বিজ্ঞাপন

‘কেবল রাষ্ট্রপ্রধানই নন, মুসলমান হিসেবেও দাফন তার প্রাপ্য’

August 15, 2022 | 3:55 pm

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

“বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ লাশ বর্তমান প্রজন্মের পক্ষে সে সময়কার অবস্থার ভয়াবহতা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। মনে হতে পারে বঙ্গবন্ধুর দাফন কাফনের জন্য আরো ভালো ব্যবস্থা করা যেতে পারতো। এই অভূতপূর্ব ঘটনার পর উদ্ভুত পরিস্থিতি লেখার মাধ্যমে বর্ণনা করা অসম্ভব।

বিজ্ঞাপন

একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও তার পরিবারবর্গকে এভাবে হত্যার পর শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্র সার্টারড হয়নি প্রকৃতপক্ষে গোটা জাতি সম্পূর্নভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলো। সেনাবাহিনীর যে দলটি বঙ্গবন্ধুর কফিন পাহারা দিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে আসে তারা দ্রুততম সময়ে লাশ কবরস্থ করে ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য অস্থির ছিলো। তাদের আচরণ ও দেহভঙ্গির মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছিলো। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষনভাবে শংকিত ছিলো।

বোঝা যাচ্ছিল, কফিনসহ লাশটি তাড়াতাড়ি কবরস্থ করে ঢাকায় ফিরে যেতে চায়। গভীরভাবে চিন্তা করলাম দাফনের আগে গোসল দেওয়া ও জানাজা পড়া প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান নন একজন মুসলমান হিসেবেও দাফন তার প্রাপ্য।”

সারাবাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ওপরের কথাগুলো বলেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফন-কাফনে অংশ নেওয়া গোপালগঞ্জ মহকুমার তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম। সম্প্রতি রাজধানীর মগবাজারে নিজ ফ্ল্যাটে সারাবাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

“হেলিকপ্টার চলে যাবার পর প্রচণ্ড ক্লান্তিতে আমার শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিলো। আমি ও ম্যাজিস্ট্রেট আবার কবরের পাশে যাই। অল্পক্ষণ আগেই বাঙালি জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের দাফন শেষ হয়েছে। ইতিহাস কাঁপানো এ করুণ এবং মর্মান্তিক ঘটনার শেষ পর্বে কবরের পাশে পরিবারের কোনও সদস্য বা নিকটআত্মীয় এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউই উপস্থিত নেই। নেই কোন সুহৃদ-শুভাকাঙ্খী; চোখের জল ফেলে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে মাগফেরাত প্রার্থনার। অথচ তরবারিবিহীন যে বীরের হুঙ্কারে প্রতিটি বাঙালির শিরা উপশিরায় রক্তকণাগুলো টগবগ করতো, যার আঙ্গুলের ইশারায় সাগরের ঢেউয়ের মতো গণজোয়ার ফুলে ফেঁপে উঠত, যার আহ্বানে রক্তঝরা মার্চে মাতৃভূমিকে হায়নামুক্ত করার জন্য আমার মতো হাজার হাজার যুবক অস্ত্র হাতে নিয়েছিলো। মহাকালের সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালীকে কল্পনাতীত অবজ্ঞা-অবহেলায় নীরবে নিভৃতে ছায়া সুশীতল টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরনিদ্রায় শুয়ে যেতে হলো। চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি। বেশ কিছু সময় বাকরুদ্ধ ছিলাম। কণ্ঠ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেট কাদের সাহেব গোপালগঞ্জ ফিরে যাবার তাগাদা দিলে সম্বিত ফিরে পাই। কবরের চারপাশে আপাতত বাঁশ দিয়ে হলেও বেষ্টনি দিতে হবে। যাতে কোন পশুপাখি কবরের ক্ষতি করতে না পারে। অবশ্য ইতোমধ্যে থানার ওসির নির্দেশে কবরের চারপাশে বাঁশের খুঁটি পোঁতার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে কবরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে সূরা ফাতেহা ও এখলাছ শরীফ পাঠ করে জাতির জনকের আত্মার মাগফেরাত কামনা করলাম করুনাময় আল্লাহর কাছে। তারপর থানার ওসির তত্ত্বাবধানে একজন সুবেদার, দুইজন হাবিলদার, ২০ জন কনস্টবলকে কবর ও বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে রেখে বাকী ফোর্সকে নিজ নিজ ইউনিটে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়ে গোপালগঞ্জের পথে রওয়ানা দিলাম।

বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ লাশ বর্তমান প্রজন্মের পক্ষে সে সময়কার অবস্থার ভয়াবহতা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। মনে হতে পারে বঙ্গবন্ধুর দাফন কাফনের জন্য আরো ভালো ব্যবস্থা করা যেতে পারতো। এই অভূতপূর্ব ঘটনার পর উদ্ভুত পরিস্থিতি লেখার মাধ্যমে বর্ণনা করা অসম্ভব। একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও তার পরিবারবর্গকে এভাবে হত্যার পর শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্র সার্টারড হয়নি প্রকৃতপক্ষে গোটা জাতি সম্পূর্নভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলো। সেনাবাহিনীর যে দলটি বঙ্গবন্ধুর কফিন পাহারা দিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে আসে তারা দ্রুততম সময়ে লাশ কবরস্থ করে ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য অস্থির ছিলো। তাদের আচরণ ও দেহভঙ্গির মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছিলো। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষনভাবে শংকিত ছিলো। বোঝা যাচ্ছিল, কফিনসহ লাশটি তাড়াতাড়ি কবরস্থ করে ঢাকায় ফিরে যেতে চায়। গভীরভাবে চিন্তা করলাম দাফনের আগে গোসল দেওয়া ও জানাজা পড়া প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান নন একজন মুসলমান হিসেবেও এটা তার প্রাপ্য। আগেই বলেছি মেজর হায়দারকে এ বিষয়ে প্রস্তাব দিলে তিনি কিছুটা নমনীয় হন। খুবই তড়িঘড়ির মধ্যে গোসল, কাফন ও জানাজার ব্যবস্থা করা হয়। সন্ধ্যার সময় গোপালগঞ্জ ফেরত এসে থানার ওয়্যারলেস কক্ষে গিয়ে মহকুমার সকল থানা ও পুলিশ ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ করি। তাদের সকলকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থেকে নিজ নিজ এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ দেই। যাতে কোনও লুটপাট বা দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি হতে না পারে। টুঙ্গিপাড়া থানার ওসির কাছ থেকে জানতে চাইলাম, ইতোমধ্যে কবরস্থানে জেয়ারত বা মিলাদের উদ্দেশ্যে কেউ এসেছে কিনা? ওসি জানান, টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতি এবং গিমাডাঙ্গা এলাকায় সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে। কোন কোনও বাড়িতে বা রাস্তায় এমনকি পাটগাতি ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থল পাটগাতি বাজারে ও নদীর ঘাটে কোন জনমানবের আনাগোনা নেই। কোন কোনও বাড়িতে বা দোকানে বাতি বা আলো নেই। সমগ্র এলাকায় যুদ্ধকালীন সময়ের ব্ল্যাকআউট অবস্থা বিরাজ করছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভৃত্য বৈকুন্ঠ ফিরেছে কিনা জানতে চাইলে ওসি বলে, বাড়িতে কেউ নেই। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি এবং কবরস্থানের পাহারায় যারা আছে তারা চব্বিশ ঘন্টা যেন সতর্ক অবস্থায় থাকে তা নিশ্চিত করতে এবং বাড়ির ভেতর গিয়ে কেউ যেন মালামাল নিতে না পারে সেজন্য দরজায় তালা দিয়ে রাখার নির্দেশ দেই। সার্কেল ইনস্পেক্টর শেখ আবদুর রহমানকে মহকুমার প্রতিটি থানা/ ক্যাম্পের খবরাখবর ঘন্টায় ঘন্টায় নিয়ে আমাকে জানানোর জন্য বলি। ইনস্পেক্টর শেখ ইছাক ফকিরকে টুঙ্গিপাড়া থেকে ফেরত আসা ফোর্সদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে আগের মতো লাইনের চার কোণায় ডিউটি পোষ্টে রেখে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেই।

ইতিহাস কাঁপানো এ করুণ এবং মর্মান্তিক ঘটনার শেষ পর্বে কবরের পাশে পরিবারের কোনও সদস্য বা নিকটাত্মীয় এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউই উপস্থিত নেই। নেই কোন সুহৃদ-শুভাকাঙ্খী; চোখের জল ফেলে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে মাগফেরাত প্রার্থনার।

ইতিহাস কাঁপানো এ করুণ এবং মর্মান্তিক ঘটনার শেষ পর্বে কবরের পাশে পরিবারের কোনও সদস্য বা নিকটাত্মীয় এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউই উপস্থিত নেই। নেই কোন সুহৃদ-শুভাকাঙ্খী; চোখের জল ফেলে স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে মাগফেরাত প্রার্থনার।

দায়িত্ব সেরে বাসায় গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে গোসল করলাম। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া হয়নি। সেদিন সন্ধ্যা রাতেই খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম। শরীরে কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই। প্রচণ্ড চিন্তায় অস্বস্তি ও অস্থিরতাবোধ করছি। মনে এলোমেলো ভাবনা, সারাদিন কি করলাম; সামনে কি করতে হবে? আর্মিরা ঢাকায় গিয়ে আমাদের সম্বন্ধে কি বলেছে! রাতে বা কালসকালে কি নির্দেশ আসে, ইত্যাদি ভাবছিলাম। ভীষনভাবে নার্ভাস ছিলাম। আর্মিদের ইচ্ছার বাইরে কাজ করেছি। দাফনকাজে সময় বেশি লেগে গেছে। সময়মতো ফোর্স মোতায়েন হয় নাই। কফিন বহন করার জন্য পর্যাপ্ত বহনকারী ছিলো না ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব কি দেবো? আর চিন্তা করতে পারছিলাম না। চোখে মুখে হাত দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলাম। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করলাম। কোনমতেই ঘুম আসেনা।

বিজ্ঞাপন

মাঝরাতে বিছানা হতে উঠে নোট বই নিয়ে লেখা শুরু করলাম। নোট বইটি ‘সাবডিভিশনাল নোট বুক’। যে বইতে মহকুমা পুলিশ অফিসার বা তদুর্দ্ধ অফিসারবৃন্দ নির্দেশনা বা প্রশংসামূলক মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। যা অধস্তন অফিসারদের জন্য মেনে চলা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া বাধ্যতামূলক। সারাদিনে টুঙ্গিপাড়ায় অনুষ্ঠিত ঘটনাটিকে ‘সকালের টেলিফোনের নির্দেশ হতে শুরু করে বিকেলে বঙ্গবন্ধুকে সমাহিত করা পর্যন্ত কর্মকান্ড’ ধাপে ধাপে সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে রাখলাম। সে লেখায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ও কবরের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলিও ছিলো।

সকালের চা নাস্তা শেষ করে প্রস্তুত হচ্ছিলাম পুলিশ লাইনে যাবার জন্য। থানার ওসি এসে খবর দিলো, যশোর ক্যান্টনমেন্ট হতে এক ব্যাটালিয়ন আর্মি আসছে গোপালগঞ্জে। তাদের রিসিভ করে থাকার ব্যবস্থা করার জন্য এসডিওকে নির্দেশ দিয়েছে। এ খবরে আমি ভীষনভাবে বিচলিত হয়ে পড়লাম। করণীয় ঠিক করতে পারছিলাম না। নির্ঘাত ফায়ারিং মঞ্চে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে! ওসিকে বললাম সকল অফিসারকে লাইনে আসার খবর দিতে হবে। আমি পুলিশ লাইনে গেলাম। অফিসাররা আসলেন। উপস্থিত সবাই গতদিনের টুঙ্গিপাড়ার খবরাখবর বিস্তারিতভাবে জানতে চাইলেন। ভারপ্রাপ্ত এসডিও আর্মিদের থাকার স্থানে টেলিফোন লাইন ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমাকে অনুরোধ করলেন, লঞ্চঘাটে আর্মিদের রিসিভ করার সময় উপস্থিত থাকতে। আমি জানালাম এসপি সাহেবের সাথে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। সারাদিন আলোচনা হলো। আমি কি সরে যাবো, না দায়িত্ব পালনে হাজির থাকবো ইত্যাদি। সকলের মতো হলো, আমার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। বিকালে এসডিও বদিউর রহমান এসে গেছেন। তার সাথে আলাপ হলো। তিনি আমাদের থেকে শুনলেন এবং ঢাকায় গত দুদিনে তার অভিজ্ঞতারও বর্ণনা দিলেন।

সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে পূর্বাপর বহু কিছু ভাবলাম। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে মনে মনে ঠিক করলাম দায়িত্ব ফেলে কর্মস্থল হতে পালাবো না। কপালে যা আছে, তাই হবে। ১৮ আগস্ট বিকাল তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে যশোর হতে লঞ্চ ও স্পীডবোটে করে আর্মি আসলো। এক ব্যাটালিয়ন নয়, একজন ক্যাপ্টেন ও একজন লেফটেন্যান্ট এর অধীনে এক কোম্পানী আর্মি। একই দিন মাদারীপুর, ফরিদপুরেও আর্মি গিয়েছে। টেলিফোনে এসডিও আমাকে জানালেন, লঞ্চ হতে আর্মিদের অবতরনস্থলে তিনি যাবেন না। তার সেকেন্ড অফিসার ও প্রবেশনার ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে। আমি লঞ্চ ঘাটে থাকবো কিনা জানতে চাইলে বলে দিলাম, আমার তো থাকার প্রয়োজন নেই। তারা মেসেজ দিয়েছে, আপনার কাছে বাসস্থানের ব্যবস্থার জন্য। ব্যবস্থা ঠিকমতো হয়েছে। থানার ওসি ও সার্কেল ইন্সপেক্টর থাকবে। পরদিন এসডিওর অফিসে গিয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব জানালেন, আর্মিরা শুধু এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এসেছে। প্রয়োজনে আর্মি অস্ত্র উদ্ধারসহ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসন ও পুলিশকে সহযোগিতা করবে। লে. মাহমুদ এখানকার ট্রুপের দায়িত্বে থাকবে। প্রয়োজনে সে আপনার সাথে যোগাযোগ করবে এবং তিনি কিছুক্ষনের মধ্যেই ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে চলে যাবেন।

২০ আগস্ট দুপুরে থানার ওসি আবুল কালামকে লে. মাহমুদ হুকুম দিলেন গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাদের পদবীসহ নাম ঠিকানা ও বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয়দের পেশাসহ লিষ্ট এবং স্বাধীনতার পর অবৈধ ব্যবসা, ঠিকাদারীর মাধ্যমে সম্পদশালী হওয়া বা অবৈধভাবে ঘরবাড়ি/জমিজমা দখলকারী ব্যক্তিদের নামের তালিকা দিতে হবে দুদিনের মধ্যে। ওসি আমার অফিসে এসে বিষয়টি জানায় এবং কি করবে তার নির্দেশনা চায়। আমি ডিসি-এসপির সাথে আলোচনা করে জানাবো বলে তাকে বিদায় দেই। ডিসি-এসপির সাথে ফোনে কথা হলো বিকালে। তাদের জানালাম এই কয়দিনের মধ্যে শহরের অবস্থাপন্ন লোকজন নৌকায় করে হাওড়/বাওড় এবং দুর্গম এলাকায় আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এ খবরে মানুষ আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বাকিরা হয়তো রাতেই শহর ছেড়ে পালাবে। ডিসি ফয়েজুর রাজ্জাক সাহেব পরামর্শ দিলেন বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেষ্ট হাউজে অবস্থানরত ব্যাটালিয়ান সিওকে (কমান্ডিং অফিসার) সন্ধ্যার পর ফোনে জানাতে। ইতোমধ্যে তিনিও বিষয়টি সিওকে জানিয়ে রাখবেন। সিও সাহেবের সাথে আলাপ হলো। তাকে এলাকার সার্বিক আইন শৃঙ্খলার অবস্থাসহ লে. মাহমুদের নির্দেশনা জানালাম এবং তার পরামর্শ চাইলাম। তিনি বললেন, ‘এলাকায় এলাকায় আর্মি ডেপ্লয় হওয়ার উদ্দেশ্য জনগণের মন হতে ভয়ভীতি ও সংশয় দূর করা এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসন ও পুলিশকে সহযোগিতা করা। জনগণকে বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে যাওয়ার অবস্থার সৃষ্টি করতে নয়। মাহমুদ যাই বলুক বা করুক আপনার সাথে পরামর্শ করে করবে। আমি তাকে বলে দিচ্ছি। আর যে কোনও সমস্যা হলে আপনি নির্ভয়ে আমাকে জানাবেন।’

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন:

‘বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়দের মারতে আর্মি আসতে পারে’

‘দুপুরে মুজিবের লাশ টুঙ্গিপাড়া যাবে, সব ব্যবস্থা করেন’

‘যে করেই হোক, বঙ্গবন্ধুর লাশের মুখ দেখতেই হবে’

‘পাঞ্জাবি ও গেঞ্জি কেটে দেখি, বঙ্গবন্ধুর বুকটা ঝাঁঝরা’


এরপর ওসি এবং সার্কেল ইন্সপেক্টরকে অফিসে ডেকে এনে আর্মির সিও সাহেবের হুকুম জানালাম এবং শহরবাসীকে নির্ভয়ে যার যার বাড়িতে অবস্থান করার অনুরোধ করতে বললাম। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) হয়ে আসলেন আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। কর্মস্থলে যোগদানের কয়েকদিনের মধ্যেই জানানো হলো ডিসি সাহেব টুঙ্গিপাড়া পরিদর্শনে আসবেন। টেকেরহাট হতে লঞ্চে (ডিসির জন্য নির্ধারিত সরকারী লঞ্চ) করে গোপালগঞ্জ এসে এসডিও ও আমার কাছ থেকে মহকুমার আইন শৃঙ্খলা, সর্বহারা তৎপরতা, অস্ত্র উদ্ধার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা নিলেন। জেলা প্রশাসকের সাথে তার স্ত্রী ও এডিসি সহিদুল আলম এসেছেন। ডিসি সাহেব স্ত্রীসহ এসডিওর বাসায় রাত্রিযাপন করলেন।

কর্মসূচী অনুযায়ী পরদিন দুটো স্পীডবোটে করে ডিসি, এডিসি, এসডিও এবং আমি টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে শেখ সায়রা খাতুন রেডক্রস হাসপাতাল ঘাটে অবতরণ করি। ডিসি সাহেব প্রথমেই হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন। তারপর দেখলেন হাসপাতালের সাথে লাগোয়া টিনসেড ঘরে প্রতিষ্ঠিত টুঙ্গিপাড়া থানা। এরপর গেলেন ডাকবাংলো ও তার নীচতলায় স্থাপিত সোনালী ব্যাংক শাখা পরিদর্শন করতে। ডাকবাংলো ও ব্যাংক ঘুরে দেখে রওয়ানা দিলেন বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে। কবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সকলে মিলে কবর জেয়ারত করলাম। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে পুলিশ অফিসার ছাড়া সরকারী বা দেশের কোন গন্যমান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তির এটাই প্রথম ভিজিট। তারা কবরস্থানসহ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলেন। ডিসি সাহেব জানতে চাইলেন দরজায় তালা দেওয়ার আগে মালামালের তালিকা হয়েছে কিনা? তালায় সিল করা নাই কেন ইত্যাদি। আমি জানালাম বঙ্গবন্ধুকে কবর দেওয়ার সময় বাড়ির সার্বক্ষনিক চাকর বৈকুণ্ঠ ভয়ে পালিয়ে ছিলো। রাত পর্যন্ত আসেনি জেনে ওসিকে দরজা জানালা বন্ধ করে তালা দিয়ে রাখতে আমিই বলেছি। যাতে বাড়ির কোন মালামাল খোয়া না যায়। ডিসি সাহেব তখন এসডিওকে বললেন, একজন ম্যাজিষ্ট্রেট এর উপস্থিতিতে সব মালামালের তালিকা করে দরজা জানালা বন্ধ করে প্রধান দরজায় তালা দিয়ে সীলগালা করে রাখতে। তিনি আরও বললেন, ডাকবাংলোর দোতলা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর রাত্রিযাপনের কক্ষটি সামনে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য বসার খোলা জায়গাসহ পুরা দোতলাটি ইনসপেকশন রুম হিসাবে ব্যবহার হবে এবং নীচতলায় টিনসেড ঘর থেকে থানা স্থানান্তর করা হবে। ব্যাংকের সাথে উভয় প্রতিষ্ঠান শেয়ার করে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করবে। এতে ডাকবাংলো, ব্যাংক ও থানার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। স্থানান্তরের কাজটি দুদিনের মধ্যে শেষ করে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তাকে জানানোর জন্য আমাকে ও ওসিকে নির্দেশ দিলেন। তিনি আরও বললেন বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানাবেন এবং তাদের অনুমতি গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।”

সমাপ্ত।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন