বিজ্ঞাপন

জুঁই মনি দাশ-এর গল্প ‘অপেক্ষা’

May 3, 2022 | 9:19 pm

বাড়ির কথা মনে পড়লেই ইমরানের হাঁটার গতি স্লথ হয়ে আসে, একটা জগদ্দল পাথর বুকের উপর চেপে বসে।তবু অফিস থেকে মেসে ফেরার পথে রোজ বাড়ির কথা মনে পড়ে। ঠিকঠাক গতিতে হাঁটলে ত্রিশ মিনিটের পথ। সকালে সে ত্রিশ মিনিটের আগেই পৌঁছে যায়। লেট মার্কের তাড়া থাকে, তিনদিন দেরি করে অফিসে গেলে একদিনের বেতন কাটা যায়।স্বস্তির ব্যাপার হলো বিশেষ ঝামেলা না থাকলে ছুটি পাঁচটায়ই হয়।সারাদিন বদ্ধ ঘরে এসির বাতাসে ইমরানের অস্বস্তি লাগে। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়। ছুটির পর সে লিফটে নামে না। আস্তেধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামে। সকালবেলায় হন্তদন্ত হয়ে অফিসে এসে সবাই বসের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে কিন্তু ফেরার সময় নিজের তাগিদেই তাড়াহুড়া করতে থাকে। ইমরানের ফেরার তাড়া থাকে না। অফিস কলিগরা সবাই ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে বলে, তোমার বালবাচ্চা নাই, মৌজ-মাস্তির সময়। বিয়াশাদি করছ তো জীবন বরবাদ। বিয়া মানে কলুর বলদের মতো ঘানির জোয়াল কাঁধে নিয়ে আমৃত্যু ঘুরতে থাকা।

বিজ্ঞাপন

দুপুরের খাবারের সময় অবশ্য বিবাহিত জীবনের সুখ টের পাওয়া যায়। ইমরান দুপুরের খাবারটা হোম ডেলিভারি থেকে নেয়। নানান খাবারের প্যাকেজ আছে। সে ডাল, মাছ, সবজি, ভর্তা, ভাজি এসবই খায়। মেসের বুয়ার রান্না খেয়ে খেয়ে মুরগির মাংস আর ডিমে অরুচি ধরে গেছে। ষাট টাকার প্যাকেজে তার মধ্যাহ্নভোজন হয়। প্রায় সবারই বাড়ি থেকে খাবার আসে। বাক্স খুললেই সুগন্ধের জাদুর বাক্স খুলে যায়। মাঝে মাঝে ভাগ পাওয়া যায়। রিয়া আর ফারজানা আপু তো যত্ন করে প্লেটে দিয়ে যায়।জোবায়ের ভাইও জোরাজুরি করে কিছু না কিছু দেয়। ইমরানের অস্বস্তি হয়। রোজ রোজ অন্যের খাবারে ভাগ বসাতে ইচ্ছে করে না। দেড় বছর ধরে সে এই অফিসে আছে কিন্তু জড়তা এখনো কাটেনি। একে তো চাকরিটা এখনো স্থায়ী হয়নি, দ্বিতীয়ত এই শহুরে জীবনের জটিল ধাঁধায় সে স্বচ্ছন্দ্য হতে পারে না। পারিবারিকভাবে চূড়ান্ত রক্ষণশীল পরিবেশে সে বেড়ে ওঠেছে। পরিবারের সদস্যরা মিলে হৈ-হুল্লোড় বা হাসি-আনন্দ আড্ডার অভিজ্ঞতা তার নেই।সবকিছুই খুব নিয়ন্ত্রিত ছিল।ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করলেও এই শহরে তার বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। ছোটবেলা থেকে পড়ার নেশা ছিল। পরে লেখালেখিও শুরু করে। সেইসূত্রেই প্রুফ রিডারের চাকরিটা তার জুটেছে।

আঠারতলা ভবনের নয়তলায় ইমরানের অফিস। সিঁড়ি বেয়ে ওঠা কঠিন; সে তুলনায় নামা বেশ সহজ। যেকোনো পতনই সহজসাধ্য ব্যাপার। উত্থান আয়াসসাধ্য।সচরাচর কেউ সিঁড়ি ব্যবহার করে না। ব্যস্ত অফিসের এই অংশটা নীরব ও নির্জন।অফিস ছুটির পর লিফটের সামনে লম্বা লাইন থাকে। কোনো কোনোদিন ইমরান নেমে গেলেও লাইনে তার কলিগরা দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকে লিফট ছাড়া বাসার ছয়তলায় থাকে, তারাও কেউ ভুলেও সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় না।মানুষের আরামপ্রিয়তার নেশায় দুনিয়া জেরবার হয়ে গেল। ইমরানের ভিড় ভালো লাগে না। মাথার মধ্যে তীব্রবেগে কত ধরনের চিন্তা যে ছুটতে থাকে, জ্যাম লেগে যায়।আপাত নিরীহ, শান্ত চেহারার ইমরানের মাথায় সারাক্ষণ বুলেট ট্রেন চলতে থাকে। ইমরানের বাবা বলতেন, দুশ্চিন্তার চেয়ে ভয়ানক হলো অতিচিন্তা। কোনোকিছু নিয়ে বেশি ভাবাভাবির কিছু নাই। বেশি ভাবলে ভুল বেশি হয়।মন আর মাথা একসাথে কাজ করলে কাজটা নির্ভুল হয়। অতিচিন্তায় মন বিক্ষিপ্ত হয়। বিক্ষিপ্ত মন হলো ভাঙা আয়না; যার প্রতিবিম্ব মানুষকে কেবল বিভ্রান্ত করে।মানুষ যা বলে তা কি নিজে বিশ্বাস করে? না, বলার জন্য বলে? তার রাশভারী বাবা তো সব ভার একা নিয়ে ভেবে ভেবেই একদিন হারিয়ে গেলেন।

ফুটপাত ধরে হাঁটলে কত বিচিত্র দৃশ্য যে চোখে পড়ে! সাড়ে তিন হাত জায়গার মধ্যেই কতজন সংসার পেতে বসে দিব্যি লাকড়ি জোগাড় করে রান্না করছে। এরমধ্যেই শিশু খেলছে, নারী-পুরুষ আদিম আনন্দে মাতোয়ারা হচ্ছে। ইমরানের আগে অস্বস্তি হত, আজকাল সে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। আস্তাকুঁড়ের পাশে বসেও খুনসুটিতে মেতে থাকা যায়, সব অভ্যাস।অফিসটাও তো একটা বড়সড় আস্তাকুঁড়। প্রত্যেকের জন্য আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুটের টেবিল বরাদ্ধ। এত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলে নিজের নিঃশ্বাসও তো গোপন করা যায় না। এরমধ্যেই অহর্নিশ চলে আনুগত্য আর আধিপত্যের লড়াই। আগ্রাসী প্রেম দখল করে নেয় নতজানু শরীর আর মন।সেখানেও খুনসুটি আছে, সব তিক্ততা আড়াল করা উচ্ছ্বাস আছে। ইমরানের মনে হয় একটাই গল্প ভিন্ন ভিন্ন পর্দায় ভিন্ন ভিন্ন নামে দেখানো হচ্ছে। এসব ভাবলে তার মাথার ভেতর যন্ত্রণা হয়।তবু ভাবনা পিছু ছাড়ে না।

বিজ্ঞাপন

মাঝে মাঝে ইমরানও এই শহরের অংশ হয়ে ওঠে। সম্পর্কের জাল কেটে সে কবেই মুক্ত হয়ে গেছে তবু মাকড়সার জালের মতো এই শহর তাকে আঁকড়ে ধরে। ফুটপাতের ভ্রাম্যমাণ হাটে বেচাকেনা চলতেই থাকে। ইমরানের সেসবে আগ্রহ নেই। তার প্রয়োজনের সংখ্যা সীমিত। এ ব্যাপারে সে স্বৈরাচারী, কোনোভাবেই চাহিদা বাড়ানো যাবে না, কোনো উস্কানিতেই না। তবু ‘ভাই‘ বলতেই তার কান সজাগ হলো। তাকিয়ে দেখলো একজন খেজুর দামাদামি করছে। সৌদি আরবের খেজুর এখন দেশে চাষ হয়, গাছপাকা হলে বেশ সুস্বাদু। পাকা টসটসে খেজুর দেখে সে থামলো। চারশ টাকা কেজি। এক কেজির নিচে দোকানদার বিক্রি করবে না। যে লোকটা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সেও এই বিপদে পড়েছে। এক কেজি কেনার টাকা নাই, তার ছেলের খুব প্রিয় তাই কারও সাথে ভাগাভাগি করে কিনতে চায়। ইমরান চারশ টাকা দিয়ে দোকানদারকে বললো, দুইটা পলিথিনে ভাগ করে দিতে। লোকটা সকৃতজ্ঞ হাসি দিয়ে তাকে দুশো টাকা এগিয়ে দিল। কী মনে করে কে জানে ইমরান জিজ্ঞেস করলো, আপনার ছেলের নাম কী? লোকটা স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলল, আদনান। ইমরান বললো, এগুলো আদনানের জন্য উপহার। লোকটার হাসিমুখটা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল। ইমরান এসব আবেগে সহজে আক্রান্ত হয় না, তবু বিবর্ণ মুখটা দেখে তার বাবার কথা মনে পড়ে। অবশ্য বাবার চোখে চোখ রেখে সে কখনো কথা বলেছে এমন স্মৃতি তার নাই। চোখ বন্ধ করলেও বাবার মুখটা স্পষ্ট ভাসে না। ইমরান অনুভব করে ভারী চেহারার একটা লোক গমগমে আওয়াজে চারপাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে, বাবা মানেই ইমরানের কাছে একটা প্রবল উপস্থিতি। না, বাবার ম্রিয়মাণ, বিবর্ণ মুখ সে মনে করতে পারছে না। ইমরান পরম যত্নে লোকটার মুঠোর মধ্যে টাকাটা ভরে দেয়।স্পর্শের উষ্ণতায় লোকটার দ্বিধা কেটে গেলে হাসিমুখে বিদায় নেয়।

ইমরানের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। ঝিম ধরা দুপুরে মা বোধহয় এখনও অপেক্ষায় থাকে। কেউ কেউ অপেক্ষা করার জন্যই পৃথিবীতে আসে। মা অপেক্ষা করতে ভালোবাসে তাই অপেক্ষারাও তার পিছু ছাড়ে না। বাবার জন্য আর অপেক্ষা নেই। পাঁচ বছর আগে সে অপেক্ষা ফুরিয়েছে। বড় ভাইয়ার জন্য চলছে এক আতঙ্কিত অপেক্ষা। হত্যা মামলার আসামি হয়ে তিন বছর ধরে জেল খাটছে। কবে মামলার রায় হবে, কবে মুক্তি মিলবে কে জানে? আদৌ মিলবে কি না কে জানে। ভাইয়াকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই তার বেকসুর খালাস পাওয়ার সম্ভাবরা ক্ষীণ। মিথ্যের পদক্ষেপ হয় সুচিন্তিত। ভাবী এই অপেক্ষার জীবন থেকে ছুটি নিয়েছে গত বছর, মায়ের ছুটি নেই। সাথে এসে জুটেছে বড় আপু। দুলাভাই দশ বছর আগে শেষবারের মতো দেশে এসেছিল। আগে দুইবছর পরপর আসত।শেষবার যাওয়ার পর থেকে যোগাযোগ কমতে শুরু করল।কিন্তু টাকা নিয়মিত পাঠাচ্ছিল। দিন যেতে লাগল আর দুলাভাইয়ের কথার সুর পাল্টাচ্ছিল।কথায় কথায় রেগে যেত। বলত প্রবাসীরা তো টাকার খনি! টাকা-পয়সার প্রয়োজন ছাড়া তাদের কেউ মনে করে না।টাকা পাঠাচ্ছি ঠিকঠাক তো ঝামেলা কিসের! এভাবেই চলছিল।বছর দুয়েক ধরে টাকা-পয়সাও অনিয়মিত, গত ছয় মাসে কোনোরকম যোগাযোগ হয়নি। মায়ের সাথে বড় আপুও অন্তহীন অপেক্ষার যাত্রী।বাড়ি বলতেই হুড়মুড় করে কিছু দৃশ্য ইমরানকে তাড়া করে। বাড়িটাকে অন্তহীন অপেক্ষার কারাগার মনে হয়।

ইমরানের সাথে তার সাবেক ভাবী নওশিনের যোগাযোগ আছে। বোধহয় নওশিনের সাথেই তার একমাত্র যোগাযোগ আছে।যোগাযোগটা বুলেট ট্রেনের গতিতে বাড়ছে, কোনো বাঁধ দিয়েই সে জোয়ারের পানি আটকাতে পারছে না। গত ছয়মাসে সে একবারও ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যায়নি। উকিল, মোক্তার, আদালত- এই শব্দগুলোই শুনতে ইচ্ছে করে না। সেও কী নওশিনের মতো বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, বড় ভাইয়া নির্দোষ না।যার কাছের বন্ধুরা খুনি সে নিজে আর কত ভালো! খুনি না হলে সে পালিয়েছিল কেন? এগুলো নওশিনের কথা। গত তিন বছর ধরে শুনতে শুনতে ইমরানের নিজের কথা হয়ে গেছে। মা বা বোন কেউ বিশ্বাস করে না তাদের ছেলে খুন করতে পারে। খুনির তো আলাদা চেহারা নেই।কারো চেহারায় কি খুনি লেখা থাকে? গতকাল মাকে এই উত্তরটাই ইমরান দিয়েছিল। গত তিন বছর সে আইনের ধারা-উপধারার বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই দূরে চলে গেছে। বাবা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। বড় ভাইয়া তার পৃথিবীটা তছনছ করে দিয়েছে। পুলিশ ভ্যারিফিকেশনে গিয়ে বাদ পড়ায় কাঙ্ক্ষিত চাকরিটায় সে যোগদান করতে পারেনি। একটা অস্থায়ী চাকরির অনিশ্চয়তা তো তার পাওনা ছিল না।

বিজ্ঞাপন

সব দোষ কী নওশিনের? ইমরান জোরে জোরে মাথা নাড়ে, না।মাত্র দেড় বছরের বিবাহিত জীবনের স্মৃতি নিয়ে কেন তাকে বাঁচতে হবে? কেউ বাঁচতে চাইলে ভালো, সেটা তার সিদ্ধান্ত।কিন্তু কেউ যদি আবার শুরু করতে চায় অন্যায় কোথায়? নওশিন অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন আসামি হলে কি বড় ভাইয়া তার জন্য অপেক্ষা করত? ইমরানের এক মন বলে করত, আরেক মন বলে কখনোই করত না।নওশিন ভীষণ একলা না হলে কি তাকে আঁকড়ে ধরত? সহজ উত্তর হলো, না। কিন্তু মন তো সহজ পথে হাঁটে না।সে নিজের মতো করে যুক্তি তৈরি করে সবচেয়ে কঠিন পথটা ধরে হাঁটতে। ইমরানের নির্লিপ্ত মনের ঘরেও এত উত্তেজনা ছিল তা সে জানত না। নওশিন আর সে হতবিহ্বল ছিল। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তারা দেখল তাদের পরিচিত পৃথিবীটা পাল্টে গেছে। নওশিনের বিপন্নতায় সে যত বিধ্বস্ত, দুলাভাইয়ের বিপন্নতায় তো তেমনটা না। এসব চোরাগোপ্তা প্রশ্নও তাকে তাড়া করে। নওশিন তার চেয়ে একবছরের ছোট বড় হলে কি অন্য অনুভূতি হতো? সে কি আগেও নওশিনকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে, বড় ভাইয়া জেলে না থাকলে তারা কি করত? নাকি জেলে না গেলে কিছুই হতো না? এতসব প্রশ্নের ভিড়েও নওশিন জ্বলজ্বল করে। একেবারে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া পৃথিবীকেও যে আজকাল আকণ্ঠ পান করতে ইচ্ছে করে সেটা তো এই মেয়েটার জন্যই। এই সত্যকে অস্বীকার করা অন্যায়। সভ্যতা তো অস্বীকার করতেই বলে।ইমরান অবাক হয়ে ভাবে লক্ষ বছরেও সভ্যতা মানুষের বুনো মনটাকে পোষ মানাতে পারেনি।এটা তো সত্য, এই নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে নওশিন তার পাশে ছিল। দিনশেষে মানুষের তো একটা আশ্রয় লাগে। মা বা বড় আপু কেন সেটা বুঝতে চায় না? তাদের আর কি হারানোর আছে!

নওশিনকেও তার পরিবার একলা করে দিয়েছে। শয্যাশায়ী বাবাকে নিয়ে ক্লান্ত মা তাকে নিজের পথ দেখে নিতে বলেছে। নওশিন জিজ্ঞেস করতে পারত অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার সময় তো সে নিজের পথ দেখে চলতে চেয়েছিল তখন কেন তারা সেটা শুনেনি? কথায় কথা বাড়ে কাজের কাজ কিছু হয় না। বাজে তর্ক আর দোষারোপ বাদ দিয়ে নওশিন আবার নতুন করে লড়তে শুরু করেছে।ঢাকায় বড় খালার বাসায় আপাতত আশ্রয় জুটেছে। বিক্রয়কর্মী হিসেবে একটা কাজ জুটেছে খালাতো বোনের সহযোগিতায়। ছয়মাস ধরে সে এই কাজটা মন দিয়ে করছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ইমরান মনের সাথে লড়াই করতে করতেই লেকের পারে পৌঁছায়। পৌঁছে দেখে নির্দিষ্ট জায়গায় নওশিন লেকের দিকে মুখ করে বসে আছে আর ঝরা কৃষ্ণচূঁড়া লেকের পানিতে একমনে ছুড়ে ফেলছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা। ইমরান এক পা দু পা করে এগিয়ে নওশিনের পাশে বসলো।সন্ধ্যার ম্লান আলোতে সব কেমন অস্পষ্ট তবু ইমরানের মনে হলো সেই আলোতে নওশিনের মুখটা কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছে।নাকি তার মনের ভুল? নওশিন একবার তার দিকে তাকায়, এই অন্ধকারেও চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে তাতে দ্বিধার আভাস নাই। আগুনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে তার ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে গেছে।কয়লার উপরের পানি তাই টলটলে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ।

দুজনই চুপচাপ, শব্দেরা মাঝে মাঝে অসহায় হয়ে পড়ে। ভেতরের তোলপাড় ভাষায় কখনো কখনো প্রকাশ করা যায় না। এরচেয়ে নীরবতা ভালো।অকারণ কোলাহল ঝামেলা বাড়ায়। প্রচুর মানুষ চারপাশে। কেউ হাঁটছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে, কেউ মন দিয়ে প্রিয় মানুষের কথা শুনছে। এই জনারণ্যেও ইমরানের একা একা লাগছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর চাকাটা হঠাৎ থেমে গেছে। ইমরানের ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। তার দ্বিধার দেয়ালটাও যে সরে গেছে সেটা তো নওশিনের জানা উচিত। ইমরান ভাবছে কিন্তু বলতে পারছে না, সে চিরকালের মুখচোরা।তাই কথা না বলে সে নওশিনের হাতটা মুঠোয় নিয়ে আস্থার উষ্ণতা বিনিময় করে।

বিজ্ঞাপন

সন্ধ্যা নেমে গেলে নওশিন নীরবতা ভেঙে বলে, তুমি দুশ্চিন্তা করো না, আমি এখন সব মেনে নিতে পারি। এখন কিছুই আর আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে না। তোমার মন যা চায় সেটাই করো। আমি এখন সামনের দিকে তাকিয়ে বাঁচি।

ইমরান এতক্ষণ ধরে বলতে চাওয়া কথাগুলো হড়বড় করে বলে, দুশ্চিন্তার কিছু নাই। তুমি নিজেকে গুছিয়ে নাও, আমিও সবকিছু আবার নতুন করে গুছাচ্ছি, নিজেকে তৈরি করছি। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

নওশিন স্মিত হেসে বললো, আমি এখন নিজের জন্য বাঁচি। রোজ রোজ অগ্নিপরীক্ষা দিতে আর ইচ্ছে করে না।বেঁচে থাকা মানেই তো সুদিনের অপেক্ষা, দিনশেষে আমাদের সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন