বিজ্ঞাপন

জুনায়েদ খান-এর গল্প ‘কাঁপন’

May 3, 2022 | 8:18 pm

শীত এলেই কেমন যেন এক ধরণের উন্মাদনা চলে আসে মনে। শিরশিরে বাতাস আর মোহনীয় কুয়াশা মিলে মনটার উপর যথেচ্ছা অত্যাচার করে। বুকভরে শুভ্র কুয়াশা টানতে টানতে মেঠোপথ ধরে বাইসাইক্লিং এর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। নিল আরমস্ট্রং কিংবা বাজ অলড্রিনদের স্পেসস্যুটের মতো ইয়ামোটা জ্যাকেট আর ভেড়ার লোমের মতো লোমশ কানটুপির ইনসুলেটরে আচ্ছাদিত হয়ে দ্বিচক্রযানের খটখটে সিটে চেপে ভোর আর সকালের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হতো। সাইকেলের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে হুহু করে বাড়তো বাতাসের বেগ। চোখের পাঁপড়ি, নাকের ডগা, গোঁফ, স্পেসস্যুটের মতো জ্যাকেট সব কিছুই কুয়াশার পরশে অল্পক্ষণেই সাদা হয়ে উঠতো। যে দেশে স্নো নেই, সে দেশে যেন কুয়াশাই স্নো! অন্যরকম একটা অনুভূতি হতো। সাদা নাকের ডগা আর থুতনীর মাঝে দুপাটি হলুদাভ সাদা দাঁতের সংঘর্ষে থেকে থেকে শ্যালো মেশিনের মতো খটখট শব্দ হতো। মেশিনের কালো ধোঁয়ার বদলে দন্তপাটি ভেদিয়ে বেরুতো সাদা ধোঁয়া! ঘাসের ঢগা, খড়ের স্তুপ, ধুলোর সাগর মাড়িয়ে বীরের বেশে এগুতো সাইকেল। মন বলতো- চল উড়ে যাই, মিশে যাই কুয়াশার দুর্বোধ্য সাদায়…

বিজ্ঞাপন

জগতে ইদানীং বিশুদ্ধ জিনিসের চরম আকাল চলছে। ঢাকা শহরে যেন এই আকালটা আরো তীব্র। মানুষে ভেজাল, খাবারে ভেজাল, বাতাসে ভেজাল এমনকি ঠান্ডা একটা ঋতু শীত, ঢাকা শহরে সেটিতেও ভেজাল। দিনে গরম তো রাতে শীত, রাতে ফ্যান চালানো গরম তো সকালে ধোঁয়াশা, সকালে সোয়েটার গায়ে তো দুপুরে হাতে। লিখিত হোক অলিখিত হোক এটাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে। মার্কেটের দোকানগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে শীতবস্ত্র নিয়ে এলেও এক-দুই সপ্তাহ বেচা-বিক্রির পর ধামাকা অফারে অর্ধেক দামে বিক্রি করে দেয়। তাদের আশাহত হওয়ার বেদনায় মাঝে মাঝে আহতও হই। প্রকৃতি এমন খেলা না দেখালেও পারতো।

ক্যালেন্ডারের পাতা অনুযায়ী পৌষের শেষদিক চলছে। দেশে ফিরে যে অফুরন্ত ব্যস্ততা ছিলো, কয়েকদিনে সেটিও কমে এসেছে। গায়ে উত্তরের হাওয়া মাখানোর অভিপ্রায়ে কোন কিছু না ভেবেই তড়িৎ সিদ্ধান্তে বেরিয়ে পড়লাম। মনের কুয়াশা আর উত্তরের কুয়াশা মিলে এবার যদি একটু আশা দেখায়!

যানবাহন হিসেবে বাস আমার পছন্দের তালিকার প্রথমে থাকলেও কুয়াশার কথা ভেবে শুরুতেই বাদ দিয়ে দিলাম। সেকেন্ড অপশন হিসেবে বেছে নিলাম ট্রেনকে। অল্প দূরত্বে ট্রেনে যাতায়াত করলেও দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার ইতিহাস আমার নিকট বা দূর-অতীতে নেই। তাই অনলাইনে অনেক কসরত করার পর পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের একখানা টিকেট কেটেই ফেললাম। নতুন ঝকঝকে ট্রেন। কয়েকদিন আগেই রেলমন্ত্রী মহাশয় নিজ হাতে লাল ফিতা কেটে উদ্বোধন করেছেন। বাংলাদেশের রেল সার্ভিসের অবস্থা যত করুণই হোক না কেন, পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের সার্ভিস অন্তত খারাপ হবে না। মন তো সেটিই বলছে।

বিজ্ঞাপন

দুইঘন্টা দেরী করে স্টেশনে পৌঁছানোর পর আরো গুণে গুণে দেড় ঘণ্টা বসে থাকার পর ট্রেন এসেছে। অপেক্ষা করতে করতে কতবার যে ট্যুর ক্যান্সেল করার চিন্তা করেছি সেটি নাহয় নাই বললাম। যে কুয়াশার পরশ পাওয়ার জন্য মন উতলা হয়েছে, সেই কুয়াশাই নাকি ট্রেনের এ ধীরগতির কারন! অগত্যা অপেক্ষা করতেই হলো।

ট্রেন আসা মাত্রই কালক্ষেপন না করে কাছাকাছি দরজা ধরে উঠে পড়েছি। ইন্টারসিটি ট্রেন। একবগি থেকে অন্য বগিতে সহজেই যাওয়া যাবে। সহজ কাজ হয়না যেন সহজে! ভিড় ঠেলে, মানুষের পায়ের পাড়া খেয়ে, দীর্ঘ পনের মিনিটের নিরলস চেষ্টার পর অবশেষে সিট খুঁজে পেয়েছি। অকুপাইড সিট!
ভাই সিটটা কি আপনার?

“না ভাই। ট্রেনের সিট। আমি শুধু বইসা আছি।” -বলে লোকটি দাঁত কেলিয়ে হেসে দিলেন।

বিজ্ঞাপন

আমি বললাম, “তা তো বটেই। কিন্তু আপনার কি টিকেট আছে?”

উনি বুক পকেট থেকে ফট করে টিকেট বের করে দেখালেন। হেসে বললেন, “বিনা টিকিটে রেলে চড়ি না ভাই।”

আমি পড়লাম মহামুশকিলে। বললাম, “এই সিটের টিকেট তো আমার। এই যে দেখুন…”

লোকটি আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বললো, “তাইলে বইসা পড়েন। আমার টিকিটে সিট নাই। স্টান্ডিং টিকিট।”

বিজ্ঞাপন

লোকটির দিকে বড়জোড় দুসেকেন্ড অবাক চোখে চেয়ে থেকে কালবিলম্ব না করে নিজের সিটে বসে পড়লাম। অপেক্ষা আর সিট খোঁঝার ঝক্কিতে বেশ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সিটে বসেই ইয়ার বাড কানে গুজে চোখ বুজলাম। প্লে লিস্ট থেকে পছন্দের গান বাজা শুরু হলো- “ঝুম… মেঘে মেঘে ডানা মেলে… ঝুম… ঘুরে ঘুরে তারেই খুঁজি…।”

বড়জোর বিশ বা ত্রিশ মিনিট হয়েছে। পরের স্টেশনে এসে ট্রেন থেমেছে। জয়দেবপুর হবে সম্ভবত। হন্তদন্ত হয়ে আমারই বয়সী এক লোক আমার সিট অবধি ছুটে এলেন। এসেই এক গাল হেসে বিনয়ের সাথে বললেন, “ভাই, এবার যে একটু উঠতে হয়। সিটটা আমার!”

মনে হলো ঘোর বর্ষায় গাঁয়ের কর্দমাক্ত রাস্তায় বিনা প্রস্তুতিতে হঠাৎ পা পিছলে পড়লাম! আমিও বোকার মতো হাসি দিয়ে বললাম, “ভাই সিটটা যে আমারও। টিকেট তো তাই বলছে!”

আমি টিকেট বের করামাত্র উনি ছোঁ মেরে আমার টিকেট নিয়ে নিলেন। তারপর বেশ কমিনিট ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিলিয়ে দেখলেন। “UMA 27 W। ঠিকই তো আছে। ডিজিটাল যুগেও ডুপ্লিকেট টিকেট ইস্যু করে রেল!”

ভদ্রলোকের কালো মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “না না, ঠিক নেই। আপনার টিকেট পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের, আর আপনি উঠেছেন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসে!”

জিহ্বায় বড় একটা কামড় বসিয়ে ভদ্রলোকের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকালাম। ভদ্রলোক অমায়িক হাসি দিয়ে বললেন, “হয় মাঝে মাঝে এমন। তা ভাই যাবেন কোথায়?”

মনে মনে বললাম, “তাড়াহুড়োর কাজ শয়তানের কাজ!” তবে মুখ খুলে বললাম, “যেতে তো চেয়েছিলাম পঞ্চগড়…”

ভদ্রলোক হেসে হেসে বললেন, “কি আর করার? সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত চলেন। তারপর দেখা যাক কি হয়!”

লোকটা আমাকে আর সিট ছাড়তে দিলেন না। “অল্প একটু তো পথ। গল্প করতে করতেই কেটে যাবে। তো ভাই নামটাই তো জানা হলো না। কি নাম আপনার?”
বললাম, “সালমান বক্সী।”

ভদ্রলোক ভ্রু কুচকে তাকালেন। “ড. সালমান বক্সী?”

অবাক হওয়ার তীব্রতায় মুখ হা হয়ে গেলো আমার। আমি এত বড় সেলিব্রেটি না যে মানুষ আমাকে নাম বলামাত্র চিনে ফেলবে! যারপর নেই অবাক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে?”

লোকটা একগাল হেসে বললেন, “কীভাবে মানে?”

“মানে কীভাবে আপনি আমাকে চেনেন?”

ভদ্রলোক ঠোঁটে রহস্য লুকিয়ে বললেন, “দেশটা বেশ ছোট আমাদের! ঘুরে ফিরে অনেকের সাথেই আবার দেখা হয়ে যায়, অনেককে চেনাও হয়ে যায়! যাহোক, দেশে ফিরলেন কবে?”

“দুমাস হবে। কিন্তু আপনি এতকিছু জানেন কি করে?”

“বেশি কিছু তো জানি না। তবে যতদূর জানি আপনার বাড়ি তো পঞ্চগড়ে না। শ্বশুড়বাড়ি নাকি ওখানে?”

এমন ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেবো কি দেবো না ভাবতে ভাবতেই সংক্ষেপে বলে ফেললাম, “না। এমনি ঘুরতে যাচ্ছি।”

লোকটা জ্ঞানগর্ভ উপদেশ কপচিয়ে বললো, “ওদিকে তো এখন অনেক শীত। এই শীতে তো ঘুরে মজা পাবেন না।”

আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললাম, “আমি শীতের রূপ দেখতেই যাচ্ছি…”

লোকটা আমার বিরক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বললো, “বাব্বাহ! আপনার প্রকৃতিপ্রেম দেখি আগের মতোই আছে!”

আমি এবার মরিয়া হয়ে বললাম, “আপনি কে আসলে বলুন তো?”

“বিস্তারিত পরিচয় না দিলে হয়তো আপনি আমাকে চিনবেন না। তাই এখন দেবো না। তবে একটা আবদার করবো।”-বলেই লোকটা আমার চোখের দিকে তাকালো।
মনের অস্বস্তি ভাবটা বাড়তে থাকলো। অস্বস্তি চেপে বললাম, “বলে ফেলুন।”

লোকটা বিপুল আগ্রহ নিয়ে বললো, “আমার বাসায় একদিনের জন্য হলেও একটা যাত্রা বিরতি দিতে হবে আপনাকে। ওখানেও শীতের কমতি নেই। খুব একটা অসুবিধে হবে না আপনার।”

আমি হ্যাঁ বা না বলে মধ্যম পন্থা অনুসরণ করে ঠোঁট প্রসারিত করলাম শুধু। লোকটার মতলব কি?

দুই.

সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে যখন ট্রেন থামলো তখন প্রায় বিকেল ছুঁইছুঁই। শীতের বিকেল। সন্ধ্যার অপেক্ষা না করেই বেপরোয়া কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। সূর্যের তেজ একদম নেই, শুধু একটা আবছা সোনালী গোলক দেখা যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। ছোট স্টেশন। জেলা সদরের স্টেশন হলেও গ্রামীণ একটা ভাব লক্ষণীয়। ট্রেন ঢোকার সময় স্টেশনে ভিড় ছিলো না বললেই চলে। তবে ট্রেন থামার পর স্টেশনের চেহারা নিমিষেই পালটে গেলো। ভিড় ঠেলে মিস্টার হাওলাদার আমাকে মূল ফটক পেরিয়ে একটা বড় পাকুড় গাছের নিচে নিয়ে এলেন। পাকুড় গাছের নিচে গোটা পাঁচেক মোটরচালিত অটোরিক্সা দাঁড়িয়ে আছে। এ রিক্সাগুলোই হাওলাদার সাহেবের বাড়ি অবধি যায়।

ভদ্রলোকের নাম সোহেল হাওলাদার। গাজীপুরে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি এন্ড পোস্ট হার্ভেস্ট বিভাগের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার। পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ঘুরতে গিয়েছিলাম কয়েকবার। হাওলাদার সাহেবের সাথে আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়েও বেশ খানিকক্ষণ আলাপও হয়েছে ট্রেনে। স্টেশনে নামার পর গল্পের টপিক বদলে গেছে। চারপাশে শব্দ উৎসের অভাব নেই। নানান সুরের ও ডেসিবলের শব্দের মাঝেই খানিকটা উচ্চস্বরে সোহেল সাহেব বলে চলছেন। আমিও উপায়ন্তর না দেখে তাল মিলিয়ে চলছি। “কবি সাহিত্যিকদেরকে শীত দেখতে পঞ্চগড় যেতে হয় না। অন্তরের চোখ দিয়ে তারা পঞ্চগড়ের শীত সিরাজগঞ্জেও দেখতে পারেন! কি বলেন বক্সী সাহেব?”

আমি বললাম, “তা ঠিক বলেছেন। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আরকি!”
আমার এমন উত্তরে হাওলাদার সাহেব খানিকটা লাইনচ্যুত হয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন।

ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় পাঁচ কিলোমিটারের পথ যেতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগলো না। যখন রাস্তাটা কাঁচা ছিলো এবং পায়ে চালিত ভ্যান ছাড়া কোন যানবাহন ছিলো না, তখন এই স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরতে হাওলাদার সাহেবদের ঘণ্টা পেড়িয়ে যেত। মানতেই হবে টেকনোলজিক্যাল রেভ্যুলেশন জীবনের হিসেব নিকেশ বদলে দিয়েছে!

দোচালা টিনের আধপাকা বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি। গ্রামে মোটামুটি বিত্তশালী মানুষদের এমন বাড়ি থাকে। মূল ফটক পেরিয়ে ডান দিকে একটু এগুলেই দুটো টিনশেড ঘরের দেখা মিললো। মিস্টার হাওলাদার সেই ঘরের সামনে রাখা কাঁঠের চেয়ারে আমাকে বসিয়ে ভেতর বাড়িতে ছুটলেন চাবি আনতে। আমার কৌতূহল ও অস্বস্তি দুটোই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। মিস্টার হাওলাদারের সাথে আমার যোগসূত্রটা আসলে কোথায়?

গেস্টরুমটা মন্দ নয়। এটাচড বাথরুম, টিভি, সোফা সেট, পড়ার টেবিল মোটামুটি সবই আছে। টেবিলে গুটিকতক বইও আছে। রাতের খাবার শেষে বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। বেশিরভাগই বাংলা সাহিত্যের বই। হাওলাদার লোকটা যে সাহিত্যমনা সেটা বাহির থেকে দেখে আন্দাজ করার উপায় নেই।

রাত আরেকটু গড়ালে পান চিবুতে চিবুতে হাওলাদার সাহেব এলেন।
“তো বক্সি সাহেব, গরীবের ঘরে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?”

আমি সঙ্কোচের সুরে বললাম, “কী যে বলেন না! আমার একটা বিছানা হলেই আর কিছু লাগে না!”

হাওলাদার পানের রস আয়েশ করে গিলে বললেন, “একটা মানুষ কিন্তু লাগে! আপনি অবশ্য ব্যাচেলর মানুষ, এসবের গুরুত্ব বুঝবেন না!”

আমি একটা প্রশস্ত হাসি দিয়ে ব্যাপারটাকে সাবধানে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
হাওলাদার এড়িয়ে যেতে দিলেন না। তিনি সরাসরি আমাকে ভড়কে দিয়ে বললেন, “নিশাত কিন্তু মেয়ে হিসেবে খারাপ ছিলো না। কোন দিক দিয়ে সে আপনার অযোগ্য ছিলো বলুন?”

আমার হাতে হেলাল হাফিজের কবিতার বই। বইটা শক্ত করে চেপে ধরে ফ্যাসফ্যাস করে বললাম, “নিশাতকেও আপনি চেনেন!”

হাওলাদার রহস্যজনক হাসি দিয়ে বললেন, “দেশটা অনেক ছোট বক্সি সাহেব। চেনাটা অস্বাভাবিক নয়।”

নিশাতের সাথে আমার পরিচয়টা ফেসবুকেই। লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে সবাই ফেসবুককে বেছে নিলেও আমি কখনো ফেসবুকে লিখতাম না। এটা আমার নিজস্ব দর্শন থেকেই করতাম। ফেসবুকে উটকো কিছু ফ্যান ফলোয়ার জুটলেও অনেক প্রিয় মানুষই এই লেখালেখির চাপে বিরক্ত হন। তাদের সাথে মধুর সম্পর্ক অদৃশ্য গাঁজনে ধীরে ধীরে আম্লিক হয়ে যায়। চুপিসারে আনফ্রেন্ডও করে দেয় অনেকে। তাই কালেভদ্রে যা লিখতাম তা আমার পারসোনাল ব্লগ আগ পত্রিকা অফিসে পাঠাতাম। পত্রিকায় ছাপালে ছাপাতো, না ছাপালে খোঁজও নিতাম না। এই লেখালেখির সূত্র ধরেই একদিন নিশাতের টেক্সট আসলো।

“আপনি কি লেখক সালমান বক্সি?”

টুকটাক লেখালেখি করলেও লেখক তকমাটা তখনো গায়ে লাগেনি আমার। মনে মনে একটু খুশিই হলাম বৈকি। “হ্যাঁ আমিই সালমান বক্সি। তবে লেখক কিনা বলতে পারছি না”

কালবিলম্ব না করে মেয়েটা রিপ্লাই দিলো, “বাব্বাহ! এত্তো বিনয়! লেখকদের বিনয় থাকা ভালো।”

“আমি এতটা বিনয়ী নই। টুকটাক লিখি। সেগুলা লেখা হয় না বলেই হয়তো নিজেকে লেখক ভাবতে চাই না।”

“আপনার লেখা পড়েই কিন্তু আপনাকে খুঁজেছি। বেশ ভালো লেখেন আপনি!”

“ভালো বিষয়টা কিন্তু আপেক্ষিক। আপনার কাছে যা ভালো লাগে, অন্যের কাছে তা নাও লাগতে পারে!”

“আমার সাথে উচ্চমর্গীয় কথা বলবেন না। সব কথা বাইনারি কোডে বলবেন।”
“সেটা আবার কেমন?”

“সাহিত্যের লোকরা অবশ্য টেকনোলজিতে একটু দুর্বল হয়। ব্যাপার না। আমি সত্যকে ১ বলি আর মিথ্যাকে ০!”

“তাহলে আমি জিরো!”

“হিরোও হতে পারেন কিন্তু!”

“হিরো আলম?”

“ধরুন ওরকমই…”

এভাবেই নিশাতের সাথে আলাপ শুরু। দুরালাপ।

নিশাতকে কি আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম কিংবা নিশাত আমাকে?

আমাদের কখনো সরাসরি দেখা হয়নি এমনকি ফোনে কখনো কথাও হয়নি। তারপরও সে এক অদৃশ্যবলে আমার আপনজন হয়ে উঠেছিলো।

‘আপনি মানুষটা কেমন যেন।’

‘কেমন?’

‘খসখসে…’

‘শিরিষ কাগজের মতো?’

‘এর চেয়েও খারাপ!’

‘শিরিষ কাগজ খসখসে হলেও তা কিন্তু তা অন্যকে মসৃণ করে’

‘আপনি ঘষা দিলে মসৃণ না হয়ে দাগ কেটে যাবে!’

‘এত রাগের কারণটা কি শুনি?’

‘রাগ হবে না? প্রতিটা গল্পে আপনি হয় কেন্দ্রীয় চরিত্র গুলোকে মেরে ফেলেন কেন নতুবা ট্রাজিক এন্ডিং টানেন? কেন?’

‘নিয়তিই তো তাদের মৃত্যু ডেকে আনে।’

‘না আনে না। লেখক চাইলে কৌশলে নিয়তি বদলে দিতে পারেন। এটাই তো ফিকশনের শক্তি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখবো।’

‘চেষ্টা করে দেখবো এটা একটা মিথ্যে কথা। যখন কেউ কথা রাখতে পারে না তখন চেষ্টা করে দেখার কথা বলে। আদৌ তারা এ নিয়ে চেষ্টাই করে না।’

‘তো কি বলতে হবে আমাকে?’

‘কিছু বলতে হবে না। ফলাফল দেখতে চাই। একটি সুন্দর এন্ডিংয়ের গল্প লিখে আমাকে পাঠাবেন। আমি রিভিউ করে মার্কিং দেবো। ৮০ পাইলে পাশ!’

‘পাশ মার্ক ৮০ হয় কি করে? ৮০ তে তো এপ্লাস!’

‘উহু এত কথা বলা যাবে না। যা বলছি তাই করবেন।’

ইচ্ছে না থাকলেও অবশ্য অল্প শব্দে একটা হ্যাপি এন্ডিং এর গল্প লিখেছিলাম। নিশাতের স্কেলে ১০০ তে পেয়েছিলাম ৫৫! সে নম্বরের নিচে ফুট নোট লিখেছিলো- ‘উট দিয়ে হালচাষ হয় না!’

আমি অবশ্য লিখেছিলাম, ‘পাওয়ার ট্রিলারের কাজ পাওয়ার ট্রিলারকেই করতে দাও না! এর মাঝে নির্বোধ প্রাণীদেরকে নিয়ে টানাটানি কেন?’

এ ভাবেই আলাপ চলতে চলতে একদিন আমার ট্রাজিক গল্পের নায়িকাদের মতো নিশাতও হারিয়ে গেলো। হয়তো নিশাতের গল্পে সেটা হ্যাপি এন্ডিংই ছিলো। হঠাৎ একদিন নিশাতের মেসেজ এলো না। আমি নক দিলাম। রিপ্লাই এলো না। অপেক্ষা করলাম। তবুও এলো না। আমিও আর ঘাটালাম না। এভাবেই দেখতে দেখতে একদিন ফেসবুকে নিশাতের নামটা কালো হয়ে গেলো। নিচে ওয়ার্নিংসহকারে লেখা আসলো- ‘This person is unavailable on messenger!’

অন্য আরো অনেকের মতোই সেদিন থেকে নিশাত গত হয়ে গেলো!

তিন.

মা বলতেন মাঘের শীতে বাঘ কান্দে। অথচ মাঘ মাস পড়তে এখনো বেশ দেরী। শীত জাকিয়ে বসেছে। হাওলাদার সাহেব সূর্য ওঠার পরপরই গরম গরম ভাঁপা পিঠা আর খেঁজুর গুড় হাতে হাজির হয়েছেন। নতুন জায়গায় ঘুম খুব একটা ভালো হয় না আমার। চোখ বুঝে এসেছিলো কেবল, তখনই দরজায় কড়া নেড়েছেন তিনি।
“শীত উপভোগ করতে চাইলে তো কম্বলের নিচে থাকলে চলবে না ডক্টর সাহেব। উঠে পড়ুন। পিঠা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে…”

শুরুতে বিরক্তি এলেও শীতসকালে পিঠার কথা কানে আসতেই বিরক্তি ও ঘুম দুটোই পালিয়ে গেলো। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলে দু মিনিটে ফ্রেশ হয়ে হাওলাদার সাহেবের সাথে পিঠা গলাধঃকরণ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লাম। পাল্লা দিয়ে খাওয়া চলছে। পিঠা শেষ হওয়া মাত্রই উনি রিফিল করতে ছুটছেন রান্না ঘরের দিকে। মিসেস হাওলাদারের পিঠার হাত মন্দ না একেবারে!

পিঠা-ভোজন পর্ব শেষ হতেই হাওলাদার আমাকে নিয়ে চললেন তার সবজি ক্ষেতে। ফুলকপি, টমেটো, ব্রোকলি, পালং শাক কী নেই তার বাগানে! শিশির আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে সব। দেখেই চোখে কেমন যেন এক স্বর্গীয় প্রশান্তি চলে এলো। এরকম জীবন্ত সবজী দেখা হয়নি বহুদিন।

“আপনি তো দেখি যোগ্য কৃষিবিদ মশাই! বিদ্যার সফল প্রয়োগ যাকে বলে আরকি!”
“কী যে বলেন না! আমার এসব দেখার সময় কই! এসব আপনার ভাবির নির্দেশে হয়েছে। একটা ছেলে আছে। ঐ সব দেখভাল করে।”

“ভাবিও কৃষিবিদ নাকি?”

“আরে নাহ! সে ইঞ্জিনিয়ারিং এর মানুষ। তবে কৃষির প্রতি টানটা কম নয়।”

হেসে বললাম, “তা তো দেখতেই পাচ্ছি! এত শত মানুষের ভীড়ে সে কৃষিবিদকেই বেছে নিয়েছে!”

আমার কথায় হাওলাদার সাহেবের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে এলেও খানিকবাদেই ম্লান হয়ে গেলো। মুখে মেকি হাসি এনে বললেন, “এই ক্ষুদ্র জীবনে কে যে কাকে বেছে নেয়, বলা মুশকীল!”

ভদ্রলোককে আর ঘাটালাম না। প্রসঙ্গ পালটে উনিই জিজ্ঞেস করে বসলেন, “আচ্ছা নিশাতের কি বিয়ে হয়েছে?”

এমন আচমকা আক্রমণে শুরুতে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। “না। অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার পর আর খোঁজ রাখা হয়নি।”

“সে কি! মেয়েটাকে তো জান দিয়ে ভালোবাসতেন আপনি! এভাবে ভুলে গেলেন!”

নিজেকে ও মিস্টার হাওলাদারকে একযোগে প্রশ্ন করলাম, “ভালোবাসতাম নাকি?”

নিশাতকে ভালোবেসেছি বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, অবশ্য একটা ভালো লাগা কাজ করতো। কথা বলতে ভালো লাগতো। দিনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা নিয়ে স্বল্পপরিসরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলতো। এর তো বেশি কিছু না। কখনো তো বলাও হয়নি, “নিশাত তোমার হাসিটা খুব সুন্দর। কিংবা এই মেরুন ড্রেসটায় তোমাকে পরীর মতো লাগছে।”

এটাকে কি জান দিয়ে ভালোবাসা বলে?

হাওলাদার আমার প্রশ্নে তাজ্জব বনে গেলেন। “বাসতেন না? আমার সোর্স তো তা বলছে না।”

আমি আবার অস্বস্তিতে পড়লাম। “দয়া করে কি বলবেন নিশাতের সাথে আপনার সম্পর্কটা কোথায়?”

হাওলাদার মুখ চেপে হেসে বললেন, “আমার কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক তো আপনার সাথে। আমি ফোর্থ সাবজেক্ট!”

আমি কিছুটা গলা চড়িয়ে বলে ফেললাম, “ফোর্থ সাবজেক্ট মানে?”

“কোন সাবজেক্টে এপ্লাস মিস গেলে সে প্রক্সি দেয়, আর সব সাবজেক্টে এপ্লাস পেলে যাকে কেউ গোণায় ধরে না! এরকম আরকি!” -মুখে হাসি রেখেই হাওলাদার উত্তর করলেন।

আমি মরিয়া হয়ে বললাম, “আপনি কি দয়া করে একটু খোলাসা করবেন? আপনার এমন আচরণে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে!”

হাওলাদার সাহেব রহস্যজনক ভঙ্গিতে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলেন। সময় হলে সব জানতে পারবেন। আপাতত শীতের সবজি দেখুন। এমন ফ্রেশ সবজি ঢাকাতে কখনো পাবেন না! ট্রান্সপোর্টেশনে কোয়ালিটি ব্যাপক ডিটোরিয়েট করে।
ফুরফুরে মনটা নিশাতের অনাকাঙ্খিত আগমনে অস্থির হয়ে উঠলো। মিস্টার হাওলাদার লোকটা আসলে কে?

দুপুর গড়িয়ে গেছে কখন টের পাইনি। ঘন কুয়াশা আর শিরশিরে বাতাসে সময় এলোমেলো হয়ে গেছে। মিস্টার হাওলাদার মুখে হাসিমেখে বললেন, “চলুন আপনাকে একটা জায়গা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”

আমি বাধা দিয়ে বললাম, “এখন থাক না। লাঞ্চের পর বেরোবে এখন।”
হাওলাদার মৃদু হেসে বললেন, “আমাদের লাঞ্চ তো ওখানেই। আপনার দাওয়াত আছে!”

আমার দাওয়াত অথচ আমিই জানি না! অবাক হলাম না। গ্রামে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কারো বাড়িতে নতুন অতিথি এলে পাড়া প্রতিবেশীরা দাওয়াত করে খাওয়ায়। দেশী মুরগি, কালোজিরা চালের পোলাও, বেগুন ভাজি, ডিম ভুনা… আহা! ভাবতেই জিবে জল চলে আসে। এককালে এমন দাওয়াত খেয়েছি কিনা!

উৎসাহ চেপে বললাম, “এমন ধুলোমাখা পা নিয়ে কেউ দাওয়াতে যায়? একটু ফ্রেশ হয়ে গেলে ভালো হতো না?”

“গাঁ-গ্রামের মানুষ ধুলোকে আলাদা করে না বক্সি সাহেব। নিজেদেরই অংশ মনে করে। ভয়ের কিছু নেই।” –হাওলাদার টিপ্পনি কেটে আমাকে থামিয়ে দিলেন।

এমন টিপ্পনির পর আর বলার কিছু থাকতে পারে না। বহুদিন পর একসময় গ্রামের বাড়ি গেলে এবাড়ি ও বাড়ি থেকে দাওয়াত দিয়ে যেত। নতুন জামাইয়ের মতো সে দাওয়াত! কতদিন হয়ে গেলো গ্রামের দিকে আর যাওয়াই হয় না। গ্রামের বাড়িটা বিক্রি করে দেবার পর কেন যেন আর মন টানেনি। আচ্ছা আমাকে কি এখনো মনে রেখেছে মানুষগুলো? হঠাৎ যদি একদিন গিয়ে উপস্থিত হই তবে কি তারা আমাকে দেখে আগের মতোই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে? নাকি হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলবে, “তুমি কে হে বাপু?”

“কি বক্সি সাহেব? চুপচাপ কেন? বিপদে ফেলে দিলাম নাকি?”

“আরে কি যে বলেন! দাওয়াত পাওয়া তো সৌভাগ্যের বিষয়। আচ্ছা খালি হাতে যাওয়াটা ঠিক হবে কি? আশেপাশে মিষ্টির দোকান টোকান নেই?”

“শহরে আছে, এখানে নেই। তবে দই পাওয়া যেতে পারে। দই হলে চলবে?”

“নাই মামার চেয়ে দই মামাই ভালো।” বলে হো হো করে হেসে উঠলাম। মিস্টার হাওলাদারও হাসিতে যোগ দিলেন।

মিনিট দশেক হাঁটাহাঁটি করার পর দইয়ের সন্ধান পেলাম। হোমমেড দই। দামে সস্তা, মানে ভালো! হোমমেড দইয়ের পলিথিনের প্যাকেট আমার হাতে তুলে দিয়ে কড়া নাড়ার বালাই ছাড়াই মিস্টার হাওলাদার হনহন করে একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন। আমি দুপায়ের উপর সমান ভর দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করতে করতেই বাইরের ঘরের দরজাটা খুলে গেলো। দরজা খুলে যে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো, তাকে দেখার জন্য আমি কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না! হারুন! আমার একসময়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। সব সময়েরও বলা যায়!

একটা বাজে দিনের পর আর দেখা হয়নি আমাদের। হারুনের সাথে কথা হলো। মধুর কথা, উত্তপ্ত কথা। মধুর কথা চলতে চলতে হঠাৎ কথা কাটাকাটি। আমি বললাম, ‘তুই অযথা অপমানিত হতে যাচ্ছিস। নিলু তোকে বন্ধু হিসেবে পছন্দ করতে পারে, কিন্তু ভালোবাসে না।’

“আচ্ছা বলতো তোর প্রব্লেমটা কি? অপমানিত হলে আমি হবো, তোর তাতে কি?”
“আমার অনেক কিছু। তোর সাথে আমি রিলেটেড। আমি চাইনা নিলুর সাথে আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হোক।”

“তুই ভালোভাবেই জানিস যে আমি আর নিলুকে বন্ধু ভাবতে পারছি না। বন্ধুত্ব আর প্রেম- দুটো অনুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা।”

“তুই এত ফিলিংসবিদ হলি কবে থেকে? সামনে জব এক্সাম আছে। কোয়ালিফাই না করলে অনুভূতি স্পেসশিপ ছাড়াই পৃথিবী ছেড়ে পালাবে।”

“সে এক্সাম তো তোরও আছে। নিজের চড়কায় তেল দে। আমাকে নিয়ে না ভাবলেও চলবে।”

“না ঠিক আছে। এতদিন পর তোর চড়কা আর আমার চড়কা ভিন্ন হয়ে গেলো। ভালো।”

“ভিন্ন তো তুই করছিস। সেই শুরু থেকেই নিলুর বিষয়ে তুই আমাকে ডিমোটিভেট করছিস। আচ্ছা বলতো ভেতরে ভেতরে কিছু হচ্ছে নাকি? কারণটা কি?”

“আশ্চর্য তো! কি হবে?”

“মানে তোর আর নিলুর মাঝে ইটিশ-পিটিশ”

“ফালতু কথা একদম বলবি না হারুন। নিলু শুনলে কষ্ট পাবে।”

“না বুঝতে পেরেছি, আর বলতে হবে না।”

আমার গলার স্বর মিইয়ে এলো, মুখ উত্তাপে লাল হয়ে গেলো। হারুনের কাছে এক কথায় দুই কথায় ধরা পরে গেলাম। হারুন হো হো করে হাসলো। সুখে না দুঃখে বুঝতে পারলাম না।

পরদিন দুপুরে হারুনের রুমে গিয়ে দেখি হারুন নেই। কতবার যে ফোন দিয়েছি তার হিসেব রাখিনি। বেয়াদবটা একটাবারের জন্যও ফোন ধরেনি। পরদিন শুধু এসএমএস দিয়েছিলো একটা।

“সামনে এক্সাম না? পড়াশোনা কর। আমিও সিরিয়াস হতে বাসায় চলে এসেছি। বাড়িতে কিছু কাজও জমে ছিলো। ঢাকা গেলে দেখা হবে। টাটা…’

দেখা আর হয়নি আমাদের। হারুন ফোন নাম্বার বদলে পর হয়ে গিয়েছিলো খুব দ্রুতই। আমিও অভিমানে আর যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। তারপর হুট করেই অস্ট্রেলিয়া থেকে অফার লেটারটা পেলাম। দুই মাসের মধ্যেই দেশ থেকে ফুড়ুৎ!
নিলু আমাদের বন্ধু ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে আমরা একসাথে কাজ করতাম। আমরা ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, আর নিলু ছিলো ইডেন কলেজের। অর্গানাইজেশনের প্রোগ্রামে দেখা তো হতোই, এছাড়াও নানান অযুহাতে আমাদের দেখা হতো প্রায়ই। হারুন চলে যাওয়ার পর মোটেই তিন বার দেখা হয়েছিলো আমার সাথে। শেষ দেখাটা হয়েছিলো ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে, একটা রেইনট্রি গাছের নিচে।

‘একটু সময় হবে তোমার? ধরো ঘন্টাখানেকের মতো’

‘শোন, আমি বেকার মানুষ। অফুরন্ত সময় নিয়ে চলাফেরা করি। সো, সময়ের কোন অভাব নেই আমার’

‘কত নারী ভক্ত তোমার। প্রতিজনকে ৫ মিনিট করে সময় দিলেও তো তোমার ঝুলিতে সময় থাকার কথা না। তার উপর আবার প্রবাসী হচ্ছো। কত্ত ব্যস্ততা…’

‘তা অবশ্য মিথ্যে বলোনি। তবে তোমার জন্য দিনের পুরো ১৪৪০ মিনিটই আমি ফ্রি!’

‘ও মা! বলে কি ছেলে! নিশাত জানে তো?’

‘আবার শুরু করলে? আচ্ছা, কটায় আসবো?’

‘পাঁচ টায়…’

ঠিক পাঁচটা বাজার পনেরো মিনিট পরে নিলুফার এসেছিলো। মলিন মুখে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলেছিলো, ‘নাও বাদাম খেয়ে ওজন কমাও। ফ্লাই করবে দুদিন পর। ওজন বেশি হলে এরোপ্লেন তো ইমব্যালেন্স হয়ে যাবে!’

বাদাম হাতে নিয়েই বললাম, ‘কি হয়েছে এবার বলো?’

‘কি আর হবে? এমনিই ভালো লাগছিলো না। ভাবলাম একটু দেখা করে আসি। আমাদের ছেড়ে চলেই তো যাচ্ছো।’

‘আচ্ছা, তাহলে বলবে না? না বললে তো ডাকাডাকির দরকার ছিলো না।’

‘আজব তো। কি বলবো?’

‘আমার সাথে লুকোচুরির চেষ্টা করবে না। তোমার মুখ বলছে কিছু একটা হয়েছে?’

‘আচ্ছা, তুমি কি সবার মুখ দেখেই সব বলে দিতে পারো?’

‘না। সবার পারি না। শুধু নিলুফা কাদিরেরটা পারি’

আমার কথা শুনে নিলু মুচকি হাসলো। “এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। বসো। আগে বাদাম গুলো শেষ করি। তারপর বলছি।”

একের পর এক বাদামের খোসা জমতে থাকে আমাদের সামনে। সাথে ছুটতে থাকে আমাদের কথার ফুলঝুড়ি।

‘আচ্ছা, তোমার ফ্লাইট যেন কবে? ২৩ মার্চ না?’

‘হ্যাঁ। রাতে, ১ টায়।’

‘তাহলে তো অনেক সময় হাতে তোমার! চাইলে কিন্তু বিয়েটা সেরেই যেতে পারো!’
‘আচ্ছা, বিয়ে ছাড়া তোমার আর কোন কথা নেই? মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই কি বিয়ে করা নাকি?’

‘আহা রেগে যাচ্ছো কেন? মেয়েটাকে অপেক্ষায় রেখে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?’
‘কোন মেয়েটা?’

‘ওমা কতজনকে লাইনে রাখছো? আমি তো শুধু নিশাতকেই জানতাম!’

‘আবার নিশাত! শোন, নিশাতকে আমার গার্ল ফ্রেন্ড বানিয়েছো তুমি। আমি বানাইনি।’

‘তবুও তো গার্লফ্রেন্ড নাকি!’

‘হ্যাঁ গার্লফ্রেন্ড, যে নিজেও জানে না তার বয়ফ্রেন্ড আছে! এত গুজববাজ কেন তুমি?’

‘গুজব নয়, গুজব নয় সত্যি। নিশাতকে ভালোবাসো এটা কিন্তু মিথ্যে নয়।’

‘হ্যাঁ শতভাগ মিথ্যে। পছন্দ আর ভালোবাসা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এতটুকু বোঝার মতো ঘিলু তো তোমার মাথায় আছে আশা করি!’

‘না আমি তো আর চিকন বুদ্ধির লেখক না যে সবকিছু আলাদা করে দেখবো। আমার মতে যাকে পছন্দ করা যায়, তাকে ভালোবাসাও যায়।’

‘আচ্ছা আমার কথা বাদ দাও। তুমি বিয়ে করছো কবে?’

‘আমি? আমার ওসব বিয়ে টিয়ে করার ইচ্ছে নাই। তবে বাসা থেকে যে ফোর্স দিচ্ছে সেটা রেজিস্ট করার স্ট্রেন্থ আমার নেই।’

‘দেখো ২৩ তারিখের আগে রাজি হওয়া যায় কিনা। প্রবাসী হলে বিয়ে খাওয়া কপালে জুটবে কিনা কে জানে!’

‘প্রবাসে মানুষ বুঝি বিয়ে করে না?’

‘আরে মানুষের বিয়ে খেয়ে আমি কি করবো। তোমার বিয়ের কথা বললাম।’

‘বিয়ে বিষয়টা এত সহজ নয় সালমান। অচেনা অজানা একটা লোককে হুট করে আপন করে নেয়া খুব কঠিন একটা বিষয়।’

‘তাহলে চেনা মানুষ খোঁজো।’

‘চেনা মানুষ হলেও হয় না, কমন মানুষ হতে হয়। কমন মানুষ বলতে কমন ইন্টারেস্টওয়ালা মানুষ। কমন ইন্টারেস্ট না থাকলে সম্পর্ক না এগোয় না। কথা বলে শান্তি পাওয়া যায় না।’

‘হু’

‘এই দেখো তোমার সাথে আমার কমন ইন্টারেস্ট না মিললে আমরা কি বন্ধু হতে পারতাম?’

‘কি জানি। জানি না।’

‘আচ্ছা জানতে হবে না। বাদাম শেষ, দিনের আলোও শেষ। এবার পালাই…’

‘পালাই মানে? বাদাম খাওয়া শেষে বলতে চাইলে যে!’

‘ “আমার বলার কিছু ছিলো না…” হা হা! এমনি বলছিলাম। কিছু বলার নেই’
‘আজব মহিলা দেখছি! আচ্ছা ফ্লাইটের আগে একবার দেখা দিও…’

‘সেটা উপরওয়ালার ইচ্ছে। আমার অবশ্য তেমন ইচ্ছে নেই…’ বলে ঠোঁট বাঁকানো হাসি দিয়ে নিলু চলে গিয়েছিলো।

এ চলে যাওয়াটাই ছিলো নিলুর শেষ যাওয়া। ২৩ মার্চ সকালে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিলাম নিলুকে। নিয়ম মেনে ত্রিশ সেকেন্ড ধরে ফোন বেজে গেছে। নিলু ধরেনি। বিকেলের ফোনটা অবশ্য রিসিভ হয়েছিলো। একটা পুরুষ কণ্ঠ বলেছিলো, ‘আপু পার্লারে। ফোনটা ভুলে বাসায় রেখে গেছেন। আপনি আসছেন তো বিয়েতে?’
‘কার বিয়ে?’

‘কেন? আপুর! আপু যে বললো আপনি আসছেন!’

‘বলেছে নাকি? আমি আজ রাতের ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি। নিলুকে বলবে আমি ফোন করেছিলাম।’

নিলুর ছোটভাই নিলুকে বলেছিলো কিনা জানি না। তবে নিলু আর ফোন করেনি। ২৩ মার্চ, ২০১২। বুকচাপা অস্বস্তি নিয়ে সেদিন দেশ ছেড়েছিলাম।

রাগ বা অভিমান বিষয়টার সাথে ঘনিষ্ট পরিচয় না থাকলেও নিলুর উপর বেশ অভিমান হয়েছিলো আমার। মাটির মানুষ এত কঠিন হৃদয়ের হয় কি করে?
কোনদিন আর নিলুর সাথে যোগাযোগ করবো না বলে শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই অস্ট্রেলিয়া থেকে নিলুকে কল করেছিলাম। যান্ত্রিক কণ্ঠে দুঃখ প্রকাশ করে এক ভদ্রমহিলা নিরলস বলে গেছে “আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মূহুর্তে বন্ধ আছে!” ফেসবুকে ইরেগুলার হলেও নিলুর একটি ফেসবুক আইডি ছিলো। শতশত বার সার্চ দিয়ে সেটিও খুঁজে পাইনি। ডিলিট না ডিএক্টিভেট করেছিলো কে জানে! সব দিক দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েও মনে একটু আশা জিইয়ে ছিলো। নিলুর একদিন নিশ্চয় দেখা হবে। টেকনোলজির এ যুগে মানুষ চাইলেও পুরোটা উধাও হতে পারে না।

দেশে ফিরে চুপিসারে নিলু আর হারুনকে খোঁজার চেষ্টা করেছি। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ছিলো হারুনের বাড়ি । তেঁতুলিয়া মফস্বল শহর। হারুনকে খুঁজে পাওয়া হয়তো কঠিন হবে না। এটা ভেবেই পঞ্চগড়ের পথে রওয়ানা দিয়েছিলাম। শীত দেখা, কলাবেচা একসাথে হওয়ার আশায়!

আমাকে দেখে হারুনের চোখ ছলছল করে উঠলো। আমার চোখও কখন আর্দ্র হয়েছে টের পাইনি। সব রাগ অভিমান ভুলে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম হারুনকে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলাম দুজনই।

নিরবতা ভেঙ্গে আমিই কথা বললাম।

‘আমাদের এভাবে যে দেখা হবে কখনো ভাবি নি’

‘আমিও’

‘এখনো কি রাগ জমিয়ে রেখেছিস?’

‘রাগ জমেছিলো কিনা জানি না। তবে তীব্র অনুশোচনা হতো মাঝে মাঝে’

‘জানিস, আমার না মাঝে মাঝে কান্না পেত খুব’

‘এত রিয়্যাক্ট কেন করছিলাম সে হিসেবটা আজও মেলাতে পারি না।’

‘বাদ দে তো এসব। বয়স কম ছিলো তখন! এখানে কি করিস? আমি তো তোর খোঁজে পঞ্চগড় যাচ্ছিলাম!’

‘তাই নাকি! আমি তো পঞ্চগড় ছেড়েছি সেই কবেই। বাবার মৃত্যুর পর বেশ কয়েক বছর ময়মনসিংহ ছিলাম। সেখানেই সোহেলের সাথে পরিচয়। তারপর সোহেলের হাত ধরে এখানে আসা।’

‘এখানে কি করিস?’

‘ময়মনসিংহে যা করতাম ওটারই আপডেটেড ভার্সন। ওখানে কোচিং খুলে মাস্টারি করতাম আর এখানে একটা কলেজে।’

‘বাহ! তোর মতো মেধাবীদেরকে শিক্ষকতাতেই মানায়।’

‘ধুর। চাকরি জোটেনি তাই মাস্টারিতে আসা। সোহেলের দাদার কলেজ। বলতে গেলে একপ্রকার সুপারিশেই হয়েছে চাকরিটা।’

সোহেল হাওলাদার বাঁধা দিয়ে বললো, ‘ছি ছি কি বলেন না হারুন ভাই। আপনার মতো মানুষের জন্য সুপারিশ লাগে নাকি!’

হারুনের চোখের ছলছল ভাবটা এখনো কাটে নি। আমি ওর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘বিয়ে তো করেছিস নাকি?’

‘সেই কবে। হাফ হালি বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছে!’

‘বলিস কি? কোথায় ওরা?’

‘তোর লাকটাই খারাপ। আজকেই ওদের মা-সমেত নানা বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। কাল একটু বাইরে যাবো তো। যাবি নাকি?’

‘কোথায়?’

সোহেল হাওলাদার এক প্রস্থ হেসে বললেন, ‘আপনাকে তো বলাই হয়নি। আমাদের একটা অর্গানাইজেশন আছে। ভলান্টারি অর্গানাইজেশন। মাঝে মাঝে ফান্ড কালেকশন করে আমরা অভাবী মানুষদের পাশে দাড়াতে চেষ্টা করি। কাল হারুন ভাই যাবেন কিছু কম্বল নিয়ে রাজশাহীতে।’

আমাদের পুরনো সংগঠন “বন্ধন” এর কথা মনে পড়লো। আমি ছিলাম প্রেসিডেন্ট, হারুন ভাইস প্রেসিডেন্ট আর নিলু সেক্রেটারি। আমি অবাক চোখে হারুনের দিকে তাকালাম?

‘বন্ধন?’

হারুন প্রশান্তির হাসি হেসে বললো, ‘হ্যাঁ রে, ছাড়তে আর পারলাম কই?’

স্মৃতিকাতর হয়ে গেলাম হঠাৎ করে। নিজেকে অপরাধীও মনে হলো।
‘আমাদের প্রাক্তন সেক্রেটারির সাথে আর যোগাযোগ হয়েছিলো?’

সেক্রেটারি শব্দটা কিছুটা জড়িয়ে গেলো মুখে। হারুনের চোখ এড়ালো না বিষয়টা। সে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘যতদূর শুনেছি, ডিভোর্সের পর ভালোই আছে!’

ডিভোর্সের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। ‘কী বলিস এসব?’

হারুন কিছুটা অবাক হয়েই বলে ফেললো, ‘কেন? দেখা হয়নি তোদের?’

আমি মুখটা হালকা প্রসারিত করে বললাম, ‘বাদ দে ওসব…’

মিস্টার হাওলাদার এগিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করলেন। “হারুন ভাই, ফ্রিজ খোলেন, দেখি ভাবি কি কি রান্না করে রেখে গেছেন!”

চার.

হারুনের বাসা থেকে বেরুতে বেরুতে বেশ রাত হলো। ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা পঁয়ত্রিশ। শীতের রাত। হু হু করে শীতল বাতাস বইছে। বাতাসের ছোঁয়া গিটগিট শব্দে কাঁপন তুলছে শরীরে। সোহেল হাওলাদার সহাস্যে প্রশ্ন করলেন, “কি বক্সি সাহেব, সিরাজগঞ্জের শীত কেমন?”

দাঁতের কাঁপাকাঁপি কোন রকমে সামলে বললাম, ‘হাড়-মাংস কাঁপানো শীত!’
হাওলাদার আমার উত্তর শুনে প্রশান্তির ঢেকুর তুললেন। যেন শীত তার বাসায় বানানো ভাঁপা পিঠা, আমাকে খেতে দিয়েছিলেন! মুখে হাসি রেখেই হাওলাদার বললেন, “বক্সি সাহেব, যদি অভয় দেন তবে একটা কথা বলি।”

আমি ফুরফুরে মেজাজে বললাম, “আশ্চর্য তো! এত ফর্মালিটিজ কেন? নিঃসঙ্কোচে বলে ফেলুন।”

হাওলাদার আমতা আমতা করতে বললো, “ইয়ে মানে আপনার জন্য একটা বিয়ের প্রোপোজাল আছে। যদি আপনার আপত্তি না থাকে আরকি।”

আমি মেকি হাসি দিয়ে সরাসরি প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করে দিলাম, “না হাওলাদার সাহেব। বিয়ে টিয়ের ঝামেলায় আর যাবো না। একা আছি, বিন্দাস আছি।”

আমার প্রত্যাখ্যানের ধার না ধেরে হাওলাদার আমাকে সরাসরি ভড়কে দিলো, “মেয়ে কিন্তু আপনার পূর্ব-পরিচিত”

হৃদপিন্ডটা ধক্ করে উঠলো। “আমার পরিচিত মানে?”

“কেন আপনার পরিচিত হতে পারে না? কত জানাশোনা আপনার।”

এই তীব্র শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি টের পেলাম। গা টা ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠলো হঠাৎ।

“কি বক্সি সাহেব? শীত করছে?”

কাঁপুনি আড়াল করে বললাম, ‘আপনি কি আমার সাথে রসিকতা করছেন?’
“ছি। এমন কেন ভাবছেন? ভাগ্যই আমাদের সাথে মাঝে মাঝে রসিকতা করে। যদি তাই না হবে তবে কেনই বা ট্রেনে আপনার সাথেই আমার দেখা হবে এবং সেই দেখা হওয়া আপনাকেই আমি আমার ডিভোর্সি বোনের জন্য বিয়ের প্রোপোজাল দিয়ে বসবো!”

হাঁটার শক্তি হারিয়ে হঠাৎ যেন পা দুটো থেমে গেলো। “আপনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কার কথা বলছেন?”

“কার কথা আর বলবো? আমার একটা পাগলী বোনের কথা বলছি। যে কোন এক অখ্যাত সালমান বক্সীকে ভুলতে পারছিলো না বলে বিয়ের একমাসের মাথায় স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছে। তারপর পুরনো কিছু বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে সমাজ সেবা করে বেড়াচ্ছে!” ভারি ও গম্ভীর গলায় লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা গুলো বললো সহেল হাওলাদার।

ঘটনার আকস্মিকতা আমাকে মুহূর্তেই পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিলো। ধকধক শব্দে হার্টবিট বাড়তে থাকলো। গলা ধরে এলো। ফিসফিসিয়ে বললাম, “নিলু?”

হাওলাদার আবছা অন্ধকারে মাথা নাড়লেন। আমি কাঁপা গলায় বললাম, “কোথায় সে?”

হাওলাদার প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললো, “এত অস্থির হচ্ছেন কেন! আপনাকে তো সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি।”

হার্টবিট বাড়ছে। পায়ে জোর পাচ্ছি না। তবুও হাওলাদার সাহেবের পিছু পিছু এবড়ো থেবড়ো পায়ে এগুচ্ছি।

“সকালে যে ভাঁপা পিঠার ভূয়সী প্রসংসা করলেন সেটা কিন্তু নিলু আপাই বানিছিলেন!”

“আচ্ছা, আমি যে এখানে এসেছি, নিলু কি জানে?”

হাওলাদার খুব সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো, “নাহ! এখন জানবে!”

গা টা আরেকবার গিঁটগিঁট করে কেঁপে উঠলো। শিরিশিরে বাতাস বইছে তো বইছেই…

আচ্ছা, উত্তরের শীত এত খারাপ হয় কেন?

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন