বিজ্ঞাপন

ফুটবলপ্রেমী বাঙালি ও বাংলাদেশের ফুটবল

December 12, 2022 | 2:53 pm

সফিউল আযম

সারাদেশে বিশ্বকাপ জোয়ার। প্রতি চার বছর পর বিশ্বব্যাপী ফুটবল আসর বসে। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই খেলাপাগল। সারাদেশে এক ধরণের উৎসবের আমেজ তৈরী হয়। মাঠে ময়দানে, চা দোকান থেকে হাট বাজার, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সব জায়গাই ফুটবলের হাওয়া। রাতদিন চলে চুলছেঁড়া বিশ্লেষণ আর জয় পরাজয়ের হিসাব–নিকাশ।

বিজ্ঞাপন

বলা যায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ফুটবল সম্প্রীতির এক উজ্জ্ব দৃষ্টান্ত তৈরী করে তা এককথায় বিরল। এখানে কোন রাজনৈতিক দল নেই, কিন্তু আছে প্রিয় তারকা, তারকাকে ঘিরে দেশকে সমর্থন। ফুটবল সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই, তারাও আলোচনায় অংশ নেন। এটা ফুটবলের প্রতি দেশের সব শ্রেণির মানুষের ভালবাসারই বহি:প্রকাশ।

১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল উরুগুয়েতে আয়োজিত হলেও বাঙালিদের সঙ্গে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রকৃত সখ্য গড়ে ওঠে আরও পরে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ সম্প্রচার করার কারণে বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকায়ও বিশ্ব ফুটবলের বিষয়গুলো আলোচনায় আসে । ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সব ম্যাচ সম্প্রচার করার মধ্য দিয়ে বাঙালিদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে পড়ে বিশ্বকাপ ফুটবল।

সারাদেশের মানুষ যখন ফুটবলের উৎসবে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে, সেখানে আমাদের ফুটবলের অবস্থান কোথায়, সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে। দেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি এত দরদ, উন্মাদনা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব ফুটবলে আমরা কেন তলানিতে, সে প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। মাত্র তিন লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড বর্তমানে ইউরোপের উঠতি ফুটবল শক্তি হলেও প্রায় ১৭ কোটির দেশে ফুটবলের কেন দৈন্যদশা সে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ফুটবলে সাংগঠনিক দক্ষতার অভাব বেশ পরিলক্ষিত। রয়েছে উদ্যোক্তা ও উদ্যোগেরও অভাব। একথা কেথা ঠিক যে, আর্থিক সমস্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশের বেশ কয়েকটি ক্লাব জড়িয়ে পড়ে ক্যাসিনো কাণ্ডে। সরকার বেশ শক্ত হাতে সেসব অনৈতিক কর্মকান্ডকে দমন করে। আবার অনেকেই ক্লাবের নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিলের মাধ্যম হিসেবে এই ক্লাবগুলোকে ব্যবহার করতো। ফলে ক্রীড়া ক্লাবগুলো পড়ে বেশ সংকটে। দল গঠনেও হিমশিম খায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারি প্রণোদনা প্রয়োজন। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ক্লাবের সাথে সম্পৃক্ত হতে প্রয়োজন দৃশ্যমান উদ্যোগ এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা শুরু হয় ২০১১ সালে। যেখানে প্রত্যেক বছর ৬৪ হাজার স্কুলের প্রায় ১০ লাখের উপরে মেয়ে ফুটবলার অংশ নিচ্ছে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে, দেশের সুনাম বয়ে আনছে। জাতীয় স্কুল ফুটবলও জাতীয় ফুটবলার তৈরীতে রাখছে অবদান। স্কুল ও বয়সভিত্তিক ফুটবল নিয়ে আরো ব্যাপক পরিসরে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।

দেশের ফুটবলের উন্নয়নে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে দায়িত্ব নিতে হবে। বয়সভিত্তিক বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী কোচিং স্টাফ প্রস্তুতকরণ প্রয়োজন। সারাদেশের তরুণ সামাজিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় দেশের আনাচে কানাছে ছড়িয়ে পড়া যুব ক্লাবগুলোকে ক্রীড়া সামগ্রী প্রদান করতে পারে, যাতে তারা উজ্জ্বীবিত হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা শহরে যথেষ্ট মাঠ নেই অনুশীলনের জন্য, ঢাকার আশে পাশে এলাকায় মাঠের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। ক্লাবগুলোকে প্রয়োজনে ঢাকার আশেপাশে স্থানান্তর করা যেতে পারে। যাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাবগুলো খেলোয়ার তৈরীতে অবদান রাখতে পারে। সর্বোপরি ক্লাবগুলোকে পেশাদারিত্ব মনোভাব পোষণ করতে হবে। শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না করে নিজেদেরও পরিকল্পনা থাকতে হবে। নিজস্ব মাঠ সবসময় থাকতে হবে, তেমন কোনও বিষয় নেই, প্রয়োজনে অন্য ক্লাবের মাঠে খেলাধুলা কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারে। দেশের মাঠগুলোকে খেলার উপযোগী করতে হবে। জেলায় যেসব স্টেডিয়াম আছে সেগুলোকে যুগোপযোগী করা। সেক্ষেত্রে ফুটবল ফেড়ারেশনকে ভূমিকা রাখতে হবে। ফুটবল মাঠে দর্শক ফেরানোর জন্য নিতে হবে উদ্যোগ। দেশের ফুটবলে স্পন্সর সংগ্রহ করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়, প্রয়োজন সঠিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা।

বর্তমানে বাংলাদেশের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া, যিনি ডেনমার্কের সবচেয়ে বড় ক্লাবের হয়ে খেলতেন। কিন্তু দেশের টানে এসে ২০১৩ সালে এদেশের ফুটবল দলেরর সদস্য হয়ে খেলছেন নিয়মিত। ফিনল্যান্ডের লীগে খেলা তারেক রায়হান কাজী বাংলাদেশ জাতীয় দলে একজন পরীক্ষিত ডিফেন্ডার। রয়েছেন পোল্যান্ড প্রবাসী ফরিদ আলী। বর্তমানে ফরিদ খেলছেন পোল্যাল্ডের সেকেন্ড ডিভিশনে। যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের স্পোর্টিং ইউনাইটেড সকার ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত খেলছেন জিদান মিয়া। লেইচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরী, ইংল্যান্ড প্রবাসী এই ফুটবলারের ভবিষ্যতে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পাবার অপেক্ষায়। কানাডিয়ান বাংলাদেশি সামিত বোস। এভাবেই হয়তো অনেকের নামই পাওয়া যাবে, যারা বিভিন্ন দেশের ফুটবলে রাখছেন অবদান। যাদের পিছনে বাফুফে খবরাখবর নিতে পারে, বাংলাদেশের ফুটবলে এসব তারকা ফুটবলার আনার উদ্যোগ নিতে পারে। দেশের ফুটবলের উন্নয়নে প্রবাসীদের আগ্রহ বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে পারে বাফুফে।

যে বাংলাদেশ একসময় আরিফ খান জয়, আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, কায়সার হামিদ, জাহিদ হোসেন এমিলি, হাসান আল মামুন, হাসান আল মাসুদ, জুয়েল রানাদের মানুষ চেনে এই ফুটবলকে কেন্দ্র করেই। এসব তারকা খেলোয়ারদের কাজে লাগানো যেতে পারে। বর্তমান বাফুফে সভাপতি ২০১৩ সালে এক ভবিষ্যত বাণীতে ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলবে বলেছিলেন বলে খবরে প্রকাশ, কাতার বিশ্বকাপ প্রায় শেষপ্রান্তে। ভবিষ্যত বাণীরও যবণিকাপাত ঘটলো। তাই পিছনে না ফেরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ভবিষ্যত বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য দুশ্যমান উদ্যোগ বড়ই প্রয়োজন।

একসময় আমাদের পাড়া মহল্লায় আবাহনী কিংবা মোহামেডানের পতাকা টানানোর হিড়িক পড়তো। বন্ধু-বান্ধব স্কুলের টিফিনের টাকা থেকে পতাকা বানিয়ে উড়াত। সেসব স্মৃতি এই প্রজন্মের অনেকের কাছে কল্পনা মনে হতে পারে। আশি ও নব্বই দশকে রেডিওতে আবাহনী, মোহামেডান খেলার ফলাফলের জন্য কান পেতে থাকতাম আমরা। কিন্তু বর্তমানে সবাই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবা লিভারপুল নিয়ে মেতে উঠে। এই প্রজন্ম আমাদের ফুটবলের সেই সোনালী যুগ থেকে বিচ্ছিন্ন। কিভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে দেশের ফুটবলের এসব দর্শককে, সে দায়িত্ব নিতে হবে বাফুফেকে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি আমরা দেখছি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মেয়েরা দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনছে। অবদান রাখছে নারী ফুটবলে। এদের জন্য আরো প্রণোদনা দেয়া, বহুমূখী কর্মসূচি নেয়া, এদের জীবন ও জীবিকায়নে সহায়তা করা, তাহলেই শুধু মেয়েরা কেন নৃ-গোষ্ঠীর ছেলেরাও এগিয়ে আসবে। যদিও মাতৃপ্রধান পরিবারে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা মেয়েরা আত্মবিশ্বাসী হয় এবং তার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম ও ফিটনেস দেশের অন্য অঞ্চলের মেয়েদের থেকে তাদের আলাদা করে। এসব এলাকায় নানা উদ্যোগে উঠে আসতে পারে শতশত ফুটবলার নারী ও পুরুষ ফুটবলার।

বাংলাদেশের মানুষের অস্থিমজ্জ্বায় মিশে আছে ফুটবল। ফুটবলের দর্শক সবসময় ছিল, এখনও আছে, সবসময় থাকবে। প্রয়োজন সঠিক ও বাস্তবমূখী পরিকল্পনা, তাহলেই এগিয়ে যাবে দেশের ফুটবল।

লেখক: এডিটর ইন চিফ, ইয়ুথ জার্নাল

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন