বিজ্ঞাপন

হাওরের বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় লাগাম টানুন

September 16, 2022 | 3:50 pm

আবির হাসান সুজন

হাওরাঞ্চলের নয়নাভিরাম দৃশ্য ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে নানা রূপ ধারণ করে। বর্ষাকালে সাগরের মতো চারদিকে পানি আর পানি। গ্রামগুলো ডুবুডুবু থাকে। জনপদগুলোকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়।

বিজ্ঞাপন

হাওরাঞ্চল গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। হাওরাঞ্চল মূলত বাস্তুসংস্থানের এক অনন্য দ্বীপ। তবে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য দিনদিন হুমকির মুখে পড়ছে। হাওর ধ্বংসে প্রকৃতি আর মানুষ মিলে দুই ধরনের প্রতিযোগিতা চলে বছরজুড়ে।

একসময় নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও গুল্মলতায় ভরাট ছিল প্রতিটি বিল। শীতকালে প্রতিটি বিল সিংরা, পানিফল, এরালী, শ্যাওলা ইত্যাদি নানা প্রজাতির গুল্মলতায় ভরপুর থাকতো। এসব গুল্মলতা এতো বেশি ছিল বা তাদের ঘনত্ব এতো বেশি ছিল যে, বাহির থেকে বিলে পানি দেখা যেত না। মাছের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বিলে প্রচুর পরিমাণ নানা প্রজাতির জলচর প্রাণী ও কীটপতঙ্গ ছিল। যা মাছ ও অতিথি পাখির খাবার জোগান দিতো।আশঙ্কাজনকহারে পরিযায়ী পাখির আগমন কমে যাওয়া হাওরের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার বড় এক প্রমাণ। অতিথি পাখি না এলে হাওরের তলদেশ শেওলায় ভরে যাবে। পানিতে অক্সিজেন থাকবে না। পাখি না এলে মাছের পুষ্টিকর খাদ্য, পাখির মলের অভাবে মাছ পুষ্টি পাবে না। যেখানে প্রতিবছর শীতে লক্ষাধিক অতিথি পাখি আসত সেখানে গতবছর মাত্র ২৫ হাজার অতিথি পাখি এসেছে। এছাড়াও হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এসব উদ্ভিদের মধ্যে যেসব উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বুনো গোলাপ, মাখনা, দেউরি, আশহান, দুদুল, কাটাঝাউ, পাথুই, কার্ড, পউরা, আরাইল, কেশুর, আগরা, গুঞ্জিকাটা ও বনতুলসী। এছাড়া হাওরের অতি পরিচিত উদ্ভিদ কচুরিপানা, আমড়া, সিঙরা, দুর্বা, শাপলা, চাইল্লা, ঢোলকলমি ও হেলেঞ্চাও আগের মতো পাওয়া যায় না।

তাছাড়াও দুই যুগ আগেও হাকালুকি হাওরে ১১০ প্রজাতির দেশীয় মাছ ছিলো। যা এখন পঞ্চাশ প্রজাতির নিচে নেমে গেছে। হাওর থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে মরায়েক, গাঙ মাগুর, রিটা, নানিদ, বাঘা আইড়, চিতল, রাণী মাছ, এলংসহ কয়েক প্রজাতি সুস্বাদু মাছ। গত ১০ বছরে হাওরাঞ্চলে মাছ কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। এক তথ্যমতে, হাওরাঞ্চলের ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে বর্তমানে ১১২টি টিকে আছে। ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও সরীসৃপ বিলুপ্তপ্রায়। গত দুই দশকে এ হাওরে পাখির বিচরণও কমেছে ৪৫ শতাংশ। প্রতিবছর শীতকালে হাওরে প্রচুর বিরল প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসত। কিন্তু বিচরণস্থল কমে যাওয়ার পাশাপাশি চোরাশিকারির দৌরাত্ম্যে সে পাখির বিচরণও এখন খুব কম।

বিজ্ঞাপন

মূলত দীর্ঘদিন ধরে হাওর এলাকার মানুষজন ক্ষুদ্র স্বার্থে প্রকৃতি ধ্বংস করে অবকাঠামোগত পরিবর্তন করছে। এছাড়া কৃষিজমিতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এবং অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র জলকপাট ও বাঁধ নির্মাণ হাওরাঞ্চলের উদ্ভিদ বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ। এতে উদ্ভিদ দিনে দিনে কমে গিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার কারণে কয়েক বছর ধরে সবজিসহ বিভিন্ন উৎপাদনশীল কৃষি ফসল উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। অপরিকল্পিত জমির ব্যবহার, পানি সেচে মাছ ধরা, রাসায়নিক সারের অবাধ ব্যবহার, পানি দূষণসহ বিভিন্ন কারণে হাওরের উদ্ভিদ বিলুপ্ত হচ্ছে। তাছাড়া পরিবেশগত পরিবর্তন, মানুষের নানামুখী পরিবেশ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে হাওরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।

অন্যদিকে বর্ষাকালে প্রতিদিন বেড়জাল ও নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করা হচ্ছে। বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দলবদ্ধভাবে জেলেরা বড় নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করেন। আগে বেড়জালের দৈর্ঘ্য ১ থেকে দেড় হাজার ফুট ছিলো আর ব্যাস বড় ছিলো । এখন জেলেদের ব্যবহৃত জালের দৈর্ঘ ৩ থেকে ৪ হাজার ফুট এবং ব্যাস ছোট। যার কারণে বড় মাছের সাথে পোনামাছও ধরা পড়ে এসব জালে। এসব জালে হাওরের জলজ উদ্ভিদগুলো পরিপূর্ণ হওয়া আগেই নষ্ট হয়ে যায়।

তাই শুধু হাওরের উদ্ভিদ ও জীব বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে সরকারি উদ্যোগে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে জলাভূমি সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।হাওরের উন্নয়নে এ অঞ্চলের নদ-নদী ও হাওর খনন শুরু করতে হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজ বন্ধ করতে হবে। কাজ দেখানোর নামে যেখানে-সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা যাবে না। সারা বছর যেন নৌ যোগাযোগ সচল থাকে তা নিশ্চিত করা জরুরি। হাওর উপযোগী গাছপালা সরকারি উদ্যোগে লাগাতে হবে।

বিজ্ঞাপন

প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয় এমন কীটনাশকের ব্যবহার হাওরাঞ্চলে নিষিদ্ধ করতে হবে। জলাধার কোনো অবস্থায়ই ইজারা দেওয়া যাবে না এবং মাছের অভয়ারণ্য ঘোষণা করে তা যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে। দেশি প্রজাতির মাছ বাঁচাতে প্রয়োজনে গবেষণাগারে এসব মাছের ডিম ফুটিয়ে হাওরে ছাড়া উচিত। অবাধে গাছ কাটা, বন্য প্রাণী, পাখপাখালি ধরা বন্ধ করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।তাছাড়াও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।বিশেষ করে হাওর এলাকার লোকজনকে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা পালন করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এজেডএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন