বিজ্ঞাপন

‘বাঙালির স্বাধীনতার বীজ বপন হয়েছিল যুব বিদ্রোহে’

April 18, 2023 | 5:39 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ যুব বিদ্রোহের মাধ্যমেই বপন হয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি যে স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছে, তার মূলে অনুপ্রেরণা ছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে সেই যুব বিদ্রোহ। জাতির জনক বহুবার সেই অনুপ্রেরণার কথা বলেছেন। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে যুব বিদ্রোহকে স্মরণ করা এবং বিপ্লবীদের সম্মান জানানো।’

বিজ্ঞাপন

‘যুব বিদ্রোহ দিবস’ উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সকালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে বোধন আবৃত্তি পরিষদের আলোচনা সভায় অনুপম সেন এসব কথা বলেন। ‘রাস্তা জুড়ে রোদ হোক’ শিরোনামে এ অনুষ্ঠানে আলোচনার পাশাপাশি গান, নৃত্য, আবৃত্তি পরিবেশন করা হয়।

অনুপম সেন বলেন, ‘এই বাংলার চিত্র একদিন এমন ছিল না। সম্পদে ভরপুর বাংলা শোষণের বিরাট শিকার হয়েছিল। ব্রিটিশরা যে কিভাবে আমাদের শোষণ করেছিল, সেটা নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। এই শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, একপর্যায়ে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেটাতে কিছুই হয়নি। এরপর তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন, এর সঙ্গে যুক্ত হল খেলাফত আন্দোলন। কিন্তু কিছুই হয়নি।’

বিজ্ঞাপন

‘ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যখন কিছুই করা যাবে না, এমন একটা মনোভাব তৈরি হয়ে গেল, তখন এই যুব বিদ্রোহ ১৯৩০ সালে সারা ভারতবর্ষ, উপমহাদেশ, সারাবিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কয়েকজন মাত্র যুবক-তরুণ, মাত্র ৭২ জন মিলে চারদিন ভারতবর্ষের একটি অঞ্চলকে স্বাধীন রেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এই যুব বিদ্রোহ গোটা এশিয়ায় জাগরণের সৃষ্টি করেছিল। মাস্টারদা’র নেতৃত্বে সেই বিদ্রোহে যেসব বিপ্লবীরা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সম্মান জানাতে হবে। এই দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের।’- বলেন অনুপম সেন

একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে যদি পূর্ণতা দিতে হয়, তাহলে এর গোড়াপত্তন যেখানে হয়েছিল, সেই ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। ভারতবর্ষে স্বাধীনতার জন্য প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে। মাস্টারদার নেতৃত্বে যে যুব বিদ্রোহ, তার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ বপন হয়েছিল, বিপ্লবের বীজ বপন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই যুব বিদ্রোহের অনুপ্রেরণার কথা, বিপ্লবীদের কথা বারবার স্মরণ করেছেন। উনার আত্মজীবনী গ্রন্থেও এটা আছে। যুব বিদ্রোহের আদর্শকে ধারণ করে আমাদের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ করতে হবে।’

বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি সোহেল আনোয়ারের সভাপতিত্বে ও অনুপম শীলের সঞ্চালনায় নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী, বোধনের সহ-সভাপতি সুবর্ণা চৌধুরীও সভায় বক্তব্য দেন। দলীয় সংগীত পরিবেশন করেন অভ্যুদয় ও ধ্রুপদ সংগীত নিকেতনের শিল্পীরা। দলীয় নৃত্যে ছিল নৃত্যরূপ একাডেমি ও নৃত্য নিকেতন। প্রমা ও বোধনের শিল্পীরা বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশ করেন। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন হোসাইন কবির, মালেক মুস্তাকিম ও সারাফ নাওয়ার।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রাগার লুট করে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন ৯৩ তম যুব বিদ্রোহ দিবসে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের স্মরণ করেছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠন। অসীম সাহসে সেই যুব বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়া বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাস্দ (মার্ক্সবাদী), সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ আরও বিভিন্ন সংগঠন। নগরীর যাত্রা মোহন সেন হল প্রাঙ্গনে বিপ্লবীদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ নেন।

সিপিবি

মঙ্গলবার সকালে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষ মুর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলা সিপিবির সভাপতি অশোক সাহা, সদস্য ফরিদুল ইসলাম ও অমিতাভ সেন। এসময় সিপিবি নেতারা বলেন, ‘ব্রিটিশ বিরোধী যুব বিদ্রোহের অনুপ্রেরণাই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সা্ম্রাজ্যবাদ বিরোধী, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুব বিদ্রোহ এখনও মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’

বিজ্ঞাপন

বাসদ

সূর্য সেনের আবক্ষ মুর্তিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাসদ চট্টগ্রাম জেলা ইনচার্জ আল কাদেরী জয়, সদস্য কমরেড নাজিমউদ্দীন বাপ্পী, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট জেলার সদস্য সচিব কমরেড আকরাম হোসেন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি রায়হান উদ্দিন, নগর শাখার সভাপতি মিরাজ উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক প্রীতম বড়ুয়া, স্কুল বিষয়ক সম্পাদক উম্মে হাবিবা শ্রাবণী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহবায়ক ইশরাত হক জেরিন ও সদস্য দেবরঞ্জন দেব।

বাসদ নেতারা বলেন, ‘মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, তারকেশ্বর দস্তিদারসহ সকল বিপ্লবীদের সংগ্রামের ইতিহাসকে শাসকশ্রেণী তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছে। বিপ্লবীরা বৃটিশ শাসনমুক্ত দেশের জন্য লড়াই করেছিলেন, তারপর পাকিস্তানি শাসনমুক্ত হয়ে আমরা আজ নিজেদের স্বাধীন বাংলাদেশ দাবি করি। কিন্তু স্বাধীন দেশে কবিতা লেখার জন্য কবিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। একদিকে ধর্ষক-রাজাকার-ঋণখেলাপীরা দেশময় ঘুরে বেড়ায়, অন্যদিকে ফেসবুকে পোস্ট করার অপরাধে কিশোর থেকে শুরু করে কলেজ শিক্ষিকা পর্যন্ত বহিষ্কার-গ্রেফতার হন। এই স্বাধীনতার জন্য বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়নি।’

ছাত্র ইউনিয়ন

নগরীর যাত্রা মোহন সেন হল প্রাঙ্গণে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষ মূর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়ন। এসময় জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ইমরান চৌধুরী, সহ সভাপতি অয়ন সেন গুপ্ত, শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক তাহলিল আবসার অর্ণব, প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক এস এম নাবিল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক তানভীর ইলাহী, সদস্য অরিত্র ভট্টাচার্য্য, কোতোয়ালী থানার সাংস্কৃতিক সম্পাদক সৌম্য মল্লিক অর্ক ও সদস্য রিষু দে ছিলেন।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশকে মুক্ত করতে মাস্টারদা সূর্য সেন লড়াই করেছেন। কিন্তু সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এখনো পৃথিবীর দেশে দেশে হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে। এদেশেও সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গিবাদী এবং অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শক্তিকে দিয়ে দেশকে পাকিস্তানের ধারায় নিয়ে যেতে ষড়যন্ত্র করছে। সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আদর্শভিত্তিক, যুগোপযোগি ও কার্যকর ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’

উল্লেখ্য, ৯৩ বছর আগে সংঘটিত ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের’ বিশদ বিবরণ গবেষক জামাল উদ্দিনের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’-বইয়ে উল্লেখ আছে। সেখানে লেখা হয়েছে- ‘১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির (বিপ্লবীদের গঠিত সংগঠন) চট্টগ্রাম শাখার সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে অস্ত্রাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র লুট করে। মাষ্টারদা সেখানেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।’

অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর রাত পেরোতেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন। জালালাবাদ পাহাড়সহ বিভিন্ন গোপন আস্তানায় আশ্রয় নেন। এরপর চারদিন স্বাধীন ছিল চট্টগ্রাম। পরে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে বৃটিশ বাহিনীর সঙ্গেবিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তিন ঘণ্টার সেই যুদ্ধে ৭০ থেকে ১০০ জন ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয় এবং ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন।

অস্ত্রাগার লুন্ঠনে মাষ্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্কশেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। এদের সাথে সুবোধ রায় নামে ১৪ বছরের এক কিশোরও ছিলেন।

সারাবাংলা/আরডি/ইআ

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন