বিজ্ঞাপন

বাংলার পট ও পটের গান

December 17, 2017 | 1:07 pm

মোহাম্মদ আসাদ

বিজ্ঞাপন

বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান পটচিত্র। ভারতবর্ষে নানা রকম পটচিত্র প্রচলন ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত। তখন পটচিত্র দেখিয়ে গ্রাম-গঞ্জের মানুষকে ধর্মাচার ও লোক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। পটচিত্র দেখিয়ে পটের গান গ্রাম-গঞ্জের মানুষের বিনোদনও ছিল। কাগজ আবিষ্কার হওয়ার আগে সকল পটচিত্র কাপড়েই আঁকা হতো। জড়ানো পটের বেশিভাগই ধর্মের বিষয় করে কিছু ছবির মাধম্যে বয়ান করা হতো। আবার কিছু পট ছিল যমের ভয় দেখানোর জন্য।

রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, মনসামঙ্গল, শক্তি, যম, দশাবতার, চণ্ডীমঙ্গল, গাজীর ইত্যাদি জড়ানো পট প্রচলন ছিল। ব্রিটিশ আমলের ময়মনসিংহ মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট গুরুসদয় দত্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৬৩টি জড়ানো পট সংগ্রহ করেছিলেন। তার বেশির ভাগই সংগ্রহ করেছিলেন বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ থেকে। গুরুসদয় দত্ত তার মধ্যে মধ্যে আটটি পট সংগ্রহ করেছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা থেকে। এই আটটি পটই ছিল গাজীর পট। সিলেটের সন্তান গুরুসদয় দত্ত বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো পট সংগ্রহ করেননি বা পাননি।

গুরুসদয় দত্ত ‘পটুয়া সঙ্গীত’ নামে একটি বই লিখেন ১৯৩৯ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বইটিতে ২৯টি পটের গান ছিল। সেখানে কোনো গাজীর পটের গান ছিল না। তাই আমারা গাজীর পট ও পটের গান নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকব। পটে আঁকা ছবি দেখিয়ে গাওয়া হয় গাজীর গান। এই পটের গানও আমাদের লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এক সময় গাজীর পট দেখিয়ে গাওয়া গান ছিল বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের বিনোদন। ধর্ম ও নীতিবাক্য শেখার ভরসাস্থল এই পট। সম্ভবত পীর গাজী তখন জনপ্রিয় ছিলেন। এই পটে বর্ণনা থাকে গাজী পীর, তাঁর ভাই কালু, তাঁদের বাবা-মা ও মাণিক পীরের বর্ণনা। এই পটে চম্পাবতীর অস্থিত্ব পাওয়া যায় না। আচার্য বংশের প্রতিমা শিল্পীরা তৈরি করতেন এই পট। তাদের থেকে পট কিনে নিয়ে পটের গান গাইতেন বেদে সম্প্রদায়ের লোকরা। সে গানের শ্রোতা ছিলেন ভাটি অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। আধুনিকতার দাপটে জনপ্রিয় এই লোকসংস্কৃতি এখন বিলীনই বলা চলে।

বিজ্ঞাপন

এক সময় বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে পটচিত্র দেখিয়ে গাজীর গান গেয়ে বেড়াত বেদে সম্প্রদায়ের পুরুষেরা। তার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদী এবং তার আশপাশের অঞ্চলেই এমন বেদেদের বিচরণ ছিল বেশি। বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে গাজীর গান পরিবেশন করতেন ধানের বিনিময়ে। গান পরিবেশনের সময় ছিল অগ্রহায়ণ-পৌষ মাস। অন্য সময় কখনোই বেদেদের গাজীর গান গাইতে দেখা যেত না। এই সময় কৃষক ধান তুলে আনে উঠানে। দু’-এক জন চাল বা টাকাও দিতেন। গাজীর পটের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রবাদ আছে ‘অদিনে গাজীর পট’। সঠিক সময় ছাড়া বা অসময়ে কেউ কিছু করলে এই প্রবাদটি বলা হয়। গাজীর পট হচ্ছে মূলত মার্কিন কাপড়ে আঁকা একটি চিত্রকর্ম, যা প্রস্থে চার ফুট, দৈর্ঘ্যে সাত-আট ফুটের মতো। আদিতে পটচিত্র করা হতো গামছার উপর। ইটের গুঁড়া, বেলের আঠা, তেঁতুলের বিচির আঠাসহ নানা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে গামছা বা মার্কিন কাপড়ে পট তৈরি করা হয়। পটের মাঝখানের বড় ছবিটি পীর গাজীর। তার দুই পাশে গাজীর ভাই কালু ও মাণিক পীরের। গাজী বসে আছে বাঘের উপর। এই ছবিটি কেন্দ্র করে আরও আছে কিছু নীতি বিষয়ক ছবি বা চিত্র। পটের গায়ক পটচিত্রটি পেঁচিয়ে হাতে রাখে। যেখানে গাওয়ার জায়গা পাওয়া যায়, সেখানে পটচিত্রটি খুলে একটি লম্বা লাঠিতে ঝুলিয়ে পিছনে এক হাতে ধরে রাখে। অন্য হাতে ছোট্ট একটি লাঠি দিয়ে পটটির বিভিন্ন অংশের ছবি চিহ্নিত করে গান গাওয়া হয়। পটের গান গায় যারা তারা গাজীকে ভক্তি করে। তার গুনগান মানুষের প্রচার করে সম্মানের সাথে।

আমাদের জানা মতে, সুধীর আচার্য ছিলেন এ অঞ্চলের সর্বশেষ পটুয়া। তার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি এলাকায়। এই সুধীর আচার্যের কাছ থেকে পট কিনে নিয়ে বেদেরা গ্রামে গ্রামে পটের গান গাইত। একসময় সুধীর আচার্য তার পেশা ছেড়ে দেন। আশির দশকে লোকশিল্পপ্রেমী তোফায়েল আহমেদ এই লোকশিল্পীকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। বর্তমানে সুধীর আচার্যের ছেলে শম্ভু আচার্য গাজীর পটকে আঁকড়ে ধরে আছেন। শম্ভু আচার্য পটচিত্র নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। পৃথিবীর বড় বড় গ্যালারিতে তার পট সংরক্ষিত আছে। আমাদের গাজীর পট সারা পৃথিবীতে লোকশিল্প হিসেবে সমাদৃত। গাজীর পট বেঁচে গেলেও পট গায়ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না অনেক দিন ধরে। পাটের গায়করা সবাই চলে গেছে অন্য পেশায়।

সর্বশেষ পট গায়ক দুর্জন আলী

বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে পটসংগীত গায়ক খুঁজতে গিয়ে মুন্সীগঞ্জের হাজারো বেদের মধ্যে একজনকে পেয়েছিলাম পট গাইতে পারে। কিন্তু তার কাছে পট পাওয়া যায়নি। পট ছাড়া পট গাওয়া, কিছুই বোঝা যায় না। নরসিংদীর দুই বেদে দুর্জন আলী ও কোণাই মিয়ার কথা শোনা যেত মাঝে মাঝে। তারা সর্বশেষ পটের গান গাইতেন। কিন্তু অনেকের মতে, এই দুই পট গায়ক মৃত্যুবরণ করেছেন এক যুগ আগে। ধরেই নিয়েছি বাংলার লোকসংগীত পটের গান হারিয়েই গেছে বাংলা থেকে। ২০১৫ সালের শুরুতে সাংবাদিক আপেল মাহমুদ জানালেন পটের গায়ক দুর্জন আলী বেঁচে আছেন। নরসিংদীর হাজীপুরে একটি পটের গায়েন দল করেছেন তার ভাতিজাকে নিয়ে। নরসিংদী শহরে গিয়ে দুর্জন আলীকে খুঁজে বের করতে তেমন কষ্ট হয়নি। আমাদের যাওয়ার খবর পেয়েই দুর্জন আলী তার দল নিয়ে তৈরি হলেন। ৯৫ বছর বয়সী দুর্জন আলী এবং তার ভাই কোণাই মিয়ার ছেলে ফজল মিয়া মূল গায়ক। বাকিরা ঢোল, বায়া ও করতাল বাজায়। দুর্জন আলী এ বছর মে মাসে মৃত্যুবরণ করেন। এখন ফজল মিয়াই হাল ধরেছেন। তার গানের ধুয়াটা হল-
‘হরদম গাজীর নাম লইও
পাষাণ মনরে, হরদমে গাজীর নাম লইয়।
দমে দমে লাইয় নাম, জিরানীনা দিয়
পাষাণ মনরে, হরদমে গাজীর নাম লইয়।।’

বিজ্ঞাপন

প্রতিটি বর্ণনা গানের পর এই ধুয়াটি গাওয়া হয়। প্রথমেই বয়ান করেন গাজীর মাহাত্ম্যের কথা। সেখানে তাজ মাথায় সোনার খড়ম পায়ে গাজীর পোশাকের বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি আছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি গাজীর আনুগত্য ও ভালোবাসার কথা। যেমনÑ

‘আশা হাতে তাজ মাথে সোনার খড়ম পায়
আল্লা আল্লা বলে গাজী ফকির হইয়া যায়।
সুন্দরবন যাইয়া গাজী খুলিলেন কালাম
যত আছে বনের বাঘ জানায় ছালাম।। ’

গাজীর বাবা-মায়ের পরিচয়, তার মাহাত্ম্য ও সাধনা বর্ণনা করেন এক এক করে। গাজীকে না মানলে কী হয় সে বর্ণনাও করেন। এর সাথে নিজেদের প্রাপ্য আদায়ের জন্যও গান রয়েছে পটে আঁকা। ‘বক্ষিল’ বা কৃপণদের মরার পর কী হবে তার ভয় দেখান।
গাজীর পটে চম্পাবতীর দেখা মেলে না। কোনো ইঙ্গিতও নাই এই পট জুড়ে। সুন্দরবন, সুন্দরবনের প্রাণ বাঘও আছে পট জুড়ে। গাজীর গল্প শেষ করে নীতিকথা-

‘রান্ধিয়া-বান্ধিয়া অন্ন পুরুষের আগে খায়,
ভরানা কলসের পানি তিরাসে শুকায়।
দুবদুবাইয়া হাঁটে নারী চোখ ঘোরাইয়া চায়,
অলক্ষ্মীরে দিয়া ঘরে লক্ষ্মী লইয়া যায়।।
নারীকে কম খেয়ে কম পরে সুখী রাখতে এই নীতি কথা। তবে এতে সে সময়ের নারীর কষ্টের কথা দৃশ্যমান। পটের নীতিকথায় নারীর দুঃখগাথা নিয়ে আলাদা গবেষণা হতে পারে। কারণ সকল নীতিকথা নারীকে নিয়েই। পুরুষের জন্য পটজুড়ে একটি নীতি কথাও নেই। আজ আমরা পটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব।
সিরিয়াস এই পটের গাছে হাস্য কৌতুকও কম নেই। তবে তারও বেশির ভাগ নারীকে নিয়েই।

বিজ্ঞাপন

‘এই বাড়ীর কুটনাবুড়ী ওই বাড়ীতে যায়,
পথে একটা ইন্দুর মরা দুই হাতে কিলায়,
কিলাইতে কিলাইতে বুড়ী খেতা হইয়া যায়।’

অথবা

‘চুল নাই বুড়ী খোঁপার লেইগা কান্দে,
কচুপাতার ডিপা দিয়া বড় খোঁপা বান্দে।’

পটের নিচের সারিতে তিনটি ছবি। দুই পাশে দুইটি ভয়ানক দানব দু’টি করে ছুরি হাতে। মধ্যেখানে তাদের মা একটি পাত্রে মানুষের মু-ু নিয়ে বসে আছে। এই ছবিগুলি আমার ছোটবেলায় অনেক ভয়ানক দেখেছি। শম্ভু আচার্য এই ছবিগুলো অনেকটা সুন্দর করে এঁকেছেন। এই ছবিগুলো দেখিয়ে গেয়ে মানুষকে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানায়।

‘যমদূত কালদূত ডাইনে আরও বায়।
মধ্যখানে বইসা আছে যমরাজের মায়।
যমদূত কালদূত দেইখ্যা লইবেন তারে
দুই হাতে দুই লোহার গদা যমের মতো ফিরে।
যমরাজের মায় বইছে তামার ডেকচি লইয়া

পাপী মানুষের কল্লা দিছে সে ডেগেতে ফালাইয়া।’
পূর্বপুরুষদের মতো ফজল মিয়া গাজীর পটের গান দু’টি চরণ দিয়ে শেষ করেন।
‘এই পর্যন্ত বইলা আমি ইতি দিয়া যাই,
আল্লায় বাঁচাইলে আবার আরেক দিন গাই।’

 

দুর্জন আলী ও তার দল

দুর্জন আলী সাত পুরুষের ২০০ বছরের এই গায়কী রীতি এখনও অটুট রেখেছেন। যে পটচিত্রটি দেখিয়ে আমাদের গেয়ে শুনিয়েছেন সে পট নিয়ে ১৯৯৯ সালে দুর্জন আলী পট গাইতে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। সে বছর লন্ডনে বাংলাদেশ উৎসবের যৌথভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। টনি ব্লেয়ারের স্বাক্ষর করা একটি সনদপত্র বুকে নিয়ে গর্ব করেছিলেন এই পট গায়ক। দুর্জন আলীর সাথে পটের গান নিয়ে সে সময় লন্ডন গিয়েছিলেন মুন্সীগঞ্জের মঙ্গল মিয়া। মঙ্গল মিয়া প্রয়োজন হলে এখনো গাজীর গান গায়। সে গাজীর সাধক নয়। গান শিখেছে তার শ্বশুরের কাছে। তার শ্বশুরও মঙ্গল মিয়ার সাথে গান গেয়েছেন শম্ভু আচার্যের পটচিত্র প্রদর্শনীতে। একটু ভিন্ন রকমের হলেও সে-ও গটের গান গাওয়ার চেষ্টা করছে।
গাজীর কালুর সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সাধক দুর্জন আলীকেই বলা যায়। তার মৃত্যুও পর ভাতিজা ফজল টিকে থাকার ওপর নির্ভর করবে এই গান। টিকে থাক গাজীর পট ও পটের গান।

মোহাম্মদ আসাদ : আলোকচিত্র সাংবাদিক ও লেখক

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন