বিজ্ঞাপন

১২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর ‘ঘুম ভাঙল’ কাস্টমসের

April 5, 2023 | 8:53 pm

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: রমজানের বাড়তি চাহিদার সুযোগে বিভিন্ন কৌশলে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে খেজুর আমদানিকারকরা অন্তত ১২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এরকম তথ্য পেয়ে নড়ে-চড়ে বসেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। বাজারে খেজুরের চড়া দামের লাগাম টানতে আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। তবে আমদানিকারক ও বিক্রেতারা বলছেন, এতে খেজুরের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিকটন খেজুর দেশে আমদানি করা হয়েছে। আর এইসব খেজুর আমদানি করা হয় কম দাম দেখিয়ে। এর মাধ্যমে আমদানিকারক সিন্ডিকেট বিপুল অংকের শুল্ক ফাঁকি দিতে পারে। জানা গেছে, ৭০ থেকে ১০০ টাকা আমদানি মূল্য ঘোষণায় আনা খেজুর বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা দরে।

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দাবি, বাড়তি দরে এই খেজুর বিক্রি করে আমদানিকারক সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে কাস্টমস কর্মকর্তাদের মত হচ্ছে, এতে আমদানি কমবে এবং বাজার স্থিতিশীল হবে। বিক্রেতারা কম দামে মজুত রাখা খেজুর বিক্রি করতে বাধ্য হবেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে ২১৮ জন আমদানিকারক তাজা খেজুর আমদানি করেছেন ৬৭ হাজার ৭৮৪ মেট্রিকটন। ব্যবসায়ীরা এসব খেজুরের গড় আমদানি মূল্য কেজিপ্রতি ৭৫ সেন্ট (বাংলাদেশি মুদ্রা প্রায় ৮০ টাকা) করে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কাস্টমস সেটা প্রত্যাখান করে শুল্ক আদায়যোগ্য মূল্য নির্ধারণ করেছে ৭৬ সেন্ট বা ৮১ টাকা। খেজুরের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা দাম হলে শুল্ক কর ১০ টাকা।

বিজ্ঞাপন

সেই হিসাবে কাস্টমস চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে খেজুর আমদানি থেকে রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ৫৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। প্রকৃত দর ঘোষণা হলে এই রাজস্ব দ্বিগুণের বেশি হতো বলে কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গত ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার ফলমণ্ডিতে খেজুর আমদানিকারকদের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। এ অভিযানেই খেজুর আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি এবং বেশি দামে বিক্রির তথ্য উঠে আসে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু রমজানকে কেন্দ্র করে ২৫ হাজার টন খেজুর আমদানি হয়েছে। কিন্তু আমদানি মূল্য প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে বড়ধরনের শুভংকরের ফাঁকি ছিল। সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব হারিয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

এ অভিযানের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে গত ২ এপ্রিল থেকে খেজুর আমদানিতে শুল্কায়ন হার পুননির্ধারণ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। নতুন হার অনুযায়ী, কার্টনে করে আনা ‘লো ক্যাটাগরির’ খেজুর প্রতিকেজিতে ৫০ সেন্ট থেকে বাড়িয়ে ১ ডলার, ‘মিডিয়াম ক্যাটাগরিতে’ ১ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২ ডলার এবং ‘প্রিমিয়াম কোয়ালিটির’ খেজুর ২ ডলার থেকে ৪ ডলার করে পরিশোধ করতে হবে আমদানিকারকদের।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার ব্যারিস্টার বদিউজ্জামান মুন্সী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মার্কেট প্রাইস যখন যাচাই করা হয়, তখন আমরা দেখি বাজারে পাবলিকের কাছ থেকে আমদানি মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে। অথচ সরকারকে নায্য রাজস্ব দেওয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা এনবিআরের অনুমোদন নিয়ে নতুন শুল্কায়ন হার ঘোষণা করেছি, যাতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত না হয়।’

তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের খেজুরের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ায় এর প্রভাব ভোক্তাদের ওপর পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রামে খেজুর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘আল্লাহর রহমত’ স্টোরের মালিক মোহাম্মদ কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিউটি ট্যাক্স বাড়লে খেজুরের দাম তো বাড়বেই। শুল্কায়নের ভ্যালু বাড়ানোর ফলে আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে। তবে এই মুহূর্তে বাড়ার সম্ভাবনা নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণ খেজুর বাজারে আছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের খেজুরের দাম বেশি। এটাতে শুল্ক বাড়ালে সমস্যা নেই। তবে ইরাক থেকে যে খেজুর আসে বিশেষ করে জাহিদি খেজুর এটার দাম কম। শুল্ক বাড়ানোয় এই খেজুরের দাম বাড়তে পারে।’

ফলমণ্ডির অ্যারাবিয়ান ডেটস সুপার শপের কর্ণধার শহিদুল আলম বলেন, ‘রমজানে আর কোনোভাবে দাম বাড়ার সম্ভাবনা নেই। রমজানের পর দাম বাড়লে বাড়তে পারে। কাস্টমসে শুল্ক বেড়েছে না কমেছে এটার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সম্পর্ক আমদানিকারকদের সঙ্গে। তবে শুল্ক যেহেতু বেড়েছে উনারাও দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। তখন আমাদেরও বেশি দামে কিনে তার পর বিক্রি করতে হবে।’

বুধবার (৫ এপ্রিল) ফলমন্ডির আড়তে ও পাইকারি বাজারে বিভিন্ন জাতের খেজুরের মধ্যে কেজিপ্রতি আজওয়া ৭৫০ থেকে ১০০০ টাকা, মাবরুম ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা, মরিয়ম ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা, দাবাস ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, জাহিদি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, মেজডুল ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা এবং আলজেরিয়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কম টাকা দিয়ে খেজুর আমদানি করে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এখন কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ফের নতুন করে খেজুর আমদানিতে শুল্ক আরোপ করেছে। এতে সরকার নায্য রাজস্ব পাবে বলা আশা করা হচ্ছে। তবে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। শুল্ক বাড়ানোর ফলে ব্যবসায়ীরা যদি ফের খেজুরের দাম বাড়িয়ে দেয়, তাহলে সাধারণ মানুষকে আবার চড়া দামে খেজুর কিনতে হবে।’

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকার খেজুর আমদানিতে রাজস্ব নীতিমালার পরিবর্তন করেছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছেন কি না সেটা আমরা নিয়মিত মনিটরিং করব।’

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/পিটিএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন