভেতরটা আমাকে আর ঘুমাতে দেয় না। যাও, আর গড়িমসি করো না। একটার মত বেজে গেছে। বেরুতে হবে।

বিজ্ঞাপন

জৈমিনি চা বানায়। মুনিয়া ভেতরে চলে যায়। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টিচ্ছটায় সাদা হয়ে গেছে জানালার কাঁচ।
জলের বেগ আছড়ে পড়ছে শার্সিতে। বাইরে শোঁ-শোঁ বৃষ্টির তুমুল শব্দ। যেনো জলের ধ্বনি হু- হু করে আসছে নতুন বাজনা-বাদ্য নিয়ে। আকাশের হৃৎপিণ্ড ছুঁয়ে ওরা মুনিয়ার শার্সিতে সুর তুলছে।জলতরঙ্গের সুর। মুনিয়া আর জৈমিনির মত যারা এখন জেগে আছে শুধু তারাই শুনতে পাচ্ছে এই গানের সুর।
মুনিয়া বিপাকে পড়ে। সে জৈমিনি সম্পর্কে জানে। মারাত্মক ক্ষ্যাপাটে ছেলে। যেটা বলবে সেটা করেই ছাড়বে। এই যে ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে এলো সে খামোকা আসেনি। তার আসার কারণ আছে। সে তার কথা রেখেছে।

বেশ কিছুদিন আগে শিল্পকলা একডেমি তরুণ চিত্রশিল্পীদের নিয়ে একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে। আয়োজন ছিলো উন্মুক্ত। মুনিয়া ছবি আঁকে। তবে তার ছবি কখনো কোথাও প্রদর্শিত হয়নি। সে ছবি এঁকে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। সাথে ক্যাপশন হিসেবে থাকে নিজের লেখা কবিতা। মাঝে মাঝে ছবি ছাড়াও কবিতা পোস্ট করে। ফেসবুকে তার স্বরচিত কবিতার পাঠক আছে অনেক। একদিকে ছবি আঁকা অন্যদিকে কবিতা লিখতে পারা মুনিয়ার ফেসবুকে বেশ জনপ্রিয়তা আছে। মোটামুটি ধরনের ফেসবুক সেলিব্রেটি । অনলাইনে যত পরিচিত সে অফলাইনে তত অপরিচিত। তাকে এনালগ পৃথিবীর কেউ তেমন চেনে না। ফেসবুক জগৎটায় সে যেভাবে দাপিয়ে বেড়ায় অফলাইন জগৎে পুরো ঘরকুনো। রূপনগর কালচারাল একটিভিটিতে তার পদচারণা নেই । তবে হাসিখুশি প্রাণবন্ত একটি মেয়ে আর ভীষণ লাজুক । তার বন্ধুবলয়ও তেমন একটা নেই। দু’চারজনের সাথে পরিচয় হাই হ্যালো পর্যন্ত। লজ্জার জন্য সিরিয়াস কোন বন্ধু বা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি কারো সাথে। তবে কখনো কোন আড্ডায় যদি সে থাকে সেই আড্ডা ওর জন্য অসাধারণ হয়ে ওঠে। মুনিয়ার কথা বলার ঢং, স্টাইল, প্রাণবন্ত হাসিচ্ছটায় নক্ষত্রের আদিম রাত্রিরাও যেনো জেগে ওঠে।

মুনিয়া একটি মায়াবী চাঁদের নাম। দূর থেকে দেখে যাকে অনুভব করা যায়। কিন্তু ছোঁয়া যায় না। তার সৌন্দর্যে স্তুতি চলে কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। সে এমনই সুন্দর। সোজা কথা ওই চাঁদ,নক্ষত্র, মুনিয়া একই প্রকৃতির। একই সৌন্দর্যের। ওদের দূরেই মানায়। কাছে থাকলে এরকম সৌন্দর্যের তেজস্ক্রিয়তায় অনেককিছু পুড়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। কারো কারো কাছে মুনিয়া প্রত্যাশার ধন। তবে তাকে না পাওয়ার হা-পিত্যেসে অনেকে তাকে রহস্যময়ী ডাকে। কেউ কেউ ইনবক্সেও নক করে। একদিন পানাসিক দেবগণ জৈমিনি যাকে মুনিয়া জৈমিনি ডাকে সেও তাকে ভয়েসমেসেজে একটি কবিতার কিছু অংশ আবৃত্তি করে পাঠিয়েছে,
ওহে সুন্দর প্রতিমা! নাবালক মুখ,
রহস্য রেখেছো মনে
কি গভীর যতনে,
হে ফুলের কোরক,ছোঁবো তোমাকে,
নিজস্ব নির্মানে…
লুটেরা হয়ে লুটে নেবো পৃথিবীর আদিম সুখ!

বিজ্ঞাপন

মুনিয়া এসব দেখে হাসে। তার চারিদিকে কত রোমিওর ঢল! একেকজনের একেক আকুতি।বন্ধুহীন মুনিয়া এসব উপভোগ করে। কবিতা, ছবি আঁকার পাশাপাশি সে গানও গাইতে পারে। দারুণ কণ্ঠ তার। অসাধারণ সুন্দরী আর মায়াবী মুনিয়া অনেকের কাছে কবিতার মেয়ে। ছবির মত মেয়ে। তার চোখ কতজনকে বিদ্ধ করে সে হিসেব নেই। কত ছেলে হাবুডুবু খায় ওর রূপে আর কবিতায়,পোট্রের্ট আর ফেসবুকে আপলোড ছবি দেখে। সেগুলোর হিসেব কে রাখে? যেদিন সে নিজের ছবি লোড করে তখন ফেসবুক বন্ধুদের হৃদয়ে ঝড় বয়।মেসেেেজর তাণ্ডবে ওর হোয়াটএপস, মেসেঞ্জার বাজার হয়ে যায়। সিডর, আইলার মতো উড়ে আসে প্রেম। একনজর দেখার আকুতি, রূপের প্রশংসা, আর কবিদের মহাকবি হয়ে ওঠা, কত নিরীহ যুবকের বুকের ক্ষরণে তার মেসেজবক্স ভেসে যায়! আহ,ছেলেদের উম্মাদ হয়ে যাওয়া,পাগল হয়ে যাওয়া এবং জান খানখান করে মরে যাওয়ার আকুতি সে এনজয় করে। রোমিওদের ভীড়ে পানাসিক দেবগণ জৈমিনিও তাকে টুইট করে। কথা বেশি না। শুধু কেমন আছেন? তারপর উধাও। আর খোঁজ নেই। আবার ক’ দিন পর হাজির।আচমকা যখন মুনিয়া ঘুমাতে যাবে ঠিক তার আগেই টুইট,ভালো আছেন? আবার লাপাত্তা। আবার কদিন পর এক সন্ধ্যাবেলায়, মুনিয়া,আজ পূর্ণিমা কিন্তু। ব্যস, এরকম করেই তার মেসেজ আসে। মুনিয়া কখনো সিন করে। কখনো করে না। রিপ্লাই তো দূর,কোথাকার কোন পানাসিক দেবগণ জৈমিনি এসব দেখার টাইম আছে? আর সব রোমিওর মত তাকেও সে এড়িয়ে যায়। মাঝে মাঝে জৈমিনি লিখে, মুনিয়া, আমিও রূপনগরে থাকি। আপনি রূপনগরের কোথায় থাকেন? মুনিয়া মনে মনে পাগল বলে উপহাস করে।

জৈমিনিও কবিতা লিখে। দারুণ কবিতা।।মুনিয়ার টাইমলাইনে যখন ওর কবিতা আসে তখন সময় পেলে পড়ে।কিছু কবিতায় মুনিয়ার চোখ আটকে যায়। এত অসাধারণ যে সে মাঝে মাঝে লাইক পাঠায়। জৈমিনির সাথে মুনিয়ার ফেসবুকে এতটুকুই যোগাযোগ। মুনিয়ার প্রায় ছবি,কবিতায় জৈমিনি লাভ রিয়াক্ট করে। সেইসাথে ছোট্ট সুন্দর একটি মন্তব্য।জৈমিনির মন্তব্যগুলো সুন্দর। পড়ে মুনিয়ার ভালোলাগে এবং সেও প্রতিমন্তব্য সুন্দর করে দেয়। এভাবেই ফেসবুকে পানাসিক দেবগণ জৈমিনির সাথে মুনিয়ার পরিচয়।তবে ওর ফেসবুক জৈমিনির কোন ছবি নেই।কভারপিকে ফুলপাখি লতায় পাতায় প্যাঁচানো।মাঝে মাঝে এই আইডিকে মুনিয়ার ফেক মনে হয়।

একদিন শিল্পকলা একাডেমির ফেসবুক পেজে একটি নিউজ পোস্ট হয়। তরুণ চিত্রশিল্পীদের নিয়ে এক্সিবিশন করতে যাচ্ছে ওরা। আগ্রহীরা যেনো শিল্পকলা একাডেমিতে যোগাযোগ করে। মুনিয়ার বান্ধবী শেলী এই পোস্ট পেয়ে মুনিয়ার কাছে ছুটে আসে। সে যেন এই এক্সিবিশনে অংশগ্রহণ করে। মুনিয়া শুনে আপত্তি জানায়। সে বলে না, না! আমি অংশগ্রহণ করবো না। ওখানে আমার চেয়েও অনেক ভালো চিত্রশিল্পী আছে। আমারটা ওদের ভীড়ে হারিয়ে যাবে। শেষে মান ইজ্জত যাবে। আমাকে নিয়ে টানাটানি করিস না শেলী। বাদ দে।

মুনিয়ার কথা শুনে শেলী বলে, তোর এই একটি দোষ, বিচারের আগে রায় দিয়ে দিস। এটা কোন কথা হলো?ওরা এক্সিবিশনের আয়োজন করেছে। নানান জায়গা থেকে নানান চিত্রশিল্পী আসবে। ওদের সেরা ছবি এখানে সো করবে। আর তোর ছবি কি খারাপ?কত সুন্দর ছবি আঁকিস। সেটা তো আমরা জানি। যদি ছবি খারাপই হবে তাহলে ফেসবুকে কি তোর ফ্যান ফলোয়ার হয়? ছবি পোস্ট করার সাথে সাথেই মুহূর্তে লাইক কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাস।
সে কেনো? বুঝিস কিছু? তোর ছবি যদি ভালো না হতো তাহলে কি এত লাইক কমেন্ট পড়তো, বল? তোর ছবি অনেক সুন্দর। ফেসবুকে এত জনপ্রিয়তার মূল কারণ তোর আঁকা ছবি। বুঝিস না কেনো, যার ফেসবুকে জনপ্রিয়তা ছবির জন্য, তার ছবি এক্সিবিশনে গেলে কেউ পছন্দ করবে না এটা কি বিশ্বাস করা যায়? নিজের উপর এত আস্থা কম কেনো তোর? কেন বিশ্বাস করিস না তুই সুন্দর ছবি আঁকিস? নিজের ছবি সম্পর্কে তুই কোন ধারনাই রাখিস না! ছবিগুলো বের কর, এখনই ওখান থেকে বেছে ভালো ছবিগুলো শিল্পকলায় দিয়ে আসবো। আমি জানি তোর দ্বারা কিছুই হবে না। তোর যত কাজ সব আমাকেই করতে হবে। বলদকে ঠেললে তো বসা থেকে ওঠে,তোকে ক্রেন দিয়ে গুঁতোলেও টেনে তোলা যাবে না।কী সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা,তুই ! শেলী গজগজ করতে থাকে।
শেষে একরকম জোর করেই সে কয়েকটি ছবি বেছে শিল্পকলায় দিয়ে আসে।

বিজ্ঞাপন

বিশ অক্টোবর। মুনিয়ার ছবির এক্সিবিশন শুরু হবে। সেই নোটিশ দিয়ে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক রমেশ সেন ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলেন। পোস্টটি শেয়ার করার অনুরোধ জানিয়ে প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকার জন্য সবাইকে আহবান জানালেন। আর যারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে তাদের বললেন, তারা যেনো তাদের আইডি থেকে তাদের বন্ধু এবং শুভাকাঙ্খীদের ওইদিন এক্সিবিশনে থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটি পোস্ট দেয়। রমেশ সেনের এই পোস্ট পেয়ে মুনিয়া এটি তার ওয়ালে শেয়ার করে এবং ক্যাপশনে লিখে ,আসছে ২০ অক্টোবর, আমি শিল্পকলায় থাকছি, আপনি থাকছেন তো? ব্যস, এটুকুই। তারপর অন্য এক কাহিনিতে বাঁক পেরোয় সময়ের শাখা -প্রশাখা।

২০ অক্টোবর। ঝকঝকে দিন। রোদের বর্ণিল উচ্ছ্বাসে সকালের যাত্রা শুরু হয়। দিনের শরীরে অগ্রহায়ণের ঘ্রাণ। নবান্নের শেকড় শহরের ভেতর বাঁক নিয়েছে।আধখানা সকাল হাই তুলে জীবনের দিকে ছুটে চলছে। বিছানার ঘনিষ্ঠতা ছেড়ে অনেকেই পেছনে ছায়া ফেলে ঘামজলে ভিজে একাকার হবার জন্যে দৌড়াচ্ছে। শুরু হয় বিস্ফোরণের দিন। শুয়ে বসে থাকার উপায় নেই।

শেলী আর মুনিয়া শিল্পকলায় আসে। বর্ণিল বেলুন আর ফুলে শিল্পকলা একাডেমির চত্বর সাজানো হয়েছে। পাশে সারিসারি কৃষ্ণচূড়া। চিরল পাতার ভেতর সবুজ প্রলোভন। সিঁড়ি লাগোয়া টবে চন্দ্রমল্লিকা ফুটে আছে। একটুদূরে জয়নুল আর কামরুলের ভাস্কর্য। তার সাথে মাঝারি রেইনট্রির ডালে ঝুলে আছে হরেক রকম অঘ্রাণ টাইমফুলের সৌন্দর্য । খুব সুন্দর। ফুলগুলোতে বাঁধ ভেঙ্গে ভেসে আসছে শিল্পকলার নান্দনিক বিকেল।

বাইরে পুব দিকে উঁচু মঞ্চ করা হয়েছে। তার লাগোয়া প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের ভেতর কত হরেক রকম ছবি। মুনিয়া ওদিকে ছুটে। আজন্ম ছবি পিপাসু মুনিয়া বিভিন্ন চিত্রকরদের আঁকা ছবি মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখে। কী অসাধারণ, কী সুন্দর! এত শিল্পীর পাশে তার ছবি দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় ।থ্যাংকস শেলি।কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার ঢেউ তুলে শেলিকে জড়িয়ে ধরে।শেলি জিগ্যেস করে,কীরে কেমন লাগছে?
–বলিস না আর! অসাধারণ লাগছে। তুই সত্যি গ্রেট রে! রিয়েলি, ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। না হলে কে কার জন্য এরকম করে, বল!
–ওহ, ওভাবে বলিস না তো, মুনিয়া? এভাবে বলতে নেই, তুই কী ভেবেছিস! আমি ওসব তোর জন্য করেছি? মোটেও না, আমি করেছি ছবিগুলোর জন্য।
তুই মুনিয়া কে রে? জাস্ট মাই ফ্রেন্ড। এর বেশি কিছু তো না, তোর মতো এরকম অনেক বন্ধু আমার আছে। কিন্তু শিল্পী মুনিয়া কে আমি ভালোবাসি। ভীষণ রকম ভালোবাসি। শিল্পী মুনিয়ার ছবিগুলোর জন্য আমি এত কিছু করেছি।
আমার অবাক লাগে তুই এত সুন্দর ছবি আঁকিস, কিন্তু কখনো তোর ছবিগুলো বাইরে নিয়ে আসিস নি। কেন রে! জীবনে একটি দূ্র্ঘূটনার জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিস? কেন মুনিয়া? মানুষের জীবনে কত কিছুই ঘটে। তাই বলে মানুষ থেমে থাকে? ঘরকুনো হয়ে পড়ে? কেন নিজ থেকে বের হয়ে আসিস না! নিজেকে প্রকাশ করিস না! তোর এত প্রতিভা থাকার পরেও কেন তুই নিজেকে চুপচাপ ফেলে রাখিস? কীসের জন্যে? কার ওপর তোর এত অভিমান? আমার খুব কষ্ট লাগে জানিস! আমার এমন প্রতিভা থাকলে আমি কবেই নিজেকে বিকশিত করতাম। তোর মত এরকম নিজেকে নিজের থেকে আড়াল করতাম না। তুই নিজেকে চিনতে পারিস নি। তোর এসব শিল্পকর্ম দেখলে আমার ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। এত সুন্দর! এত সুন্দর কবিতা লেখে যে মেয়ে, এত সুন্দর গান গায়, ছবি আঁকে, এত রূপ যে মেয়ের সে কেনো হীনমন্যতায় ভোগে? তোর ভেতর কী নেই বল? একটা মেয়ে এত প্রতিভা নিজের ভেতর চুপচাপ লুকিয়ে রেখেছে একটি ঘরের কোণে, তা আমি মানতে পারছি না। যে ঘটনা তোর জীবনে ঘটে গেছে তা ভুলে যা মুনিয়া। এটা নিয়ে আর পড়ে থাকিস না। নিজেকে বিকশিত কর।ভাব, নিজেকে নিয়ে। নিজেকে টুকরো টুকরো করে অনেক ভেঙ্গেছিস। এবার তোর দাঁড়ানোর সময় এসেছে। ওখান থেকে নিজেকে তৈরী করে নে। নিজেকে কখনো একা ভাবিস না আর। আমিও একা দৌড়াচ্ছি, ছুটছি, ঘুরছি, ফিরছি আনন্দ করছি, তো কি হয়েছে? জীবন আমার জন্য কি থেমে আছে, নাকি থাকবে বল?জীবন তোকে কোনদিন বলবে না তার কাছে যেতে। বরং তোকেই তার ভেতর প্রবেশ করতে হবে। তোর জীবনের চাকা তোকে ঘুরাতে হবে। প্লিজ, গেট আপ মুনিয়া। গেট আপ।
শেলির এত লম্বা লেকচারে মুনিয়া বিব্রত হয়ে যায়।সে মৃদুবাচ্য করে,ওহহ শেলি! থামবি?
কী শুরু করেছিস বল তো? মানুষ শুনতে পাচ্ছে না!
এটা ইউনিভার্সিটি পেয়েছিস? তুই দেখছি টিচারদের মতো শুরু করলি? তোর কথা রাখলাম। এলাম এখানে। এসেই তো আনন্দ পাচ্ছি। কৃতজ্ঞ তোর কাছে। কিন্তু আমার কষ্টগুলো তো সত্যি। এটা আমাকে এমনভাবে অক্টোপাসের মতো ধরেছে যে, এ থেকে আমি বের হতে পারছি না।

শেলি বলে, না, এবার বের করে দে এসব। তুই কখনো নিজেকে একা ভাবিস না। ভাববি, তোর একজন ভালো বন্ধু আছে। জানিস,তোর বন্ধু হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। আমার ভীষণ ভালো লাগে ভাবতে তুই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। শেলির কথা শুনে হেসে ওঠে মুনিয়া। হাসি তো নয় যেনো মুখে চাঁদের ঝিলিক। শেলি ওকে টেনে বলে,তোর এই হাসির জন্যও তোকে খুব ভালোবাসিরে!

প্রদর্শনী শুরু হয়। অনেক লোকজন আসছে চিত্রমেলা ও কবিতা আড্ডায়। সবাই ঘুরেঘুরে ছবি দেখছে। মঞ্চে কবিতা হচ্ছে,গান হচ্ছে। কবিদের পদচারণায় মুখর শিল্পকলা একাডেমি। কত রঙবেরঙের পোশাক আার বাহারী সাজে সেজেছে কবিও আগুন্তকেরা। কিছু নাচের মেয়ে পাশে ঘুরঘুর করছে।যেনো প্রজাপতি। রঙিন,বর্ণিল আর চঞ্চলতায় মুখর রেখেছে চারপাশ ।
অপূর্ব আয়োজন ।কবি, সাহিত্যিক,গায়ক,গায়িকা, চিত্রশিল্পী, দর্শকে মুখরিত শিল্পকলা ভবন। ফুচকাওয়ালা,বাদামওয়ালা,চাওয়ালাদেরও ভীড় কম না। দূরে একটি নেসক্যাফের কফিশপ দেখে মুনিয়া শেলিকে বলে, চল, কফি খেয়ে আসি। তারপর এখানে বসে কবিতা শুনবো।
— চল।
ওরা কফি খাচ্ছে। মুনিয়া বলে, শেলি, থ্যাংকস তোকে আবারও। আমার খুব ভালো লাগছে। তুই আমাকে টেনে না আনলে এত মজা পেতাম না। বহুদিন পর সত্যি নিজেকে দেখতে পেয়েছি। ওরা কফি খেয়ে মঞ্চের কাছে চলে আসে। দুজন দুটি চেয়ার টেনে বসে। বরাবরের মতো মুনিয়ার নজর প্যান্ডেলের ভেতরে যেখানে ওদের ছবি রাখা। হঠাৎ মুনিয়া চেঁচিয়ে বলে,শেলি,আমার ছবিগুলো কই? দেখতে পাচ্ছি না যে!
–আসলেই তো! চল দেখি।শেলি মুনিয়াকে টেনে নিয়ে যায়। ওখানে যারা বিপণনে আছে তাদের জিজ্ঞেস করতেই বলে একজন এসে সব নিয়ে গেছে।
মুনিয়া বললো,কীইইইই?
–জ্বী,ম্যাম। তিনি একজন পুরুষ এবং আপনার পরিচিত। আপনার ছবি আরো থাকলে তিনি কিনে নেবেন।
মুনিয়ার পিঠ চাপড়ে শেলি চিৎকার করে, দেখ মুনিয়া!প্রথমদিনেই তোর বাজিমাত। এবার বল, আমাকে কী খাওয়াবি?
বিপণন কেন্দ্রের মহিলা বললো, ম্যাম আপনার আরো ছবি থাকলে এখনই নিয়ে আসুন। আমাদের এক্সিবিশনের পরিচালক আপনার সাথে পরিচিত হবেন। তাছাড়া আপনার সব চিত্রকর্ম বিক্রয় হওয়ায় শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক মঞ্চে আপনার নাম ঘোষণা করবেন।আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন সবার সাথে। এককাজ করুন, আপনার পরিচিত কেউ থাকলে দ্রুত বাসায় পাঠিয়ে যথাসম্ভব আরো কিছু ছবি নিয়ে আসুন। আমাদের পরিচালক আপনার চিত্রকর্ম রাখার জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ করে গেছেন। ছবি নিয়ে এলে এই সামনের অংশটিতেই আপনার সব ছবি রাখা হবে। অনেকে এসে আপনার ছবি চেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। প্লিজ, যত দ্রুত পারেন নিয়ে আসুন।

শেলি আনন্দে লাফ দেয়। তারপর মুনিয়ার দুইগালে জোরসে চুমু খেয়ে বলে, তুই থাক।আমি যাচ্ছি। আমিই তোর ছবি নিয়ে আসবো। এরপর মুনিয়ার গাল টিপে বলে, সুন্দরী মাইয়া, দেখ, এবার কী হয়?শেলি দেয় দৌড়। চলে গেলে মুনিয়া ওখান থেকে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে আসে। একটি খালি চেয়ারে বসে পড়ে।
–হ্যালো, এক্সকিউজ মি, কেন আই সিট নেক্সট টু য়্যু?ইজ দেয়ার এনিওয়ান উইথ য়্যু?
মুনিয়া পাশ ফিরে দেখে।একটি ছেলে তাকে নোটিশ করছে।সঙ্কোচ নিয়ে বলে, অফকোর্স,বসতে পারেন। আমার সাথে কেউ নেই।ছেলেটি বসে। কিছুক্ষণ কোন কথা নেই । এরপর ছেলেটি জিগ্যেস করে, আমরা কথা বলতে পারি?
— ইয়েস,বলতে পারেন।
–আপনার নাম?
–মুনিয়া,বলেই চুপ করে থাকে । ছেলেটি ভাবে,তার নাম জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু না। মুনিয়া মঞ্চের দিকে তাকিয়ে কবিতা শোনে। ছেলেটি মুনিয়ার মনোযোগ নিতে চেষ্টা করে, আপনার ছবি অনেক সুন্দর।
মুনিয়া অবাক হয় শুনে। আমার ছবি? কোথায় দেখেছেন?
–কেনো? এই প্রদর্শনীতে।
–তাই? কিন্তু ওগুলো তো এখন নেই।
–জ্বী, একজনে সব কিনে নিয়ে গেছে। আমি কিনতে যাবো ভেবেই গিয়ে দেখি একটিও নেই।
–ওহহ,আপনি কিনবেন? সমস্যা নেই। আমার বান্ধবী আরো নিয়ে আসছে। একটু পরেই সে চলে আসবে।
–জানি।
–জানেন?
–হুম,
–কীভাবে?
–ওই যে ওরা বললো। আপনার বান্ধবী নাকি ছবি আনতে গিয়েছে।
–ও, আচ্ছা।
এমন সময় একটি ছেলে জৈমিনি জৈমিনি ডেকে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।
— জৈমিনি, তুই এখানে? আমি তোকে খুঁজছি। তোর ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়েছি। ওহহ,এতো ছবি! বাপরে বাপ! কী খাটুনিই না দিলি।
— কী করতে হবে এর জন্য?
-কফি খাওয়াবি?
–খাবি? তাহলে চল। মুনিয়াকে ও সে অফার করে। চলুন, আপনিও।একসাথে কফি খাবো।
–না না, আপনারা খেয়ে আসুন। আমার বান্ধবী এসে আমাকে না পেলে খুঁজবে।
— টেনশন করেন কেনো? চলুন! আপনার বান্ধবী রাস্তা চেনে।আপনাকে না পেলে নিশ্চয়ই ফোন করবে।
— হুম,তা করবে। তবে আমাকে না পেলে রেগে যাবে।
— তাই? তাহলে তার রাগের বিনিময়ে আমি কী করতে পারি?
মুনিয়া এবার হেসে ওঠে। না, আপনার কিছু করতে হবে না। ধন্যবাদ।
–আপনি এত সুন্দর করে হাসেন? অবশ্য আপনি এমনিতে অনেক সুন্দর। ছবির চেয়েও বাস্তবে আপনি অনেক বেশি সুন্দর।
— আপনি আমাকে আগে দেখেছেন?
–না।
–তবে?
— তবে’র ও জবাব পাবেন না মিস মুনিয়া। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাদের খুব চেনা চেনা লাগে।আপনি তাদের মতো।
— আপনি দেখছি আমার নাম জানেন, ইন্টারেস্টিং।
–আপনার অনেককিছু জানি আমি।
–তাই? আর কি জানেন বলুন তো?
— বলব, তার আগে চলুন, কফি খেয়ে আসি। কফি খেতে খেতে না হয় বলবো।
— আপনি খেয়ে আসুন। আমার বান্ধবী আমাকে না পেলে রেগে যাবে।
— না, রাগবে না। কথা দিলাম, আপনার সব ছবি আমি কিনে নেব। আর কোন কথা আছে?
— আপনি সব কিনে নেবেন? কেনো?
–নেবো এইজন্য যে, একজন কবি,চিত্রশিল্পী সবশেষে প্রিয়মানুষ আপনি। আমার প্রিয়জনের ছবি নিয়ে যদি আমার ওয়ালে রাখি সেটা কি খুব অপরাধ হবে?
— না, তা নয়, এত ছবি কেউ কিনে?
শিবু ওদের কথা শুনছে।জৈমিনির কথার রিপিট করে, কীরে আর কত ছবি কিনবি? একটু আগে তোর পাঁচটি ছবি বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলাম। বিশ মিনিটও হলো না। এখন আরো নিবি?
— হুম নেবো। আজ বিশেষ কেউ আছে। তার সব ছবি দিয়ে আমার ঘর ভরিয়ে তুলবো।
এবার জৈমিনি বলে, মুনিয়া চলুন, প্লিজ! আর না করবেন না। এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন আমি আপনাকে বিষ খাওয়াবো না বা আমি মেয়েধরা নই। জৈমিনির কথা শুনে মুনিয়া মুচকি হেসে বলে, কিন্তু আমার বন্ধু এসে আমাকে পাবে না।

ঠিক আছে তাকে ফোন করুন এবং বলে দিন, আপনাকে না পেলে ছবিগুলো এক্সিবিশনে পাঠিয়ে দিতে। আমি ওখানে পেমেন্ট করে আসছি। সব ছবি আমার। আমি নিয়ে নিচ্ছি। মুনিয়া ওয়েট, ওখানে বলে আসি।জৈমিনি যেতেই মুনিয়াও ওর পিছু নিলো।সেওদের সাথে কথা বলছে। মুনিয়া ওখানে গিয়েই, থামুন! আমার কথা শুনুন। আমার একটি বিষয় জানার আছে। আপনি এত ছবি দিয়ে কী করবেন? জৈমিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুনিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ওভাবে তাকিয়ে থাকায় মুনিয়া জৈমিনির চোখ থেকে ওর চোখ সরিয়ে নেয়। এই প্রথম মুনিয়া জৈমিনিকে দেখে। তার চোখে চোখ রাখতেই মুনিয়ার আচমকা কী যেনো হয়। ছেলেদের চোখ এত সুন্দর! জৈমিনির চোখের মণি হলুদ ,হলুদ? হ্যাঁ, হলুদই তো! মুনিয়া এমনই দেখতে পেয়েছে। নাকি সন্ধ্যার আলো ওর চোখে পড়ে চোখের রঙ হলুদ হয়ে গেছে? নাহ, এমন হওয়ার কথা নয়। যদি সুযোগ হয় তাহলে মুনিয়া আবার জৈমিনির চোখে চোখ রাখবে। উজ্জ্বল, ফর্সা, দীঘলদেহী জৈমিনিকে ভেবে ওর ভেতরটা কেমন করে ওঠে। পুলক অনুভব করে সে। মুনিয়া কিছুই বলতে পারে না। বিস্ময়লাগা চোখে সে ওকে দেখে। মাথা ঝাঁকিয়ে জৈমিনি বিক্রয়কর্মীর সাথে কথা বলে। তার পেছনদিকটাও সুন্দর। গোলাপি হাওয়াই সার্টের ওপর ঘাড় থেকে চুলগুলো নেমে পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। পেছনে কিছুটা চুল ঝুঁটিবাঁধা। মাথাটা চুলে গিজগিজ করছে। সেখান থেকে উন্মুক্ত,অবাধ্য কিছু চুল ওর কানের দিকটা ঢেকে রেখেছে।
জৈমিনি ওদের সাথে কথা বলছে। মুনিয়ার কথা আসে না। একটা ঘোর পেয়ে বসে ওকে।জৈমিনি যখন কথা বলে মুনিয়ার মনে হয় ওই ঠোঁট থেকে যত কথা বের হয় সব ধ্বনি ওর ঠোঁটের মত চওড়া। যেনো আশপাশ কাঁপিয়ে ভেতর থেকে কথাগুলো ভুট্টার মত ফুটে বের হয়ে আসে ।সবগুলো কথাই খুব স্পষ্ট, প্রাণবন্ত। মুনিয়ার মনে হয় জৈমিনির ওপরের ঠোঁট আর নিচের ঠোঁটের পুরুত্ব সমান।একটু মোটা মত,তবে খুব গোলাপি। ছেলেদের ঠোঁট গোলাপি? কেমন যেন বেমানান!

ছেলেরা এত সুন্দর হয়? মুনিয়া জৈমিনিকে আবারো দেখে। গোলাপি সার্টের সাথে কটকটে নীল ঘষা জিন্স পরে এসেছে সে। পায়ে কটকি জুতো। ওর রুচি আছে খুব। হাতে চওড়া ব্রেসলেট,গলায় রূপালি চেইনের কিছু অংশ কণ্ঠার নিচে সার্টের ভেতর আটকে আছে।মুনিয়া নিজে নিজে উচ্চারণ করে, আপনি এত সুন্দর কেনো? ছেলেদের এত সুন্দর হতে নেই। সুন্দর হবে মেয়েরা। ছেলেরা সুন্দর হলে রূপের কীর্তন করবে কে? ছেলেদের রূপের বর্ণনা বেমানান। ওরা মুগ্ধ থাকবে রূপসী মেয়েদের জন্য। ওরা মেয়েদের রূপবর্ণনা করতে করতে পিপাসার্ত হয়ে উঠবে। তৃষ্ণায় খাচ্ছি খাবি করতে করতে হৃদয়ে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলবে অনির্দিষ্টকালের যন্ত্রণা। কিন্তু এই ছেলের জন্য যে কোন মেয়ের হৃদয়জনিত বিপরীত ক্রিয়া শুরু হবে। মেয়েরা এই ছেলের জন্য মারা পড়বে নির্ঘাৎ। না জানি কত মেয়ে এই ছেলের জন্য পাগল হয়েছে! হঠাৎ মুনিয়ার বোধোদয় হয়,ওহহ গড! আমি কাকে নিয়ে ভাবছি!একটি অপরিচিত ছেলের জন্য ওর এত ভাবনা কেন? জৈমিনি কথা শেষ করে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, চলুন। এমনভাবে বলছে যেনো সে মুনিয়াকে বহুবছর চেনে।
মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,আরে বাবা! এত সঙ্কোচ করছেন কেনো? আমি বাঘ বা ভাল্লুক নই। তবে এটা ঠিক আমি আপনার ভক্ত।একজন ভক্তকে গুরুর সেবায় নিয়োজিত থাকার একটু সুযোগ দিন। কৃতার্থ হই।জৈমিনির পিড়াপিড়িতে অগত্যা মুনিয়া রাজি হয়। ওরা দুজন হাঁটছে। সাথে শিবু।জৈমিনিকে বলছে,একটু আগে এতগুলো ছবি নিলি। আবারও?
— হুম নিয়েছি। তো কী হয়েছে? আরো নেবো।
মুনিয়া বলছে,বাহ! আপনি এত পোট্রের্ট নিয়ে কী করবেন?
–দেখবো।
–তা তো বুঝলাম,দেখবেন। কিন্তু, মানুষ একসাথে এতগুলো পোট্রের্ট কেনে না। আপনি কিনলেন।
শিবু ফোঁড়ন কাটে, সে মানুষ না। আস্তপাগল একটা।

ওরা শিল্পকলার গেটের বাইরে চলে আসে। পাশেই রোডের এককোণে কফিওয়ালা কফি বানায়। তাকে ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলি গরম কেটলির নল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর শুন্যে মিলিয়ে যায়। শিল্পকলা একাডেমির চত্বর থেকে চারটি রাস্তা চারদিকে চলে গিয়েছে। মূল রাস্তার সামনে রূপনগর সার্কিট হাউস। এই রাস্তাটার ওপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে সার্কিট হাউসের সবুজ ফুল আর লতাপাতায় ঘেরা সুশোভিত বাগান। দারুণ, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তার ডান দিক থেকে একটু পশ্চিম ঘেঁষে আরেকটি রাস্তা চলে গেছে সোজা নজরুল ইনস্টিটিউটের দিকে। নজরুল ইন্সটিটিউটের পাশ ঘেঁষেই বিন্দুসাগর। জায়গাটি খুব সুন্দর আর নয়নাভিরাম। এরপর উত্তরে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটা হচ্ছে আদালত পাড়া আর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। এই জায়গাগুলো রূপনগরের প্রাণ। খুব ছিমছাম আর শান্ত । রিক্সায় চড়ে এ মাথা থেকে ও মাথায় চক্বর দিলে একটুও ক্লান্তি আসে না। যে কারুরই ভালোলাগে এই জায়গাগুলো।পূর্ব দিকের রাস্তাটি মীনা বাজার হয়ে সোজা পুরনো গোমতির দিকে চলে গেছে। তারপর বিরুলা বাজারের দিকে বাঁক নিয়ে ভারতের বর্ডারে শেষ হয়েছে। এপারে বাংলা ওপারে ইন্ডিয়া। এপারে দাঁড়িয়ে ওপারের মানুষ দেখা যায়। শুধু এক কদম বাড়িয়ে সামনে এগোনো যায় না।।কি অদ্ভুত! একই গাছ,মাটি,পানি এপার ওপারে মিলেমিশে এক হয়ে আছে। শুধু মানুষ পারেনি তাদের মতো একসাথে গলাগলি করে থাকতে। পারেনি বলে কাঁটাতারের বর্ডার দিয়ে মানুষেরা পাঁচিল তুলে একে অপর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। মানুষ কখনোই প্রকৃতির মতো উদার হতে পারেনি। অথচ প্রকৃতিই তাকে এতকিছু দিয়েছে। শিল্পকলা থেকে দক্ষিণের রাস্তাটি জেলা স্কুলের বিশাল ঈদগাহ ঘেঁষে শহরের ব্যস্ততম এলাকা জিন্দাপাড়ের দিকে চলে গিয়েছে। ওখান থেকে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় আসা যাওয়া করে। জিন্দাপাড় হচ্ছে শহরের টার্নিং পয়েন্ট। এখানেই শহরের নগরভবন অবস্থিত। এই যে এত রাস্তা, রাস্তার ওপর এত মানুষ, মানুষগুলো কোথায় যায়? কোথা থেকে আসে ? উত্তরের মানুষ দক্ষিণে যায়,দক্ষিণের মানুষ উত্তরে,পুবের মানুষ পশ্চিমে, পশ্চিমের মানুষ পুবে। শুধু যায় আর আসে। মানুষের এরকম আসা-যাওয়া দেখে মুনিয়া ভাবে মানুষগুলো ঠিক কফির ধোঁয়ার মতো। এই এদের দেখা যায় এই আবার মিলিয়ে যায়।
প্রতিটি মানুষ যেন একটি সুরঙ্গ থেকে বের হয়ে আসা ধোঁয়ার কুন্ডলী। পাক খেতে খেতে আরেক সুরঙ্গের দিকে চলে যায়। তারপর কোথায় মিলিয়ে যায়! এই ঘূর্ণমান জীবনে কে তার খবর রাখে?

শিবু কফির মগে চুমুক দেয়। কফিটা ভালো হয়নি। সে জৈমিনিকে বলে, এটা কি খাওযালি,জৈমিনি? ভালো হয়নি। জৈমিনির কাছেও কফিটা ভালো লাগেনি। যতটুকু ফ্লেভার ছিলো কফিটাতে তারচেয়ে স্বাদ কম হওয়ায় সে বলে, নাহ, আজ সন্ধ্যাটা উপভোগ্য হয়নি। মিস মুনিয়া, আপনার নিশ্চয়ই কফি ভালো লাগেনি?
— না, ঠিক আছে। আমার চলবে।
— চলার কথা নয়। চলুন,সামনে। একটি কফিহাউজ আছে। ওখানে কফিসন্ধ্যা হবে।
–শিবু, চল, জিন্দাপাড় কফিসপে। ওখানে কফি উইথ সিগারেট খেয়ে আসি।ওরা সামনে এগোয়।
শিবু বলে, কীভাবে যাবি, জৈমিনি ?
মুনিয়ার যদি আপত্তি না থাকে আপনি আমার বাইকে লিফট নিতে পারেন। আর শিবু তুই একটি অটো ধরে চলে আয়।
—-না, থাক।আপনারা যান। শেলি এসে আমাকে না পেলে রাগ করবে।
–না, রাগ করবে না। সে আপনাকে না পেলে ফোন করবে। আপনি জানিয়ে দেবেন, কোথায় কি করতে হবে। ব্যস, ঝামেলা শেষ।
জৈমিনি বাইকে উঠে । মুনিয়ার দিকে তার সবুজাভ চোখের তীর্যক ফলা রেখে বলে, প্লিজ বিউটি লেডি, কাম অন। আই’ম প্রেয়িং ফর ‘য়্যু। স্টে উইথ মি দিস মোমেন্ট। আই হোপ,য়্যু ডোন্ট ডিজাএ্যাপয়েন্টেড মি। অগত্যা মুনিয়া বাইকে বসে।জৈমিনি ইয়াহু বলে চিয়ার্স করে। তারপর বাইকে স্টার্ট দিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলে, থ্যাংকস সুইটি। দিস মোমেন্ট ইজ ডেডিকেটেড টু য়্যু।
মুনিয়া চুপে চুপে, আপনি আসলেই পাগল।

বাইক দক্ষিণ দিকে যাবার কথা। ওদিকেই জিন্দাপাড়। যেখানে গিয়ে ওরা কফি খাবে। শিল্পকলা চত্বর থেকে চারটি রাস্তা চারদিকে মোড় নিয়েছে। দক্ষিণ দিকে গাড়ি ঢুকতেই হঠাৎ কী যে হয় জৈমিনির, সে গাড়ি সেদিকে না নিয়ে সোজা উত্তরে টার্ণ করায়। গাড়ি হাওয়ার চেয়েও দ্রুত বেগে ছোটে।ছোটে তো ছোটেই। জেমিনি ইয়াহু ইয়াহু করতে থাকে। আর গলা চেঁচিয়ে বলে,ইয়াং লেডি,টুডে আই উইল বি লস্ট উইথ য়্যু ! দারুণ চার্মিং হবে আজকের এই সন্ধ্যা।ওহহ,কী যে অসাধারণ!

দুরন্ত বাতাসে মুনিয়া চুল আর ওড়না সামলাতে পারে না। উল্টোবাতাসে চুলগুলো সব জৈমিনির মাথার কাছে আছড়ে পড়ে। জৈমিনির চোখে মুখে মুনিয়ার চুলের ঝাপটা। ওর ওড়না চাকার সাথে পেঁচিয়ে যাবার মতো অবস্থা। প্রচন্ড দাপুটে বাতাসে মুনিয়ার দম বন্ধ হবার যোগাড়। সে হায় হায় করে।ওহহ জৈমিনি , কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কোথায় যাচ্ছেন বলুন তো?
— ইয়াং লেডি, ওয়েট এন্ড সি। কোথায় নিয়ে যাচ্ছি, দেখবেন। কফি খাওয়ানোর কথা ছিল না, আমার? কফি খাবো। কফি হাউসে যাচ্ছি। তবে সেটা ওয়ান্ডারফুল প্যারাডাইজ। জিন্দাপাড় খাবো না। ওখানে লোকারণ্য। লোকারণ্যে দেবীর পুজো হয় না। নদীর জলের পাশে বসে কফি খাবো।আর আপনাকে স্বর্গ দেখাবো। স্বর্গ দেখবেন না? স্বর্গ কন্যাকে নিয়ে চা খাবো নরকে বসে? তা কি হয়? উত্তাল জলরাশির নিচে বসে কফি পান করবো। আপনি কফি পান করবেন। দুরন্ত মাছেরা জলে ভেসে আপনাকে ছুঁতে চাইবে। ওরা আপনাকে ধরতে পারবে না। আপনি আপনার সুন্দর পা জলে ফেলে দেবেন। অমনি দুষ্ট মাছেরা আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দেবে আপনার পা। হয়তো ওদের ছোট চোয়াল দিয়ে আপনাকে চুকচুক করে কামড়ে দেবে।একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুনতো এই দৃশ্যকল্পটি?কী,কেমন লাগছে বলুন? কখনো স্বর্গে গিয়েছেন? না যান তো দুঃখ নেই। এই পানাসিক দেবগণ জৈমিনি আজ আপনার জন্য ইন্দ্র থেকে স্বর্গের চাবি চেয়ে এনেছে। সে আপনাকে আজ স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীতে নিয়ে যাবে। এই অধমকে সেই স্বর্গের দরোজায় পৌঁছানোর সুযোগ দিন। আমার সাথে ঐরাবত নেই। তবে ঐরাবত হিসেবে এই নাগমল্লই যথেষ্ট। সে তার বাজাজ পালসার ১৫০ মডেলের হোন্ডাটি মুনিয়াকে দেখায়। আসলেই হোন্ডাটি রাজসিক। কটকটে কালো রেঞ্জের ওপর লাল টকটকে সিটকাভার। পেছনে চৌকোণো লেজের মত একটি ঝুঁটি। হোন্ডাটি দেখলেই আর দশটি হোন্ডা থেকে আলাদা চেনা যায়। একদম জৈমিনির মতো সুন্দর, সুদর্শন আর কান্তিময় পুরুষের জন্য নন্দিত পঙ্খীরাজ।

মুনিয়া অবাক হয়ে যায়। আপনি পানাসিক দেবগণ জৈমিনি? কোন পানাসিক জৈমিনি?জৈমিনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর গিয়ারে স্ট্রং টার্ন দিয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয়। — কী হয়েছে? গাড়ী থামালেন কেনো?
জৈমিনি বাইক থেকে নেমে মুনিয়ার সামনে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাতে গড়াচ্ছে। অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে। দিগন্তের ওপারে এখনও কিছুটা আলো জেগে আছে। সেই আলো আঁধারির ভেতর পৃথিবীটা স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওপরে আকাশ। একটি, দুটি, তিনটি করে আকাশমণি তারা প্রসব করছে। ফুটফুটে ওই আকাশের সন্তানেরা ঝিলিমিলি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জৈমিনির চোখে।জৈমিনির ওই চোখের দিকে মুনিয়া বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বল করা ওই দুটি চোখে মুনিয়ার কি মনের পতন হচ্ছে? এসব কী ভাবছে সে? নাহ, তার মাথায় এসব আসতে পারে না। জৈমিনির চোখ থেকে মুনিয়া চোখ সরিয়ে প্রশ্ন করে, আপনি কোন পানাসিক দেবগণ জৈমিনির কথা বলছেন?
জৈমিনি উত্তর দেয়, আমি আপনার ফেসবুক বন্ধু পানাসিক দেবগণ জৈমিনির কথা বলছি। যে আপনাকে প্রায় সময় নক করতো।আমি সেই জৈমিনি। আপনি কখনোই আমাকে পাত্তা দিতেন না। ওরে বাবা! আপনি যা মুডি! আজকে আপনি শিল্পকলায় আসছেন। আপনার চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে। ফেসবুকে আপনার এই পোস্ট পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। ছুটেছি পাগলের মতো। আপনাকে দেখার এই সুযোগ আমি হারাতে চাইনি। তাই সমস্ত কাজ ফেলে ছুটে এসেছি শিল্পকলায়।
মুনিয়া মুচকি হাসে। তারপর বলে, তো দেখলেন আমাকে?
–দেখেছি নারী তোমাকে দেখারও অধিক
যতটুকু ভেবেছি তুমি তারও ততোধিক..

জৈমিনি নিজের পরিচয় দিয়ে অট্টহাস্যে চারদিক ভাসিয়ে দেয়। আর বলে,মুনিয়া, আপনি খুব সুন্দর। খুব সুন্দর আপনি।আমি চিত্রকর হলে এখনই সন্ধ্যার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা আপনার ছবি এঁকে ফেলতাম। আপনাকে যদি না পাই সেই ভয়ে এক্সিবিশনে গিয়ে প্রথমে আপনার পাঁচটি ছবি কিনে ফেলি। যেনো পরপর ছবিগুলো সাজিয়ে পোস্ট করে আপনাকে চমকে দিতে পারি। আপনি যেনো বুঝতে পারেন এক অধম ফ্যান আপনাকে কী রকম ভালেবাসে! সামনা সামনি না হোক,ফেসবুকে তো এই অজুহাতে আপনার সাথে কথা বলা যাবে।আপনাকে দেখা, আপনার সাথে কথা বলা আমার বহুদিনের আকাঙ্খা ছিলো। একই শহরে থেকেও এমন মোহনীয় নারীকে না দেখতে পাওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করি কী করে? তাই ছবিগুলোই আমার ভরসা ছিলো।

মুনিয়া জৈমিনির কথা কেড়ে নিয়ে বলে,কিন্তু আপনি তার আগেই আমাকে চমকে দিয়েছেন। প্রথমে ছবি পাঁচটি নিলেন। এরপর বাকীগুলো অর্ডার করলেন।কেনো জৈমিনি ? এত ছবি দিয়ে কী করবেন?
–কী করবো? জানতে চান? দেখুন,আমি ছবি আঁকতে পারি না, কিন্তু প্রিয়জনের হাতের ছোঁয়া অনুভব করতে পারি।যে জন্য ছবিগুলো নিয়েছি।এগুলো দিয়ে আমার লিভিং রুম আর বেডরুম সাজাবো। তারপর এই ছবিগুলোয় আপনাকে খুঁজে বেড়াবো। জানেন?আপনার ফেসবুকে পোস্ট করা ছবিতে নিজেকে ভাবতাম। সে যাক। একদিন আপনার ছবিঘরে হানা দেবো ভেবে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম। সে আবার হো হো করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হেসে ওঠে।
এরপর মুনিয়ার দিকে চেয়ে বলে,শ্রীমতি, নাইট ইজ কামিং। দেন আই’ভ টু বি গিলটি ওফ বিং লেট। লেটস গো, ইন দ্য ওয়াটারস অফ অমরাবতী। দি টাইম ফর ড্রিংকিং। কফি ইজ ওভার। প্লিজ লাভিং মেনকা উঠুন। এই নাগমল্ল প্রস্তুত আপনার জন্যে । আপনাকে নিয়ে সে চঞ্চল হাওয়ার পিঠে সওয়ার করবে।

মুনিয়া জৈমিনির পেছনে বসে। বাজাজ পালসার ১৫০ এর গতি মনে হয় ১৬০ এ চলছে। হাওয়ার চেয়েও দ্রুতগতিতে রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে সোঁ-সোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। সাঁইসাঁই করে দু’পাশের গাড়ি ফুড়ুৎ করে সরে যাচ্ছে। সামনে হেডলাইটের আলো।এই আলোর ভেতর দূরের পোকার কুন্ডলী ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।জৈমিনি থেকে থেকে ঝংকার তোলে। বাতাসের গর্জনে কোনকিছু শোনার উপায় নেই। মুনিয়ার চুল জৈমিনিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।মুনিয়া বলছে, আস্তে চালান। আমি চুলগুলো বাঁধি। ওগুলোর জন্য আপনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। জৈমিনি জানায়, নোহ লেডি, বাতাসকে আজ বাধা দেবেন না। চুলগুলো ছড়িয়ে দিন। ওরা আলিঙ্গন করুক আজ আমায়। আপনার চুলের ঘ্রাণ হাজার মৃত্যুর জীবন থেকে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে।ওহহ উমাবতী, বাতাস আজ বখাটে হয়ে উঠুক।
কিছু বখাটেরা ভীড় করুক আপনার চারপাশ। আজ মানুষের পৃথিবীতে এই বাতাসই থাকুক।

গাড়ী চলছে দূর্বার গতিতে। সড়ক পেরিয়ে এবার কাঁচাপথে উঠে আসে নাগমল্ল।জৈমিনি বলে, জলের আকাশ দেখবেন?
–হু।
— আপনার ডানে তাকান। দেখুন,
—-ওয়াও,এ আমি কী দেখছি!

অন্ধকার রাত। মুনিয়ারা গোমতী নদীর বাঁধের ওপর এসে পড়ে। পাশে নদী। রাস্তার ওপর কিছু কিছু ল্যাম্পপোস্ট আছে। ওগুলোর আলো জলের ওপর পড়ছে। রাতে গোমতীর জলে ল্যাম্পপোস্টের ছায়া এক মারাত্মক ঘোর তৈরি করেছে। এর ওপর তারা ভরা আকাশ। ফুটন্ত তারার আকাশ জলের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। এই দৃশ্যটি যে কী ভয়ঙ্কর সুন্দর তা মুনিয়া না দেখলে বিশ্বাসই করতো না।
মুনিয়া বললো, থামুন, আমি এই ঘোর দেখতে চাই। এখানে আজ আমি রাতকে খুলে নেবো।রাতের আঁধারে পরিয়ে যাব এক কিশোরী জীবন।
জৈমিনি থামে। তারপর বলে, মুনিয়া, এই পুননির্মাণ অসাধারণ হবে। সত্যি, আপনার দুদিকে দুটি ছায়া। তার ভেতর থেকে সেই কিশোরীকে বের করতে পারবেন? আচ্ছা থাক, না পারলে আমি আছি।
তারপর আবার বলে, মুনিয়া, , কোন হাত দিয়ে আপনি ছবি আঁকেন?
সে ডানহাত দেখিয়ে বলে, এটি দিয়ে।জৈমিনি সামনে এগিয়ে আসে। মুখোমুখি তাকায়। ফুঁ দিয়ে মুনিয়ার চোখের ওপর ঝুলতে থাকা চুল সরিয়ে দেয়। সে মুনিয়ার গা ঘেঁষে প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই।বাঁধের ওপর ঈষৎ সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটছে। গাড়ি চলার জন্য রাস্তা কিছুটা ফাঁকা রেখেছে ওরা। না রাখলে গাড়ি ওদের ডলে চলে যাবে। তখন কেউ টের পাবে না কফি খেতে এসে দুটি মানবমানবী কী নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছে!

জৈমিনির শ্বাস পড়ছে মুনিয়ার মাথার ওপর।ওর মাথা প্রায় জৈমিনির বুক ঠেঁসে আছে।
— মুনিয়া,নড়বেন না। চোখটি বন্ধ করুন প্লিজ!
মুনিয়ার মুখ থেকে কোন কথা বেরোয় না। রাতের এইরূপের সাথে অপরিচিত মুনিয়া দ্বিধাগ্রস্ত। কিছুটা মোহগ্রস্তও। পাগলাটে এক যুবক তাকে চন্দ্রশহরে ভ্রমন করাচ্ছে। চারিদিকে এত আঁধার! অথচ ছেলেটির চন্দ্রবদন আর উল্লাস মুনিয়ার ভেতরের কঠিন দুর্দমনীয় শিলাস্তরী মনটিকে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। কী ভয়ংকর জাদু জানে এই ছেলে। সে চোখ বন্ধ করে। জৈমিনি ডানহাতে ওর দুইহাত তুলে নেয়। তারপর বলে, কী সুন্দর এই হাতগুলো।
একটি কথা বলতে চাই,মুনিয়া!
–বলুন।
আমি এখন থেকে আপনি শব্দ উইথড্র করলাম। এই পুঁচকে মেয়েকে আপনি সম্মোধন বেমানান। এমন অপ্সরী রাতে একজন সুদর্শনাকে নিয়ে একটি সুদর্শন ছেলে জলবিহারে নেমে আপনি আপনি করবে, তা কী করে হয়? এখন থেকে মুনিয়া তুমি হয়ে গেলে। তুমিময় আজ জৈমিনির কফিপার্টি। বুঝলে ডিয়ার! চোখ খুলবে না। তোমার আঁকিয়ে হাতগুলো একটু ছুঁয়ে থাকতে দাও। কেমন করে ছবি আঁকো কন্যা? জীবন আঁকবে ? এই নরোম তুলতুলে হাত দিয়ে আমার একটি গোটাজীবন এঁকে দেবে? এঁকে এঁকে উড়িয়ে দেবে কি বুভুক্ষু আমাকে? চাই কেউ আমাকে এঁকে দিক! স্পেশাল কেউ, আমাকে ছিঁড়ে আমারই শুশ্রূষা করুক!সে মুনিয়ার হাতে দুটি গোলাপ গুঁজে দেয়। সাদা ধবধবে দুটি গোলাপ। মুনিয়ার দু’হাত তুলে গোলাপের ভেতর চুমু খায়। এরপর বলে, তোমার জন্য এই দুটি সাদা গোলাপ কম হয়ে গেছে। আসলে তোমার জন্য পৃথিবীতে এখনও কোন ফুলই ফোটেনি। কী আর করা। আমার বাগানের সেরা গোলাপগুলোই বেছে রেখেছি তোমার জন্য। এরচে, এই অধমের আর কোন ফুলের গল্প নেই।
বলো মুনিয়া,তোমাকে কী দিয়ে আজ অভিনন্দন জানাবো? এই রাত তুমি আমাকে দিলে। একটি সন্ধ্যা, মাতন্ড বাতাস, তারাভরা আকাশ, ওই জলের স্থির হয়ে বসে থাকা, একটি পূর্ণ প্রকৃতি, কী দাওনি তুমি আমাকে আজ? এত পেলাম যার কাছে, তাকে কি দুটি সাদা গোলাপে মানায়? ওহ কী বোকা আমি! আমি ভেবেছি শিল্পকলা একাডেমিতে যদি সুযোগ মেলে, যদি কোনরকম তোমাকে দুটি ফুল দিতে পারি হয়তো ওটা আমার জন্য অনেক কিছু হবে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি কিছু যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে সে কি আমি জানি?
মুনিয়া চোখ বন্ধ করে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনছে সে। কত দীর্ঘকাল সে এমন কথা শোনেনি। যেনো পৃথিবীর আরেক প্রান্ত থেকে কেউ তাড়িয়ে তাড়িয়ে কথাগুলো টেনে আনছে। সেইসাথে তাকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে যেনো কেউ উড়িয়ে উড়িয়ে তার সমস্ত নিয়ে যাচ্ছে। ভাবে, জীবন কি এমন? বৃত্তে বন্দী হয়ে থাকা? নিজের সাথে একাকী লুকোচুরি খেলা? কানামাছি ভোঁ-ভোঁ খেলার নাম জীবন? যদি তাই হয় তাহলে সে কেনো যাকে চেয়েছে তাকে ছুঁতে পারেনি? তবে আজ কেনো এই গোমতীর জলাধারে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে এসে তার ডানায় পালক গুঁজে দিলো? মুনিয়াকে পাখি বানালো? কেনো আজ মুনিয়া উড়তে চাইছে? সমস্ত আকাশকে তার আবাস ভেবে সে উড়তে চাইছে! মনে মনে ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে সে বলছে,জৈমিনি, আমাকে নিয়ে চলো, তোমার যেখানে খুশি। মুনিয়ার ভেতর যে বাঁধভাঙা প্লাবন!

মুনিয়া চোখ খোলো। জৈমিনির ডাকে মুনিয়ার হুঁশ আসে।
এতক্ষণ মুনিয়া কোথায় ছিলো? ছেলেটা মারাত্মক জাদু জানে। মুনিয়া নিজেকে সংযত করে। ওহহ, ছেলেটা যে কী! একেবারে হৃদপিন্ড ছুঁয়ে ছেড়েছে। ছেলেটা একটা নদী। এই উষ্ণ আবহাওয়ার দিনেও কেমন করে সে তাকে শীতল করে দিলো। জৈমিনি মুনিয়ার দু হাত ধরে বলে,এ কী? তোমার হাত বরফ হয়ে গেছে।
শীত লাগছে? বাতাসে খুব দৌড়েয়েছি তাই না? চলো,আমার অক্টোবরের ঋতু, নাহ,বরং বসন্তই ডাকি তোমাকে। এসো বসন্ত,অমরাবতীতে যাওয়া যাক। মুনিয়াকে সে পালসারে তুলে নেয়।

চলে আমার পালসার হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া
দেখবো স্বর্গ দুজন এখন ঘুইরা ঘুইরা……………

কী অদ্ভুত গান গেয়ে আর সিটি বাজিয়ে জৈমিনি মুনিয়াকে নিয়ে অমরাবতীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

হঠাৎ গাড়ি স্লো করে জৈমিনি। ওরা থামে। বাঁধের ওপর সড়ক থেকে একটি রাস্তা ঢালু হয়ে একদম নিচে নেমে গেছে।খাড়ারাস্তা থেকে ওর বাজাজ পালসার ঢালু হয়ে নিচে নামবে। জায়গাটা রিস্কি। একটু এদিক ওদিক হলে সব শেষ। গাড়িসহ সোজা নদীতে। জৈমিনি আহ্লাদী হয়ে ওঠে, ওহে আমার কৃষ্ণচূড়াপুর! আপনি এখন আমাকে আপনার সিটবেল্ট ভাবতে পারেন। এটাতো বিমান নয় যে, বিমানবালা এসে আপনাকে সিটবেল্ট পরিয়ে দেবেন। আপাতত পানাসিক দেবগণ জৈমিনিকে সিটবেল্ট ভেবে আপনার দু’হাত দিয়ে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরুন। না হলে মহামান্যা, আমরা দুজনেই এই উড্ডয়নে এসে গোমতীর থিরজলে সমাহিত হবো। আপাতত এই সুন্দর লগ্ন আমি নষ্ট হতে দিতে পারি না। আপনি যদি চান তো ডুবতে রাজি আছি। মুনিয়া দেখে,সত্যিই বাঁধ থেকে রাস্তাটি অনেক নিচে নেমে গেছে। পাশ দিয়েই গোমতীর ছলাৎ ছলাৎ জল। জলে টইটম্বুর নদী। অগত্যা মুনিয়া পালসারে দুইপা দু’দিকে ছড়িয়ে জৈমিনির কোমর পেঁচিয়ে ধরে।জৈমিনি গাড়িতে স্টার্ট দিতেই গাড়ি অটোমেটিক ঢালু পথ বেয়ে তরতরিয়ে নিচের দিকে চলে যায়।

ওয়াও,হি হি হি হিন্দি সিনেমার নায়কদের মতো পাগলামি করতে করতে জৈমিনি সামনে ছুটে। মুনিয়া ওর কোমর পেঁচিয়ে ধরেছে এই আনন্দে আটখানা হয়ে সে চিৎকার করে,,হে গোমতী সুন্দরী! ফুলেদের আর কাছে ডাকবো না,তোমার হৃদয় আজ আমার পাঁজরের সাথে লেগে আছে।আজ পাঁজর আর হৃদয় একসাথে কথা বলছে, বিশ্বাস করো মন, তোমার হৃদয়ের চেয়ে এত নরম বিছানা কোথায় আছে?

মুনিয়া ওর পাগলামি দেখেই চলেছে। একেকবার একেক নামে ডাকছে তাকে। সে ঘোর আর ধন্দে পড়ে যায়।বহুবছর মুনিয়াকে যন্ত্রণা আর অবিশ্বাসের ক্লেদ জড়িয়ে রেখেছে,আজ ছেলেটার মাতলামিতে তার শরীরের নিভৃত কপাট খুলে কে যেনো তাকে মুক্তি দিতে চাইছে। কে যেনো বলছে,লাইফ ইজ বিউটিফুল। লাইফ ইজ লাভলি ডিয়ার,এনজয় দা চার্মিং লাইফ। আসলে কথাগুলো জৈমিনির। নদীর মতো বয়ে ভেতরে বলে চলেছে সে। মুনিয়া ভাবতে ভাবতে কল্পজগতে চলে আসে। অলক্ষ্যে সে শোনে তার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা কোন একটা মানুষ এসব বলছে। হঠাৎ সম্বিত ফিরলে মুনিয়া দেখে কথাগুলো জৈমিনি বলছে। আশ্চর্য! জৈমিনি কী করে মুনিয়ার মনে ঢুকে অন্য কারো স্বরে কথাগুলো বলছে? যে কথাগুলো বহুবছর গোপন ছিলো তার বুকের ভেতর! যেন আজ পিছুটান ছেড়ে আসা কোন স্বপ্নাহত হরিয়াল মেয়ের ঘুম ভাঙ্গিয়ে এসব কথাগুলো বলার জন্য গোমতীর স্বচ্ছ জল তারজন্য তিরতির করে কাঁপছে!যেনো বহুবছর বুকের ভেতর ঘুমিয়ে ছিলো এই কথাগুলোই। আজ তারা টোঁকা পেয়ে,ছোঁয়া পেয়ে জলের ভেতর থেকে কলকল করে বের হয়ে আসছে, গোমতীর স্বচ্ছ জলের অতল থেকে। মুনিয়া ভাবে, কে নদী? গোমতী নাকি জৈমিনি ?
মুনিয়ার ভেতর অশান্ত ঢেউ। তার প্রাণ দুইদিকে চলে গেছে। একটি জৈমিনির পিছুপিছু। আরেকটি কিছুক্ষণ আগের বিষাদিত স্মৃতি। দুটোই কল্পনা করে সে। দেখে বিষাদিত স্মৃতিরা তাকে ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুত। বাকী রইলো জৈমিনি । তার মনপ্রাণ সবকিছু ভেঙে ওইদিকেই ছুটছে। মনের এই বেখেয়ালি রূপের সে কোন আকার দেখতে পায় না। নিরাকার এই মনে সাকার জৈমিনির ছায়া ছাড়া এখন আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই। মুনিয়া ঘোরে ডুবে যায়। যেমন করে সে অস্তমিত সূর্যকে গোমতীর জলে ডুবে যেতে দেখেছে ঠিক সেরকম করে সে জৈমিনির নদীতে টুপ করে ডুবে যায়।

সত্যিই, ওরা প্যারাডাইজ হাউজে এসেছে। জৈমিনির অমরাবতী। এককাপ কফি ওকে কোথায় নিয়ে এলো!
চারদিকে সবুজ আর সবুজ। নানান রকম ফুল আর লোকালয়হীন এক জলজ আবাস। অপূর্ব! সত্যিই অপূর্ব! জলের ওপর সবুজ দ্বীপ। ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যেনো গম্ভীর রাত্রির বুকে কথাহীন গান। এই গানগুলোর কোন সুরকার,গীতিকার নেই। একমাত্র প্রকৃতির নির্মল ছন্দই রচনা করে এসব গান আর আপন মলয়রাগে চিত্রিত করে অবিনাশী সুর। আজ এই রাত্রিতে মুনিয়া এখানে না এলে জানতেই পেতো না জলও কথাছাড়া নিজস্ব ভাষায় এত সুন্দর গান গাইতে পারে।
মুনিয়াকে নিয়ে ওপরে না বসে সোজা ঘাটলায় চলে আসে জৈমিনি । বড় ঘাটলা। দূরে সবুজ বনে হালকা নীল বাতি জ্বলছে। অনেক দূর থেকে আসা নীল রঙের অস্পষ্ট আলো জলের ওপর অসাধারণ এক ছায়া ফেলছে। জল কলকল করে বয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছে। আর পেছনে ফিরে আসছে না। আবার জলের দল, দলবেঁধে সামনে চলে যাচ্ছে। মুনিয়া আর জৈমিনি ঘাটলার একদম নিচের একটি সিঁড়িতে বসে।
—-মুনিয়া, কেমন লাগছে?
–হুমমম,
–তোমার ভালো লাগছে?
–হুমমমম,
–আমি যে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি রাগ করেছো?
–উমমমমম না।
—মুনিয়া……..?
—হুমমম,
—তুমি খুব সুন্দর। তুমি এই রাতের চেয়েও বেশি সুন্দর। তুমি পৃথিবীর সেরা সুন্দর। তুমি একটি অবাক……. জানো?
–না, জানি না
—থাক, তোমার জানতে হবে না.
—আজ এখানে থাকবে?
–হুমমমমম,
—সত্যি বলছো?
–হুমমমম,
—মুনিয়া,তুমি খু–উ–ব সুন্দর। তোমার হাত ধরি?
–হুমমমম।
—-মুনিয়া,পা ভেজাবে?
—হুমমম।
—দেখি, পাগুলো আমাকে দাও
— এই যে! জৈমিনি নিচের আরেকটি সিঁড়িতে নেমে আসে। মুনিয়ার দুটি পা তার দুই হাতের ভেতর ধরে বসে থাকে। পা থেকে ক্রসবেল্ট জোড়াজুতো খুলে ফেলে।একটু ঝুঁকে নদী থেকে এক আঁজলা জল নিয়ে আসে। সেই জল দিয়ে সে মুনিয়ার পা ধুয়ে দেয়। পাগুলো ধুয়ে দেওয়ার পর সে অপূর্ব চোখে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর বলে বাহ! দেবালয় থেকে নেমে আসা দেবীর পা ধুয়ে দিচ্ছে অধম এক সেবক। আমার কী ভাগ্য, যে আজ আমি দেবীর চরণ ছুঁতে পেরেছি। ওহহ ,দেবী! তোমার চরণের আশীর্বাদ দাও আমাকে! আমি কৃতার্থ হই।
তারপর আবার বলে, মাছেদের চুমু খেতে দেবে না? আজ কথা ছিলো ওই পা যুগল নদীর জলে ডুবে যাবে।আর মাছেরা তাদের নরম চষ্ণু দিয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দেবে। পা দাও দেবী। গোমতী ধন্য হোক। সে মুনিয়ার খোলা পা দুটি জলে নামিয়ে দেয় ।ওর ধবধবে ফর্সা পা জোড়া গোমতী লুফে নেয়।

মুনিয়ার পা গোমতীর জলে ভেসে যায়। ওপরে তারাভরা আকাশ, নিচে জৈমনিবৃক্ষের ডালে মুনিয়া নামক প্রজাপতির ফুরুৎ ফুরুৎ ওড়াউড়ি। মুনিয়ার হৃদয় পাললিক ভূমির মতো ভেজা। উৎকর্ষ জমিন একজন কৃষকের আজন্ম চাওয়া। নরম থকথকে ভূমি না হলে কৃষক জমিতে চাষ দেবে কেনো? মুনিয়া আজ গোমতীর জল পেয়ে সমতটের উর্বর কন্যা। সে তার বুকে চেপে থাকা সমস্ত পাথর এই জলে ছুঁড়ে নিজেকে ফিরিয়ে নেবে জীবনের কাছে পূনর্বার। এই ভাবছে সে এখানে বসে। জৈমিনি কফি নিয়ে আসে। সোনালি রাত জলের গান বাজিয়ে চলে।জেমিনি বলে, আহ!আজ অমৃত খাচ্ছি।
—কিন্তু সেই অমৃত আপনি। জৈমিনি, আপনি অসাধারণ। খাঁ- খাঁ দুঃখে নিহত হওয়া এই আমাকে সত্যি অমরাবতীর রাজধানীতে নিয়ে এলেন। আপনার অমরাবতী অপূর্ব!
–যাহোক মর্ত্যের দেবীকে তুষ্ট করতে পেরে এই অধম মহাখুশি।দেবীর সাক্ষাৎ আর কবে পাবো? দেবীকে রেসপন্স করলে কোন জবাব পাই না। এই অধম সেবক দেবীর খুব কাছাকাছি থাকতে চায়। দয়া করে দেবী কি তার কন্টাক্ট নাম্বারটা দেবে? মুনিয়া এবার হো হো করে হেসে ওঠে। তার হাসির শব্দে জৈমিনি অবাক হয়, বলে, মুনিয়া, তুমি হাসতে জানো? মুচকি হেসে মুনিয়া বলে, না, কাঁদতে জানি। তবে আজকে হাসছি। এখন তো মনে হয় আমি আসলেই হাসতে জানি।

রাত নটার ঘরে ছুঁই ছুঁই করছে। প্যারাডাইজ হাউস একটু পর বন্ধ হয়ে যাবে। ওদের লোক এসে বলে, স্যার, আমরা ক্লোজ করবো। দয়া করে আপনাদের উঠতে হয় যে! আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আজকের দিনের চেয়েও আগামী প্রতিটি দিন আপনাদের আরো ভালো সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত। আশা করছি, আপনারা আবার আমাদের সেবা নিতে আসবেন, এবং এই প্যারাডাইজ হাউজের সেবা আপনাদের আরও স্বর্গীয় অনুভূতি দেবে। আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
–ঠিক আছে আমরা উঠছি। আবার আসবো এই সুন্দর স্বর্গে।
জৈমিনি আরো কয়েকটি সিঁড়ি নেমে সর্বশেষ সিঁড়িতে দাঁড়ায়। ওখানে হাঁটুর ওপর জল। বর্ষা এখনও যায়নি। অক্টোবরের শেষ সময়। আকাশ জুড়ে মেঘের আনাগোনা। প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে গতসপ্তাহে। গোমতী যৌবনা। জলে টইটুম্বুর।ওই জলে দাঁড়িয়ে আছে জৈমিনি । জলের স্রোত তার পায়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সে নিচু হয়ে জল স্পর্শ করে। কিছু জল হাতের তালুর ওপর নিয়ে কপালে ঠেকায়। তারপর বলে,হে গোমতী, আমি তোমাকে প্রণাম করছি। জীবনের বিভীষিকা ভুলে আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমাকে উজার করে দিয়েছো। তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাওনি। হে স্রোতস্বিনী! তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করো। জীবনের শ্রেষ্ঠ একটি সময় তুমি আজ আমাকে উপহার দিলে। তোমাকে কোনদিন ভুলবো না। হে আমার প্রিয় নদী! তুমি মুনিয়ার মতো মহান। সে আঁজলায় কিছু জল নিয়ে মুখ ধুয়ে নেয়।
মুনিয়া এসব দেখে এগিয়ে আসে। একী,আপনি কাঁদছেন?
— না, তেমন কিছু না। ওসব দেখতে নেই মুনিয়া।
জলের ওপর আছি। সে দিয়েছে আজ আমাকে অনেক।তাই নিজের একটু উষ্ণীষ এখানে রেখে গেলাম। চলো, এবার ওঠা যাক। সে মুনিয়ার হাত ধরে ওপরে উঠে আসে।

হাওয়ার তীব্রগতিকে পাশকাটিয়ে বাজাজ পালসার চলছে। বাতাসও যেনো এই বাইকের গতিকে রুখতে পারছে না। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে পালসার।পেছনে গোমতী নদী, মিষ্টি রাতের স্মৃতি, তারা ভরা আকাশ, জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, দূরে সবুজ বনের নীলাভ আলো, কফির ঘ্রাণ। সবশেষে প্যারাডাইজ হাউজের সুখময় ভালোবাসা বুকে নিয়ে জৈমিনির স্বর্গীয় বাহন নাগমল্ল ছুটছে। ছুটতে ছুটতে একেবারে মুনিয়ার বাসার দোরগোড়ায়। মুনিয়া জৈমিনিকে বিদায় জানিয়ে যখন বাসায় ঢুকে তখন রাত দশটা। এক অসাধারণ সুখস্মৃতিতে আচ্ছন্ন মুনিয়া জৈমিনিতে ডুবে থাকে।

সেই জৈমিনি আজ ঝড়বৃষ্টি রাতে মুনিয়ার বাসায় উপস্থিত। মুনিয়া বের হয়ে আসে। পরনে কালো জর্জেট শাড়ি। সাথে সাদা ব্লাউজ।রেডি হয়েই কিচেনে দাঁড়ায়।জৈমিনি চায়ের কাপে চা ঢালছে।মুনিয়াকে দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে যায়। সারা শরীরে এত উপচে পড়া রূপ এই পুঁচকি মেয়ে ধারন করে কী করে? জৈমিনি চা নিয়ে এগিয়ে আসে। তারপর মুনিয়াকে বলে,
আমি কেবল মাত্র তোমার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। আমি কেবলই জেগে উঠলাম। জেগে উঠেই এমন পরিপূর্ণ ভোর দেখবো,আহা! জীবন এত সার্থক হবে ভাবিনি।
সে অবাক চোখে বলে, মুনিয়া কেনো তুমি এত সুন্দর? এই দেখো,এখন আর চা খেতে ইচ্ছে করছে না। চোখের সামনে এমন রূপবতী থাকলে পৃথিবীর সকল পিপাসা মিটে যায়। ক্ষুধা মরে যায়। আচ্ছা,প্রভূ কেনো সকল নারীকে তোমার মত রূপবতী করে দেয় না? তাহলে তো পৃথিবীতে কোন অভাব থাকে না।ক্ষিধেয় মানুষ মরে না।
— হুম,ঠিক বলেছেন। পৃথিবীর সকল নারী আমার মতো হোক। আর সকল পুরুষ আপনার মতো। যাতে মাঝরাতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওই পুরুষেরা রূপবতীদের ঘরে এসে হানা দিতে পারে।
–তা যা বলেছো মুনিয়া। এটা খারাপ হবে না। এতে পৃথিবীর সকল পুরুষ প্রেমিক হয়ে উঠবে।ভাবো তো একবার?পৃথিবী স্বর্গ হয়ে যাচ্ছে। প্রেমিক-প্রেমিকার মন তখন সুখে বিভোর। কীসের খাবার কীসের কী! প্রেম চাই তখন,শুধু প্রেম।
–তাহলে আর কী! সারা পৃথিবী পাগলে ভরে উঠবে।
–হুম,জৈমিনি হাসে। পৃথিবী যদি সুখময় হয়ে ওঠে প্রেমের জন্য, তাহলে পাগলই ভালো।

জৈমিনি কীরকম পাগল ছেলে মুনিয়া সেদিনই টের পেয়েছে। যেদিন কফি খাওয়াকে কেন্দ্র করে অমরাবতীতে তাকে ঘুরিয়ে এনেছে সে যে এক নতুন জন্মের সমান। জৈমিনি তাকে নবজন্ম দিয়েছে। জীবন যে কত সুন্দর, অলক্ষ্যে নিভৃতে এসে সে নির্মান করে গেছে। সে যে কত অবাক ছেলে তার সাথে পরিচয়ের পর মুনিয়া বুঝতে পেরেছে। পরিচয়ের পর যখন ফেসবুকে ওরসাথে কথা হয় সেখানে প্রেমের প্রস্তাব থাকে না। কিন্তু প্রতিটি কথা প্রেমময়। ভিডিও কলে যখন কথা হয় ওর চোখে মুখে দেখেছে সে বর্ণময় রঙিন উচ্ছ্বাস। ছেলেটা আসলেই রঙিন। কত দিকজুড়ে যে সে রঙীন তা বলে শেষ করা যাবে না। এই যে আজ রাতে মুনিয়ার বাসায় হানা দিয়েছে সে আচমকা করেনি। বলে কয়েই এসেছে। অমরাবতী থেকে ফেরার পর মুনিয়াকে সে একদিনের জন্যও কল করার সুযোগ দেয়নি। সুযোগ পেলেই সে কল করে। মুনিয়াকে নেটে পেলে আর কথা নেই। অডিওতে ভিডিওতে কল করে এমন পাগলামি জুড়ে দেয় যে মুনিয়ার হৃদয়টা মুহূর্তেই বোগেনভিলিয়া হয়ে ওঠে। এত রঙীন! ছেলেটা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অদৃশ্য ঘ্রাণে রঙিন করে দিচ্ছে। কিছুতেই মুনিয়া তাকে এড়িয়ে যেতে পারছে না। সে ভাবে ওর এতদিনের সংস্কার,রীতি,আভিজাত্য এগুলো আজ কোথায়? নিজেকে যে কঠিন আবরণে সে ঢেকে রেখেছে সেগুলো কোন ফুল্ল পৃথিবীতে চলে যাচ্ছে ? কোন মেঘমল্লার ঝংকারে আজ রুমঝুম রুমঝুম করে বাজছে মুনিয়ার পাঁজর?

ওর সাথে কথার মধ্যেই অঝোরে বৃষ্টি নামে। সে নিজেই বৃষ্টি। যে আকাশ খটখটে সেখানে সে বৃষ্টি নামাবেই।অক্টোবরের সময়গুলো যখন বৃষ্টিকাতর, পথঘাট জলময় তখন জৈমিনি বলতো মুনিয়াকে,একদিন খুব ঘন করে জল রূপনগরকে গিলে নেবে। কানপেতে রেখো মুনিয়া,সেদিন আমি আসবো। তোমার কাছে। ভেজা শরীর নিয়ে আমি দাঁড়াব তোমার সম্মুখে। তোমাকে নিয়ে শব্দের জলাশয়ে হারিয়ে যাবো। সেদিন আমার সমস্ত অস্থিমজ্জায় তোমার জন্য উল্লাস নিয়ে আসবো। আচমকা এসে তোমাকে চমকে দেবো। সেদিন থেকে একটু জলবৃষ্টি বেড়ে গেলেই মুনিয়ার উৎকণ্ঠার আর অন্ত থাকতো না। কখন জৈমিনি এসে পড়ে। ওর ঠিক নেই। একদম পাগলাটে। যা বলবে তাই করে বসবে।

রাত হলে জৈমিনি অস্থির হয়ে পড়ে। কতবার মুনিয়াকে বলেছে, জানো মুনিয়া, রাত আমাকে নিজের ভেতর থাকতে দেয় না। যখন তখন আমাকে আমার ভেতরটাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়। শরীর যদি এতদিকে ছড়িয়ে পড়ে তবে কতখানি নিজের ভেতর থাকা যায় বলো? একদিন আমি আসবো।টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া শরীরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়া শরীরটা তোমাকে দেখাবো। এই অক্টোবরে কোন এক ঝুমঝুম বৃষ্টিরাতে তোমাকে নিয়ে উধাও হবো।দেখো মুনিয়া, সেদিন তোমাকে নিয়ে পাগল এই জৈমিনি হলুদ পাখির মতো তোমার ভেতর ডানা ঝাপটাবে।

অবশেষে সে এলো। জানালার শার্সিভেঙে বৃষ্টি যখন তার চিত্রকলা দেখাচ্ছে, বিপুল বিনাশী রাত যখন টইটুম্বুর জলে কেঁপে কেঁপে কল্লোল তুলছে সেই বৃষ্টিময় রাতেই সে এলো। একেবারে মুনিয়ার অন্দরমহলে।
জৈমিনি বেরিয়ে পড়ে মুনিয়াকে নিয়ে। বাইরে বৃষ্টির আঁচ কিছুটা কমে এসেছে। সেই আগের মতো জৈমিনি হৈ হৈ করে ওঠে। আজ বৃষ্টি নয় মুনিয়া, আজ হৃদয়ে ভালোবাসা প্রবেশ করেছে। আজ ভেতরে প্রেম জমেছে। আজ মেঘের মতো প্রেম জমেছে। এই মেঘগুলোকে ঝরাবো বলেই তো রাতের ডানা কাটতে এসেছি। আচ্ছা মুনিয়া রাতকে কাটবে বলে তুমি কী নিয়ে এসেছো?
মুনিয়া খলখলিয়ে হেসে ওঠে, কিছুই বলে না। শুধু পাগল একটা বলে হাসতে থাকে।
হাসো মুনিয়া, তুমি হাসলে পৃথিবীর সব দূষিতরা ভালোবাসার মায়াবী মৌসুমে পরিণত হবে।

জৈমিনি তার নতুন এক্সব্লেডের ডাবল ডিস্কের ১৬০ সিসির স্ট্রিট অলরাউন্ডার হোন্ডাটির ওপর মুনিয়াকে বসিয়ে দেয়। হোন্ডাটি নতুন। আজ সে বাজাজ পালসার আনেনি।বৃষ্টিজল কেটে এটি সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। হোন্ডায় বসে ওরা দুজনে ভিজছে । হঠাৎ বাইকটি সিঙ্গেল চ্যানেল অ্যান্টি-লক ব্রেকিং সিস্টেমে তাপ ছড়িয়ে দেয়।তারপর পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণে এসে থেমে যায়। সে বাইকটিতে রোবো ফেসড হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে দেয়। মুহূর্তেই পুরো রোডজুড়ে চাঁদের আবছায়ার মতো আলো তৈরী হয়। এরকম বৃষ্টিভেজা রাতে চাঁদের আলো তৈরীর জন্য সে এই বাইকটি নতুন কিনেছে।

বাহ,কি সুন্দর! মুনিয়া জুতোগুলো ফেলে দেয়।তারপর দেয় দৌড়। বাইকের এই মায়াবী আলোয় মুনিয়া রোডের এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়ায়। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। মুনিয়া ভিজে একাকার।শরীরে যেনো শাড়ী নেই। পাতলা শিফন,রসুনের চামড়ার মতো কোনরকম শরীরে টিকে আছে। সাদা ব্লাউজ। দেখা যাচ্ছে না। ওটাও ভিজে ওর ফর্সা শরীরে মিশে গেছে। মুনিয়ার সেদিকে খেয়াল নেই। জৈমিনি এগিয়ে আসছে একটু একটু করে। মেঘের রাত। আঁধার রাত। নকল চাঁদআলোর রাত। মুনিয়া এতক্ষণ পর টের পেলো ওরা নতুন গোমতীর পাড়ে এসেছে। চারদিকে বৃষ্টি। নিচে নদী। পাশে বাঁধ। বাঁধের সাথেই পিচঢালা কালো পথ। মুনিয়ার শাড়ি ওকে পেঁচিয়ে ধরেছে। ওর লিকলিকে শরীরটা শাড়ীর সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। জৈমিনি দেখছে মুনিয়াকে। এই রাতে ফিনফিনে শরীর থেকে ভেজা ঘ্রাণ পাচ্ছে জৈমিনি। সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে বলে, মুনিয়া স্নান করবে? মুনিয়া বলে,জলের সাথেই তো আছি জৈমিনি ?
— হুম,ওহে কস্তুরী রমণী! এই গভীর নিরিবিলি পথে যে বৃষ্টি আমাদের ভিজিয়েছে আজ আমাদের উচিত তাকেও ভিজিয়ে দেয়া।

জৈমিনি মুনিয়ার হাত ধরতেই মুনিয়ার পা দুটি শাড়ির সাথে প্যাঁচ লেগে যায়। সামনে পা বাড়াতে না পেরে তাল হারিয়ে সে বাঁধের পেছনে পড়ে যায়। ওদিকটায় বৃষ্টির গড়াগড়ি। জল চুঁইয়ে বাঁধের দিকে ছুটছে। মুনিয়া সেখানেই পড়ে থাকে। যেনো বৃষ্টির বিছানায় শুয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক কোন নারী। জৈমিনি অস্থির হয়ে ওঠে । সে নিজেকে সামলাতে পারে না। সেও উপুড় হয়ে মুনিয়ার ওপর পড়ে। জলজ মাটিতে নারীর ঘ্রাণ, তার নিবিড় ঠোঁটের ওপর বৃষ্টিকণারা হল্লা করছে। নিশ্বাসের ভেতর ডাক, আরো কি বর্ষা হবে? কে জানে? বৃষ্টির এই শাখা প্রশাখা জৈমিনির দুটো পাকে শিকড় বানিয়ে মুনিয়ার পদতলে গেঁথে রাখে।

মুনিয়া উঠে বসে। একদম জৈমিনির বুকের ভেতর তার বুক। গেঁথে যায় একে অপরের সাথে। যেমন করে বৃষ্টি এসে গেঁথে থাকে মাটির বুকে।জৈমিনি আর মুনিয়ার শ্বাস এক হয়ে আসে । মুনিয়া বলে, কতখানি বর্ষা এখানে? আমি আরো বর্ষা দেখতে চাই। মুনিয়া জৈমিনির ভেতর ঢুকে পড়ে।ওর সাদা পাতলা মসলিনের সার্টটির অস্তিত্ব নেই। ওটা জলে ভিজে শরীরে এমনভাবে মিশেছে যে তার ধবধবে ফর্সা বুক ভেদ করে স্তনযুগল দেখা যায়। মুনিয়া তার সার্ট খুলে ফেলে।জৈমিনির ঘাড় থেকে নিচে নেমে আসা চুলগুলো পিঠে লেপ্টে থাকে। যেনো সে গ্রীকনগরের বীর হারকিউলিস। গোমতীর তীরে এসে বসে আছে মুনিয়ার জন্য। ওর ভ্রু বেয়ে বেয়ে জল নিচে গড়াচ্ছে। মুনিয়া মুখ ওপরে তুলতেই ওর দুই ভ্রু থেকে দুইফোঁটা জল মুনিয়ার মুখের ভেতর টুপ করে পড়ে। মুনিয়ারও যেনো ব্যাপক তৃষ্ণায় পেয়েছে। সে জলগুলো খেয়ে নেয়। জৈমিনির আরো কাছে ঘেঁষতেই ওকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। ওর দুই হাতের ওপর মনুষ্যআকৃতির ঘুড়ি। ইচ্ছে করলেই জৈমিনি তাকে আকাশে ছেড়ে দিতে পারে। আবার আকাশ থেকে টেনে বুকের অতলে নামিয়ে আনতে পারে মুনিয়া নামক ঘুড়িকে।সে তাকে কোলে রেখেই ওর ঠোঁটের ওপর ঝুঁকে আসে। তারপর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে বলে, মুনিয়া বৃষ্টি কোথায় হচ্ছে?
— ঠোঁটের ভেতর। মুনিয়া বলে।
–জলোচ্ছ্বাস চাও?বৃষ্টি আরো নাচুক চাও?
–হুম,,
–কিন্তু তাহলে তোমাকে যে নাচতে হবে?নাচবে?
–হুমম।।

জৈমিনি ঠোঁটের ভেতর মুনিয়াকে লুকিয়ে ফেলে।।মুনিয়া কোন হা করতে পারে না। মুগ্ধ বকুল যেমন ফুটবার আগে তার সমস্ত সুবাস নিয়ে নিজেকে তৈরী করে তেমনি মুনিয়াও যেন এই বৃষ্টিতে ভিজে কলি থেকে ফুল হয়ে যায়। সে দুই হাতে জৈমিনির ঘাড় জড়িয়ে ধরে। তার দীঘল চুলের ভেতর ওর দুইহাত ডুবিয়ে দেয়।জৈমিনি চুমু খেয়ে চলেছে পাগলের মতো।মুনিয়ার ঠোঁটে উড়ছে চুম্বনের জৈমিনিপাখি। চুম্বনের নদীতে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সে আরো গভীরে ডুবে যায়,সে কোল থেকে মুনিয়াকে নামিয়ে তার হাঁটুর ওপর
মাথা রাখে। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়ায়। এরপর সে মুনিয়ার শরীর থেকে ভেজা শাড়ি খুলে ফেলে।

এক্সব্লেডের রোবো ফেসড হ্যাডল্যাম্পটি হঠাৎ অলৌকিক হয়ে ওঠে। ওর আলোয় মুনিয়ার শরীরের প্রতিটি বাঁকের দেখা পেয়ে পথ হারিয়ে ফেলে জৈমিনি। সেইসাথে বৃষ্টির জন্য স্পেশাল ক্রয়করা আলো দানকারী রাস্তার রাজা নিউ এক্সব্লেডরও যেনো দিশা হারিয়ে ফেলে। সে রাস্তার ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে। তারপর ক্যালেন্ডারের পুরনো পাতা খুলে নতুন পাতা উল্টে দেয়ার মত মুনিয়ার পেটিকোট খুলে নেয়,ইলাস্টিকের কুচি পেটিকোটের বন্ধন ছেড়ে ঋজু জৈমিনির করতলে বন্দী হয়ে যায়। মুনিয়ার জঙ্ঘার দিকে নুয়ে চিৎকার করে জৈমিনি,ওহহ, অচেনা আমি ভালোই ছিলাম,মুনিয়া কী চেনালে আমাকে তুমি? সে মুনিয়ার জঙ্ঘার ভেতর স্কেচ আঁকার মত মাথা ঘষে বলতে থাকে এ অসহ্য সুন্দর! এত সুন্দর আমি নিতে পারছি না। আমার সেই ক্ষমতা নেই। হঠাৎ সে মুনিয়াকে প্রণাম করে বসে।

মুনিয়া তখন তিরতির করে কাঁপছে। সমস্ত শরীর তার অবশ বিবশ। তার শরীর জুড়ে তখন জৈমিনির নিঁখুত তুলির ছোঁয়া। সে তাকে একের পর এক এঁকে চলেছে। আকস্মিক জৈমিনির প্রণাম দেখে সে একটু পেছনে সরে এসে বলে, কী করছেন? এ কী! এ কী!
জৈমিনি বলে,তুমি দেবী। দেবীকে প্রণাম করতে দাও। প্রণাম শেষে তার প্রসাদে ধন্য হই।
জৈমিনির কথার মাঝে মুনিয়া ওকে টেনে দাঁড় করায়। বৃষ্টিতে ভেজা মুনিয়ার গন্ধমযুগলও যেনো জলের দাগ মুছে জৈমিনিকে দেখছে। কী অপূর্ব! বৃষ্টির শাখায় বসে ওরা দূর গ্রহ ছেড়ে জৈমিনির দিকে প্রজাপতির মতো উড়ছে।সে টিকতে না পেরে মুনিয়ার ব্লাউজ খুলে ফেলে। ছাতিম ফেটে যাওয়ার মতো ওর ব্লাউজ ফেটে বের হয়ে আসে পৃথিবীর আদিমতম গোলাপি সৌন্দর্য।

ওহহ ঈভ! তুমি এখানে? পৃথিবীতে সৃষ্টি হওয়া প্রথম নারী জৈমিনির সামনে দাঁড়িয়ে? পোশাকহীন,আবরণহীন! বৃষ্টির ঝাপটায় জলের ফোঁটাগুলো মুনিয়ার স্তনবৃন্ত বেয়ে গোমতীর গোপন যৌবনে পারমানবিক বাঁশি বাজাচ্ছে। যেনো এখনই বাঁশির সুর বেজে উঠবে আর ইশ্রাফিলের প্রলয়শিংগার মত পৃথিবীকে ধ্বংস করবে। আজ কে ধ্বংস হবে? মুনিয়া? জৈমিনি ? নাকি পৃথিবী? মুনিয়ার বুকে গজানো আঙুরফুলে তাকিয়ে থাকে জৈমিনি। কী মোহময় স্বর্গের উদ্যান! নারীশরীর এত মোহনীয়? জৈমিনির অন্তরজুড়ে ঈশ্বরবন্দনা । এত কান্তিময় নারী আজ সর্বস্ব খুলে আরেক নদীময় জলউদ্যানে দাঁড়িয়ে আছে। যে নদীউদ্যান তার যোণিমুখ খুলে আকাশের জল গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছে। আরেকদিকে নারীর যোণীসর্বস্ব সৌন্দর্যে অসহায় এক পুরুষ ছটফট করে মরছে। সে বৃষ্টি হতে চায়। ওই গিরিখাতে ঝরঝর ঝরে বইয়ে দিতে চায় পতনে মৃত্যুর ফল্গুধারা। সে পারে না। এত সৌন্দর্যের কাছে সে পৌঁছাতে পারে না। এত দীর্ঘ সুন্দর আর আলোকিত লহমার তেজে মুহূর্তেই সে অন্ধ হয়ে যায়। মুনিয়ার এমন সম্মুখ সৌন্দর্যে জৈমিনি বিহ্বল হয়ে পড়ে। যাকে কাছে পাওয়ার এত তীব্র ছটফটানি আজ তাকে কাছে পেয়েও ভয়। মুনিয়ার জঙ্ঘায় নতজানু হয়ে সে যাবতীয় প্রাক-পুরাণের নারী মনে মনে কল্পনা করে।কিন্তু কোথাও সে মুনিয়ার মতো কাউকে খুঁজে পায় না।। অবশেষে সে মুনিয়ার নগ্ন বাহুতে মাথা রেখে দাবী জানায়, দেবী, আমাকে তোমার বুকের কবোষ্ণ ওমে বাঁচিয়ে রাখো..আমার সকল সুখ ও অসুখ তোমার নামে উৎসর্গ করে দিলাম।

মুনিয়া তখন আর নিজেতে নেই।
তার একাকী বিষাদগুলো বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে গেছে। আর বিনিময়ে ঝলোমলো জৈমিনিকে তার বুকে রেখে গেছে। সে জৈমিনিকে নিজের কাছে টানতেই জৈমিনি একটু দূরে সরে যায়। মুনিয়া অবাক হয়। সে সরে যাচ্ছে কেনো? এই বৃষ্টি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জৈমিনি তাকে প্রাসাদ থেকে মেঘমল্লার মেদুরে এনে দাঁড় করিয়েছে। এখন সে কেনো দূরে সরে যাচ্ছে? আরেক ব্রহ্মলোকে পাড়ি দিতে চাইছে কেনো সে? মুনিয়া এবার শক্ত হয়ে দাঁড়ায়।
–দেবী ডেকেছো না? আজ মহিষাসুর বধ হবে। সে জৈমিনিকে একটানে নিজের ভেতর তুলে আনে। জৈমিনির খোলা আর উদ্দাম বুকের নিচে মুনিয়ার মাথা রেখে সে জৈমিনির কোমর পেঁচিয়ে ধরে। ওর পাঁজর জুড়ে মুনিয়ার সুডৌল স্তনের ছোঁয়া। জৈমিনি কাঁপছে। মুনিয়া টের পাচ্ছে ওর শরীর টলছে। জৈমিনি বলছে,এ সুন্দর! এ ভয়ংকর সুন্দর! এমন সুন্দর নেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। দেবী, আমি তোমার এই সোনা -প্রান্তরে এক নগন্য কৃষক। মুনিয়া জৈমিনির ঠোঁট ছুঁয়ে আছে। জৈমিনি টলমল। সে তার ঠোঁট এগিয়ে নিতে পারছে না। ফলবতী শাখাকে যেমন করে টেনে আনে কৃষক তেমন করে জৈমিনির মাথা টেনে আনে মুনিয়া। তার ঠোঁটের ওপর রেখে দেয় ওর টোঁট। চারঠোঁটের ভেতর তীব্র ছুটোছুটি। ওরা দুজন হৃদয়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। খুব চেনা এই শব্দ। চিরন্তন নরনারীরা যেসব শব্দ প্রেমেজলে পদ্মবিলের জন্ম দেয় তেমন শব্দে ওরা হারিয়ে যাচ্ছে।
ওরা ঠোঁটে ঠোঁটে ভালোবাসা পরখ করে। জৈমিনি আরো নিচে নেমে আসে জল যেমন দৌড়ায় ঢালুপারে। জৈমিনি সেদিকে গড়িয়ে মুনিয়ার মণিকাঞ্চনে তীব্র চুম্বন এঁকে কোলে তুলে নেয়। তারপর বাঁধের উঁচু ঢিবির ওপর যে জায়গাটি পাঁচিলের মতো সেখানে তাকে বসিয়ে দেয়। বসিয়ে দিয়ে মুনিয়াকে সে দেখে। অপার বিস্ময় নিয়ে দেখে।

অক্টোবরের বৃষ্টির মাঝেও জৈমিনির চোখে চাঁদ ওঠে।
চোখজোড়ায় যুগল চাঁদের জ্যোৎস্না। এমন অপরূপা মুনিয়াকে কুড়িয়ে পাবার আনন্দে সে বলে,মুনিয়া তোমাকে দেখতে দাও। তোমাকে ছুঁয়ে দেখার চেয়ে দেখে ছুঁতে চাই। মুনিয়া পাপড়ির মতো মেলে ধরে বলে,জৈমিনি, জৈমিনি,জৈমিনি!
— হুম, বলো।বলো মুনিয়া! আমি জাগ্রত।শুনছি তোমাকে।
–আপনি আমার মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। চলুন টস ধরি। আপনি আমাকে ছোঁবেন নাকি আমি আপনাকে ছোঁবো? কিন্তু ধরবো কী দিয়ে? দুপাশেই আপনি!
তারচেয়ে বরং আমি……
জৈমিনিকে বুকের ওপর টেনে আনে মুনিয়া। আপনি আমাকে দেখে ছুঁতে চান এই তো? তাতো হচ্ছে না,যথেষ্ট দেখেছেন। আসুন এইদিকে……
জৈমিনির লম্বা চুলে মুনিয়া হাত বুলাতে থাকে। ওর চওড়া দু-ঠোঁটের ফাঁকে তার ঠোঁটগুলোকে ভিজিয়ে বলে,এই ঠোঁটগুলো এতদিন খুৃঁজছিলেন না?
আকাশের জলে যদি মাটি ভিজে যায়, আপনার ঠোঁটগুলো কেনো আমাকে পায় না? ওর কানে মুখ রেখে মুনিয়া ফিসফিস করে বলে,জৈমিনি! তোমাকে ভালোবাসতে চাই….খুব করে চাই তোমাকে আজ!তোমার কানে কানে এই কথাটি বলার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম। কবে তোমার সাথে দেখা হবে আর বলতে পারবো, তোমাকে আমি ভালোবাসি।

মুনিয়া আরো বলে, নগ্ন নারীর সম্মুখে পোশাক বেমানান। কেনো তুমি তোমাকে সভ্য করে রেখেছো? আদিম পরম্পরায় ফিরে গেছি আমি কবেই। তবে কেন তুমি এখনো তোমার করাল চাবুকে জলধর দ্বিখণ্ডিত করছো না? শুধু আকাশ কত ভেজাবে বলো? আকাশ মাটিকেই ভেজাতে পারে,নারীকে নয়। নারীর জন্য গুহামুখো নরের প্রয়োজন। এসো আদিম ,বৃষ্টি অনেক কথা বলে গেছে। বাকী রইলে তুমি। তোমার সমস্ত কথা আমাকে শোনাও। আমি জল, অরণ্যে, স্থলে আমার বিভিন্নতা দেখাই,এসো পুরুষ, আমাকে গ্রহণ করবে এসো।
মুনিয়া জৈমিনির ব্লু ডেনিম জিন্স প্যান্টকে ভর্ৎসনা করে। এটাকে পৃথিবীর ভারবাহী ফালতু বস্তুর সাথে তুলনা করে। এগুলো পৃথিবীর আবর্জনা। বর্জ্যের ভাগাড়। মুনিয়া জৈমিনিকে তিরস্কার করতে থাকে। জৈমিনি উঠে দাঁড়ায়। তারপর, একটানে খুলে ফেলে তার পরনে থাকা ডেনিমের জিন্স জিপার। সম্পূর্ণ নগ্ন পোশাকহীন মুনিয়ার চোখের ওপর দাঁড়িয়ে জৈমিনি। নিচে শুয়ে আছে অলীক নারী। দ্রাক্ষাময়ী, ভেজা গাত্রে সাজাচ্ছে উষ্ণতার মখমল চূড়ো। সে ছাতার মতো উপুড় হয়ে পড়ে মুনিয়ার তীব্র খরোতোর শরীরে। বুক দিয়ে ঢেকে দেয় মুনিয়াকে। ওর কানের কাছে মুখ টেনে ফিসফিস করে বলে,মুনিয়া শীত লাগছে?
–হুম,
বৃষ্টি পড়ছে?
— এতক্ষণ পড়েছে। এখন আর পড়ছে না।
–এই দেখো আমার শরীর এখন তোমার পোশাক। ঢেকে দিচ্ছি আমাকে দিয়ে তোমাকে। উষ্ণতাও পাবে এখান থেকে। আমার শরীর এখন ছাতার মতো। ঢেকে দিলাম তোমার চুলথেকে নখ পর্যন্ত। আর বৃষ্টি ছোঁবে না তোমাকে।
এরপর সে বলে,
–মুনিয়া,তোমাকে ছুঁতে দেবে?
–হুমমমম,আমার এখন শীতার্ত সময়। আমাকে উষ্ণতা দাও,
সে তার সমস্ত শরীর ঢেলে দেয় মুনিয়ার ওপর। মুনিয়া টেনে নেয় জৈমিনিকে। দুটি শরীর অপূর্ণতার উৎস খুঁজে নিজেদের একে অপরের সাথে গেঁথে দেয়। জৈমিনি পাগলের মতো মুনিয়াকে কাঠঠোকরার মত ঠোকরাতে থাকে। মুনিয়ার শরীর তখন ফুলের মত ফুটছে, পাখির মত কিচিরমিচির করছে, প্রজাপতির মতো উড়ছে।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন