বিজ্ঞাপন

‘উপেক্ষিত’ আবদুল্লাহ আল নোমান, যাননি বিএনপির সমাবেশে

October 13, 2022 | 10:18 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: আবদুল্লাহ আল নোমান। রাজনীতির বয়স অর্ধশতাব্দীরও বেশি। ছিলেন বামপন্থি রাজনীতিক, আশির দশকে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে যোগ দেন বিএনপিতে। দলটির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। সংসদ সদস্য হয়েছেন, পালন করেছেন মন্ত্রীর দায়িত্বও। এখন দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম আবদুল্লাহ আল নোমান। এক সময় চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতি মানেই ছিল আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্ব। মহানগরে-উত্তরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কেন্দ্রীয়ভাবে যুবদল-শ্রমিকদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাকে ছাড়া চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি, এক সময় কল্পনাই করতে পারতেন না দলটির নেতাকর্মীরা।

কিন্তু বুধবার (১২ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশে যাননি আবদুল্লাহ আল নোমান। নেতাকর্মীরা বলছেন, এই প্রথম চট্টগ্রামে বিএনপির বড় কোনো কর্মসূচিতে তিনি উপস্থিত থাকলেন না। অথচ কেন্দ্র থেকে জেলা, মহানগরের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা ছিলেন, শুধু ছিলেন না চট্টগ্রামে বিএনপির এক সময়ের কাণ্ডারি নোমান। এর দু’দিন আগেই চট্টগ্রামে এসে নিজ সংসদীয় আসনে সমাবেশের প্রস্তুতি সভা করে আবার ফিরে গেছেন ঢাকায়। সমাবেশে কেন নোমান অনুপস্থিত— এ নিয়ে আলোচনা আছে খোদ দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেই।

নোমানের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির কোনো পর্যায়ে আবদুল্লাহ আল নোমানকে রাখা হয়নি। যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে প্রস্তুতি কমিটির পক্ষ থেকে তাকে মহাসমাবেশে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। এই ‘উপেক্ষার’ কারণে অভিমানী নোমান যাননি সমাবেশে। এমনকি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ফোন করে অনুরোধ জানিয়ে তাকে নিতে পারেননি।

বিজ্ঞাপন

তবে আবদুল্লাহ আল নোমান বলছেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি সমাবেশে যেতে পারেননি। প্রস্তুতি কমিটিতে না রাখলেও নিজ উদ্যোগে তিনি সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন প্রস্তুতি সভার মাধ্যমে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশের জন্য কেন্দ্র থেকে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে উপদেষ্টা করে টিম প্রধান করা হয়েছিল ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানকে। আর সমন্বয়কারী ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম।

গত ১০ অক্টোবর আবদুল্লাহ আল নোমান চট্টগ্রামে এসে নিজ সংসদীয় আসন ডবলমুরিং-হালিশহর এলাকায় থানা ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীদের নিয়ে ‘প্রস্তুতি সমাবেশ’ করেন। সেই সমাবেশে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনও অংশ নেন। গণসমাবেশের সমর্থনে প্রস্তুতি সমাবেশ করে রাতেই আবার তিনি ফিরে যান ঢাকায়।

বিজ্ঞাপন

সমাবেশে উপস্থিত না থাকার বিষয়ে আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলা’র। তিনি বলেন, ‘১০ তারিখ প্রোগ্রাম করার পর শরীরটা এত খারাপ হয়ে গেল, ঢাকায় চলে আসতে হলো। ১২ তারিখ আর যেতে পারলাম না। আর সুনির্দিষ্টভাবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে ঢাকা বিভাগে। এটা দল থেকেই দিয়েছে। ডিসেম্বরে ঢাকায় সমাবেশ হবে। সেখানে আমার দায়িত্ব থাকবে।’

চট্টগ্রামের সমাবেশের জন্য দল থেকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমার দায়িত্ব সেভাবে না, সেখানে কমিটি করা হয়েছিল। আমীর খসরু, শাহজাহান সমন্বয়কারী— এভাবে কমিটি করা হয়েছিল। যেহেতু আমি কমিটিতে প্রধান দায়িত্বে ছিলাম না বা কোনো দায়িত্বেই ছিলাম না, আমি নিজের উদ্যোগে আমার নির্বাচনি এলাকায় মহাসমাবেশের সমর্থনে একটা সমাবেশ করেছি। সেখানে ফেস্টুন, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, লিফলেট সব ১২ তারিখের মহাসমাবেশের সমর্থনে করা হয়েছিল। সবাইকে বলেছি, মহাসমাবেশ সফল করুন। আমি বলিনি যে, আমি থাকব না। কিন্তু শরীরের কারণে পারলাম না।’

নোমান বলেন, ‘১০ তারিখ প্রস্তুতি সমাবেশ শেষ করে রাতে আবার নেতাকর্মীদের নিয়ে বসেছিলাম। ব্যানার বানানো হয়েছে। আমার ফটো দিয়ে এক হাজার গেঞ্জি বানানো হয়েছে। সেগুলো নিয়ে নেতাকর্মীরা সমাবেশে গেছেন। এর বেশি দায়িত্ব তো আমার ছিল না।’

প্রস্তুতি কমিটির পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১০ তারিখ আমি সমাবেশ করলাম। রাতে তো চলে গেলাম। পরদিন ১১ তারিখ মহাসমাবেশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন ছিল। ওইদিন সকালে শামীম (মাহবুবের রহমান শামীম) আমাকে সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার জন্য ফোন করেছিল। তখন আমি অলরেডি ঢাকায় চলে এসেছি। শামীম কিংবা অন্য কারও সঙ্গে এর বেশি ডিটেইল কথা আমার হয়নি বা তারাও বলেনি।’

বিজ্ঞাপন

ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্য অনুযায়ী নিজেকে ‘উপেক্ষিত’ ভাবছেন কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় দল, কিছু সমস্যা তো থাকবেই। উপেক্ষিত মনে করছি না। এ ধরনের অনেক বড় বড় প্রোগ্রাম আমি আগে করেছি। ম্যাডামকে (বেগম খালেদা জিয়া) সঙ্গে রেখেই চট্টগ্রামে করেছি।’

বুধবার সকালে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফোন করেছিলেন জানিয়ে নোমান বলেন, ‘মহাসচিব ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় ফোন করেছিলেন। বললেন, আপনি কোথায়। আমি বললাম, ঢাকায়। তখন বললেন যে, আপনি যাবেন না ? আমি বললাম- শারীরিকভাবে সুস্থ না। মহাসচিব বললেন, আপনি না গেলে কেমনে হয়? আমি বললাম- হয়ে যাবে। বড় মিটিংয়ে কে গেল, কে গেল না সেটা সবাই জানতে পারে পরে। মিটিং তো হয়েই যায়। মহাসচিব আর কোনো কথা বলেননি।’

কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘বড় বড় সমাবেশে লোকজন যোগান দেওয়াটা বড় বিষয় না। মানুষ তো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছে। রাস্তায় রাস্তায় জটলা ছিল শুনেছি। সরকারবিরোধী স্বতঃস্ফূর্ততা মানুষের মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বিএনপির সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততাটা হচ্ছে। এখন সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য।’

সমাবেশে আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নোমান ভাইয়ের সঙ্গে আমার টেলিফোনে কয়েক বার কথা হয়েছে। সর্বশেষ উনাকে আমি সংবাদ সম্মেলনে আসার জন্যও ফোন করেছিলাম। উনি আসেননি সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু উনি দু’দিন আগে চট্টগ্রামে এসে সভা করেছেন। এর পর আবার কেন ঢাকায় চলে গেলেন, কেন সমাবেশে আসেননি সেটা আমি বলতে পারব না। আর নোমান ভাই সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা। উনাকে অশ্রদ্ধা বা উপেক্ষা করার তো প্রশ্নই আসে না।’

বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায়ী সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ১৯৯১ সালে নোমানের হাত ধরেই বিএনপিতে যোগ দেন। নোমানের সমর্থন নিয়েই তিনি বন্দর আসন থেকে তিন দফা সংসদ সদস্য হন। সেই আমীর খসরু দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং নোমান ভাইস চেয়ারম্যান। সাংগঠনিকভাবে খসরুর নিচে অবস্থানকে অসম্মানজনক মনে করেন প্রবীণ নেতা নোমান।

চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরা গ্রামে জন্ম নেওয়া আবদুল্লাহ আল নোমান বড় ভাই আবদুল্লাহ আল হারুন ছিলেন চট্টগ্রাম ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ষাটের দশকের শুরুতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নোমান যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। মেননপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

ছাত্রজীবন শেষে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ছিলেন। গোপনে ভাসানীপন্থি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত হন। ১৯৭০ সালে তাকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ শেষে আবারও ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর ১৯৮১ সালে যোগ দেন দলটিতে। চট্টগ্রামের রাউজান ও কোতোয়ালি আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি সরকারের মন্ত্রিসভায় খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাজনৈতিক ঘরানার বাইরেও চট্টগ্রামে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা আছে আশিতে পা দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা আবদুল্লাহ আল নোমানের।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন